মাসুদা ভাট্টি
এ মুহূর্তে দু'জন নেতা যদি চান তাহলে কতগুলো সমস্যার সমাধান হতে পারে।
প্রথমত, বাংলাদেশের জনগণ মুক্ত হতে পারে যে কোনো রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে।
গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ হতে পারে ঝামেলামুক্ত। কোনো অরাজনৈতিক
শক্তির ক্ষমতা দখল থেকে দূরে থাকতে পারে দেশ। নির্বাচন ব্যবস্থা হতে পারে স্থায়ী ও কোনো তৃতীয় পক্ষের খবরদারি ছাড়াই, বিশ্বের অন্য অনেক গণতান্ত্রিক
রাষ্ট্রের মতোই
কোনো আগ্রহী ব্যক্তি যদি গুগল সার্চ ইঞ্জিনে 'বিশ্বের ক্ষমতাধর মহিলা' লিখে খোঁজ করতে বোতামে চাপ দেন তাহলে যেসব তথ্য আসে তা থেকে এটুকু জানতে পারবেন যে, এই ক্ষুদ্র বাংলাদেশে দু'দু'জন নারী রয়েছেন, যারা বিভিন্ন সময়ে বিশ্বের ক্ষমতাধর মহিলাদের তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন। একথা আমরা যারা এ দেশে বসবাস করি তারাও ভালোভাবেই জানি যে, এ দু'জন নারী কতটা ক্ষমতাবান। তারা চাইলেই যে দেশের ভাগ্য বদলাতে পারেন সে কথাই আজকের লেখার মূলকথা।
সম্প্রতি বিশ্বখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন বিশ্বের নারী রাষ্ট্র প্রধানের মধ্যে শেখ হাসিনাকে সপ্তম ক্ষমতাধর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচন করেছে। এ ম্যাগাজিন শেখ হাসিনাকে উল্লেখ করেছে_ 'এ হিস্টরি অব সারভাইভিং' হিসেবে। '৭৫-এর হত্যাকাণ্ড থেকে ২০০৪ সালের একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলা_ এই দীর্ঘ সম্পর্কে শেখ হাসিনাকে পার হতে হয়েছে নানা চড়াই-উতরাই। বাংলাদেশের মতো একটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার দেশে শেখ হাসিনাকে এগোতে হয়েছে অনেক হিসাব কষে, সাবধানতার সঙ্গে। এমনকি অনেক সময় তার নিজ দলের পুরুষ নেতাদের সঙ্গেও তাকে যুঝতে হয়েছে। এ ক্ষেত্রে তিনি যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা, তার এ পরিচয়ও খুব বেশি সাহায্যে আসেনি। তাকে চলতে হয়েছে সম্পূর্ণ একাই। তারপরও তিনি এগিয়ে গেছেন এবং বাংলাদেশের মানুষের কাছ থেকে তিনি লাভ করেছেন অকুণ্ঠ সমর্থন। যে কারণে তিনি দু'দু'বার আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় নিয়ে এসেছেন। দলের ভেতরও প্রতিষ্ঠা করেছেন নিজস্ব আধিপত্য। আর বর্তমানে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার কোনো বড় বাধা ছাড়াই দেশ পরিচালনা করছে। ষড়যন্ত্র যে নেই তা নয়, কিন্তু সেসব ক্ষমতারই অংশ, কোনো ক্ষমতাবলয়ই নিরঙ্কুশ নয়, একথা আমাদের মানতেই হবে। তাছাড়া দেশের সংবিধানও প্রধানমন্ত্রীকে দিয়েছে একচ্ছত্র ক্ষমতা। সুতরাং তিনি যে বিশ্বের ক্ষমতাবান রাষ্ট্রপ্রধানদের তালিকায় স্থান লাভ করবেন, তা বলাইবাহুল্য।
আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে শেখ হাসিনা ও তার দলের রয়েছে বিশেষ প্রভাব। দু'বার ক্ষমতায় এসেই কেবল নয়, শেখ হাসিনা বরাবরই আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আলোচিত নাম। তিনি অর্জন করেছেন বেশকিছু আন্তর্জাতিক পুরস্কারও। ইউনেস্কো শান্তি পুরস্কার যার মধ্যে অন্যতম। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা হিসেবেও তার পরিচিতি বিশ্বাঙ্গনে ব্যাপক। সুতরাং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার জন্য বাংলাদেশের পক্ষে দাবি-দাওয়া আদায় বেশ সহজ। যদিও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একটি বিশেষ মহল তার একরোখা স্বভাবকে মেনে নিতে পারে না এবং তিনি ক্ষমতায় এলে তাদের অপতৎপরতা বৃদ্ধি পেতে দেখা যায়। দেশের ভেতরে ও বাইরে যার এত ক্ষমতা তার পক্ষে যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণই অত্যন্ত সহজ, প্রয়োজন কেবল সদিচ্ছার। সম্প্রতি বিশ্বের একটি খ্যাতনামা জরিপকারী সংস্থার মতে, তিনি বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রীও। ক্ষমতা ও জনপ্রিয়তা যদি এক সঙ্গে কারও ঝুলিতে থাকে তাহলে তার পক্ষে জনগণের জন্য যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণই সহজ হয়। সুতরাং শেখ হাসিনার কাছ থেকে জনগণের চাওয়া সীমাহীন। এখন আসছে সময়ে মানুষ তার কাছ থেকে কী পেল, সে হিসাবই করবে।
২০০৫ সালে ফোর্বস ম্যাগাজিন বিশ্বের তথা এশিয়ার ক্ষমতাবান নারীদের তালিকায় স্থান দেয় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে। খালেদা জিয়া সে সময় সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভকারী জোটের নেতা ও অন্যতম ক্ষমতাবান প্রধানমন্ত্রী। দলের ভেতর তার কথার ওপর কথা নেই। বিএনপির নেতৃত্বভার গ্রহণের পর তার নেতৃত্বকে কখনও কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীর মুখোমুখি হতে হয়নি, যেটি শেখ হাসিনাকে পেরিয়ে আসতে হয়েছে। সুতরাং তার আধিপত্য দল ও রাষ্ট্রে তখন একচ্ছত্র। দলের বাইরে খালেদা জিয়ার একটি সমর্থকগোষ্ঠীও রয়েছে। সুতরাং মানুষের আশাও তার কাছে বিশাল। এমনকি তার দল এখন বিরোধী দল হওয়ার পরও তিনি যে কম ক্ষমতাবান এরকম ভাবার কোনো কারণে নেই। সরকারের যে কোনো ভুল-ত্রুটির ফসল ঘরে তুলবে তার দল, সেটাই স্বাভাবিক। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও রয়েছে খালেদা জিয়া ও তার দলের বেশ ক'টি স্থায়ী বন্ধু রাষ্ট্র। সেদিক দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে খালেদা জিয়া চাইলেই বাংলাদেশের জন্য বেশ বড় কিছু আনতে পারেন। আগেই বলেছি, দেশের ভেতর খালেদা জিয়ার বিরাট সমর্থকগোষ্ঠী রয়েছে, যাদের কারণে তিনি তিনবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন। সুতরাং তার পক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ অত্যন্ত সহজ, যা অন্য অনেক দেশের নেতাদের পক্ষেই অসম্ভব ব্যাপার। এখানেও সেই একই প্রশ্ন_ সদিচ্ছার।
এ মুহূর্তে এই দু'জন নেতা যদি চান তাহলে কতগুলো সমস্যার সমাধান হতে পারে। প্রথমত, বাংলাদেশের জনগণ মুক্ত হতে পারে যে কোনো রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে। গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ হতে পারে ঝামেলামুক্ত। কোনো অরাজনৈতিক শক্তির ক্ষমতা দখল থেকে দূরে থাকতে পারে দেশ। নির্বাচন ব্যবস্থা হতে পারে স্থায়ী ও কোনো তৃতীয় পক্ষের খবরদারি ছাড়াই, বিশ্বের অন্য অনেক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মতোই। সমস্যামুক্ত হয়ে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যেতে পারে দেশ। জননিরাপত্তা ফিরে আসতে পারে, রাজনৈতিক সংঘাতমুক্ত হতে পারে রাজনৈতিক পরিবেশ। সর্বোপরি দেশে বিদেশি বিনিয়োগ পরিবেশ সৃষ্টি হবে। আমরা জানি, বিগত দশকে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নানা ক্ষেত্রে বেশ ঔজ্জ্বল্য লাভ করেছে। হেনরি কিসিঞ্জারের কথিত তলাবিহীন ঝুড়ি '৭৫-এর পর থেকে স্বৈরশাসকের কব্জায় পড়ে এবং বিশ্বে যেসব দেশে গণতন্ত্র নেই সেসব দেশের তালিকায় স্থান পায়। সে সময় বাংলাদেশ কেবল প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের কারণেই সংবাদ শিরোনাম হতো। '৯০ সাল পর্যন্ত এই ধারাবাহিকতা বজায় ছিল। তারপর বাংলাদেশের গণতন্ত্রে উত্তরণ বিশ্বের গণমাধ্যমে নতুনভাবে উপস্থাপিত হয়। তারপর থেকে অবশ্য খুব কমই বাংলাদেশকে নেতিবাচক প্রচারণার শিকার হতে হয়েছে। একমাত্র ব্যতিক্রম এখানে মৌলবাদী শক্তির ক্ষমতা গ্রহণ এবং বাংলাভাই সংক্রান্ত মৌলবাদী শক্তির উত্থানকে উদার গণতান্ত্রিক বিশ্ব কোনোভাবেই ভালোভাবে নেয়নি। কেউ যদি একটু গবেষকের দৃষ্টিতে এই চলি্লশ বছরকালকে বিশ্লেষণ করে দেখেন তাহলে দেখবেন, স্বৈরশাসক ও মৌলবাদ আক্রান্ত আমলে বাংলাদেশে বিদেশি নিয়োগ হয়েছে সবচেয়ে কম। এখানে একথা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, বাংলাদেশে যখন নিরবচ্ছিন্ন গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা বজায় থাকে তখন বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি থাকে ইতিবাচক এবং এ সময় বিনিয়োগও বাড়ে অন্য সময়ের তুলনায় বেশি।
বৈশ্বিক অর্থনীতির নিক্তিতে বাংলাদেশ এখন এমন এক জায়গায় অবস্থান করছে যেখান থেকে সামান্য প্রচেষ্টাতেই বাংলাদেশ উঠে আসতে পারে একটি মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায়। গত তিন বছর ধরে বিশ্ব যে অর্থনৈতিক মন্দার মুখোমুখি হয়েছে তার আঁচ খুব একটা বাংলাদেশে লাগেনি। জনসংখ্যার এই বিরাট বোঝা সত্ত্বেও বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়েছে। এর অন্যতম কারণ দেশটিতে মোটামুটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ ছিল এবং সবকিছু ছাপিয়ে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়াই চোখে পড়ার মতো ছিল। এখনও তা অব্যাহত রয়েছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট সরকার নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বেশকিছু ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। শিক্ষা, কৃষি, টেলি যোগাযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি ইত্যাদি ক্ষেত্র এ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির ভেতরে পড়ে। এ অবস্থায় শুধু রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে যদি এই দুই ক্ষমতাধর নেতা কোনো ভুল করেন তাহলে তা হবে বাংলাদেশের মানুষের জন্য চরম দুর্ভোগ্যের। দু'জন মানুষের সিদ্ধান্তই যদি কেবল ১৬-১৭ কোটি মানুষের ভাগ্য বদলাতে পারে তাহলে তাদের নিশ্চয়ই উচিত, কোনো দল বা গোষ্ঠী নয়, কোনো ক্ষমতার লোভ নয়, কেবল এই কোটি মানুষের কথা, যারা তাদের কথায় প্রাণ দিতে জানে এবং সে প্রমাণ তারা ইতিমধ্যে দিয়েছে। সুতরাং এ দুই ক্ষমতাবানের কাছে বাংলাদেশের মানুষের চাওয়া কিছু অযৌক্তিক এবং অহেতুক নয়, বরং জনগণের পক্ষে তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের যথেষ্ট যুক্তি আছে।
মাসুদা ভাট্টি :সম্পাদক, একপক্ষ
masuda.bhatti@gmail.com
শক্তির ক্ষমতা দখল থেকে দূরে থাকতে পারে দেশ। নির্বাচন ব্যবস্থা হতে পারে স্থায়ী ও কোনো তৃতীয় পক্ষের খবরদারি ছাড়াই, বিশ্বের অন্য অনেক গণতান্ত্রিক
রাষ্ট্রের মতোই
কোনো আগ্রহী ব্যক্তি যদি গুগল সার্চ ইঞ্জিনে 'বিশ্বের ক্ষমতাধর মহিলা' লিখে খোঁজ করতে বোতামে চাপ দেন তাহলে যেসব তথ্য আসে তা থেকে এটুকু জানতে পারবেন যে, এই ক্ষুদ্র বাংলাদেশে দু'দু'জন নারী রয়েছেন, যারা বিভিন্ন সময়ে বিশ্বের ক্ষমতাধর মহিলাদের তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন। একথা আমরা যারা এ দেশে বসবাস করি তারাও ভালোভাবেই জানি যে, এ দু'জন নারী কতটা ক্ষমতাবান। তারা চাইলেই যে দেশের ভাগ্য বদলাতে পারেন সে কথাই আজকের লেখার মূলকথা।
সম্প্রতি বিশ্বখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন বিশ্বের নারী রাষ্ট্র প্রধানের মধ্যে শেখ হাসিনাকে সপ্তম ক্ষমতাধর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচন করেছে। এ ম্যাগাজিন শেখ হাসিনাকে উল্লেখ করেছে_ 'এ হিস্টরি অব সারভাইভিং' হিসেবে। '৭৫-এর হত্যাকাণ্ড থেকে ২০০৪ সালের একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলা_ এই দীর্ঘ সম্পর্কে শেখ হাসিনাকে পার হতে হয়েছে নানা চড়াই-উতরাই। বাংলাদেশের মতো একটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার দেশে শেখ হাসিনাকে এগোতে হয়েছে অনেক হিসাব কষে, সাবধানতার সঙ্গে। এমনকি অনেক সময় তার নিজ দলের পুরুষ নেতাদের সঙ্গেও তাকে যুঝতে হয়েছে। এ ক্ষেত্রে তিনি যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা, তার এ পরিচয়ও খুব বেশি সাহায্যে আসেনি। তাকে চলতে হয়েছে সম্পূর্ণ একাই। তারপরও তিনি এগিয়ে গেছেন এবং বাংলাদেশের মানুষের কাছ থেকে তিনি লাভ করেছেন অকুণ্ঠ সমর্থন। যে কারণে তিনি দু'দু'বার আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় নিয়ে এসেছেন। দলের ভেতরও প্রতিষ্ঠা করেছেন নিজস্ব আধিপত্য। আর বর্তমানে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার কোনো বড় বাধা ছাড়াই দেশ পরিচালনা করছে। ষড়যন্ত্র যে নেই তা নয়, কিন্তু সেসব ক্ষমতারই অংশ, কোনো ক্ষমতাবলয়ই নিরঙ্কুশ নয়, একথা আমাদের মানতেই হবে। তাছাড়া দেশের সংবিধানও প্রধানমন্ত্রীকে দিয়েছে একচ্ছত্র ক্ষমতা। সুতরাং তিনি যে বিশ্বের ক্ষমতাবান রাষ্ট্রপ্রধানদের তালিকায় স্থান লাভ করবেন, তা বলাইবাহুল্য।
আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে শেখ হাসিনা ও তার দলের রয়েছে বিশেষ প্রভাব। দু'বার ক্ষমতায় এসেই কেবল নয়, শেখ হাসিনা বরাবরই আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আলোচিত নাম। তিনি অর্জন করেছেন বেশকিছু আন্তর্জাতিক পুরস্কারও। ইউনেস্কো শান্তি পুরস্কার যার মধ্যে অন্যতম। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা হিসেবেও তার পরিচিতি বিশ্বাঙ্গনে ব্যাপক। সুতরাং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার জন্য বাংলাদেশের পক্ষে দাবি-দাওয়া আদায় বেশ সহজ। যদিও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একটি বিশেষ মহল তার একরোখা স্বভাবকে মেনে নিতে পারে না এবং তিনি ক্ষমতায় এলে তাদের অপতৎপরতা বৃদ্ধি পেতে দেখা যায়। দেশের ভেতরে ও বাইরে যার এত ক্ষমতা তার পক্ষে যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণই অত্যন্ত সহজ, প্রয়োজন কেবল সদিচ্ছার। সম্প্রতি বিশ্বের একটি খ্যাতনামা জরিপকারী সংস্থার মতে, তিনি বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রীও। ক্ষমতা ও জনপ্রিয়তা যদি এক সঙ্গে কারও ঝুলিতে থাকে তাহলে তার পক্ষে জনগণের জন্য যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণই সহজ হয়। সুতরাং শেখ হাসিনার কাছ থেকে জনগণের চাওয়া সীমাহীন। এখন আসছে সময়ে মানুষ তার কাছ থেকে কী পেল, সে হিসাবই করবে।
২০০৫ সালে ফোর্বস ম্যাগাজিন বিশ্বের তথা এশিয়ার ক্ষমতাবান নারীদের তালিকায় স্থান দেয় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে। খালেদা জিয়া সে সময় সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভকারী জোটের নেতা ও অন্যতম ক্ষমতাবান প্রধানমন্ত্রী। দলের ভেতর তার কথার ওপর কথা নেই। বিএনপির নেতৃত্বভার গ্রহণের পর তার নেতৃত্বকে কখনও কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীর মুখোমুখি হতে হয়নি, যেটি শেখ হাসিনাকে পেরিয়ে আসতে হয়েছে। সুতরাং তার আধিপত্য দল ও রাষ্ট্রে তখন একচ্ছত্র। দলের বাইরে খালেদা জিয়ার একটি সমর্থকগোষ্ঠীও রয়েছে। সুতরাং মানুষের আশাও তার কাছে বিশাল। এমনকি তার দল এখন বিরোধী দল হওয়ার পরও তিনি যে কম ক্ষমতাবান এরকম ভাবার কোনো কারণে নেই। সরকারের যে কোনো ভুল-ত্রুটির ফসল ঘরে তুলবে তার দল, সেটাই স্বাভাবিক। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও রয়েছে খালেদা জিয়া ও তার দলের বেশ ক'টি স্থায়ী বন্ধু রাষ্ট্র। সেদিক দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে খালেদা জিয়া চাইলেই বাংলাদেশের জন্য বেশ বড় কিছু আনতে পারেন। আগেই বলেছি, দেশের ভেতর খালেদা জিয়ার বিরাট সমর্থকগোষ্ঠী রয়েছে, যাদের কারণে তিনি তিনবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন। সুতরাং তার পক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ অত্যন্ত সহজ, যা অন্য অনেক দেশের নেতাদের পক্ষেই অসম্ভব ব্যাপার। এখানেও সেই একই প্রশ্ন_ সদিচ্ছার।
এ মুহূর্তে এই দু'জন নেতা যদি চান তাহলে কতগুলো সমস্যার সমাধান হতে পারে। প্রথমত, বাংলাদেশের জনগণ মুক্ত হতে পারে যে কোনো রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে। গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ হতে পারে ঝামেলামুক্ত। কোনো অরাজনৈতিক শক্তির ক্ষমতা দখল থেকে দূরে থাকতে পারে দেশ। নির্বাচন ব্যবস্থা হতে পারে স্থায়ী ও কোনো তৃতীয় পক্ষের খবরদারি ছাড়াই, বিশ্বের অন্য অনেক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মতোই। সমস্যামুক্ত হয়ে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যেতে পারে দেশ। জননিরাপত্তা ফিরে আসতে পারে, রাজনৈতিক সংঘাতমুক্ত হতে পারে রাজনৈতিক পরিবেশ। সর্বোপরি দেশে বিদেশি বিনিয়োগ পরিবেশ সৃষ্টি হবে। আমরা জানি, বিগত দশকে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নানা ক্ষেত্রে বেশ ঔজ্জ্বল্য লাভ করেছে। হেনরি কিসিঞ্জারের কথিত তলাবিহীন ঝুড়ি '৭৫-এর পর থেকে স্বৈরশাসকের কব্জায় পড়ে এবং বিশ্বে যেসব দেশে গণতন্ত্র নেই সেসব দেশের তালিকায় স্থান পায়। সে সময় বাংলাদেশ কেবল প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের কারণেই সংবাদ শিরোনাম হতো। '৯০ সাল পর্যন্ত এই ধারাবাহিকতা বজায় ছিল। তারপর বাংলাদেশের গণতন্ত্রে উত্তরণ বিশ্বের গণমাধ্যমে নতুনভাবে উপস্থাপিত হয়। তারপর থেকে অবশ্য খুব কমই বাংলাদেশকে নেতিবাচক প্রচারণার শিকার হতে হয়েছে। একমাত্র ব্যতিক্রম এখানে মৌলবাদী শক্তির ক্ষমতা গ্রহণ এবং বাংলাভাই সংক্রান্ত মৌলবাদী শক্তির উত্থানকে উদার গণতান্ত্রিক বিশ্ব কোনোভাবেই ভালোভাবে নেয়নি। কেউ যদি একটু গবেষকের দৃষ্টিতে এই চলি্লশ বছরকালকে বিশ্লেষণ করে দেখেন তাহলে দেখবেন, স্বৈরশাসক ও মৌলবাদ আক্রান্ত আমলে বাংলাদেশে বিদেশি নিয়োগ হয়েছে সবচেয়ে কম। এখানে একথা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, বাংলাদেশে যখন নিরবচ্ছিন্ন গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা বজায় থাকে তখন বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি থাকে ইতিবাচক এবং এ সময় বিনিয়োগও বাড়ে অন্য সময়ের তুলনায় বেশি।
বৈশ্বিক অর্থনীতির নিক্তিতে বাংলাদেশ এখন এমন এক জায়গায় অবস্থান করছে যেখান থেকে সামান্য প্রচেষ্টাতেই বাংলাদেশ উঠে আসতে পারে একটি মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায়। গত তিন বছর ধরে বিশ্ব যে অর্থনৈতিক মন্দার মুখোমুখি হয়েছে তার আঁচ খুব একটা বাংলাদেশে লাগেনি। জনসংখ্যার এই বিরাট বোঝা সত্ত্বেও বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়েছে। এর অন্যতম কারণ দেশটিতে মোটামুটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ ছিল এবং সবকিছু ছাপিয়ে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়াই চোখে পড়ার মতো ছিল। এখনও তা অব্যাহত রয়েছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট সরকার নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বেশকিছু ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। শিক্ষা, কৃষি, টেলি যোগাযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি ইত্যাদি ক্ষেত্র এ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির ভেতরে পড়ে। এ অবস্থায় শুধু রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে যদি এই দুই ক্ষমতাধর নেতা কোনো ভুল করেন তাহলে তা হবে বাংলাদেশের মানুষের জন্য চরম দুর্ভোগ্যের। দু'জন মানুষের সিদ্ধান্তই যদি কেবল ১৬-১৭ কোটি মানুষের ভাগ্য বদলাতে পারে তাহলে তাদের নিশ্চয়ই উচিত, কোনো দল বা গোষ্ঠী নয়, কোনো ক্ষমতার লোভ নয়, কেবল এই কোটি মানুষের কথা, যারা তাদের কথায় প্রাণ দিতে জানে এবং সে প্রমাণ তারা ইতিমধ্যে দিয়েছে। সুতরাং এ দুই ক্ষমতাবানের কাছে বাংলাদেশের মানুষের চাওয়া কিছু অযৌক্তিক এবং অহেতুক নয়, বরং জনগণের পক্ষে তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের যথেষ্ট যুক্তি আছে।
মাসুদা ভাট্টি :সম্পাদক, একপক্ষ
masuda.bhatti@gmail.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন