সোমবার, ২১ মে, ২০১২

সরকারের জুলুম নির্যাতন ও বিরোধী রাজনীতির ভবিষ্যৎ


মো. নূরুল আমিন

নবগঠিত ১৮ দলীয় জোটের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের জামিন আবেদন নাকচ করে মেট্রোপলিটন কোর্ট কর্তৃক তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে বলে কেউ কেউ ধারণা করছেন। গত ২৯ এপ্রিল হরতাল চলাকালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনের দিকের রাস্তায় একটি বাস পোড়ানো এবং সচিবালয়ের অভ্যন্তরে অবস্থিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সামনে ককটেল নিক্ষেপের জন্য এই শীর্ষ নেতাদের অভিযুক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছিল। অভিযুক্ত মোট ৪৫ জন জোট নেতার মধ্যে ৫ জন হচ্ছেন দলীয় প্রধান এবং ১০ জন প্রাক্তন মন্ত্রী। দলের মহাসচিব যুগ্ম-মহাসচিব ছাড়াও পার্শ্ব সংগঠনের শীর্ষ নেতারাও এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত আছেন। আরো আছেন বর্তমান ও সাবেক এমপি। বলাবাহুল্য অভিযুক্ত রাজনীতিকদের কেউই অগ্নিসংযোগ কিংবা গ্রেনেড নিক্ষেপের সময় ঘটনাস্থল কিংবা তার আশপাশ এলাকায়ও ছিলেন না। এদের মধ্যে কেউ কেউ ঢাকাতেও ছিলেন না। কিন্তু তথাপিও তাদের মামলা, গ্রেফতারি ও জেল জুলুমের শিকার হতে হয়েছে। গত ১৭ এপ্রিল বিএনপির সাবেক এমপি, আন্তর্জাতিক বিষয়ক কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি এবং সিলেট জেলা সভাপতি ইলিয়াস আলীকে গুম করার প্রতিবাদে এবং অবিলম্বে তাকে ফিরিয়ে দেয়ার দাবিতে বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধীদলীয় জোট বিক্ষোভ ও হরতাল কর্মসূচি পালন করে। এই হরতালকে কেন্দ্র করেই মামলার সূত্রপাত হয় এবং সারাদেশে হাজার হাজার বিরোধীদলীয় নেতাকর্মী গ্রেফতার হন। আগেই বলেছি অভিযুক্ত শীর্ষ নেতৃবৃন্দের অনেকেই ঘটনাস্থলে ছিলেন না, ঢাকার ঘটনায় মামলা দেয়া হলেও অনেকে ঢাকাতেও ছিলেন না। আবার আরেকটা মজার ঘটনা হচ্ছে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের বেশিরভাগই পুলিশ কর্তৃক বিএনপি অফিসে অবরুদ্ধও ছিলেন। এই অবরুদ্ধ অবস্থায় তারা কিভাবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে গাড়ি পোড়ালেন এ প্রশ্ন অনেকেই করেছেন। পুলিশ অবশ্য অত্যন্ত ত্বরিৎ গতিতে মাত্র এগার দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করে সংশ্লিষ্ট নেতাদের বিরুদ্ধে রিপোর্ট দিয়ে একটি রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন। পুলিশের রিপোর্ট অনুযায়ী তারা গাড়ি পোড়ানো এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সামনে গ্রেনেড নিক্ষেপের সাথে জড়িত ছিলেন। তারা নাকি হুকুম দিয়ে তদারক করে গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেছেন এবং সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চালিয়েছেন। অভিযুক্ত নেতৃবৃন্দ অন্তর্বর্তীকালীন জামিনের জন্য প্রথম হাইকোর্টে যান। হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ গত ৭ মে একটি দ্বিধাবিভক্ত রায় দেন। এবং এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মামলাটি মাননীয় প্রধান বিচারপতি কর্তৃক তৃতীয় একটি বেঞ্চে পাঠানো হয়। গত ১৩ মে তৃতীয় বেঞ্চ অভিযুক্ত বিরোধীদলীয় নেতাদের ১৬ তারিখের মধ্যে নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন এবং এই নির্দেশের আলোকে তারা মেট্রোপলিটন আদালতে আত্মসমর্পণ করেন এবং জামিনের আবেদন জানান। মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট তাদের আবেদন প্রত্যাখ্যান করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। তারা এখন কারাগারে রয়েছেন। সরকার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, বিরোধী নেতাদের কারাগারে পাঠিয়ে আদালত আইনের শাসনকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন। কেননা তাদের মামলা ছিল জামিন অযোগ্য অপরাধ। কথাটি হয়ত সত্য, হয়ত সত্য নয়। যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে এবং তার প্রেক্ষিতে যারা কারাগারে আছেন এবং যাদের মধ্যে কেউ পলাতকও রয়েছেন তারা আমাদের সমাজের নেতৃত্ব দেন। তারা চোর-ডাকাত কিংবা দাগী অপরাধী নন। এদের মধ্যে একাধিকবার মন্ত্রিত্ব করেছেন এমন লোকও যেমনি আছেন তেমনি ভবিষ্যতে এমপি, মন্ত্রী হতে পারেন এমন ব্যক্তিও রয়েছেন। যারা গাড়ি পোড়ানো কিংবা গ্রেনেড হামলার সাথে সরাসরি জড়িত ছিল তাদের একজনকেও গ্রেফতার করে আইনের আওতায় না এনে দেশবাসীর সম্মানিত নেতৃবর্গকে হুকুমের আসামী বানিয়ে অপমান-অপদস্ত করার নজীর আওয়ামী লীগের শাসনামল ছাড়া আর কখনো দেখা যায়নি। এ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই এ সংস্কৃতির সূচনা করেন।
পাঠকদের নিশ্চয়ই মনে আছে যে, ২০১০ সালে অভ্যন্তরীণ কোন্দলকে কেন্দ্র করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের দু'গ্রুপে মারাত্মক কলহের সৃষ্টি হয়। এ কলহ নিরসনের জন্য আওয়ামী লীগের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সফর করেন। কিন্তু বিবাদ মীমাংসায় ব্যর্থ হন। পরবর্তীকালে এই বিবাদটি সহিংস সংঘর্ষে রূপ নেয়। এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও ক্ষমতাসীন দলের এই ছাত্রসংগঠনটি অন্তর্দ্বনেদ্ব লিপ্ত হয় এবং দু'গ্রুপের মারামারির মাঝখানে পড়ে ছাত্রলীগারদের গুলীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন মেধাবী ছাত্র আবুবকর মর্মান্তিকভাবে প্রাণ হারায়। এতে দেশব্যাপী নিন্দার ঝড় ওঠে। সরকারি দল ও সরকার বিব্রতকর অবস্থায় পতিত হন। এ অবস্থায় দেশবাসীর দৃষ্টিকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার উদ্দেশ্যে তারা সুপরিকল্পিতভাবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবিরের উপর হামলা চালায় এবং নিজেরাই ফারুক নামের এক ছাত্রলীগ কর্মীকে হত্যা করে তার লাশ প্রথমে ড্রেনের মধ্যে লুকিয়ে রেখে পরে তা থেকে উদ্ধার করে এই নির্মম হত্যাকান্ডের দায় জামায়াত-শিবিরের উপর আরোপ করে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরবর্তীকালে সরকার সারাদেশে জামায়াত-শিবির নির্মূলের অভিযান শুরু করে। তারা কম্বিং অপারেশনের নামে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে গোটা আইন-শৃক্মখলা রক্ষাকারী বাহিনী, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ-যুবলীগ ও শ্রমিক লীগের ক্যাডারদের লেলিয়ে দেয় এবং টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত গোটা বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার প্রত্যেকটিতে জামায়াত-শিবিরের কার্যালয়ে হামলা করা হয়। এই দলটি ও তার অঙ্গ সংগঠনসমূহের হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। জামায়াতের আমীর মতিউর রহমান নিজামীসহ শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে ফারুক হত্যা মামলার আসামী করা হয়। ঐ সময়ে তারা যে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন অনেকে আশা করেছিলেন যে, এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিরোধীদলগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে নেমে প্রতিবাদ করবেন। কিন্তু হয়তো কৌশলগত কারণে তারা তা করেননি। তখন যদি তারা তা মোকাবিলা করতে পারতেন তাহলে ২০১২ সালে এসে সরকার এতো বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারতো না এবং ১৮ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ গ্রেফতার, রিমান্ড, নির্যাতনের শিকার হতেন না। বলা বাহুল্য, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারুক হত্যার তদন্ত গত আড়াই বছরেও পুলিশ সমাপ্ত করতে পারেনি এবং এই হত্যা মামলাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে এখনো শুধু রাজশাহী নয়, সারা দেশে জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার, নির্যাতন অব্যাহত রয়েছে। প্রায় সাড়ে তিন সহস্রাধিক ছাত্র এই মিথ্যা মামলার শিকার হয়েছে। তারা ক্লাস করতে পারছে না, পরীক্ষা দিতে পারছে না এবং চরম স্বৈরাচারী শাসনামলেও জেলখানায় পরীক্ষা দেয়ার যে সুযোগ ছিল এই সরকারের আমলে তাদের সেই সুযোগ থেকেও বঞ্চিত করা হয়েছে। আমাদের শুধু রাজনীতি নয়, জাতীয় জীবনের জন্যও এটি একটি ট্র্যাজেডি। জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের এই সরকার জেলখানায় ডান্ডাবেড়ি পরিয়েছেন এবং হাতকড়া লাগিয়ে ডান্ডাবেড়ি পরা অবস্থায় আদালতে হাজির করে রাজনীতিকে কলঙ্কিত করেছেন। টিভি চ্যানেলসমূহের কৃপায় বিশ্ববাসী তা প্রত্যক্ষ করেছে। বিএনপিসহ ১৮ দলীয় জোটের অন্য শীর্ষ নেতৃবৃন্দকেও যদি ডান্ডাবেড়ি পরানো হয় তাহলে বিস্ময়ের কিছু থাকবে বলে মনে হয় না এবং আমাদের অনুভূতি এবং রাজনীতিকদের মানসম্মানবোধ যে অবস্থায় গিয়ে পৌঁছেছে তাতে তার প্রতিবাদ কতটুকু হয় তা দেখার জন্য অনেকে অপেক্ষা করছে।
এই দেশের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ১৯৪৭ সালে আমাদের প্রথম স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে, স্বায়ত্তশাসন ও গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের জন্য যত আন্দোলন হয়েছে, এমনকি স্বাধীনতা আন্দোলনেও হরতাল, অবরোধ, অসহযোগ, বিক্ষোভ, অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর প্রভৃতি এইসব আন্দোলনের অপরিহার্য অংশে পরিণত হয়েছিল। জুলুম-নির্যাতন যে নৈরাজ্যের সৃষ্টি করে, তাতে এক শ্রেণীর সুযোগ সন্ধানীর অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতার সুযোগ সৃষ্টি হয়। এরা যেমন রাজনৈতিক কর্মীও হতে পারে, তেমনি রাজনৈতিক কর্মসূচিকে মানুষের চোখে হেয়প্রতিপন্ন করার জন্য সরকারি এজেন্টও হতে পারে। কিন্তু এর জন্যে বৈধ অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলনরত দলসমূহের শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে দায়ী করা এবং তাদের গ্রেফতার-নির্যাতন রাজনৈতিক শিষ্টাচারের পরিপন্থী।
যারা রাজনীতি করেন, ক্ষমতায় গিয়ে দেশ শাসন করেন তারা দেশের অনন্তকালীন ইজারা পান না। দেশ তাদের পৈতৃক কিংবা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি নয় এবং দেশের মানুষ তাদের প্রজাও নন। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আগে তাদের নিজেদের কথা ভাবা দরকার।
'What Would have been my condition if I were the victim? আমি যাকে নির্যাতনের শিকার বানাচ্ছি সেই ব্যক্তি যদি আমি নিজে হতাম তাহলে আমার অবস্থা কি দাঁড়াত?' এই প্রশ্ন ও চিন্তা-বিশ্বাস, দূরদর্শী প্রত্যেকটি রাজনীতিকের উপলব্ধি করা উচিত। আর ক্ষমতায় গিয়ে যারা মনে করেন তাদের সরকারই শেষ সরকার এবং দেশে তাদের পর আর কোন সরকার আসবে না তাদের জন্য সবসময়ই ভয়াবহ পরিণতি অপেক্ষা করে। ঢাকার মেট্রোপলিটান আদালত বিরোধীদলীয় নেতাদের জামিন আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন। এতে আমার বলার কিছু নেই। আমি আতঙ্কিত হই যখন পত্র-পত্রিকায় দেখি যে, খুলনার একজন বিচারক বিরোধীদলীয় দুই কর্মীকে জামিন দেয়ার পর সরকার দলীয় এডভোকেটদের প্রতিবাদের মুখে চীফ মেট্রোপলিটন হাকিম ঐ বিচারকের বিচারিক ক্ষমতাই প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। এই যদি অবস্থা হয় তাহলে বিচার বিভাগের যে স্বাধীনতার কথা বলা হয়, তা কোথায় থাকে? আর যদি দলীয় প্রভাবে বিচারকদের বিচারিক দায়িত্ব পালন করতে হয় তাহলে ইনসাফের স্থান থাকে কোথায়? গত ১৯ মে শুক্রবারের প্রথম আলো পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় একটি ছবি ছাপানো হয়েছে। যশোর শহরে চিত্রা মোড় থেকে তোলা এহসান মিথুনের এই ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে যে, একজন পুলিশ কর্মকর্তা হরতাল সমর্থক এক ব্যক্তিকে গলা টিপে শ্বাসরোধ করার চেষ্টা করছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যন্ত্রণায় ছটফট করছেন। এর আগে এক পুলিশ কর্মকর্তাকে দেখা গিয়েছে হরতাল সমর্থক এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে রাস্তায় ফেলে গলায় বুট-জুতা দিয়ে পিষে ফেলছে। কয়েকদিন আগে বেসরকারি রেজিস্টার্ড প্রাইমারী স্কুলের আন্দোলনরত এক শিক্ষক পুলিশী নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা গেছেন। পুলিশ কর্মকর্তাদের এই ঔদ্ধত্য ও বাড়াবাড়ির উৎস জানা দরকার। সরকার নিজেদের শাসন-কর্তৃত্ব, দুর্নীতি এবং লুটপাটকে নিষ্কণ্টক করার জন্য সমগ্র দেশবাসীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। দেশের পত্র-পত্রিকা এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াসমূহের জনমত জরিপে প্রতিদিনই তাদের জনপ্রিয়তায় ধস নামার চিত্র ফুটে উঠছে। এই অবস্থায় হতাশ কর্মীদের মনোবল চাঙ্গা রাখার জন্য মার্কিন একটি অখ্যাত প্রতিষ্ঠানকে কোটি কোটি টাকা উৎকোচ দিয়ে জরিপের নামে তারা একটি হাস্যকর প্রহসনের রিপোর্ট প্রকাশ করিয়েছেন যাতে বলা হয়েছে যে, দেশের ৭৭ ভাগ মানুষ শেখ হাসিনার নেতৃত্বের উপর আস্থাশীল। এবং এশিয়ার প্রায় সকল নেতাকেই তিনি জনপ্রিয়তার দৃষ্টিকোণ থেকে পেছনে ঠেলে দিয়েছেন। এই তথ্যটি হাসার না কাঁদার তা বুঝে উঠা মুশকিল।
গত ১৭ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস ও সমুদ্র জয় উপলক্ষে ছাত্রলীগ কর্তৃক প্রদত্ত এক বর্ণাঢ্য সংবর্ধনায় তিনি কয়েকটি কথা বলেছেন যা গভীরভাবে বিশ্লেষণের দাবি রাখে। তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি নাকচ করে দিয়ে দলীয় সরকারের অধীনে পুনরায় নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রত্যয় ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেছেন, হরতালের নামে যারা নৈরাজ্য সৃষ্টি করছে তাদের সঠিক পথে আনার উপায় তার জানা আছে। সহনশীলতাকে দুর্বলতা মনে না করার জন্য তিনি বিরোধীদলের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন যে, সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী আগামী ২০১৪ সালের ২৫ জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন করতে হবে এবং ২০১৩ সালের ২৫ অক্টোবরের মধ্যে নির্বাচনের ঘোষণা দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরো ঘোষণা করেছেন যে, পৃথিবীর অন্য ৮/১০টি গণতান্ত্রিক দেশ অন্য যেভাবে চলে সেভাবেই দেশ চলবে। গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা ছাড়া দেশের উন্নয়ন হয় না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তত্ত্বাবধায়ক সংক্রান্ত অবস্থান ও মন্তব্যগুলোর বিস্তারিত বিশ্লেষণ হওয়া দরকার এবং আগামী মঙ্গলবার ইনশাআল্লাহ এই বিষয়ে আমি আলোচনার আশা রাখি। তবে নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি যে ঘোষণা দিয়েছেন যদিও কেউ কেউ এই ঘোষণাকে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব ও অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তথাপিও ব্যক্তিগতভাবে আমি এর সম্পর্কে কোন মন্তব্য না করে একটা সন্দেহ পোষণ করতে চাই। দেশে বর্তমানে যে অবস্থা বিরাজ করছে এবং দেশে-বিদেশে ক্ষমতাসীন দলের ভাবমর্যাদা যেভাবে ধ্বংস হচ্ছে তাতে আওয়ামী লীগ ২০১৪ সাল নাগাদ নির্বাচনমুখী হয় কিনা তা নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। শেখ হাসিনা বলেছেন, পৃথিবীর অন্য দশটা দেশ যেভাবে চলে বাংলাদেশও সেভাবে চলবে। কিন্তু তার দলের বর্তমান ও অতীত কর্মকান্ড তার এই কথার প্রমাণ দেয় না। অন্য দশটা দেশে কেউ দেশকে পৈতৃক সম্পত্তি মনে করে না বলে আমরা মনে করি। অন্য কোন দেশে কেউ ক্ষমতায় গিয়ে আইন করে সরকারি বাড়ি-গাড়ি, সুযোগ-সুবিধা ও এসএসএফ নিরাপত্তা নেয় না কিন্তু আমাদের দেশে নেয়া হয়। অন্য কোন দেশে নিজে নিরাপদ বেষ্টনীতে থেকে অন্যদের অনিরাপদ অবস্থায় ঠেলে দেয়া হয় না কিন্তু আমরা দেই। কাজেই অন্য দশটি গণতান্ত্রিক দেশের সাথে আমাদের দেশের তুলনা করার মধ্যে বাস্তবতা খুঁজে পাওয়া মুশকিল। আর নির্বাচন! ক্রমবর্ধিতহারে জনপ্রিয়তায় ধস নামলে আওয়ামী লীগ যে নির্বাচনের বুকে লাথি মারতে পারে তার নজীর অতীতে রেখেছে। ১৯৭২-৭৫ সালের মধ্যে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন তৎকালীন সরকার দেশকে একটি লুটপাট সমিতিতে রূপান্তরিত করেছিল। বিদেশীরা এদেশের নাম দিয়েছিল তলাবিহীন ঝুড়ি। তাদের দুঃশাসন, জুলুম, নির্যাতন ও লুটপাট দেশকে মৃত্যুপুরীতে রূপান্তরিত করেছিল এবং দেশের কোটি কোটি মানুষ কণ্ঠরুদ্ধ অবস্থায় জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়েছিল। ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে লক্ষাধিক লোক প্রাণ হারিয়েছিল। রক্ষীবাহিনীর নির্যাতনের ভয়ে মানুষকে বিনিদ্র রজনী যাপন করতে হতো। এ অবস্থায় সরকার ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে প্রণীত এক আইন বলে দেশে একদলীয় বাকশাল ব্যবস্থা কায়েম করেন। এই সংশোধনীর আওতায় সংসদীয় পদ্ধতি প্রেসিডেন্ট পদ্ধতিতে রূপান্তরিত হয়। প্রধানমন্ত্রী রাতারাতি রাষ্ট্রপতিতে পরিণত হন। এই সংশোধনী অনুযায়ী ধরে নেয়া হয় যে, সংসদে তখন অর্থাৎ ২৫ জানুয়ারি তারিখে ১৯৭৩ সালে নির্বাচিত যেসব সদস্য ছিলেন তারা এবং রাষ্ট্রপতি সেইদিনই (২৫ জানুয়ারি) জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন এবং সংসদ সদস্যরা অতঃপর তাদের পদে পাঁচ বছর বহাল থাকবেন। প্রেসিডেন্ট আজীবন তার পদে থাকতে পারবেন, তার জন্য কোন নির্বাচনের প্রয়োজন হবে না। এই সংশোধনীর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ তখন সংসদ ও সংসদ সদস্যদের মেয়াদ দু'বছর বাড়িয়ে দিয়েছিল। ঐ সময় তাদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা যেমন ছিল আজো তেমনি আছে। এই অবস্থায় নির্বাচন না দিয়ে তারা হয়ত আইন করে বর্তমান সংসদের মেয়াদ বাড়িয়েও দিতে পারেন। পড়ন্ত জনপ্রিয়তার ঝুঁকি না নিয়ে এ কাজটি করা তাদের জন্য অসম্ভব বলে মনে হয় না। বিরোধী নির্যাতনের যে ধারা চলছে তা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে এর প্রতিবাদ করবে কে? এই অবস্থায় শুধু বিরোধীদলের অস্তিত্ব নয়, দেশ ও জাতির অস্তিত্ব এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে বিরোধী দলসমূহের ঐক্য ও অঙ্গীকারের কোনও বিকল্প নেই। বিরোধী রাজনীতির ভবিষ্যৎ এখানেই।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন