মামুন রশীদ
অর্থবছরের শেষদিকে এসে আমাদের মিডিয়া বা গণমাধ্যমগুলো ব্যাপক হারে দেশের অর্থনীতি সম্পর্কে নানা প্রতিবেদন, বিশ্লেষণ ও সাক্ষাৎকার তুলে ধরে। আমরা প্রায় সবাই জানি যে গণমাধ্যমের এসব পরিবেশনায় অগ্রাধিকারমূলক খাতগুলোতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির ওপর জোর দেওয়া হয়, যাতে এর কয়েকগুণ ইতিবাচক প্রভাব পড়ে আমাদের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) এবং একটি মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে বাংলাদেশের রূপান্তর সুগম হয়। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছয় থেকে সাত শতাংশের সীমা ছাড়িয়ে দুই অঙ্কের দিকে উঠতে থাকে। এ জন্য অবশ্য আমাদের পর্যাপ্ত পরিমাণে অর্থ বা সম্পদ আহরণ ও অধিকতর সম্ভাবনাময় খাতগুলোতে বিনিয়োগ বাড়ানোর বিষয়ে জোর দেওয়ার কথাও বলা হয়। কিছুদিন আগে আমাদের কয়েক বন্ধুর আলোচনায় প্রশ্ন ওঠে, কোনো সমাজতান্ত্রিক বা সাংস্কৃতিক বিপ্লব ছাড়া আমরা শুধু রাজস্ব আহরণের বা আয়ের বর্তমান ধারা বজায় রেখে কতদূর পর্যন্ত যেতে পারব? আমাদের বাংলাদেশের রাজস্ব আয় বাড়ানোর আর কোনো সুযোগ আছে কি?
আমাদের উন্নয়ন অংশীদার ও নীতিনির্ধারকরা অব্যাহতভাবে বলে আসছেন, এ দেশের রাজস্ব কাঠামোতে দুর্বলতা রয়েছে। এ জন্য নীতি-পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। আমাদের বাজেট ঘাটতি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। যা ইতিমধ্যে বেড়ে জিডিপির ৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে এবং যেকোনো সময় তা ছাড়িয়ে যেতে পারে। অন্যদিকে কর-রাজস্ব ও জিডিপির অনুপাত সেই ১০ থেকে ১১ শতাংশের মধ্যেই রয়ে গেছে। বিশ্বে যেসব দেশে কর-রাজস্ব ও জিডিপির অনুপাত সবচেয়ে কম, সেগুলোর মধ্যে বাংলাদেশও একটি।
আমাদের দেশে অবাধে কর ফাঁকি দেওয়ার ঘটনা ঘটেই চলেছে। এখানে সচরাচর এমন লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন, যারা বিশ্বাস করেন যে কর আদায় একটি ন্যায্য প্রক্রিয়া কিংবা জাতির বৃহত্তর উন্নয়নের স্বার্থে নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী সবারই কর পরিশোধ করা উচিত অথবা তাঁরা যে কর দেন, সেটির বিনিময়ে সাধারণ জনগণের জন্য কিছু সরকারি সুবিধার ব্যবস্থা করা যায়। এহেন ধ্যানধারণা বা দৃষ্টিভঙ্গির কারণে এ দেশের জনগণের মধ্যে কর পরিশোধে অনীহা বা অনিচ্ছা পরিলক্ষিত হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) একজন সাবেক চেয়ারম্যানের কাছ থেকে শুনেছি, একজন অর্থনীতিবিদ খুব কৌতূহল সহকারে কালো টাকা সাদা করেছেন, যাঁরা তাঁদের সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। অথচ তিনি নিজেই ট্যাক্স রিটার্নে বা আয়কর বিবরণীতে কোনো আয়ের উল্লেখই করেননি। কারণ হিসেবে তিনি বলেছিলেন, সব আয়ের উৎস ছিল কনসালটেন্সি বা পরামর্শ, বেতন নয়।
রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ কম হওয়ায় তা বাজেটের ক্রমবর্ধমান ঘাটতি মেটানোর কাজে যেমন লাগানো যাচ্ছে না, একই কারণে কৃচ্ছ্রতার কোপ গিয়ে পড়ছে উন্নয়ন বাজেট ও অগ্রাধিকারমূলক বিনিয়োগের ওপর। আমাদের বাজেটীয় ব্যবস্থাপনায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিনিয়োগ ব্যয় কাটছাঁট করা এবং ব্যাংক খাত থেকে ঋণ গ্রহণের প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আহরণ ও তা ব্যয় করার বিষয়ে সব স্টেকহোল্ডার বা সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো সমাজের বৃহত্তর আর্থিক কল্যাণের লক্ষ্যে বা ফিসক্যাল সোশ্যাল কন্ট্র্যাক্টের আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্যে না পৌঁছানো পর্যন্ত দুর্বল রাজস্ব কাঠামোকে জোরদার করে তোলা প্রায় অসম্ভবই বলা যায়। বর্তমানে সমাজের বৃহত্তর আর্থিক কল্যাণের বা ফিসক্যাল সোশ্যাল কন্ট্র্যাক্টের অস্তিত্ব থাকলেও তা রাজস্ব আদায় ও ব্যয়ের অগ্রাধিকারের মধ্যে বোধগম্য সম্পর্কের অনুপস্থিতির কারণে দুর্বলই রয়ে গেছে।
বাংলাদেশে এখনো রাজস্ব আয় ও সরকারি ব্যয়ের ধরনটি সমাজের সমষ্টিগত স্বার্থের চেয়ে কতিপয় গোষ্ঠীর কায়েমী স্বার্থেই যেন নিরূপিত হয়। যে কারণে ক্ষমতাধর ও ধনিক শ্রেণীর বেশির ভাগই রাষ্ট্রের প্রাপ্য রাজস্ব পরিশোধ করে না কিংবা করলেও সেটা হয় নামমাত্র।
এ ধরনের একটি কন্ট্র্যাক্ট বা আর্থ-সামাজিক পুনর্গঠন নিশ্চিত করতে আমাদের তিনটি মৌলিক প্রশ্নের উত্তর জানা দরকার। প্রথমত, রাজস্ব ঘাটতিসহ বৈদেশিক সাহায্য ও ব্যাংক ঋণ গ্রহণের পরিমাণ কমাতে হলে বা অভ্যন্তরীণ রাজস্ব কমলে সার্বিকভাবে রাজস্ব আহরণের সবচেয়ে বড় উৎসগুলোর কী হবে? দ্বিতীয়ত, ব্যয়ের ক্ষেত্রে কোন কোন খাতকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে? তৃতীয়ত, বাজেটে অগ্রাধিকারমূলক খাতগুলোর জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের যথাযথ ব্যবহার বা ব্যয় এবং করদাতাদের দেওয়া করের বিনিময়ে প্রয়োজনীয় সুবিধা কিভাবে নিশ্চিত করা হবে?
অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণে রাজস্ব আহরণ নিশ্চিত করতে হলে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে বিদ্যমান অন্যায্যতা দূর করার ইস্যুতে জোর দিতে হবে। নতুন সোশ্যাল কন্ট্র্যাক্ট সামাজিক ন্যায্যতা পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে সেসব খাত ও ব্যক্তিদের করের আওতায় নিয়ে আসতে হবে, যারা এখনো কর বেষ্টনীর বাইরে রয়েছে। পাশাপাশি জমির মূল্যবৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে তার ওপর করারোপের হার বৃদ্ধি এবং অনানুষ্ঠানিক খাতের ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের জন্য কর প্রদানপ্রক্রিয়া সহজীকরণ স্কিম বা কর্মসূচি প্রবর্তনের মাধ্যমে করভিত্তি সম্প্রসারণ করতে হবে। এ ছাড়াও রাজস্ব আয় বাড়াতে হলে আমাদের অর্থনীতিতে অগ্রাধিকার বিবেচনায় সার্বিকভাবে 'ছাড় প্রদান' অথবা 'স্বল্প হারে কর' আরোপের যে প্রবণতা রয়েছে, সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। মনে রাখতে হবে, করভিত্তি সম্প্রসারণ করলে তা শুধু রাজস্ব আয়ের পরিমাণই বাড়াবে না, সেই সঙ্গে জাতীয় উন্নয়নে অবদান রাখবে এবং সামাজিক ন্যায়বিচারও নিশ্চিত করবে।
দেশে কর ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা রোধ ও বৃহৎ কর পার্থক্য কমাতে হলে কর প্রশাসনের সেবামানে উন্নতি ঘটানোর বিষয়ে গভীর মনোযোগ দিতে হবে। কারণ কর আদায় ও কর ফাঁকিবাজদের ধরাটা অনেকাংশেই কর প্রশাসনের দক্ষতার ওপর নির্ভর করে। সেই সঙ্গে আমি মনে করি, কর প্রশাসন ধৈর্য সহকারে ও পরিশ্রম করে নতুন এবং সম্ভাবনাময় করক্ষেত্র বা করের উৎস উদ্ঘাটন করতে পারে। আমরা অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণের আলোকে বলতে পারি যে কর রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ বাড়াতে হলে কর প্রশাসনের গুণমান ও দক্ষতা বাড়ানো অপরিহার্য। এ ক্ষেত্রে আমরা কর রাজস্ব আদায়কারীদের উৎসাহিত করতে উপযুক্ত প্রণোদনার ব্যবস্থাও রাখতে পারি। যাতে তারা যথাযথভাবে কর আদায়ের দায়িত্ব পালন করে।
সোশ্যাল ফিসক্যাল কন্ট্র্যাক্ট বা সমাজের বৃহত্তর আর্থিক কল্যাণের দ্বিতীয় প্রধান উপাদান হলো, অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে ব্যয় নির্ধারণ করা। এ ক্ষেত্রে বড় প্রশ্ন হলো, কিভাবে আপনি অর্থ ব্যয়ের অগ্রাধিকার নির্বাচন করবেন এবং কোন খাতে সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দেবেন? বিদ্যুৎ ও জ্বালানিসহ কয়েকটি খাতের ভর্তুকি ও ঋণের দায় তথা সুদ পরিশোধ করতেই সরকারি রাজস্বের প্রায় অর্ধেকটা চলে যায়। আমাদের দেশে সরকারি ব্যয়ের দুটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো- প্রথমত, বেশির ভাগ রাজস্বই ব্যয় করা হয় অনুন্নয়ন বাজেটে; দ্বিতীয়ত, রাজস্ব আয়ের বাকি যে অংশটা থাকে, সেটিরও আবার অপচয় বা অপব্যয় হয়ে থাকে। এ জন্য স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো সামাজিক খাতগুলোতে বাজেট বরাদ্দ প্রয়োজন ও প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম হয়। যে কারণে দেশের মোট জনসংখ্যার একটি বড় অংশ সরাসরি সরকারের রাজস্ব ব্যয়ের সুফল পায় না। সে জন্য সোশ্যাল ফিসক্যাল কন্ট্র্যাক্ট বা সমাজের বৃহত্তর আর্থিক কল্যাণের লক্ষ্যে আমাদের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জন্য বিনিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন। তৃতীয় প্রশ্নটি রয়েছে দুর্নীতি দমন ও সুশাসন জোরদারকরণ নিয়ে। আমাদের একটি সাধারণ পর্যবেক্ষণ বা অভিজ্ঞতা হচ্ছে, বাজেটে জনকল্যাণ ও অবকাঠামো উন্নয়নে কম পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করা হয় এবং তা কাঙ্ক্ষিতদের কাছে ঠিকমতো পৌঁছায় না। দলীয় পৃষ্ঠপোষকতা, দুর্বল ব্যবস্থাপনা, নিম্নমানের সেবা ও সুশাসনের অভাবের কারণেই মূলত বাংলাদেশে অর্থ আত্মসাৎ, অপচয় ও দুর্নীতির উর্বর ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে।
দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক সম্ভাবনা পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগাতে হলে আমাদের ওপরের প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে একটি নতুন সোশ্যাল ফিসক্যাল কন্ট্র্যাক্ট বা সমাজের বৃহত্তর আর্থিক কল্যাণের ভিত্তি তৈরি করতে হবে। দেশে সোশ্যাল ফিসক্যাল কন্ট্র্যাক্ট বা সমাজের বৃহত্তর আর্থিক কল্যাণের পদক্ষেপ নিতে হলে আমাদের রাজস্ব আহরণ ও ব্যয় বরাদ্দের পরিমাণ নির্ধারণ নিয়ে একটি প্রাণবন্ত বিতর্ক হতে পারে। শুধু নির্দিষ্ট কোনো পছন্দ বা অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে কর-রাজস্ব আহরণ ও ব্যয় নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত নয়। একই সঙ্গে কর প্রদানের সামর্থ্য আছে- এমন কাউকেই কোনো অবস্থায় ছাড় দেওয়া উচিত নয়। এমনকি অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতাদেরও ছাড় দেওয়া যাবে না।
বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে উত্তরণের পর্যায়ে রয়েছে। যেখানে আনুষ্ঠানিক জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদন) আকার ১১ হাজার ৫০০ কোটি মার্কিন ডলারের সমান এবং জিডিপির বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ৬ থেকে ৭ শতাংশ। আর অনানুষ্ঠানিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের আর্থিক মূল্যও প্রায় আনুষ্ঠানিক অর্থনীতির ৩০ থেকে ৫০ শতাংশের সমান। এর ওপর রিয়েল এস্টেটসহ বিভিন্ন সেবা খাতও স্ফীত বা সম্প্রসারিত হচ্ছে। এ অবস্থায় আমাদের সিভিল ব্যুরোক্রেসি বা বেসামরিক আমলাতন্ত্রে বিশেষ করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) গবেষণা সক্ষমতা বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। যাতে রাজস্ব আহরণের নতুন নতুন ক্ষেত্র চিহ্নিতকরণ ও রাজস্বের পরিমাণ প্রাক্কলন বা নিরূপণের কাজ সহজতর হয়। দেশে এখন সর্বাত্মক বিচার-বিশ্লেষণ পদ্ধতি (এই প্রক্রিয়ায় শীর্ষস্থানীয় সরকারি-বেসরকারি বিজনেস স্কুলের ছাত্রছাত্রীদেরও সম্পৃক্ত করা যেতে পারে), সুদৃঢ় রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ও সদিচ্ছা এবং সংশ্লিষ্ট সব স্টেকহোল্ডার বা পক্ষের ঐকমত্য প্রয়োজন। যা আমাদের প্রবৃদ্ধি অর্জনের পরবর্তী প্রত্যাশিত ধাপে উন্নীত হতে এবং সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে অভূতপূর্ব অবদান রাখবে। আমরা 'বাড়ির গাছে ধরা লেবুর রস নিংড়ানোর' মতো যতটা সুযোগ হাতের নাগালে পেয়েছি, তার অনেকটাই কাজে লাগিয়েছি। এখন আরো যেসব সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে, সেগুলোকে সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় কাজে লাগাতে হবে। আগের চেয়েও অনেক বেশি কিছু করতে হবে। তাহলেই কেবল দেশ এগিয়ে যাবে, সেই সঙ্গে আমরাও।
লেখক : ব্র্যাক বিজনেস স্কুলের অধ্যাপক এবং অর্থনীতি বিশ্লেষক
অর্থবছরের শেষদিকে এসে আমাদের মিডিয়া বা গণমাধ্যমগুলো ব্যাপক হারে দেশের অর্থনীতি সম্পর্কে নানা প্রতিবেদন, বিশ্লেষণ ও সাক্ষাৎকার তুলে ধরে। আমরা প্রায় সবাই জানি যে গণমাধ্যমের এসব পরিবেশনায় অগ্রাধিকারমূলক খাতগুলোতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির ওপর জোর দেওয়া হয়, যাতে এর কয়েকগুণ ইতিবাচক প্রভাব পড়ে আমাদের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) এবং একটি মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে বাংলাদেশের রূপান্তর সুগম হয়। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছয় থেকে সাত শতাংশের সীমা ছাড়িয়ে দুই অঙ্কের দিকে উঠতে থাকে। এ জন্য অবশ্য আমাদের পর্যাপ্ত পরিমাণে অর্থ বা সম্পদ আহরণ ও অধিকতর সম্ভাবনাময় খাতগুলোতে বিনিয়োগ বাড়ানোর বিষয়ে জোর দেওয়ার কথাও বলা হয়। কিছুদিন আগে আমাদের কয়েক বন্ধুর আলোচনায় প্রশ্ন ওঠে, কোনো সমাজতান্ত্রিক বা সাংস্কৃতিক বিপ্লব ছাড়া আমরা শুধু রাজস্ব আহরণের বা আয়ের বর্তমান ধারা বজায় রেখে কতদূর পর্যন্ত যেতে পারব? আমাদের বাংলাদেশের রাজস্ব আয় বাড়ানোর আর কোনো সুযোগ আছে কি?
আমাদের উন্নয়ন অংশীদার ও নীতিনির্ধারকরা অব্যাহতভাবে বলে আসছেন, এ দেশের রাজস্ব কাঠামোতে দুর্বলতা রয়েছে। এ জন্য নীতি-পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। আমাদের বাজেট ঘাটতি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। যা ইতিমধ্যে বেড়ে জিডিপির ৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে এবং যেকোনো সময় তা ছাড়িয়ে যেতে পারে। অন্যদিকে কর-রাজস্ব ও জিডিপির অনুপাত সেই ১০ থেকে ১১ শতাংশের মধ্যেই রয়ে গেছে। বিশ্বে যেসব দেশে কর-রাজস্ব ও জিডিপির অনুপাত সবচেয়ে কম, সেগুলোর মধ্যে বাংলাদেশও একটি।
আমাদের দেশে অবাধে কর ফাঁকি দেওয়ার ঘটনা ঘটেই চলেছে। এখানে সচরাচর এমন লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন, যারা বিশ্বাস করেন যে কর আদায় একটি ন্যায্য প্রক্রিয়া কিংবা জাতির বৃহত্তর উন্নয়নের স্বার্থে নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী সবারই কর পরিশোধ করা উচিত অথবা তাঁরা যে কর দেন, সেটির বিনিময়ে সাধারণ জনগণের জন্য কিছু সরকারি সুবিধার ব্যবস্থা করা যায়। এহেন ধ্যানধারণা বা দৃষ্টিভঙ্গির কারণে এ দেশের জনগণের মধ্যে কর পরিশোধে অনীহা বা অনিচ্ছা পরিলক্ষিত হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) একজন সাবেক চেয়ারম্যানের কাছ থেকে শুনেছি, একজন অর্থনীতিবিদ খুব কৌতূহল সহকারে কালো টাকা সাদা করেছেন, যাঁরা তাঁদের সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। অথচ তিনি নিজেই ট্যাক্স রিটার্নে বা আয়কর বিবরণীতে কোনো আয়ের উল্লেখই করেননি। কারণ হিসেবে তিনি বলেছিলেন, সব আয়ের উৎস ছিল কনসালটেন্সি বা পরামর্শ, বেতন নয়।
রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ কম হওয়ায় তা বাজেটের ক্রমবর্ধমান ঘাটতি মেটানোর কাজে যেমন লাগানো যাচ্ছে না, একই কারণে কৃচ্ছ্রতার কোপ গিয়ে পড়ছে উন্নয়ন বাজেট ও অগ্রাধিকারমূলক বিনিয়োগের ওপর। আমাদের বাজেটীয় ব্যবস্থাপনায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিনিয়োগ ব্যয় কাটছাঁট করা এবং ব্যাংক খাত থেকে ঋণ গ্রহণের প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আহরণ ও তা ব্যয় করার বিষয়ে সব স্টেকহোল্ডার বা সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো সমাজের বৃহত্তর আর্থিক কল্যাণের লক্ষ্যে বা ফিসক্যাল সোশ্যাল কন্ট্র্যাক্টের আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্যে না পৌঁছানো পর্যন্ত দুর্বল রাজস্ব কাঠামোকে জোরদার করে তোলা প্রায় অসম্ভবই বলা যায়। বর্তমানে সমাজের বৃহত্তর আর্থিক কল্যাণের বা ফিসক্যাল সোশ্যাল কন্ট্র্যাক্টের অস্তিত্ব থাকলেও তা রাজস্ব আদায় ও ব্যয়ের অগ্রাধিকারের মধ্যে বোধগম্য সম্পর্কের অনুপস্থিতির কারণে দুর্বলই রয়ে গেছে।
বাংলাদেশে এখনো রাজস্ব আয় ও সরকারি ব্যয়ের ধরনটি সমাজের সমষ্টিগত স্বার্থের চেয়ে কতিপয় গোষ্ঠীর কায়েমী স্বার্থেই যেন নিরূপিত হয়। যে কারণে ক্ষমতাধর ও ধনিক শ্রেণীর বেশির ভাগই রাষ্ট্রের প্রাপ্য রাজস্ব পরিশোধ করে না কিংবা করলেও সেটা হয় নামমাত্র।
এ ধরনের একটি কন্ট্র্যাক্ট বা আর্থ-সামাজিক পুনর্গঠন নিশ্চিত করতে আমাদের তিনটি মৌলিক প্রশ্নের উত্তর জানা দরকার। প্রথমত, রাজস্ব ঘাটতিসহ বৈদেশিক সাহায্য ও ব্যাংক ঋণ গ্রহণের পরিমাণ কমাতে হলে বা অভ্যন্তরীণ রাজস্ব কমলে সার্বিকভাবে রাজস্ব আহরণের সবচেয়ে বড় উৎসগুলোর কী হবে? দ্বিতীয়ত, ব্যয়ের ক্ষেত্রে কোন কোন খাতকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে? তৃতীয়ত, বাজেটে অগ্রাধিকারমূলক খাতগুলোর জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের যথাযথ ব্যবহার বা ব্যয় এবং করদাতাদের দেওয়া করের বিনিময়ে প্রয়োজনীয় সুবিধা কিভাবে নিশ্চিত করা হবে?
অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণে রাজস্ব আহরণ নিশ্চিত করতে হলে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে বিদ্যমান অন্যায্যতা দূর করার ইস্যুতে জোর দিতে হবে। নতুন সোশ্যাল কন্ট্র্যাক্ট সামাজিক ন্যায্যতা পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে সেসব খাত ও ব্যক্তিদের করের আওতায় নিয়ে আসতে হবে, যারা এখনো কর বেষ্টনীর বাইরে রয়েছে। পাশাপাশি জমির মূল্যবৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে তার ওপর করারোপের হার বৃদ্ধি এবং অনানুষ্ঠানিক খাতের ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের জন্য কর প্রদানপ্রক্রিয়া সহজীকরণ স্কিম বা কর্মসূচি প্রবর্তনের মাধ্যমে করভিত্তি সম্প্রসারণ করতে হবে। এ ছাড়াও রাজস্ব আয় বাড়াতে হলে আমাদের অর্থনীতিতে অগ্রাধিকার বিবেচনায় সার্বিকভাবে 'ছাড় প্রদান' অথবা 'স্বল্প হারে কর' আরোপের যে প্রবণতা রয়েছে, সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। মনে রাখতে হবে, করভিত্তি সম্প্রসারণ করলে তা শুধু রাজস্ব আয়ের পরিমাণই বাড়াবে না, সেই সঙ্গে জাতীয় উন্নয়নে অবদান রাখবে এবং সামাজিক ন্যায়বিচারও নিশ্চিত করবে।
দেশে কর ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা রোধ ও বৃহৎ কর পার্থক্য কমাতে হলে কর প্রশাসনের সেবামানে উন্নতি ঘটানোর বিষয়ে গভীর মনোযোগ দিতে হবে। কারণ কর আদায় ও কর ফাঁকিবাজদের ধরাটা অনেকাংশেই কর প্রশাসনের দক্ষতার ওপর নির্ভর করে। সেই সঙ্গে আমি মনে করি, কর প্রশাসন ধৈর্য সহকারে ও পরিশ্রম করে নতুন এবং সম্ভাবনাময় করক্ষেত্র বা করের উৎস উদ্ঘাটন করতে পারে। আমরা অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণের আলোকে বলতে পারি যে কর রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ বাড়াতে হলে কর প্রশাসনের গুণমান ও দক্ষতা বাড়ানো অপরিহার্য। এ ক্ষেত্রে আমরা কর রাজস্ব আদায়কারীদের উৎসাহিত করতে উপযুক্ত প্রণোদনার ব্যবস্থাও রাখতে পারি। যাতে তারা যথাযথভাবে কর আদায়ের দায়িত্ব পালন করে।
সোশ্যাল ফিসক্যাল কন্ট্র্যাক্ট বা সমাজের বৃহত্তর আর্থিক কল্যাণের দ্বিতীয় প্রধান উপাদান হলো, অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে ব্যয় নির্ধারণ করা। এ ক্ষেত্রে বড় প্রশ্ন হলো, কিভাবে আপনি অর্থ ব্যয়ের অগ্রাধিকার নির্বাচন করবেন এবং কোন খাতে সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দেবেন? বিদ্যুৎ ও জ্বালানিসহ কয়েকটি খাতের ভর্তুকি ও ঋণের দায় তথা সুদ পরিশোধ করতেই সরকারি রাজস্বের প্রায় অর্ধেকটা চলে যায়। আমাদের দেশে সরকারি ব্যয়ের দুটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো- প্রথমত, বেশির ভাগ রাজস্বই ব্যয় করা হয় অনুন্নয়ন বাজেটে; দ্বিতীয়ত, রাজস্ব আয়ের বাকি যে অংশটা থাকে, সেটিরও আবার অপচয় বা অপব্যয় হয়ে থাকে। এ জন্য স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো সামাজিক খাতগুলোতে বাজেট বরাদ্দ প্রয়োজন ও প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম হয়। যে কারণে দেশের মোট জনসংখ্যার একটি বড় অংশ সরাসরি সরকারের রাজস্ব ব্যয়ের সুফল পায় না। সে জন্য সোশ্যাল ফিসক্যাল কন্ট্র্যাক্ট বা সমাজের বৃহত্তর আর্থিক কল্যাণের লক্ষ্যে আমাদের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জন্য বিনিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন। তৃতীয় প্রশ্নটি রয়েছে দুর্নীতি দমন ও সুশাসন জোরদারকরণ নিয়ে। আমাদের একটি সাধারণ পর্যবেক্ষণ বা অভিজ্ঞতা হচ্ছে, বাজেটে জনকল্যাণ ও অবকাঠামো উন্নয়নে কম পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করা হয় এবং তা কাঙ্ক্ষিতদের কাছে ঠিকমতো পৌঁছায় না। দলীয় পৃষ্ঠপোষকতা, দুর্বল ব্যবস্থাপনা, নিম্নমানের সেবা ও সুশাসনের অভাবের কারণেই মূলত বাংলাদেশে অর্থ আত্মসাৎ, অপচয় ও দুর্নীতির উর্বর ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে।
দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক সম্ভাবনা পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগাতে হলে আমাদের ওপরের প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে একটি নতুন সোশ্যাল ফিসক্যাল কন্ট্র্যাক্ট বা সমাজের বৃহত্তর আর্থিক কল্যাণের ভিত্তি তৈরি করতে হবে। দেশে সোশ্যাল ফিসক্যাল কন্ট্র্যাক্ট বা সমাজের বৃহত্তর আর্থিক কল্যাণের পদক্ষেপ নিতে হলে আমাদের রাজস্ব আহরণ ও ব্যয় বরাদ্দের পরিমাণ নির্ধারণ নিয়ে একটি প্রাণবন্ত বিতর্ক হতে পারে। শুধু নির্দিষ্ট কোনো পছন্দ বা অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে কর-রাজস্ব আহরণ ও ব্যয় নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত নয়। একই সঙ্গে কর প্রদানের সামর্থ্য আছে- এমন কাউকেই কোনো অবস্থায় ছাড় দেওয়া উচিত নয়। এমনকি অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতাদেরও ছাড় দেওয়া যাবে না।
বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে উত্তরণের পর্যায়ে রয়েছে। যেখানে আনুষ্ঠানিক জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদন) আকার ১১ হাজার ৫০০ কোটি মার্কিন ডলারের সমান এবং জিডিপির বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ৬ থেকে ৭ শতাংশ। আর অনানুষ্ঠানিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের আর্থিক মূল্যও প্রায় আনুষ্ঠানিক অর্থনীতির ৩০ থেকে ৫০ শতাংশের সমান। এর ওপর রিয়েল এস্টেটসহ বিভিন্ন সেবা খাতও স্ফীত বা সম্প্রসারিত হচ্ছে। এ অবস্থায় আমাদের সিভিল ব্যুরোক্রেসি বা বেসামরিক আমলাতন্ত্রে বিশেষ করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) গবেষণা সক্ষমতা বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। যাতে রাজস্ব আহরণের নতুন নতুন ক্ষেত্র চিহ্নিতকরণ ও রাজস্বের পরিমাণ প্রাক্কলন বা নিরূপণের কাজ সহজতর হয়। দেশে এখন সর্বাত্মক বিচার-বিশ্লেষণ পদ্ধতি (এই প্রক্রিয়ায় শীর্ষস্থানীয় সরকারি-বেসরকারি বিজনেস স্কুলের ছাত্রছাত্রীদেরও সম্পৃক্ত করা যেতে পারে), সুদৃঢ় রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ও সদিচ্ছা এবং সংশ্লিষ্ট সব স্টেকহোল্ডার বা পক্ষের ঐকমত্য প্রয়োজন। যা আমাদের প্রবৃদ্ধি অর্জনের পরবর্তী প্রত্যাশিত ধাপে উন্নীত হতে এবং সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে অভূতপূর্ব অবদান রাখবে। আমরা 'বাড়ির গাছে ধরা লেবুর রস নিংড়ানোর' মতো যতটা সুযোগ হাতের নাগালে পেয়েছি, তার অনেকটাই কাজে লাগিয়েছি। এখন আরো যেসব সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে, সেগুলোকে সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় কাজে লাগাতে হবে। আগের চেয়েও অনেক বেশি কিছু করতে হবে। তাহলেই কেবল দেশ এগিয়ে যাবে, সেই সঙ্গে আমরাও।
লেখক : ব্র্যাক বিজনেস স্কুলের অধ্যাপক এবং অর্থনীতি বিশ্লেষক
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন