মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মিঞা
জিয়াউর রহমানের কথা বলতে হলে একটু পিছিয়ে দেখার প্রয়োজন আছে। দীর্ঘকাল শাসনের পর ব্রিটিশরা এ উপমহাদেশ ত্যাগকালে পাকিস্তান নামক যে রাষ্ট্রটি সৃষ্টি হয়, সেখানে প্রথম থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা পূর্ব পাকিস্তানে একটি শোষণ প্রক্রিয়া শুরু করে। এ শোষণ চলতে চলতে ১৯৭০ সালে যে সাধারণ নির্বাচন হয়, সেখানে আওয়ামী লীগ ৬ দফা দাবি জনগণের সামনে তুলে ধরেছিল। এ ৬ দফা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। ফলে নির্বাচনে পাকিস্তানের দুই অংশের মিলিত ফলাফলে আওয়ামী লীগ বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করল। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী যখন দেখল যে সংবিধান অনুসারে আওয়ামী লীগ থেকে প্রধানমন্ত্রী করতে হবে, তখন তারা নানা ধরনের বিকল্প পথ খুঁজতে চেষ্টা করল। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ যে সংসদ ডাকা হয় তা ইয়াহিয়া খান পিছিয়ে দেন। এ ঘটনায় পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে আরো বড় ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। এমন অবস্থায় ১৫ মার্চ ইয়াহিয়া খান ঢাকায় আসেন আওয়ামী লীগের সঙ্গে আলোচনা করতে। কিন্তু আলোচনা যেভাবে চলেছে এবং পাকিস্তানের শাসকদের যে বডি ল্যাঙ্গুয়েজ ছিল, তাতে এ দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে দৃঢ় ধারণা জন্মে যে আলোচনা আসলে কিছুই নয়। আসলে তারা পাকিস্তানের ক্ষমতা কোনোক্রমেই আওয়ামী লীগের হাতে ছাড়তে নারাজ। এর পর যা হলো তার কিছুটা আমি মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর গ্রন্থের ১৮নং পৃষ্ঠা থেকে উদ্ধৃত করছি-
'দৃশ্যত ২৫ মার্চের রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান সহকর্মীদের সঙ্গে বাড়িতেই ছিলেন। সেখানে বসেই তিনি তাঁর সহকর্মীদের অন্যত্র সরে যাওয়ার নির্দেশ দেন। আত্মগোপন করার কথা বলেন। কিন্তু তিনি নিজে কী করবেন, সে কথা কাউকে বলেননি। তিনি এ কথাও কাউকে বলে যাননি যে তাঁর অনুপস্থিতিতে কে বা কারা সংগ্রামের নেতৃত্ব পালন করবেন।'
কিন্তু ইতিমধ্যে দেশের বিরাট অংশের মানুষ এবং সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্যদের মধ্যে ধারণা জন্মে যে ইয়াহিয়া খান সেনাবাহিনীকে লেলিয়ে দিতে যাচ্ছে। এ অবস্থায় ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় চট্রগ্রামে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর জিয়াকে নির্দেশ দেওয়া হয় সোয়াত জাহাজে যেতে। কিন্তু তিনি বাসা থেকে বের হয়ে সহকর্মীদের কাছে খবর পান যে তাঁকে আটকে ফেলার জন্যই হয়তো সেখানে যেতে বলা হয়েছে। এ সময় সহকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে তিনি তৎকালীন চট্টগ্রামের পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দায়িত্বরত কর্মকর্তাকে অবরুদ্ধ করেন। ওখানেই জিয়ার নেতৃত্বে সহকর্মীরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে রিভল্ট করতে সিদ্ধান্ত নেন। ওই দিনই চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের গঠিত কলকাতায় অবস্থিত প্রবাসী সরকারের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ৯ মাসের এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভ করে। অবশ্যই যুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল আওয়ামী লীগের প্রধানের নামে। স্বভাবতই স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তৎকালীন সরকার বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে যা ছিল আওয়ামী লীগের নীতিরই পরিপন্থী। ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগই মৌলিক অধিকার হরণের সিদ্ধান্ত নেয়। তখন বাংলাদেশের মানুষ একটি নির্জলা গণতন্ত্রের পক্ষে ছিল। কিন্তু ১৯৭৫ সালে বহুদলীয় গণতন্ত্রের বদলে একদলীয় শাসনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। দেশের অনেক পত্রপত্রিকা বন্ধ করে দেওয়া হয়। বিচারকদের চাকরিবিধিতে বিভিন্ন অসংগতি তৈরি হতে থাকে, যার ফলে তাঁদের স্বাধীনতা বিঘ্নিত হতে থাকে। এরই মধ্যে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাষ্ট্রপ্রধান এক নৃশংস হত্যার শিকার হন। তাঁকে ও তাঁর পরিবারের বেশ কয়েকজন সদস্যকে হত্যা করা হয়। এই দুর্ভাগ্যজনক হত্যাকাণ্ডের পর রাষ্ট্র পরিচালনার ভার যাঁর ওপর ন্যস্ত হলো, তিনিও ছিলেন একজন সামনের কাতারের ও আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ নেতা। তখন সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন সফিউল্লাহ। দেশের এই বিশৃঙ্খল পরিবেশে সেনাবাহিনীর মধ্যেও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। একপর্যায়ে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ জিয়াউর রহমানকে অন্তরীণ করেন। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ তাঁর কাছ থেকে জোর করে পদত্যাগপত্র নেন। তখন বিচারপতি সায়েম রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
এদিকে জিয়াউর রহমান অন্তরীণ হওয়ায় সেনাবাহিনীর মধ্যে বিক্ষুব্ধ অবস্থা সৃষ্টি হয়। একপর্যায়ে সেনাবাহিনীর একটি বড় অংশ তাঁকে অন্তরীণ অবস্থা থেকে মুক্ত করে আনে। এই বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে খালেদ মোশাররফ নিহত হন।
বলে রাখা ভালো, জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে কিছু অপপ্রচার চলে আসছে। যেমন বলা হয়, তিনি প্রথম বাংলাদেশে সামরিক শাসন চালু করেন। এটি সত্য নয়। এমন কথাও বলা হয় যে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর যেসব সদস্য তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধানকে হত্যা করে তাদের জিয়াউর রহমান দায়মুক্ত করেছিলেন ইনডেমিনিটির মাধ্যমে। এটিও অসত্য। কারণ দায়মুক্ত করেছিলেন খোন্দকার মোশতাক আহমেদ ১৯৭৫ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর।
জিয়াউর রহমান ক্ষমতা গ্রহণের পর জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেন। যেমন তিনিই প্রথম বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের কথা বলেছিলেন। তিনি বলতে চেয়েছিলেন, বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদ শুধু ভাষার ওপর নির্ভরশীল নয়। কারণ জাতিগোষ্ঠী হিসেবে আমাদের একক পরিচয়ে পরিচিত করার সুযোগ নেই। আমাদের দেশে অনেক আদিবাসী রয়েছে, যাদের ভাষা বাংলা নয়। আবার ধর্মের ওপর নির্ভর করেও জাতির পরিচয় দেওয়া যাবে না। এখানে রয়েছে অনেক ধর্মের মানুষ। মুসলমান শুধু বাংলাদেশেই নয়, আরো অনেক দেশেই আছে। মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তান তাদের প্রভুত্ব সৃষ্টি করতে চেষ্টা করে গেছে। অতএব আমাদের যে চৌহদ্দি, এর মধ্যেই আমরা যারা এ ভূমিতে রয়েছি, তাদের এক জাতীয়তাবাদী চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সেটাই বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ।
তিনি ১৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন। এর মধ্যে কৃষির ওপরই সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন জিয়াউর রহমান। আর তা করতে গিয়ে খাল খনন করা হয়ে উঠেছিল অপরিহার্য। এ খাল খনন কতটা উপযোগী এবং প্রয়োজনীয় ছিল, তা আজ আমরা গভীরভাবে উপলব্ধি করছি। অন্যদিকে তিনি ভারতের সঙ্গেও পাঁচ বছরের একটি পানি চুক্তি করেছিলেন। সে চুক্তি এতটাই কার্যকর ছিল যে পানি নিয়ে কোনো বিপত্তি সৃষ্টি হওয়ার সুযোগ ছিল না। যে প্রেরণা তিনি সৃষ্টি করেছিলেন, তাতে কৃষি এবং শিল্পে প্রাণ সঞ্চার হতে শুরু করেছিল।
বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রেও জিয়াউর রহমান বিশেষ সফলতা লাভ করেছিলেন। তাঁর সময়ই ওআইসির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আল কুদস কমিটির সদস্য নির্বাচিত হয়েছিল বাংলাদেশ। এ ছাড়া বাংলাদেশ নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিল জাপানের মতো শক্তিশালী দেশের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। ইরাক-ইরান যুদ্ধ থামাতেও তাঁর ওপর পড়েছিল এক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। কিন্তু সে দায়িত্ব তিনি পালন করে যেতে পারেননি। এ যুদ্ধ শুরু হয়েছিল ১৯৮০ সালের সেপ্টম্বরে, আর জিয়াউর রহমান নিহত হলেন ১৯৮১ সালের ৩০ মে।
লেখক : সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
জিয়াউর রহমানের কথা বলতে হলে একটু পিছিয়ে দেখার প্রয়োজন আছে। দীর্ঘকাল শাসনের পর ব্রিটিশরা এ উপমহাদেশ ত্যাগকালে পাকিস্তান নামক যে রাষ্ট্রটি সৃষ্টি হয়, সেখানে প্রথম থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা পূর্ব পাকিস্তানে একটি শোষণ প্রক্রিয়া শুরু করে। এ শোষণ চলতে চলতে ১৯৭০ সালে যে সাধারণ নির্বাচন হয়, সেখানে আওয়ামী লীগ ৬ দফা দাবি জনগণের সামনে তুলে ধরেছিল। এ ৬ দফা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। ফলে নির্বাচনে পাকিস্তানের দুই অংশের মিলিত ফলাফলে আওয়ামী লীগ বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করল। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী যখন দেখল যে সংবিধান অনুসারে আওয়ামী লীগ থেকে প্রধানমন্ত্রী করতে হবে, তখন তারা নানা ধরনের বিকল্প পথ খুঁজতে চেষ্টা করল। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ যে সংসদ ডাকা হয় তা ইয়াহিয়া খান পিছিয়ে দেন। এ ঘটনায় পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে আরো বড় ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। এমন অবস্থায় ১৫ মার্চ ইয়াহিয়া খান ঢাকায় আসেন আওয়ামী লীগের সঙ্গে আলোচনা করতে। কিন্তু আলোচনা যেভাবে চলেছে এবং পাকিস্তানের শাসকদের যে বডি ল্যাঙ্গুয়েজ ছিল, তাতে এ দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে দৃঢ় ধারণা জন্মে যে আলোচনা আসলে কিছুই নয়। আসলে তারা পাকিস্তানের ক্ষমতা কোনোক্রমেই আওয়ামী লীগের হাতে ছাড়তে নারাজ। এর পর যা হলো তার কিছুটা আমি মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর গ্রন্থের ১৮নং পৃষ্ঠা থেকে উদ্ধৃত করছি-
'দৃশ্যত ২৫ মার্চের রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান সহকর্মীদের সঙ্গে বাড়িতেই ছিলেন। সেখানে বসেই তিনি তাঁর সহকর্মীদের অন্যত্র সরে যাওয়ার নির্দেশ দেন। আত্মগোপন করার কথা বলেন। কিন্তু তিনি নিজে কী করবেন, সে কথা কাউকে বলেননি। তিনি এ কথাও কাউকে বলে যাননি যে তাঁর অনুপস্থিতিতে কে বা কারা সংগ্রামের নেতৃত্ব পালন করবেন।'
কিন্তু ইতিমধ্যে দেশের বিরাট অংশের মানুষ এবং সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্যদের মধ্যে ধারণা জন্মে যে ইয়াহিয়া খান সেনাবাহিনীকে লেলিয়ে দিতে যাচ্ছে। এ অবস্থায় ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় চট্রগ্রামে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর জিয়াকে নির্দেশ দেওয়া হয় সোয়াত জাহাজে যেতে। কিন্তু তিনি বাসা থেকে বের হয়ে সহকর্মীদের কাছে খবর পান যে তাঁকে আটকে ফেলার জন্যই হয়তো সেখানে যেতে বলা হয়েছে। এ সময় সহকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে তিনি তৎকালীন চট্টগ্রামের পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দায়িত্বরত কর্মকর্তাকে অবরুদ্ধ করেন। ওখানেই জিয়ার নেতৃত্বে সহকর্মীরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে রিভল্ট করতে সিদ্ধান্ত নেন। ওই দিনই চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের গঠিত কলকাতায় অবস্থিত প্রবাসী সরকারের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ৯ মাসের এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভ করে। অবশ্যই যুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল আওয়ামী লীগের প্রধানের নামে। স্বভাবতই স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তৎকালীন সরকার বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে যা ছিল আওয়ামী লীগের নীতিরই পরিপন্থী। ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগই মৌলিক অধিকার হরণের সিদ্ধান্ত নেয়। তখন বাংলাদেশের মানুষ একটি নির্জলা গণতন্ত্রের পক্ষে ছিল। কিন্তু ১৯৭৫ সালে বহুদলীয় গণতন্ত্রের বদলে একদলীয় শাসনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। দেশের অনেক পত্রপত্রিকা বন্ধ করে দেওয়া হয়। বিচারকদের চাকরিবিধিতে বিভিন্ন অসংগতি তৈরি হতে থাকে, যার ফলে তাঁদের স্বাধীনতা বিঘ্নিত হতে থাকে। এরই মধ্যে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাষ্ট্রপ্রধান এক নৃশংস হত্যার শিকার হন। তাঁকে ও তাঁর পরিবারের বেশ কয়েকজন সদস্যকে হত্যা করা হয়। এই দুর্ভাগ্যজনক হত্যাকাণ্ডের পর রাষ্ট্র পরিচালনার ভার যাঁর ওপর ন্যস্ত হলো, তিনিও ছিলেন একজন সামনের কাতারের ও আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ নেতা। তখন সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন সফিউল্লাহ। দেশের এই বিশৃঙ্খল পরিবেশে সেনাবাহিনীর মধ্যেও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। একপর্যায়ে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ জিয়াউর রহমানকে অন্তরীণ করেন। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ তাঁর কাছ থেকে জোর করে পদত্যাগপত্র নেন। তখন বিচারপতি সায়েম রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
এদিকে জিয়াউর রহমান অন্তরীণ হওয়ায় সেনাবাহিনীর মধ্যে বিক্ষুব্ধ অবস্থা সৃষ্টি হয়। একপর্যায়ে সেনাবাহিনীর একটি বড় অংশ তাঁকে অন্তরীণ অবস্থা থেকে মুক্ত করে আনে। এই বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে খালেদ মোশাররফ নিহত হন।
বলে রাখা ভালো, জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে কিছু অপপ্রচার চলে আসছে। যেমন বলা হয়, তিনি প্রথম বাংলাদেশে সামরিক শাসন চালু করেন। এটি সত্য নয়। এমন কথাও বলা হয় যে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর যেসব সদস্য তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধানকে হত্যা করে তাদের জিয়াউর রহমান দায়মুক্ত করেছিলেন ইনডেমিনিটির মাধ্যমে। এটিও অসত্য। কারণ দায়মুক্ত করেছিলেন খোন্দকার মোশতাক আহমেদ ১৯৭৫ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর।
জিয়াউর রহমান ক্ষমতা গ্রহণের পর জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেন। যেমন তিনিই প্রথম বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের কথা বলেছিলেন। তিনি বলতে চেয়েছিলেন, বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদ শুধু ভাষার ওপর নির্ভরশীল নয়। কারণ জাতিগোষ্ঠী হিসেবে আমাদের একক পরিচয়ে পরিচিত করার সুযোগ নেই। আমাদের দেশে অনেক আদিবাসী রয়েছে, যাদের ভাষা বাংলা নয়। আবার ধর্মের ওপর নির্ভর করেও জাতির পরিচয় দেওয়া যাবে না। এখানে রয়েছে অনেক ধর্মের মানুষ। মুসলমান শুধু বাংলাদেশেই নয়, আরো অনেক দেশেই আছে। মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তান তাদের প্রভুত্ব সৃষ্টি করতে চেষ্টা করে গেছে। অতএব আমাদের যে চৌহদ্দি, এর মধ্যেই আমরা যারা এ ভূমিতে রয়েছি, তাদের এক জাতীয়তাবাদী চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সেটাই বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ।
তিনি ১৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন। এর মধ্যে কৃষির ওপরই সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন জিয়াউর রহমান। আর তা করতে গিয়ে খাল খনন করা হয়ে উঠেছিল অপরিহার্য। এ খাল খনন কতটা উপযোগী এবং প্রয়োজনীয় ছিল, তা আজ আমরা গভীরভাবে উপলব্ধি করছি। অন্যদিকে তিনি ভারতের সঙ্গেও পাঁচ বছরের একটি পানি চুক্তি করেছিলেন। সে চুক্তি এতটাই কার্যকর ছিল যে পানি নিয়ে কোনো বিপত্তি সৃষ্টি হওয়ার সুযোগ ছিল না। যে প্রেরণা তিনি সৃষ্টি করেছিলেন, তাতে কৃষি এবং শিল্পে প্রাণ সঞ্চার হতে শুরু করেছিল।
বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রেও জিয়াউর রহমান বিশেষ সফলতা লাভ করেছিলেন। তাঁর সময়ই ওআইসির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আল কুদস কমিটির সদস্য নির্বাচিত হয়েছিল বাংলাদেশ। এ ছাড়া বাংলাদেশ নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিল জাপানের মতো শক্তিশালী দেশের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। ইরাক-ইরান যুদ্ধ থামাতেও তাঁর ওপর পড়েছিল এক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। কিন্তু সে দায়িত্ব তিনি পালন করে যেতে পারেননি। এ যুদ্ধ শুরু হয়েছিল ১৯৮০ সালের সেপ্টম্বরে, আর জিয়াউর রহমান নিহত হলেন ১৯৮১ সালের ৩০ মে।
লেখক : সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন