সোমবার, ২৮ মে, ২০১২

ঢাকা-ওয়াশিংটনের নিরাপত্তা জোড়ে বেমানান বাংলাদেশের ফ্যাসিবাদ



শওকত মাহমুদ
অনুমানকে অবাধে খেলতে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি রডহ্যাম ক্লিনটনের সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফর মূল্যায়ন করাই বোধহয় সঙ্গত। কেননা, রাষ্ট্রের বর্তমান ও ভবিষ্যত্ পরিচালক এবং অভিজনদের সঙ্গে তার সংলাপের বৃত্তান্ত যতটুকু জানা হয়েছে বা যতখানি তারা মন খুলে বলাবলি করেছেন, তারও বেশি অপ্রকাশিত। তবে যুক্তরাষ্ট্রে বসে ওই সফরসৃষ্ট সঙ্কেতের মোদ্দা কথার হদিসে অনুমানকে মেলে দিয়েই বুঝে নিতে হবে, হিলারির ঐতিহাসিক সফরটি কেন ও কতখানি দুলিয়ে দিয়ে গেছে বর্তমান ও আগামীর বাংলাদেশকে।
হিলারি ক্লিনটনও বাংলাদেশ ঘুরে গেলেন আর শেখ হাসিনাও রাজনৈতিক প্রতিহিংসাকে চূড়ান্ত মাত্রায় বিষিয়ে তুললেন। এমন একটা ধারণা এ মুহূর্তের বাংলাদেশে জাগতেই পারে, অন্তত ‘যোগসূত্র’ বা ‘ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব’ তালাশি অধীর মানুষজনের মধ্যে। বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীকে গুম এবং শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামকে অপহরণ ও ক্রসফায়ারে মেরে ফেলার তাজা অপরাধগুলো টপকে উল্টো বিরোধী ১৮ দলের ৩৩ নেতাসহ অসংখ্য রাজনৈতিক কর্মীকে জেলে পুরে প্রতিপক্ষকে ‘সমুচিত শিক্ষা দেয়ার’ হুমকি রাজনীতির ধরা-বাঁধা হিসাবে মেলে না। ঠাণ্ডা মাথার ছকে হোক, মাথা-মোটা পরিকল্পনায় হোক বা কাঁচা-ইশারাতেই হোক—যে কারণে আওয়ামী লীগ সরকার এই সর্বনাশা খেলায় মেতে ওঠুক না কেন, এটি যে নাটকের শেষ অংকের দ্রুত মঞ্চায়ন, তা নিয়ে সংশয় নেই। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের চাল-চলন সে সাক্ষ্যই দেয়।
এ প্রসঙ্গেই মনে পড়ে গেল একটি ‘জরুরি আবেদন’-এর কথা। আমেরিকার সেক্রেটারি অব স্টেট হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশে নামার দিন অর্থাত্ ৫ মে ‘দৈনিক আমার দেশ’ পত্রিকার প্রথম পাতায় যুক্তরাষ্ট্রের দুই প্রবাসী বাংলাদেশী নেতা এক বিজ্ঞাপন মারফত বিশ্বের এক নম্বর ডিপ্লোম্যাটকে বলেছিলেন— "... in the event your visit fails to respond to the hope of our people, it is likely that the Govt. will take it as a green signal to continue and intensify its repressive activities aiming to eliminate the opposition and silence the media ... in case the situation is not rapidly reversed, it is feared that the opposition leadership and activists will have no other options left but to go underground. If this unfortunate scenario unfolds in reality, the implications will he extremely grave not just for Bangladesh but also for the region and the world at large." (আপনার সফর যদি জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে সরকার এ সফরকে সবুজ সঙ্কেত হিসেবে গণ্য করে বিরোধী দলকে নির্মূল ও মিডিয়াকে বাকরুদ্ধ করার দমননীতি অব্যাহত এবং কঠোরতর করবে। যদি পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন না হয়, তবে বিরোধী নেতা ও কর্মীদের লোকচক্ষুর অন্তরালে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না এবং এই দুর্ভাগ্যজনক অবস্থা ঘটলে, আশঙ্কা করছি, পরিণতিতে শুধু বাংলাদেশের জন্য নয় বরং এ অঞ্চল এবং কালে বিশ্বের জন্যই চরম দুর্যোগময় হবে)। কথাটা ফেলে দেয়ার মতো নয়।
সরকারের গোস্বা
হিলারি যা বলে গেছেন তা অননুবাদ্য বা দুর্ভেদ্য কিছু নয়। বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক কথনের অন্তরাত্মা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার কাছে আর অনুচ্চার নেই। যার যার বুঝ্ নিয়ে ফেলেছেন। স্টেট ডিপার্টমেন্টের অধুনা প্রকাশিত মানবাধিকার রিপোর্ট বাংলাদেশের বিপর্যস্ত মানবাধিকারকে আরও উদাম করেছে। বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত ভাবনার জানান্ যেমনি করে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিয়ে গেছেন, তেমনি করে আমাদের গণতন্ত্র সম্পর্কে সমূহ উদ্বেগও প্রকাশ করেছেন এবং এক ধরনের মানবিক হস্তক্ষেপের (Humanitarian Intervention) ঘণ্টাও বাজিয়েছেন। এই দু’য়ের যোগে আগামীতে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশকেন্দ্রিক যদি দিনবদলের পালা ঘটে, তাতে শেখ হাসিনা যে ওই পরিবর্তনের যোগ্যজন হতে পারছেন না, তা তিনি সম্ভবত আঁচ করেছেন। তাকে আরও চমকে দিয়েছে বাংলাদেশ ঘুরে যাওয়া ভারতের ডাকসাইটে মন্ত্রী প্রণব মুখার্জির প্রথম বারের উচ্চারণ—বাংলাদেশে শুধু এক দল নয়, সব দলের সঙ্গেই ভারত সম্পর্ক রাখতে চায়। অন্যদিকে বেগম খালেদা জিয়াকে যথেষ্ট স্বস্তি দিয়েছে হিলারির সফর এই অর্থে যে, তিনি এবং তার দলের দীর্ঘদিনের একটি আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়েছে। তা হলো, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সরাসরি (দিল্লি হয়ে নয়) সম্পর্কের দাবিটি তিনি গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে সর্বশেষ সফরে জোর গলাতেই তুলেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র এবারই তার প্রথম স্বীকৃতি দিল। বিরোধী দলে থেকে রাষ্ট্রের জন্য এমন দাবি আদায় বোধকরি এই প্রথম। কোনো কোনো মহল এমন ভাবতেও রাজি যে, বাংলাদেশ ও বিশ্বের শীর্ষ পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি সম্পর্কের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে ভারতের ভৌগোলিক আগ্রাসনের আশঙ্কা দূর হলো এবং বাংলাদেশের বন্দর, রাস্তা, ট্রানজিট নিয়ে ভারতের ব্যাপক পরিকল্পনা আর প্রত্যাশিত মসৃণতা পাবে না। এর জন্যই কি বাংলাদেশের মানুষের ওপর এ দুর্যোগ নেমে এসেছে? এ জন্যই কি হাসানুল হক ইনুর মতো কাঁচা-রাজনীতিক (Row-politician) বেগম জিয়াকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করার নির্লজ্জ দম্ভোক্তি করেছেন? ডাকসাইটে ব্রিটিশ সাপ্তাহিক ‘দ্য ইকোনমিস্ট’ বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের ফ্যাসিবাদী আচরণের জন্য দিল্লিকে হুঁশের জন্য আবেদন করে অনেক কিছুই স্পষ্ট করতে চেয়েছে।
এখন প্রশ্ন হলো, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যদি মালুম হয়েই থাকে, তিনি আমেরিকানদের সহানুভূতি হারানোর পথে অথবা বাংলাদেশের আগামীর রাজনীতিতে তার স্থান ততটা নেই, তাহলে তো ভালোমানুষির দিকে ফিরতে তার কোমর বেঁধে নামা উচিত। গুম-খুন বন্ধ করবেন, বিরোধী নেতা, সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমের ওপর নিপীড়ন কমিয়ে দেবেন, আলোচনার সুমিষ্ট আহ্বান রাখবেন, সংসদে গালাগালির পর্বে ইতি টানবেন। বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের নামে মিথ্যা মামলাগুলো তুলে নেবেন। দুর্নীতিগ্রস্ত বা দুর্নীতির অপবাদগ্রস্ত মন্ত্রীদের বাদ দিয়ে হিলারির মাধ্যমে পদ্মা সেতুর জন্য বিশ্বব্যাংক থেকে আটকে যাওয়া টাকাটা আনবেন। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী স্বজনদের ঝামেলা থাকলে দূর করবেন। ড. ইউনূসকে চায়ের দাওয়াত দিয়ে আপসের খিলখিল হাসি হাসবেন। কিন্তু শেখ হাসিনা ওই পথে যাননি। হিলারির বিদায়ের পর মন্ত্রীদের দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে ঘুরিয়ে এক হাত ঝেড়েছেন, ড. ইউনূসের প্রতি এমনকি নোবেল পুরস্কার প্রসঙ্গেও কটুকাটব্য করিয়েছেন। ওয়াশিংটন এবং নিউইয়র্কে এ নিয়ে ঢের বিরক্তি দেখেছি। অবশ্য, তিনি যে নিজে নোবেলের জন্য দৌড়-ঝাঁপ করেছেন এবং জাহাঙ্গীর কবীর নানক, মির্জা আজম, আবুল বারাকাত ও সৈয়দ বোরহান কবীরদের দিয়ে বিশ্বের নানা শহরে শান্তির জলসা বসিয়ে সার্টিফিকেট আদায়ের চেষ্টা করে যাচ্ছেন, তা সৈয়দ আশরাফ উল্লেখ করেননি। আওয়ামী লীগের সুবিধা হলো, আমেরিকাকে গালও দিতে পারে, আবার ভালোবাসা দ্রবীভূত হতে সময়ও লাগে না (Love and Hate)। এক কমিউনিস্ট নেতা একবার বলেছিলেন, শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর নয় বরং খন্দকার মোশতাকের মার্কিন ঘেঁষা পররাষ্ট্রনীতিতে বিশ্বাসী। আবার সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত স্বল্প-সাময়িক স্বেচ্ছানির্বাসনে না থাকলে হিলারি-ব্লেকদের বাংলাদেশ ত্যাগের পর বোধ হয় আবারও বলতেন—ব্লেক সাহেবদের কথায় বাংলাদেশ চলে না।
ড. ইউনুসকে সম্মান দেয়ার জন্য হিলারির অনুরোধকে শেখ হাসিনার ‘প্রজ্ঞা’ প্রত্যাখ্যান করেছে। যা-তা ব্যাপার নয়। কিন্তু আমেরিকাকে বুড়ো আঙুল দেখানোর মতো নৈতিক সাহস ও বিচক্ষণতা যাদের নেই, তারা ইতিহাসের দিনানুদৈনিকের তুচ্ছাতিতুচ্ছে বিলীন হয়ে যায়। যাক গে, বিষয়টা হলো, শেখ হাসিনা, যিনি ইলিয়াস- গুমের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি নিতে পারছেন না, কেন উল্টো ইলিয়াস-ফেরত দাও আন্দোলনের ওপর লাঠি-পেটা-হ্যান্ডকাফ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন? বিএনপির সিনিয়র নেতাসহ গুরুত্বপূর্ণ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন? দেশজুড়ে বিএনপির লোকজনের বাড়িতে হানা দেয়ালেন? যুদ্ধের আরও নয়া ফ্রন্ট ওপেন করলেন কেন? হতে পারে তিনি এমন মন্ত্রণা পেয়েছেন, যার শিরোনাম ‘আমেরিকা রুখো’। হতে পারে, তিনি মনে করছেন, বিএনপি সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না, আঘাত হেনে স্থবির করে দাও। তারপর বিএনপিকে ভাঙবেন অথবা তার অধীনে সংসদ নির্বাচনে ওই ভাঙা গ্রুপকে নিয়ে আসবেন অথবা বিরোধী নেত্রীকে তাদের পরামর্শে আনবেন। কখনও সঠিক, কখনও বেঠিক—এমন আন্দাজধারীরা বলতে পারেন, শেখ হাসিনা কোনো না কোনো সময় রক্তাক্ত বেয়নেটের ওপর রজনীগন্ধা ফুল বসিয়ে সংলাপের আহ্বান হয়তো জানাবেন; কিন্তু বিএনপি নেতাদের জেল-জুলুমে রগড়ে অথবা আদালতের সাজা দিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অযোগ্য করার পর। প্রয়োজনে আরও হার্ডলাইনে গিয়ে। যদি দেখেন তাতে সাময়িকের জন্য ক্ষমতায় থেকে যাওয়া সম্ভব, তবে সংলাপ নিয়ে তামাশা করবেন, আদৌ সে পথ মাড়াবেন না। তবে আলোচনা হলে তার শর্ত হবে—শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী রেখে ভোটের সময় অন্তর্বর্তী সরকার হবে। দশজনের মন্ত্রিসভায় দু’তরফের ৫ জন করে মন্ত্রী থাকবেন। কমনওয়েলথ দূত স্যার নিনিয়ানের ফর্মুলার মতো, যা বিষবত্ ছিল তখনকার বিরোধী নেত্রী শেখ হাসিনার জন্য। যাহোক, একটা জাতীয় সরকারের মতো অন্তর্বর্তী সরকার থাকলে ভোট কোনোক্রমে না হলেও শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থেকে যাবেন। শেখ হাসিনা এ প্রস্তাবও করতে পারেন—প্রয়োজনে নির্বাচন এগিয়ে এনে ২০১৩-এর জুনের মধ্যেই করা যেতে পারে এবং নির্বাচন কমিশন তখন আর সরকারের অধীনে থাকবে না। সংসদের ভোট এগিয়ে আনতে অর্থাত্ আগামী জুনে এমনকি এ বছরের শেষে, যদি দমননীতি সফল হয়, ভোট করতে তিনি দলের দ্বিতীয় সারির কয়েকজনকে ইঙ্গিত দিয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রের খবর। জেলবন্দি, ফ্যাসিবাদে পীড়িত বিএনপির ওপর এমন আপসের ফর্মুলা চাপিয়ে দিয়ে মূল দাবি—শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রী থেকে যাওয়া (গ্যালাপ পোলের ২০১১ সালে পরিচালিত ত্রুটিযুক্ত জরিপে যদি তিনি দেশের ৭৭ ভাগ মানুষের সমর্থন ভোগ করছেন, তাহলে ক্ষমতা ছেড়ে কেয়ারটেকার সরকার দিয়ে ভোটের ময়দানে আসতে অসুবিধা কী?) ভারতের একটি মহল শেখ হাসিনাকে আরও ফ্যাসিবাদী হওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকতে পারে, কারণ বাংলাদেশ যদি আমেরিকার নিরাপত্তা বলয়ে ঢুকে যায়, তবে ভারতের অনেক পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে পারে। আমেরিকাকে বাংলাদেশ থেকে সরাতে শেখ হাসিনার গোলযোগ পাকানো হবে ওই মহলের তুরুপের তাস। অন্যদিকে ভারতের বড় পুঁজিপতিরা বাংলাদেশে ঢুকে গেলে সে পুঁজি রক্ষায় আওয়ামী লীগ সরকার বিপদে ভারত সরকারের হাত ধরে টানাটানি করতে পারে।
চাপাক্রান্ত বেগম খালেদা জিয়া বিষয়টি মেনে নিতেও পারেন বলে আস্তিনে ছুরি-বাঁধা হাসিনা সমর্থকরা মনে করতে পারেন। আর ঢাকায় এমন বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের অভাবও হবে না, যারা বিএনপি চেয়ারপার্সনকে গিয়ে অকৃত্রিম বন্ধুর মতো বলবেন—তখন হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকলেও আপনি যদি ভোটে যান তারপরও আপনিই জয়ী হবেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার না থাকলেও। ভোটের বাইরে থাকলে শেখ হাসিনা বিএনপিকে কেটে-মেরে একদম শুইয়ে দেবে। যাহোক, এসব হচ্ছে বর্তমান ঘটনাবলীর ধারাবাহিকতায় ভবিষ্যত্ যাত্রা সম্পর্কে নিছকই অনুমান। তবে বিরোধী নেত্রী বেগম জিয়াকে যে কায়দায় পারিবারিকভাবে এবং রাজনৈতিক সহকারীদের কাছ থেকে নিঃসঙ্গ করে রাখা হয়েছে বা হচ্ছে, সে ক্ষেত্রে তার সমৃদ্ধ দেশানুরাগী রাজনৈতিক জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটি তিনি সঠিকভাবেই নেবেন বলে পর্যবেক্ষকদের অনুমান। (অসমাপ্ত)

(গতকালের পর)
যে নেত্রী দুটি স্বৈরাচারকে আপসহীন আন্দোলনে পরাজয়ের গৌরব ধারণ করেন, তার জন্য সময়োচিত সিদ্ধান্ত কঠিন নয়। এবার তিনি সাফল্যের সঙ্গেই কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি তুলে তুলে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের নির্ধারিত মেয়াদের দেড় বছর আগেই শেখ হাসিনাকে কেয়ারটেকার সরকারের ইস্যুতে টেনে নিয়ে এনেছেন এবং বিশ্বকে এ দাবির যৌক্তিকতা বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন। বাংলাদেশের শাসন-ক্ষমতা অতীতের কোনো সময় এক ব্যক্তির হাতের মুঠোয় এমনভাবে বন্দি হয়নি, যেভাবে হয়েছে এখনকার শেখ হাসিনার হাতে। রাষ্ট্রের চারটি স্তম্ভই—শাসন, বিচার, সংসদ ও সংবাদপত্র এক দাগে একরৈখিকভাবে বর্তমান সরকারপ্রধানের মুঠোয়, কোনো চেক অ্যান্ড ব্যালান্স নেই। একমাত্র তিনি যদি, অন্তর্বর্তী বা যে নামের সরকারে হোক, একাই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে থাকেন, তবে বঙ্গভবন, সচিবালয়, নির্বাচন কমিশন, আদালত এবং নিরাপত্তা বাহিনীর স্বাধীনতা বলে কিছু থাকবে না। বাংলাদেশ চরম অনুদার (Extremely Illiberal) রাষ্ট্রের পরিচয় থেকে যা, স্টেট ডিপার্টমেন্ট, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে স্পষ্ট, মুক্ত হবে না। বুড়িগঙ্গায় প্রতি মাসে গড়ে ৪০টি গুম-খুনের লাশ ভেসে উঠতে থাকবেই। পাশ্চাত্যের ‘নৈতিকতা’য় তীব্রতর, অত্যন্ত শক্তিশালী লেখক মরহুম ক্রিস্টোফার হিচেন্সের একটি মন্তব্যে আমরা আস্থা রাখতে পারি, যে কথার ঐতিহাসিক প্রমাণযোগ্যতা সংশয়াতীত। তিনি ২০০৮ সাালে ‘ফরেন অ্যাফেয়ার্স’ ম্যাগাজিনে দেশে দেশে যুক্তরাষ্ট্রের মানবিক হস্তক্ষেপ আলোচনা করতে গিয়ে উপসংহার টেনেছিলেন এই বলে— ”Surely, identifying the situation that is appropriate for intervention is both art and science, but history has taught us that tyranny often looks stronger than it really is, that it has unexpected vulnerabilities (very often to do with the blunt fact, tyranny, as such, is incapable of self-analysis), and that taking a stand on principle, even if not immediately rewarded with pragmatic results, can be an excellent dress rehearsal for the real thing” (নিশ্চিত অর্থেই, হস্তক্ষেপের জন্য উপযুক্ত সময় চিহ্নিত করা একই সঙ্গে কলা ও বিজ্ঞান। তবে ইতিহাসের শিক্ষা হলো, স্বৈরাচারকে প্রায়ই বলবান মনে হয়, কিন্তু আদপে ততটা শক্তিশালী নয়; কারণ আকস্মিক বিপদাপদ স্বৈরশাসনকে জড়িয়েই থাকে। স্বৈরাচারের জন্য চরম সত্যটা হলো যে, তা নিজের অবস্থা সম্পর্কে ঠাহর করতে পারে না। নীতির প্রশ্নে একটা অবস্থান নিলে, তা যদি আশু ফল না-ও দেয়, তবে তা পরিবর্তনের জন্য চমত্কার রিহার্সাল হিসেবে কাজ করে)। (অসমাপ্ত)।
মানবিক হস্তক্ষেপ
স্টেট ডিপার্টমেন্টের ওয়েবসাইটে অনেকটা আচমকাই হিলারির বাংলাদেশ সফরটি ঘোষিত হয়েছিল। জর্জ শুলজের পর যুক্তরাষ্ট্রের আরেকজন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকায় নামবেন, এটাই অবিশ্বাস্য ছিল। নানা বচনে এমন ধারণাই ছিল, হিলারি এই চাকরির মেয়াদে আর বাংলাদেশমুখো হবেন না। বিরোধী মত, দল ও অভিজন সমাজের ওপর হাসিনা সরকারের পীড়নে যুক্তরাষ্ট্র নানাভাবেই বিরক্তি বোধ করছিল। পারিবারিক বন্ধু নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে সরানোর পর হিলারি ক্রুদ্ধ হয়ে প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করেছিলেন। কিন্তু তার অনুরোধ রাখেননি প্রধানমন্ত্রী। এ নিয়ে হিলারিও চটে আছেন। গত সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনকালে নানা অনুষ্ঠানে হিলারি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে চোখাচোখি পর্যন্ত করেননি, নিজ অফিসে পরে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনিকে কড়া কথা শুনিয়েছেন। এরপর আমরা দেখি, হিলারি ক্লিনটন ছয় মাস আগে বাংলাদেশে তার নির্ধারিত সফর বাতিল করে দেন এই বলে—‘আমরা উদ্বিগ্ন যে, বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের জন্য জায়গা সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে। রাজনৈতিক হয়রানি, সাংবাদিক গ্রেফতার এবং কিছু এনজিওর ওপর চাপ বাড়ানো হয়েছে ... গণমাধ্যমের স্বাধীনতায়, নাগরিক সমাজের প্রতি আপনার সমর্থনে ঘাটতি আছে। আশা করি একটি উন্নত পরিস্থিতি আমার বাংলাদেশ সফর সম্ভব করে তুলবে।’ তাহলে প্রশ্ন জাগে, তিনি যে বাংলাদেশ গেলেন, তা কি উন্নত পরিস্থিতির সন্ধান পেয়ে না অধিক অবনতিতে উদ্বিগ্ন হয়ে? মূলত সফরের সিদ্ধান্তটি তার এবং যুক্তরাষ্ট্রের এস্টাবলিশমেন্টের। এই সফরের কারণ কী এবং কেন, খুঁজতে যদি নানা ঘটনাকে গুচ্ছে গুচ্ছে সাজাই এবং একটি আখ্যান রচনা করি, তাহলে ক্রিস্টোফার হিচেন্সের কিছু মন্তব্য ব্যক্ত করাই উপযুক্ত হতে পারে। যুগে যুগে দেশে দেশে আমেরিকার মানবিক হস্তক্ষেপের পর্যালোচনায় তিনি লিখেছিলেন—”A failed state may not trouble Americans’ sleep, but a rogue one can. On some occasions, there may seem to be overwhelming moral grounds to quite the sidelines and intervene. On others, the imperatives are less clear-cut. In all instances, nothing exceptional should be contemplated unless it has at least some congruence with the national interest.” (একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র আমেরিকানদের ঘুম নষ্ট করে না, করতে পারে একটি দুর্বৃত্ত সরকার। কিছু ক্ষেত্রে এমন নৈতিক প্রণোদনা থাকে যে, সাইডলাইন ছেড়ে হস্তক্ষেপে নামতেই হয়। অন্য ক্ষেত্রে প্রয়োজনটা তেমন স্বচ্ছ নয়। তবে সব মিলিয়ে জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে যথার্থতা না থাকলে কোনো সময় এমন পদক্ষেপ নেয়া হয় না।)
যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত অবস্থান
দক্ষিণ এশিয়ায় চীন, পাকিস্তান ও ভারত পারমাণবিক শক্তি—সীমান্তের কতক জায়গায় এরা পরস্পর অস্ত্র তাক করে বসে আছে। তারপর উপমহাদেশের নানান জায়গায় জঙ্গিবাদী তত্পরতা (বাংলাদেশ বাদে), চীন ও ভারতের আর্থিক পরাশক্তি হয়ে ওঠার গল্প, বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানে ভারতের গাঢ় উপস্থিতি, ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্যাপক অক্ষমতাকে উদাম করে দিয়ে ভারতীয় সেনাপ্রধানের চিঠি, শ্রীলঙ্কার সঙ্গে চীনের মাখামাখি—সব মিলিয়েই মার্কিনিদের ভাবনা দ্রবীভূত হয়েছে। এর মধ্যে একক ভাষা ও জাতীয়তাবাদের দেশ হিসেবে বাংলাদেশ আমেরিকানদের নির্ভরযোগ্য বন্ধু হতেই পারে। বাংলাদেশে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত প্রচ্ছন্ন মৌলবাদ থাকতে পারে আবার ধর্মীয় রাজনীতি যাতে জঙ্গিবাদের বিপরীত পরিণামে ঢলে না পড়ে, সেজন্য চাই সবল গণতান্ত্রিক রাজনীতি। রাষ্ট্রীয় বলে সন্ত্রাস দমন করতে গেলে উল্টো বিপদ, যার আশঙ্কা এখন বাংলাদেশে যথেষ্ট। আওয়ামী দুঃশাসনের প্রতিবাদের সব নিয়মতান্ত্রিক পথ বন্ধ এবং গুম-গ্রেফতার-নির্যাতনের মাধ্যমে বিরোধী দল ও অভিজন সমাজকে নিশ্চিহ্ন করলে বাংলাদেশ জঙ্গিবাদের ক্ষেত্র হয়ে দক্ষিণ এশিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে—সে আশঙ্কা মার্কিনিদেরও আছে।
আরও চার বছরের জন্য নির্বাচিত হওয়ার ভালো সম্ভাবনা এখন পর্যন্ত অপেক্ষা করছে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার জন্য। মার্কিন প্রেসিডেন্টদের মধ্যে অন্যতম রণমুখী হলেও ওবামার ইমেজ কিন্তু বেশি গণতান্ত্রিক—এটাই তার রাষ্ট্রপতিত্বের বৈশিষ্ট্য। নিউ আমেরিকা ফাউন্ডেশনের পরিচালক পিটার বার্জেন গত ২৯ এপ্রিল ‘দি নিউইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকায় নিবন্ধে বলেছেন, “The President who won the Noble peace prize less than nine months after his inauguration has turned out to be one of the most militarily aggressive American leaders in decades” (অভিষেকের নয় মাসেরও কম সময়ের মধ্যে নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়া প্রেসিডেন্ট ওবামা বহু দশকের আমেরিকান নেতাদের মধ্যে সবচেয়ে সমরবাজ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন)। বুশ আমলে পাকিস্তানে প্রতি ৪৩ দিনে একটি করে গড়ে ড্রোন বিমান হামলা হতো। ওবামার প্রথম দুই বছরে ড্রোন হামলা হয়েছে প্রতি চারদিনে একটি। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ওবামা ইরাক, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, সোমালিয়া, ইয়েমেন ও লিবিয়াতে সশস্ত্র সংঘর্ষে মার্কিনিদের যুক্ত করেছেন। ওসামা বিন লাদেন পাকড়াও এবং হত্যার দুঃসাহসিক অভিযানের নির্দেশ দিয়েছেন। প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায়, যার ব্যাপ্তি পেন্টাগনের ম্যাপে বঙ্গোপসাগরও রয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র যে কৌশলগত কারণে ব্যাপক পরিকল্পনা নিয়েছে, তা প্রেসিডেন্ট ওবামা খোলাখুলি বলেছেন। অবশ্য আফগানিস্তান থেকে সরিয়ে এনে মার্কিন সামরিক স্থাপনা প্রশান্ত অঞ্চলে বিস্তৃত করার ছকটি কতখানি সত্যনিষ্ঠ, সে হিসাব ইতিহাসই দিতে পারবে। চীন ও ভারতের সঙ্গে পৃথক নিরাপত্তা ফোরাম যেমনি করে যুক্তরাষ্ট্র গ্রহণ করেছে, পাশাপাশি প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের সঙ্গে নিরাপত্তা সংলাপ করেছে। গত ১৯ এপ্রিল ঢাকায় এ বৈঠকে ছিলেন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী এন্ড্রু শাপিরো এবং ঊর্ধ্বতন মার্কিন সামরিক কমান্ডাররা। এ সম্পর্কিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তি মারফত আমরা জানতে পারি, বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহযোগিতা এখন জবরদস্ত রূপ নিয়েছে। বঙ্গোপসাগরকে (দু’পাশে ভারত ও মিয়ানমার) নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাংলাদেশ হচ্ছে মুখ্য শক্তি। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে বাংলাদেশের সঙ্গে নিরাপত্তা সহযোগিতা, মার্কিনি অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সশস্ত্র বাহিনীকে শক্তিশালী করা যেতে পারে। কোনো কোনো মহল এমনও মনে করছেন, চীন ও ভারতের মাঝখানে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো যুক্তরাষ্ট্রের নজরদারিতে রয়েছে।
জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনীর তুলনায় ন্যাটোতেও বাংলাদেশী সামরিক কর্মকর্তাদের মিথষ্ক্রিয়া বাড়ছে। বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর আন্তর্জাতিকতার সঙ্গে ন্যাটো বা ইউএন পিস কিপিংয়ের সংশ্লিষ্টতা খুবই বেশি। এখন প্রশ্ন হলো, যুক্তরাষ্ট্র যে দক্ষিণ এশিয়ায় নিরাপত্তা নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করছে, তা কি যুক্তরাষ্ট্র-ভারত অক্ষবলয় সম্প্রসারিত করার জন্য? ভারতকে আঞ্চলিক মুরুব্বি রেখে তার জন্য, আরও বাড়িয়ে বললে, চীনকে ব্যতিব্যস্ত রাখতে, আমেরিকা এমন সব করছে? এ ক্ষেত্রে আমি দু’জন বিশিষ্ট কলামনিস্ট শ্রদ্ধেয় ফরহাদ মজহার ও সাদেক খানের মতামতকে উদ্ধৃত করতে চাই। ফরহাদ মজহার ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে—‘হিলারির বাংলাদেশ সফরকে দিল্লি-ঢাকা-ওয়াশিংটন মিলে চীনের বিরুদ্ধে একটা প্রতিরোধের প্রাচীর গড়ে তোলার সফর হিসেবে যদি আমরা দেখি তাহলে সেটা খুবই সরলভাবে দেখা হবে। বাংলাদেশ ভারতের সমরনীতি, প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার অধীন একটি দেশ। সেই ক্ষেত্রে দিল্লির সঙ্গে ওয়াশিংটনের সম্পর্কই তো যথেষ্ট। তার বাইরে বাংলাদেশের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপাক্ষিক ‘রাজনৈতিক-সামরিক নিরাপত্তা সম্পর্ক’ গড়ে তোলার প্রয়োজন ঘটল কেন? কী দরকার প্রতি বছর নিয়মিত সরকার ও রাষ্ট্রের ঊর্ধ্বপর্যায়ের নিরাপত্তাসহ সব বিষয় নিয়ে সংলাপের প্রয়োজনীয়তা এবং সেই সংলাপকে প্রতিষ্ঠানিক রূপ দেবার চেষ্টা?... অনুমান করা যায়, বাংলাদেশের কৌশলগত তাত্পর্য অর্জনের মানে হচ্ছে বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুনির্দিষ্ট কিছু প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তা ও রাজনীতি সংশ্লিষ্ট স্বার্থ রক্ষা করতে পারে। যে ভূমিকা ভারতের আঞ্চলিক ভূমিকা থেকে আলাদা।’
সাদেক খান বলছেন, বঙ্গোপসাগরের আঞ্চলিক নিরাপত্তা বিধানে বাংলাদেশের ‘মুখ্য ভূমিকা’র সূচনা ঘটেছে। প্রজাতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি ও স্বতন্ত্র ভূমিকার একটা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ ঘটেছে। একই সময়ে বাংলাদেশ সফররত ভারতের সিনিয়র মন্ত্রী প্রণব মুখার্জিকে বাংলাদেশে ভারতের ‘সাংস্কৃতিক আত্তীকরণ অভিযান’-এর কারিগর হিসেবে উল্লেখ করে জনাব খান মন্তব্য করেন—“অথচ এ উপস্থিতিকে উপলক্ষ করেই বাংলাদেশে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর ভ্রুকুটি-কাতর নানা মহল ‘বাংলা-মার্কিন অংশীদারিত্ব’ সংলাপকে চীন-বিরুদ্ধ মার্কিন-ভারত অক্ষশক্তির আওতাভুক্ত একটা কর্মসূচি বলে ধরে নিয়েছে।”
ভারতীয় বুদ্ধিজীবীরা হিলারির বাংলাদেশ সফরকে তুচ্ছ ঠাউরে একে নতুন মার্কিন-ভারত অক্ষশক্তির সম্প্রসারণ বলে ভাবছেন। যেমন ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী যশোবন্ত সিং নির্লিপ্ত প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন (গালফ নিউজ, ২০ মে), ‘আসলে ড. ইউনূস নিয়েই হিলারি হাসিনার সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলেন। এ নিয়ে তাদের মধ্যে মতবিরোধ আছে।’ আরেক কলামনিস্ট এমকে ভদ্রকুমার অনলাইন প্রতিবেদনে দাবি করেছেন, যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ দৃঢ় সম্পর্ক ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের কক্ষপথে সমান্তরালভাবেও চলতে পারে, ... যুক্তরাষ্ট্র-ভারত অক্ষশক্তি গঠনে বাংলাদেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অবস্থানে রয়েছে।
সাংবাদিক-বিশ্লেষক বন্ধু মঈনউদ্দীন নাসেরের একটি প্রাসঙ্গিক মন্তব্যে (সাপ্তাহিক ঠিকানা, ২ মে ২০১২) ভর করে আমরা উপসংহার টানতে পারি। তিনি লিখেছেন, ‘দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিনি হুকুমতে ভারত যে আর আঞ্চলিক মোড়ল থাকতে পারছে না, যুক্তরাষ্ট্র তা মালুম করতে শুরু করেছে। ভারতের কারণে ভারতের সঙ্গে প্রতিবেশীদের সম্পর্ক ভালো নয়, যতটা ভাল চীনের সঙ্গে। কিছুদিন আগে জেনেভায় মানবাধিকার কাউন্সিলে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে মার্কিনি প্রস্তাবে এ অঞ্চলে ভারত ছাড়া আর কোনো দেশ ‘হ্যাঁ’ ভোট দেয়নি। তাহলে ভারতের দাদাগিরি রইল কোথায়?’ চীন আমেরিকার জন্য এখনও হুমকি নয়, যতটা ভারতের আগ্রাসনবাদী সামরিক মনোভাব। তাছাড়া অভ্যন্তরীন রাজনীতির জটিল রসায়নে রাষ্ট্রটি এখন প্রায় জেরবার। কোয়ালিশন সরকারের অন্যতম শরিক মমতা ব্যানার্জি (হিলারি কলকাতাও ঘুরে গেছেন) শিগগিরই নির্বাচন দাবি করেছেন; একই সঙ্গে বৃহত্তম ভোট ব্যাংক উত্তর প্রদেশের সাম্প্রতিক বিধান সভা নির্বাচনে বিপুল বিজয়ী মোলায়েম সিং যাদবের সমাজবাদী দল একই সুর তুলতে যাচ্ছে। সময়টা এমন বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তানে একই সময়ে নির্বাচনের দাবি এবং ক্ষমতার পরিবর্তনের সম্ভাবনা সামনে আসছে। যুক্তরাষ্ট্রের এশিয়া বিশ্লেষকরা মনে করেন, কারও ওপর নির্ভর না করে যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিপক্ষীয় দ্বিপক্ষীয় করে একক প্রাধান্যের নিরাপত্তা ও বাণিজ্যিক বলয় গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পেছনের আসনে সরে যাওয়াতে ভারতেরও আপত্তি থাকার কথা নয়। তবে এর বিনিময়ে ইরান থেকে তেল আমদানি কমাতে যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধকে ‘আর কত ছাড়’ গোছের গা-ঝাড়া দিয়ে উপেক্ষার কূটনীতিও ফাঁকে দিয়ে ভারত সেরে নিতে চায়।
অতএব হিলারি ক্লিনটনের স্বেচ্ছা বাংলাদেশ ও ভারত সফরের কৌশলগত, বাণিজ্যিক, সামরিক এবং মানবিক দিকগুলো এক গুচ্ছে বেঁধে নিলে অনুমানের আকাশ মেঘমুক্ত হতে পারে। কিন্তু ওই ছকে বাংলাদেশের বর্তমান ফ্যাসিবাদ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ঢোড়া সাপের ফনার মতো। হাসিনা সরকারের উগ্র ফ্যাসিবাদী তত্পরতা, জনগণ, অভিজন সমাজ, বিরোধী দল, গণমাধ্যম, মানবাধিকার, রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব বিলীন করে দেয়ার বর্বরতা প্রাত্যহিকের মতোই যেন আজ স্বাভাবিক। গণতন্ত্রে দম ফেলার জায়গাটুকু সঙ্কুচিত করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রবাসী বাংলাদেশীদের পক্ষে ‘ভয়েস অব বাংলাদেশ’ এবং এবং ‘আই-বিএনপি’ নামের দুটি সংগঠন হিলারির কাছে ওই জরুরি আবেদনে যথার্থই বলেছিল— “The democratic space has been squeezed to a point when it is no longer possible for the opposition to express dissent or launch protests without the fear of severe reprisal” (গণতন্ত্রের ক্ষেত্রকে এমনভাবে সঙ্কুচিত করা হয়েছে যখন ভয়াবহ দমনের আশঙ্কা ছাড়া বিরোধী দলের ভিন্নমত প্রকাশ বা বিক্ষোভের সুযোগ নেই)। বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীকে বিশেষ সরকারী বাহিনী দিয়ে গুম করা হয়েছে প্রায় দেড় মাস। গার্মেন্ট শ্রমিক আমিনুল ইসলামকে গুম করে হত্যার তাজা অপরাধে পরিস্থিতি উত্তপ্ত। যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক আর জে রামেল বিশ্বের নানা দেশে বিভিন্ন সময়ে সরকার কর্তৃক গণহত্যা (Genocide), রাজনৈতিক খুন-খারাবি (Politicide) এবং সরকারি বাহিনী দ্বারা গণ খুন (Democide) —এই তিন ভাগে রাজনৈতিক ইতিহাসকে পর্যালোচনা করেছেন। (Democide শব্দটি এসেছে গ্রিক উঃসড়ং অর্থাত্ ‘জনগণ’ এবং Laeder অর্থাত্ ‘খুন’-এর সম্মিলিত প্রয়োগে) এতে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান কর্তৃক বাংলাদেশীদের গণহত্যারও উল্লেখ আছে। ‘Death by Govt.’ বইয়ে তিনি বলছেন— “Democide’s necessary and sufficient meaning is that of the restricted to intentional killing of an unarmed person or people for political reason ... as the arbitrary power of a regime increases, that is, as we move from democratic through anthoritarian to totalitatian regimes, the amount of killing jumps by huge multiplus.” (ডেমোসাইডের অর্থ হচ্ছে সরকার কর্তৃক রাজনৈতিক কারণে নিরস্ত্র ব্যক্তিকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হত্যাকাণ্ড। একটি সরকারের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা যখন বাড়ে অর্থাত্ গণতন্ত্র থেকে কর্তৃত্ববাদী এবং একদলীয় স্বৈরাচারে পরিণত হয়, তখন এ ধরনের হত্যার সংখ্যা লাফিয়ে বাড়তে থাকে)। মানবাধিকার সংগঠনগুলো আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ক্রমবর্ধমান ক্রসফায়ার, গুম, গুপ্তহত্যা, জেল হেফাজতে নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা এবং বিচার বিভাগের নগ্ন রাজনীতিকীকরণের যে বীভত্স ছবি ক’দিন আগে তুলে ধরেছে, তার হিসেব দিতে গিয়ে তারাও নজির খুঁজে পাচ্ছে না।
যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত জাতীয় স্বার্থে হোক আর বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী মানুষের জন্য নেমে আসা মানবিক ধস রোধে হোক, হিলারি ক্লিনটন এসে সরকারকে বেশ কটু কথা শুনিয়ে গেছেন। বিশ্বের এক নম্বর শক্তিবান রাষ্ট্রের শীর্ষ কূটনীতিক হিলারি কী ধমক দিয়েছেন, তা সরকারের মন্ত্রীদের প্রলাপ ও আর্তনাদেই পরিষ্কার। হাসিনা সরকার কি এত ক্ষমতাবান যে যুক্তরাষ্ট্রকে চটিয়ে এবং আন্তর্জাতিক দাতাদের উদ্বেগকে ‘ধুত্তোরি’ বলে ক্ষমতা অব্যাহত রাখবে? সৈয়দ আশরাফের মতো ব্রিটিশ প্রবাসী বাংলাদেশী কী করে নোবেল শান্তি পুরস্কারপ্রাপ্তির মানদণ্ড হিসেবে ‘চিজ স্যান্ডউইচ আর হোয়াইট ওয়াইন’-এর উল্লেখ করলেন?
হিলারির সফরসূচিটাও ছিল সরকারের জন্য বেমক্কা। ঢাকায় নেমে বিমানবন্দরে প্লেনে বসেই, বাইরে ডা. দীপু মনিকে আচম্বিত অপেক্ষায় রেখে, এক ঘণ্টার মতো বৈঠকে মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর দফতরে দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকের পর যৌথ সংবাদ সম্মেলন এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে ‘পার্টনারশিপ ডায়লগ’ চুক্তি (মূলত বেগম খালেদা জিয়ার শাসনামলে এমনটি সই হয়েছিল) নবায়ন—এটুকুই ছিল সরকারের সঙ্গে হিলারির মিথষ্ক্রিয়া। প্রধানমন্ত্রীর বাড়ি ‘গণভবন’ পর্যন্ত হিলারি যাননি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নৈশভোজ নাকচ করেছেন। বরঞ্চ, বিরোধী দলের নেতা বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার বাসায় গিয়ে সাক্ষাত্ করেছেন। বেগম জিয়ার বাসায় ডাবের পানি পান করার আগেই হিলারি সংবাদ সম্মেলনে মানবাধিকার পরিস্থিতিতে উদ্বেগ ব্যক্ত করেছেন। এ সংক্রান্ত প্রশ্নটি করেছেন তার সফরসঙ্গী (?) মার্কিন সাংবাদিক! বাংলাদেশের কোনো সাংবাদিকের পক্ষে বিদ্যমান ব্যস্ততায় সরকারের কর্তাব্যক্তিদের সামনে এমন প্রশ্ন করা যে সম্ভব নয়, হিলারি তা মাথায় রেখেই বাংলাদেশে এসেছেন। পুরো সফরে হিলারি সরকারকে ঢেঁকুর তোলার তৃপ্তি দেননি, বরং নির্ভার করেছেন বিরোধী দল এবং অভিজন সমাজকে। বেগম জিয়া বারবার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক চেয়েছেন। হিলারি সে প্রত্যাশার স্বীকৃতি দিয়েছেন। তিনি নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছেন। মানবাধিকারের অমানবিক পরিস্থিতির তদন্তে নিরপেক্ষ কমিশন চেয়েছেন। ড. ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংক প্রসঙ্গে সরকারের পাগলাটে আচরণ সম্পর্কে আবারও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক-সামরিক ও নিরাপত্তার কৌশলগত নেটওয়ার্কে বাংলাদেশকে এ অঞ্চলে যে জবরদস্ত সহযোগী হিসেবে স্বীকৃতি দিল হিলারি কিন্তু মুখ ফুটে তা বলেননি, বরং স্পষ্ট করে সবার বোধগম্য করেছেন। এতে করে পর্যবেক্ষকরা অনেকখানি নিঃসন্দেহ যে, বাংলাদেশকে সামরিকভাবে ব্যবহার করার ভারতীয় পরিকল্পনা অথবা বাংলাদেশে সামরিক অভিযান পরিচালনার স্বপ্ন যদি ভারতীয় সমরবিদরা দেখে থাকবেন, তা হলে স্বপ্নভঙ্গের যথেষ্ট মাল-মসলা হিলারি জুগিয়ে গেছেন। সেজন্যই হয়তোবা হাসিনাকে স্টালিন হতে প্ররোচনা দিচ্ছে কোনো মহল। তারা যুক্তি দেখাতে পারেন—হিলারি তো পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকবেন না। কিন্তু জাতীয় স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান স্টেট ডিপার্টমেন্টের ব্যক্তিবিশেষের ওপর নির্ভরশীল নয়। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রকেও এখন দেখাতে হবে, তারা কতখানি সিরিয়াস এই নতুন দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে। সেজন্য হিলারির সফরের ফলো-আপ কী হয়, তাও দেখার বিষয়।
অনুমান তো অনুমান। আন্দাজ তো আন্দাজই। হিলারি ক্লিনটন শেখ হাসিনাকে কী বলে গেছেন, তা জানা সম্ভব নয়। তবে নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত ‘এশিয়ান টাইমস’ পত্রিকার সম্পাদক আবু জাফর মাহমুদ তার ফেসবুকে যা বলেছেন, তাতে করে অনুমানের দিগন্ত বিস্তৃততর হতে পারে। ‘হিলারির কড়াকড়ি : বাংলাদেশে পরিবর্তনের ইঙ্গিত’ শীর্ষক রচনায় তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বলছেন, স্বাধীন রাষ্ট্র স্বাধীনভাবে চালানোর ওপর জোর দিয়ে তিনি ভারতীয় নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হয়ে বাংলাদেশ পরিচালনার জন্য তাগিদ দেন। এ প্রসঙ্গে তিনি নিরাপত্তায় নিয়োজিত বিদেশি স্পেশাল ফোর্সের উপস্থিতিকে উদ্বেগজনক উল্লেখ করেন। ওই ফেসবুক আরও বলছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠান প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী আদালতের আদেশের প্রসঙ্গটি আনলে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রায়ের অপর অংশটি তাকে শুনিয়ে বলেন, একতরফা নির্বাচন কেউ গ্রহণ করবে না। নির্বাচন হতে হবে সবার গ্রহণযোগ্য।
কথার পিঠে কথা আসে। অনুমানের পিঠে সত্য আসে আবার অসত্যও উড়ে বেড়ায়। হাসিনা-হিলারি সংলাপটি অমন হয়েছিল কিনা, আমাদের বোঝা কঠিন। তবে সরকারের মন্ত্রীদের তাত্ক্ষণিক ও সৈয়দ আশরাফের লিখিত বক্তৃতায় যেসব নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া আমরা লক্ষ্য করেছি, তাতে আন্দাজ কিছুটা ঠিকঠাক আছে বলে মনে হতে পারে। সবশেষে বলব, বাংলাদেশের জনগণের এখন জড়তা ঝেড়ে সাহসী সিদ্ধান্ত নেয়ার সময়। ফ্যাসিবাদকে চূড়ান্তভাবে উপড়ে ফেলে ঢাকা-ওয়াশিংটন সরাসরি সম্পর্ককে প্রতিষ্ঠিত করা এবং ভারতের আধিপত্যবাদকে বাংলাদেশের প্রতি সমমর্যাদার বন্ধুত্বে নিয়ে আসার কাজটি জরুরি।
লেখক : বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন