॥ বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরোত্তম ॥
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
৭
তুমি নাই প্রায় এক সপ্তাহ। কেমন যেন একেবারে খাঁচায় বন্দী। ছেলেবেলায় বাড়ি থেকে ছয়বার পালানো বাঁধনছাড়া মানুষ আমি। কিন্তু ওর আগে এক দিনও এভাবে কাটাইনি। ছেলেবেলায় বাড়ি থেকে পালালে বাবা ও বড় ভাইয়ের ভয়ে সতর্ক থাকতে হতো। কিন্তু তোমার মৃত্যুর পর পালিয়ে থাকা একেবারে অসহ্য। তাই বেরিয়ে পড়তে চেয়েছিলাম প্রতি মুহূর্তে। কিন্তু নানা কারণে হয়ে উঠছিল না। মাকে দেখার জন্য মন বড় ছটফট করছিল। তাই বেরিয়ে পড়ার মুহূর্তে; আজাদ-মুরাদকে নিয়ে মা এসেছিলেন। জীবনে কখনো মাকে দেখে অমন ব্যাকুল হয়ে কাঁদিনি। মাও কেঁদেছিলেন। কিন্তু তার চোখে পানি ছিল না। কিছুণ পর শান্ত হলে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলেছিলেন, ‘বজ্র, আর ঘরে থাকিস না। বঙ্গবন্ধুর খুনিরা তোকে পেলে মেরে ফেলবে। ঘর থেকে নিয়ে তোকে মেরে ফেললে আমি শান্তিতে কাঁদতেও পারব না। তুই রাস্তায় গিয়ে জাতির পিতার হত্যার প্রতিবাদ করে যদি মারাও যাস তখন আমি প্রাণভরে কাঁদতে পারব। বলতে পারব আমার বজ্র বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিবাদ করে জীবন দিয়েছে।’ হে পিতা, তোমাকে আজ কী বলি। আমার কোনো শ্রম, ঘাম কাজে এলো না। আমার মায়ের কষ্টের কোনো মূল্য হলো না। কেমন যেন সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেল। এখন নিমুরাদরা যা দাপাদাপি করছে তাতে সম্মানে বেঁচে থাকাই মুশকিল। গত ১৬ মে বোয়ালমারীতে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের একটি গণহত্যার স্মরণসভায় গিয়েছিলাম। সেই ঘটনাটা জানাতে বড় ইচ্ছে করছে তাই ওটা আগে বলে নিই। ১৫ মে ফরিদপুর সার্কিট হাউজে রাত যাপনের কথা তো বলেছি। পরদিন বোয়ালমারী যাওয়ার পথে রাজবাড়ী মোড়ে বিএনপির নেতা সাবেক মন্ত্রী কামাল ইবনে ইউসুফের এক ঘনিষ্ঠ কর্মী খন্দকার চান্দের বাড়িতে সকালের নাশতা করেছি। নাশতার চেয়ে তাদের
আন্তরিকতা ও আগ্রহ ছিল অনেক বেশি। কেন জানি না কোথাও গেলে লোকজন কম হয় না। আর খাওয়ার সময় তো এমনিতেই হিসাব থাকে না। আমরা ছিলাম ১২ জন। মনে হয় নাশতায় শরিক হয়েছিল তিন বারোং ছত্রিশ অথবা চার বারোং আটচল্লিশ জন। খন্দকার চান্দ বেশ হৃদয়বান মানুষ। যতœ করার জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিল। তার স্ত্রী নার্গিস খন্দকার মাচ্চর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। খুব ধীরস্থির শান্ত স্বভাবের মানুষ। নাশতা শেষে একটা চমৎকার গামছা উপহার দিয়ে আমার হৃদয় জয় করে ফেলেছে। গামছার বদলে লাখো কোটি টাকা দিলেও হয়তো অতটা আনন্দিত হতাম না। সেখান থেকে ৯টা কয়েক মিনিটে বোয়ালমারীর পথে রওনা হয়েছিলাম। মাঝে বেশ কয়েক জায়গায় মোটরসাইকেল আরোহীরা অপোয় ছিল। তাই বোয়ালমারী পৌঁছতে বেলা ১১টা বেজে গিয়েছিল। এখন সভা সমিতিতে যেতে মোটরসাইকেল এক মস্তবড় উপদ্রব। তোমার সময় এটা মোটেই ছিল না। স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে পুরো টাঙ্গাইল জেলায় মোট ১০-১২টা মোটরসাইকেল ছিল। ’৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি অস্ত্র জমা নেয়ার পথে তোমাকে নিয়ে যে মোটরসাইকেল শোভাযাত্রা করা হয়েছিল। যেখানে ৪০টা ভালো মোটরসাইকেল জোগাতে আমাদের ভীষণ পেরেশান হতে হয়েছিল। আজকাল বৃহত্তর ময়মনসিংহের অনেক জেলায় চার হাজার মোটরসাইকেল জোগাড় করতেও তেমন বেগ পেতে হবে না।
যাক আগের কথা আগে বলে নিই। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময় রাস্তাঘাট ছিল খুবই অনুন্নত। আগে আরিচা-শ্রীরামদি ঘাট বা দৌলতদিয়া পারাপার হতে সময় লাগত দুই-আড়াই ঘণ্টা। অন্য দিকে নগরবাড়ী-আরিচায় যেতে তিন-চার ঘণ্টা লেগে যেত। ’৭২ সালের এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহে প্রায় ১০০ সহযাত্রী নিয়ে কলকাতা সফর থেকে প্রথম ফরিদপুর সার্কিট হাউজে এসেছিলাম। খুবই পুরনো ফরিদপুর সার্কিট হাউজ। ১০০ বছরের বেশি হবে বয়স। ফরিদপুর সার্কিট হাউজের মতো হাতেগোনা আর মাত্র কয়েকটা। আশপাশের ঘরগুলোর উচ্চতা কম হলেও মাঝের দু’টি রুমের ছাদের উচ্চতা ২০ ফুট। গত বছর আজমীরে গিয়ে মারোয়ারা প্যালেসে ছিলাম। তারও ফোর থেকে ছাদের উচ্চতা ২০ ফুট। ৫০০ থেকে সাড়ে ৬০০ স্কয়ার ফুটের বিশাল রুম। ফরিদপুর সার্কিট হাউজের রুম কিছুটা ছোট ১৮ বাই ১৮। আগে ছিল ছয়-সাত একর ফাঁকা জায়গার মধ্যে সার্কিট হাউজ। এখন দালানকোঠা করে ভরে ফেলা হয়েছে। ’৭২ সালের পরে বেশ কয়েকবার ফরিদপুর সার্কিট হাউজে রাত কাটিয়েছি। ’৭৩ বা ’৭৪ সালের ঘটনা। একদিন সার্কিট হাউজে গিয়ে দেখি রীবাহিনী ক্যাম্প করেছে। রীবাহিনী গঠনে কাদেরিয়া বাহিনীর বিশাল ভূমিকা ছিল। প্রায় ৯ থেকে সাড়ে ৯ হাজার কাদেরিয়া বাহিনীর সদস্য ছিল রীবাহিনীতে। আমি গেছি শুনে রীবাহিনীর পরিচালক সরোয়ার মোল্লা খুব আগ্রহ নিয়ে ছুটে এলেন। অনেক গল্পগুজব হলো। কেন এসেছেন জিজ্ঞেস করতেই বললেন, ‘আর বলবেন না, বড় বিপদে আছি। শেষ পর্যন্ত জেল খাটতে হয় কিনা আল্লাহ মাবুদ জানেন।’ জেল খাটবেন কেন? ‘আর বলবেন না। শহীদ সাহেবের আর আমার সিকিউরিটি তর্কাতর্কি করে বক্সিং প্র্যাকটিস করতে গিয়ে একজন মারা গেছে।’ বললাম, ‘চিন্তা করবেন না। ভালোভাবে তদন্ত করুন, প্রয়োজন হলে আমাকে বলবেন।’ ঢাকায় এসে আনোয়ারুল আলম শহীদের কাছে সব শুনে খবর দিলাম মূল বীর কাদেরিয়া বাহিনীর সদস্য ঘাটাইলের দুর্মুজ খাঁকে। পাঠক যারা ‘স্বাধীনতা ৭১’ পড়েছেন তারা অবশ্যই দুর্মুজ খাঁকে চিনতে পারবেন। মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে তার কমান্ডার বেনু ব্যক্তিগত শত্র“ মেরেছিল। সে জন্য তার মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল। যুদ্ধ শেষে নিহতের আত্মীয়স্বজন মা করে দেয়ায় সে বেঁচে যায়। তার স্থান হয় রীবাহিনীতে। সে সব সময়ই ভীষণ সাহসী আনমনা স্বভাবের ছিল। রীবাহিনী গঠনের সময় থেকেই সে আনোয়ারুল আলম শহীদের নিরাপত্তা রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করত। মহাপরিচালক, পরিচালক, লিডার, ডেপুটি লিডার ও অন্যান্য পদবির কর্মকর্তা নিয়ে রীবাহিনী গঠিত হয়। মহাপরিচালক ছিলেন কর্নেল নুরুজ্জামান। পরিচালক ছিলেন তিনজনÑ আনোয়ারুল আলম শহীদ, মোল্লা গোলাম সরোয়ার ও মেজর হাসান। কবে কোন সময় আনোয়ারুল আলম শহীদ আর মোল্লা গোলাম সরোয়ার দু’জন ফরিদপুর গিয়েছিল অথবা কোনোভাবে একত্র হয়েছিল। সেখানে দুই পরিচালকের দুই দেহরীর মধ্যে তর্কবিতর্ক বাধে। গোলাম সরোয়ারের রী দুর্মুজ খাঁকে বলে, ‘তোরা কোনো যুদ্ধই করিসনি, শুধু শুধু ফুটানি করিস।’ দুর্মুজ খাঁ রেগে গিয়ে জবাব দেয়, ‘আমরা যত যুদ্ধ করেছি তোরা তত যুদ্ধের নামও শুনিসনি।’ নানা তর্কবিতর্কের মাঝে হঠাৎ কী করে কথা হয় ঠিক আছে তুই আমারে এক বক্সিং দে, আমি তোরে আরেক বক্সিং দেই। দেখা যাক কার কত জোর। তবে একা নয়, দুই ডাইরেক্টরের সামনে দু’জন দু’জনকে বক্সিং দেবে। দিন-তারিখ ঠিক করে তারা সার্কিট হাউজের সামনে এক বিকেলে বক্সিং যুদ্ধ অনুষ্ঠিত করে। সেও এক অভাবনীয় ব্যাপার। দুর্মুজ খাঁ বলে, সরোয়ার মোল্লার সিকিউরিটিকে তুই আগে মার, সে বলে না তুই আগে মার। দুর্মুজ খাঁ গর্ব করে বলে আমি মারলে তুই আর মারার সুযোগ পাবি না। কিন্তু সে কিছুতেই রাজি হয় না। দু’জন অনেক তর্কবিতর্ক করে। পরিচালকেরা এতে ধৈর্য হারিয়ে ফেলে। শেষ মুহূর্তে দুর্মুজ খাঁ গোলাম সরোয়ার মোল্লার দেহরীকে আঘাত করে। বুকের ওপর এমন জোরে ঘুষি মারে সে টাল সামলাতে না পেরে পড়ে যায়, আর উঠতে পারে না। হাসপাতালে নিতে নিতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। এ নিয়ে তারা খুব ঝামেলায় পড়ে। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তারা মুক্তি পায়। সেখানকার আরেকটি ঘটনা। তখন দেশে খুব খাদ্য ঘাটতি চলছে। নানা দেশ থেকে আমদানি করা খাদ্য আমেরিকার কারসাজিতে আমাদের বন্দরে না ভিড়ে অন্যত্র ভিড়ছে। চিটাগাংয়ের কাছাকাছি আসা খাদ্য বোঝাই জাহাজগুলোকে অন্য বন্দরে পাঠিয়ে দিয়ে একটা অহেতুক খাদ্যসঙ্কট সৃষ্টি করা হয়েছিল। যেখানে চালের দাম ছিল বারো আনা থেকে এক টাকা সের। সেই চালের দাম উঠেছিল আড়াই-তিন টাকায়। চার দিকে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। তাই ’৭৪-এর শেষে দেশবাসীর কাছে আহ্বান করেছিলে, এক ইঞ্চিও জমি পতিত যাতে না থাকে। সরকারি জমি যে আবাদ করবে ফসল সে পাবে। আরিচা ফেরির কারণে মাঝে মধ্যেই ফরিদপুর সার্কিট হাউজে থাকতাম। ফরিদপুর সার্কিট হাউজে এক বুড়ো পিয়ন ছিলেন। সার্কিট হাউজের পিয়নেরা সাধারণত যেমন হন তেমন ছিলেন। সরকারি অতিথিশালায় বড় বড় যারা ওঠেন, তারা তেমন মাটির দিকে তাকিয়ে চলেন না। এটা প্রায় সর্বেেত্রই একই রকম। ‘নিজের ধন পরকে দিয়ে দৈবগ্য মরে কেথা বয়ে’ আমার অবস্থাও সেই রকম। অনেক কাজই সরল বিশ্বাসে করেছি। কোনো ভূতভবিষ্যৎ চিন্তা করিনি। ’৬২-’৬৫ পর্যন্ত বাড়ি থেকে ছয়বার পালিয়েছি। বাড়ি পালানোর সময়গুলো বড় অনাদর, বড় কষ্টে কেটেছে। তাই গরিব মানুষ দেখলেই মায়া হতো। এখনো যেমনটা হয়। সার্কিট হাউজের পিয়নের ছেলে নাকি লেখাপড়া করত। বইয়ের টাকা, এসএসসি পরীার টাকা, আইএ পরীার টাকা বছর তিনেকে পাঁচ-ছয় হাজার নিয়েছে। এখন পাঁচ-ছয় হাজার টাকার তেমন মূল্য নেই। কিন্তু ’৭২-’৭৫ সালে পাঁচ-ছয় হাজার টাকা ছিল অনেক টাকা। তখন সোনার দাম ছিল দেড়-দুই শ’ টাকা ভরি। ফরিদপুর শহরের আশপাশে এক পাখি জমির দাম হয়তো হতো হাজার টাকা, যা এখন হয়তো কোটি টাকা হবে। যাক ওগুলো। ওগুলো আমার উদ্দেশ্য নয়। আমার উদ্দেশ্য ফরিদপুর সার্কিট হাউজের পিয়নের সার্কিট হাউজ আঙিনায় ধান চাষ। ওই ধান লাগানোর জন্যও টাকা দিয়েছিলাম। মাঝে একবার দেখেছি ধানগাছ বেশ বড় বড় হয়েছে। তারও মাস দেড়েক পর কোনো এক সভায় কুষ্টিয়া অথবা চুয়াডাঙ্গা গিয়েছিলাম। ফেরার পথে রাতে ফরিদপুর সার্কিট হাউজে উঠি। গাড়ি থেকে নামতেই সেই পিয়ন পায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়েন। বাপের বয়সের মানুষ বড় বিব্রতবোধ করছিলাম। টেনে তুলে জিজ্ঞেস করতেই সন্তানহারা পিতার মতো কাঁদতে কাঁদতে আকুল হয়ে বলল, ‘আপনার টাকায় ধান বুনেছিলাম। সব ধান পেকেছে। একদিন ২৫-৩০ মণ কেটে বাড়িতেও নিয়েছি। এখন নাজির সাহেব বলছেন, আমি ধান নিতে পারব না। তিনি নিবেন। ধান মাড়ানো হলে সেখান থেকে অর্ধেক দেবেন। আমি এত কষ্ট করে ধান ফলালাম এখন নাজির সাহেব নিয়ে যাবে কোনো বিচার পাব না। আপনি একটা কিছু করেন।’ সে যে কী কান্না! না দেখলে কেউ বুঝতে পারবে না। রাতেই নাজিরকে ডাকলাম। সব নাজিররা যেমন হয় তিনিও তেমন ছিলেন। একজন নাজির সারা জীবন একই জায়গায় থাকেন। চাকরিটা ছোট হলেও মতা অনেক। অনেক ডিসিই জানেন না তার জেলায় কোথায় কী আছে কী নেই। কিন্তু নাজিরের সব নখদর্পণে। ডিসিরা চাইলে নাজিররা পারেন না এমন কোনো কাজ নেই। বলতে গেলে সিন্দুরে পোকার কলিজা অথবা বাতাসের ডগা এনে দিতে পারেন। নাজিরের চাকরি করতে হলে সবার আগে ‘জি হুজুর’, মানে পো ধরা শিখতে হয়। গরিব পিয়ন ধান বুনেছেন সেটা নিতে গেছেন কেন জিজ্ঞেস করলে বিনয়ের অবতার সেজে জবাব দিলেন ডিসি সাহেব বলেছেন, গরিব মানুষ ওর ধান তুলতে অসুবিধা হবে তাই সরকারিভাবে উঠিয়ে ওকে যেন অর্ধেক দিয়ে দেই। আমার এখানে কী করার আছে? সব ডিসি স্যারের হুকুম। পরদিন সকালেই চলে আসতে চেয়েছিলাম। বিষয়টা বোঝার জন্য একটু দেরি করে রওনা হব বলে ঠিক করলাম। ফোন করলাম ডিসি সাহেবকে। তিনি খুব অমায়িক ভদ্র মানুষ। বললেন, সকালে একসাথে নাশতা খান। যদি আমার বাড়িতে আসেন তাহলে খুব খুশি হব। জনাব মোহাম্মদ আলী ছিলেন তখন ফরিদপুরের ডিসি। ক’দিন পরই তিনি তোমার পিএস হয়েছিলেন। জনাব মোহাম্মদ আলীর আগে খুব সম্ভবত জনাব ফরাসউদ্দিন তোমার পিএস ছিলেন। লোক হিসেবে তিনি অসাধারণ। যেমন পণ্ডিত তেমনি ভালো মানুষ। এখনকার মতো হালকা নন। তখন যে পদে যার যতটুকু যোগ্যতা থাকা দরকার তার পুরোমাত্রাই ছিল। সকালে গোলাম মোহাম্মদ আলীর বাসায় নাশতা খেতে। মানুষটা দেখতে যেমন সুন্দর, ব্যবহারও ছিল অমায়িক। জিজ্ঞেস করলাম পিয়নের ধান নাজিরের নিয়ে যাওয়ার কথা। বললেন, হ্যাঁ, ব্যাপারটা শুনেছি। নাজির বলছিলেন, গরিব পিয়নটা অর্থাভাবে ধান কাটতে পারছেন না। তাই নাজির সরকারিভাবে ধান কেটে যতটা সম্ভব দিতে চেয়েছেন। তুমি এখন বোঝ। ডিসি আর নাজিরের কথায় পার্থক্য কোথায়? ডিসি সাহেবকে বললাম, এটা মোটেই ঠিক হচ্ছে না। সরকারি নীতিমালা অনুসারে সরকারি জায়গায় যে যা বুনবে সে ফসল সে ভোগ করবে। পিয়ন বুনেছেন পিয়নই ষোলো আনা পাবেন। জিজ্ঞেস করলাম, ‘সার্কিট হাউজের জায়গাটি কার?’ বললেন, ‘পূর্ত মন্ত্রণালয়ের। ডিসি তার জিম্মাদার।’ বললাম, ‘পিয়নের ধান পিয়নকে নিতে বলতে পারেন কি না।’ ভদ্রলোক বললেন, ‘আপনি বললে না করি কী করে। কিন্তু একবার বলে ফেলেছি। এখন অন্য রকম বললে সম্মান থাকে না।’ বললাম, ‘ঠিক আছে, পূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে যদি বলে।’ তিনি বললেন, ‘আমার দিক থেকে কোনো আপত্তি নেই। আর আমিও চাই পিয়নের ধান পিয়ন নিক।’ ‘ঠিক আছে।’ মাগুরার সোহরাব হোসেন তখন ছিলেন ত্রাণ পুনর্বাসন ও পূর্তমন্ত্রী। ডিসির বাড়ি থেকে ফোন করলাম। পেয়েও গেলাম সহজে। পূর্তমন্ত্রী সোহরাব হোসেন দেখতে খুবই কালো। মাগুরার সোহরাব হোসেন আর চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী দেখতে প্রায় একই রকম। গায়ের রঙ কালো হলেও মানুষ হিসেবে ছিলেন দিলখোলা। তাদের অন্তর ছিল ধবধবে সাদা। অমন পরিষ্কার হৃদয়ের মানুষ খুব একটা পাওয়া যায় না। স্বাধীনতার পর জাহাঙ্গীর স্মৃতি সেবাশ্রমের জন্য যখন যা চেয়েছি ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে দিয়েছেন। তালিকার কোনো জিনিস বাদ দেননি। এমনকি কখনো পরিমাণও কমাননি। কোনো একবার নাকি ডিজি রিলিফ কিছু কমিয়ে দিতে অনুরোধ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘কাদের সিদ্দিকীর লেখার ওপর কলম ধরব তা কী করে সম্ভব।’ কথাটা নিজে শুনিনি। ওটা আশপাশ থেকে শোনা। ’৭৩-এ সোহরাব হোসেনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হয়েছিল। তাকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দিতে নানা অভিযোগ আনা হয়েছিল। সেসব অভিযোগের ওপর ভিত্তি করে তুমি তিন সদস্যের এক তদন্ত কমিটি গঠন করেছিলে। কমিটির নেতা ছিলেন খাদ্যমন্ত্রী ফণী ভূষণ মজুমদার। যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মনি ভাই এবং আবদুর রাজ্জাক ভাই। আমি এসবের কিছুই জানতাম না। হঠাৎ একদিন ডাক পেয়ে তার বাসায় যাই। তিনি সব কিছু খুলে বলেন, ‘ভাই, স্বাধীনতা যুদ্ধে সব কিছু হারিয়েছি। এখন দুর্নীতির অভিযোগে মন্ত্রিত্ব গেলে বেঁচে থাকার কোনো অর্থ থাকে? কয়েকজন নেতা ষড়যন্ত্র করে আমাকে শেষ করতে চায়। ফণীদার বাড়িতে মিটিং হচ্ছে। কালকের মধ্যেই মন্ত্রিত্ব যাবে। তোমার যদি কিছু করার থাকে করতে পারো।’ সোহরাব ভাইয়ের বাড়ি থেকে ফণীদার বাড়ি গিয়েছিলাম। কেউ কোনো বাধা দিলো না। আর তখন কেউ কোনো বাধা দিতও না। ফণীদার ঘরে গিয়ে দেখি মনি ভাই আর রাজ্জাক ভাই কথা বলছেন। ফণীদা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী কাদের, তুমি এ সময়?’ বললাম, ‘সোহরাব ভাইয়ের বাড়ি গিয়েছিলাম তার নাকি মন্ত্রিত্ব যাচ্ছে।’ ফণীদা বললেন, ‘তাকে নিয়েই তো আলোচনা করছি।’ বললাম, ‘ভালো। দুর্নীতির অভিযোগে কাল সোহরাব ভাইয়ের মন্ত্রিত্ব গেলে পরশু দিন আরেকজনের যাবে, তারপর পুরো মন্ত্রিসভা নিয়েই টানাটানি হবে। সোহরাব ভাইয়ের গায়ের রঙ কালো হলেও ভেতরটা জ্বলজ্বলে উজ্জ্বল আলোকিত। একটু চিন্তাভাবনা করবেন।’ মনি ভাই ও রাজ্জাক ভাই আমাকে ভীষণ স্নেহ করতেন। মনি ভাই বললেন, ‘এই কাদের, তুই আবার এর মধ্যে জড়াতে গেলি কেন?’ বললাম, ‘জড়াতে যাইনি। সোহরাব ভাইয়ের সাথে বহু দিন ধরে জড়িয়েই আছি।’ রাজ্জাক ভাই উঠে এসে বললেন, ‘এই তুই কী করে সোহরাব ভাইয়ের প?ে’ বললাম, ‘আমি কোনো প-েবিপে না, সোহরাব ভাই ভালো মানুষ তাই বলতে এসেছিলাম।’ উঠে দাঁড়াতেই ফণীদা বললেন, ‘কাদের তুমি একটু নেতার কাছে যাও। এখানে যা বললে নেতাকেও তাই বলো গিয়ে। দেখো রাস্তা একটা বের হয়ে যাবে।’ আমার বাসার কাছেই গণভবনে তুমি থাকতে। সময়টা খেয়াল নেই। দেখেই বললে, ‘কী রে, কী মনে করে এসেছিস?’ বললাম, ‘সোহরাব ভাই ডেকে পাঠিয়েছিলেন। তার নাকি মন্ত্রিত্ব যায়। আমার চোখে সোহরাব ভাই খুবই ভালো মানুষ।’ তুমি বললে, ‘আরে ও দেখতে কালো হলে কী হবে ওর ভেতরটা বড় সাদা। কিছু মানুষ ওকে নিয়ে নানা কথা বলছে। তাই ফণীদাকে, মনি ও রাজ্জাককে তদন্ত করে রিপোর্ট দিতে বলেছি।’ বললাম, ‘মনি ভাই আর রাজ্জাক ভাই তো তার ঘোর বিরোধী।’ তুমি বলেছিলে, ‘আরে পাগল তা জানি।’ বলেছিলাম, ‘তা যদি জানো তদন্ত করতে দিলে কেন? কাল সোহরাব হোসেনের মন্ত্রিত্ব যাবে। পরশু আরেকজনের। তারপর তোমাকে ধরে টান দেবে।’ মাথায় হাত দিয়ে বলেছিলে, ‘আরে থাম, বুঝেছি।’ সাথে সাথে ফণীদা, শেখ ফজলুল হক মনি ও রাজ্জাক ভাইকে ডেকে পাঠিয়েছিলে। বলেছিলে, ‘আর তদন্ত-ফদন্ত করতে হবে না। লিখে দাও কোনো অভিযোগের ভিত্তি নেই।’ সোহরাব হোসেন কাহিনী সেখানেই শেষ। সেই সোহরাব ভাইকে ফরিদপুরের ডিসি মোহাম্মদ আলীর বাড়ি থেকে ফোন করে অনেক কষ্টে পেয়েছিলাম। সোহরাব ভাইকে সব খুলে বললে তিনি ডিসি মোহাম্মদ আলীকে তুনি সব ধান পিয়নকে দিয়ে দিতে বললেন। তোমাকেও ফোন করেছিলাম, সব কথা শুনে মোহাম্মদ আলীকে বলেছিলে, ‘কাদের সীমার বাইরে কথা বলে না। ওর কথা রা করার চেষ্টা করো।’ ফরিদপুর সার্কিট হাউজের পিয়ন কাহিনী ওখানেই শেষ। নাজিরের বাড়িতে নেয়া সব ধান ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন, যা ভারত-পাকিস্তান আমলে আর কখনো ঘটেনি। জেলার নাজিররাই সার্কিট হাউজের মালিক-মোক্তার। এনডিসি আর নাজির মিলে জেলা চালান। এনডিসি জুনিয়র অফিসার হন বলে অনেক েেত্র নাজিরদের এক দাঁতের বুদ্ধিও রাখেন না। নাজিররা খুব বুদ্ধিমান হন। তারা জানেন পানিতে বাস করে কুমিরের সাথে লড়াই করা কোনো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। তাই তারা অমন করেনও না। ফরিদপুরের নাজিরও করেননি। এখন ফরিদপুর সার্কিট হাউজ আঙিনা নতুন নতুন নানা ইমারতে ভরে গেছে। ২৫-৩০টির বেশি রুম হবে। বিএনপির মন্ত্রী, জমিদার পরিবারের সন্তান চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ নিশ্চয়ই সার্কিট হাউজ সম্প্রসারণে ভূমিকা রেখেছেন। পুরনো ভবনটি ভেঙে না ফেলায় বেশ ভালো লেগেছে। আর বিশেষ করে দু-তিন বছর পর ফরিদপুর গিয়ে সেই পুরনো ভবনে সিট পেয়ে খুব খুশি হয়েছিলাম। (চলবে)
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
৭
তুমি নাই প্রায় এক সপ্তাহ। কেমন যেন একেবারে খাঁচায় বন্দী। ছেলেবেলায় বাড়ি থেকে ছয়বার পালানো বাঁধনছাড়া মানুষ আমি। কিন্তু ওর আগে এক দিনও এভাবে কাটাইনি। ছেলেবেলায় বাড়ি থেকে পালালে বাবা ও বড় ভাইয়ের ভয়ে সতর্ক থাকতে হতো। কিন্তু তোমার মৃত্যুর পর পালিয়ে থাকা একেবারে অসহ্য। তাই বেরিয়ে পড়তে চেয়েছিলাম প্রতি মুহূর্তে। কিন্তু নানা কারণে হয়ে উঠছিল না। মাকে দেখার জন্য মন বড় ছটফট করছিল। তাই বেরিয়ে পড়ার মুহূর্তে; আজাদ-মুরাদকে নিয়ে মা এসেছিলেন। জীবনে কখনো মাকে দেখে অমন ব্যাকুল হয়ে কাঁদিনি। মাও কেঁদেছিলেন। কিন্তু তার চোখে পানি ছিল না। কিছুণ পর শান্ত হলে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলেছিলেন, ‘বজ্র, আর ঘরে থাকিস না। বঙ্গবন্ধুর খুনিরা তোকে পেলে মেরে ফেলবে। ঘর থেকে নিয়ে তোকে মেরে ফেললে আমি শান্তিতে কাঁদতেও পারব না। তুই রাস্তায় গিয়ে জাতির পিতার হত্যার প্রতিবাদ করে যদি মারাও যাস তখন আমি প্রাণভরে কাঁদতে পারব। বলতে পারব আমার বজ্র বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিবাদ করে জীবন দিয়েছে।’ হে পিতা, তোমাকে আজ কী বলি। আমার কোনো শ্রম, ঘাম কাজে এলো না। আমার মায়ের কষ্টের কোনো মূল্য হলো না। কেমন যেন সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেল। এখন নিমুরাদরা যা দাপাদাপি করছে তাতে সম্মানে বেঁচে থাকাই মুশকিল। গত ১৬ মে বোয়ালমারীতে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের একটি গণহত্যার স্মরণসভায় গিয়েছিলাম। সেই ঘটনাটা জানাতে বড় ইচ্ছে করছে তাই ওটা আগে বলে নিই। ১৫ মে ফরিদপুর সার্কিট হাউজে রাত যাপনের কথা তো বলেছি। পরদিন বোয়ালমারী যাওয়ার পথে রাজবাড়ী মোড়ে বিএনপির নেতা সাবেক মন্ত্রী কামাল ইবনে ইউসুফের এক ঘনিষ্ঠ কর্মী খন্দকার চান্দের বাড়িতে সকালের নাশতা করেছি। নাশতার চেয়ে তাদের
আন্তরিকতা ও আগ্রহ ছিল অনেক বেশি। কেন জানি না কোথাও গেলে লোকজন কম হয় না। আর খাওয়ার সময় তো এমনিতেই হিসাব থাকে না। আমরা ছিলাম ১২ জন। মনে হয় নাশতায় শরিক হয়েছিল তিন বারোং ছত্রিশ অথবা চার বারোং আটচল্লিশ জন। খন্দকার চান্দ বেশ হৃদয়বান মানুষ। যতœ করার জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিল। তার স্ত্রী নার্গিস খন্দকার মাচ্চর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। খুব ধীরস্থির শান্ত স্বভাবের মানুষ। নাশতা শেষে একটা চমৎকার গামছা উপহার দিয়ে আমার হৃদয় জয় করে ফেলেছে। গামছার বদলে লাখো কোটি টাকা দিলেও হয়তো অতটা আনন্দিত হতাম না। সেখান থেকে ৯টা কয়েক মিনিটে বোয়ালমারীর পথে রওনা হয়েছিলাম। মাঝে বেশ কয়েক জায়গায় মোটরসাইকেল আরোহীরা অপোয় ছিল। তাই বোয়ালমারী পৌঁছতে বেলা ১১টা বেজে গিয়েছিল। এখন সভা সমিতিতে যেতে মোটরসাইকেল এক মস্তবড় উপদ্রব। তোমার সময় এটা মোটেই ছিল না। স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে পুরো টাঙ্গাইল জেলায় মোট ১০-১২টা মোটরসাইকেল ছিল। ’৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি অস্ত্র জমা নেয়ার পথে তোমাকে নিয়ে যে মোটরসাইকেল শোভাযাত্রা করা হয়েছিল। যেখানে ৪০টা ভালো মোটরসাইকেল জোগাতে আমাদের ভীষণ পেরেশান হতে হয়েছিল। আজকাল বৃহত্তর ময়মনসিংহের অনেক জেলায় চার হাজার মোটরসাইকেল জোগাড় করতেও তেমন বেগ পেতে হবে না।
যাক আগের কথা আগে বলে নিই। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময় রাস্তাঘাট ছিল খুবই অনুন্নত। আগে আরিচা-শ্রীরামদি ঘাট বা দৌলতদিয়া পারাপার হতে সময় লাগত দুই-আড়াই ঘণ্টা। অন্য দিকে নগরবাড়ী-আরিচায় যেতে তিন-চার ঘণ্টা লেগে যেত। ’৭২ সালের এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহে প্রায় ১০০ সহযাত্রী নিয়ে কলকাতা সফর থেকে প্রথম ফরিদপুর সার্কিট হাউজে এসেছিলাম। খুবই পুরনো ফরিদপুর সার্কিট হাউজ। ১০০ বছরের বেশি হবে বয়স। ফরিদপুর সার্কিট হাউজের মতো হাতেগোনা আর মাত্র কয়েকটা। আশপাশের ঘরগুলোর উচ্চতা কম হলেও মাঝের দু’টি রুমের ছাদের উচ্চতা ২০ ফুট। গত বছর আজমীরে গিয়ে মারোয়ারা প্যালেসে ছিলাম। তারও ফোর থেকে ছাদের উচ্চতা ২০ ফুট। ৫০০ থেকে সাড়ে ৬০০ স্কয়ার ফুটের বিশাল রুম। ফরিদপুর সার্কিট হাউজের রুম কিছুটা ছোট ১৮ বাই ১৮। আগে ছিল ছয়-সাত একর ফাঁকা জায়গার মধ্যে সার্কিট হাউজ। এখন দালানকোঠা করে ভরে ফেলা হয়েছে। ’৭২ সালের পরে বেশ কয়েকবার ফরিদপুর সার্কিট হাউজে রাত কাটিয়েছি। ’৭৩ বা ’৭৪ সালের ঘটনা। একদিন সার্কিট হাউজে গিয়ে দেখি রীবাহিনী ক্যাম্প করেছে। রীবাহিনী গঠনে কাদেরিয়া বাহিনীর বিশাল ভূমিকা ছিল। প্রায় ৯ থেকে সাড়ে ৯ হাজার কাদেরিয়া বাহিনীর সদস্য ছিল রীবাহিনীতে। আমি গেছি শুনে রীবাহিনীর পরিচালক সরোয়ার মোল্লা খুব আগ্রহ নিয়ে ছুটে এলেন। অনেক গল্পগুজব হলো। কেন এসেছেন জিজ্ঞেস করতেই বললেন, ‘আর বলবেন না, বড় বিপদে আছি। শেষ পর্যন্ত জেল খাটতে হয় কিনা আল্লাহ মাবুদ জানেন।’ জেল খাটবেন কেন? ‘আর বলবেন না। শহীদ সাহেবের আর আমার সিকিউরিটি তর্কাতর্কি করে বক্সিং প্র্যাকটিস করতে গিয়ে একজন মারা গেছে।’ বললাম, ‘চিন্তা করবেন না। ভালোভাবে তদন্ত করুন, প্রয়োজন হলে আমাকে বলবেন।’ ঢাকায় এসে আনোয়ারুল আলম শহীদের কাছে সব শুনে খবর দিলাম মূল বীর কাদেরিয়া বাহিনীর সদস্য ঘাটাইলের দুর্মুজ খাঁকে। পাঠক যারা ‘স্বাধীনতা ৭১’ পড়েছেন তারা অবশ্যই দুর্মুজ খাঁকে চিনতে পারবেন। মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে তার কমান্ডার বেনু ব্যক্তিগত শত্র“ মেরেছিল। সে জন্য তার মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল। যুদ্ধ শেষে নিহতের আত্মীয়স্বজন মা করে দেয়ায় সে বেঁচে যায়। তার স্থান হয় রীবাহিনীতে। সে সব সময়ই ভীষণ সাহসী আনমনা স্বভাবের ছিল। রীবাহিনী গঠনের সময় থেকেই সে আনোয়ারুল আলম শহীদের নিরাপত্তা রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করত। মহাপরিচালক, পরিচালক, লিডার, ডেপুটি লিডার ও অন্যান্য পদবির কর্মকর্তা নিয়ে রীবাহিনী গঠিত হয়। মহাপরিচালক ছিলেন কর্নেল নুরুজ্জামান। পরিচালক ছিলেন তিনজনÑ আনোয়ারুল আলম শহীদ, মোল্লা গোলাম সরোয়ার ও মেজর হাসান। কবে কোন সময় আনোয়ারুল আলম শহীদ আর মোল্লা গোলাম সরোয়ার দু’জন ফরিদপুর গিয়েছিল অথবা কোনোভাবে একত্র হয়েছিল। সেখানে দুই পরিচালকের দুই দেহরীর মধ্যে তর্কবিতর্ক বাধে। গোলাম সরোয়ারের রী দুর্মুজ খাঁকে বলে, ‘তোরা কোনো যুদ্ধই করিসনি, শুধু শুধু ফুটানি করিস।’ দুর্মুজ খাঁ রেগে গিয়ে জবাব দেয়, ‘আমরা যত যুদ্ধ করেছি তোরা তত যুদ্ধের নামও শুনিসনি।’ নানা তর্কবিতর্কের মাঝে হঠাৎ কী করে কথা হয় ঠিক আছে তুই আমারে এক বক্সিং দে, আমি তোরে আরেক বক্সিং দেই। দেখা যাক কার কত জোর। তবে একা নয়, দুই ডাইরেক্টরের সামনে দু’জন দু’জনকে বক্সিং দেবে। দিন-তারিখ ঠিক করে তারা সার্কিট হাউজের সামনে এক বিকেলে বক্সিং যুদ্ধ অনুষ্ঠিত করে। সেও এক অভাবনীয় ব্যাপার। দুর্মুজ খাঁ বলে, সরোয়ার মোল্লার সিকিউরিটিকে তুই আগে মার, সে বলে না তুই আগে মার। দুর্মুজ খাঁ গর্ব করে বলে আমি মারলে তুই আর মারার সুযোগ পাবি না। কিন্তু সে কিছুতেই রাজি হয় না। দু’জন অনেক তর্কবিতর্ক করে। পরিচালকেরা এতে ধৈর্য হারিয়ে ফেলে। শেষ মুহূর্তে দুর্মুজ খাঁ গোলাম সরোয়ার মোল্লার দেহরীকে আঘাত করে। বুকের ওপর এমন জোরে ঘুষি মারে সে টাল সামলাতে না পেরে পড়ে যায়, আর উঠতে পারে না। হাসপাতালে নিতে নিতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। এ নিয়ে তারা খুব ঝামেলায় পড়ে। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তারা মুক্তি পায়। সেখানকার আরেকটি ঘটনা। তখন দেশে খুব খাদ্য ঘাটতি চলছে। নানা দেশ থেকে আমদানি করা খাদ্য আমেরিকার কারসাজিতে আমাদের বন্দরে না ভিড়ে অন্যত্র ভিড়ছে। চিটাগাংয়ের কাছাকাছি আসা খাদ্য বোঝাই জাহাজগুলোকে অন্য বন্দরে পাঠিয়ে দিয়ে একটা অহেতুক খাদ্যসঙ্কট সৃষ্টি করা হয়েছিল। যেখানে চালের দাম ছিল বারো আনা থেকে এক টাকা সের। সেই চালের দাম উঠেছিল আড়াই-তিন টাকায়। চার দিকে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। তাই ’৭৪-এর শেষে দেশবাসীর কাছে আহ্বান করেছিলে, এক ইঞ্চিও জমি পতিত যাতে না থাকে। সরকারি জমি যে আবাদ করবে ফসল সে পাবে। আরিচা ফেরির কারণে মাঝে মধ্যেই ফরিদপুর সার্কিট হাউজে থাকতাম। ফরিদপুর সার্কিট হাউজে এক বুড়ো পিয়ন ছিলেন। সার্কিট হাউজের পিয়নেরা সাধারণত যেমন হন তেমন ছিলেন। সরকারি অতিথিশালায় বড় বড় যারা ওঠেন, তারা তেমন মাটির দিকে তাকিয়ে চলেন না। এটা প্রায় সর্বেেত্রই একই রকম। ‘নিজের ধন পরকে দিয়ে দৈবগ্য মরে কেথা বয়ে’ আমার অবস্থাও সেই রকম। অনেক কাজই সরল বিশ্বাসে করেছি। কোনো ভূতভবিষ্যৎ চিন্তা করিনি। ’৬২-’৬৫ পর্যন্ত বাড়ি থেকে ছয়বার পালিয়েছি। বাড়ি পালানোর সময়গুলো বড় অনাদর, বড় কষ্টে কেটেছে। তাই গরিব মানুষ দেখলেই মায়া হতো। এখনো যেমনটা হয়। সার্কিট হাউজের পিয়নের ছেলে নাকি লেখাপড়া করত। বইয়ের টাকা, এসএসসি পরীার টাকা, আইএ পরীার টাকা বছর তিনেকে পাঁচ-ছয় হাজার নিয়েছে। এখন পাঁচ-ছয় হাজার টাকার তেমন মূল্য নেই। কিন্তু ’৭২-’৭৫ সালে পাঁচ-ছয় হাজার টাকা ছিল অনেক টাকা। তখন সোনার দাম ছিল দেড়-দুই শ’ টাকা ভরি। ফরিদপুর শহরের আশপাশে এক পাখি জমির দাম হয়তো হতো হাজার টাকা, যা এখন হয়তো কোটি টাকা হবে। যাক ওগুলো। ওগুলো আমার উদ্দেশ্য নয়। আমার উদ্দেশ্য ফরিদপুর সার্কিট হাউজের পিয়নের সার্কিট হাউজ আঙিনায় ধান চাষ। ওই ধান লাগানোর জন্যও টাকা দিয়েছিলাম। মাঝে একবার দেখেছি ধানগাছ বেশ বড় বড় হয়েছে। তারও মাস দেড়েক পর কোনো এক সভায় কুষ্টিয়া অথবা চুয়াডাঙ্গা গিয়েছিলাম। ফেরার পথে রাতে ফরিদপুর সার্কিট হাউজে উঠি। গাড়ি থেকে নামতেই সেই পিয়ন পায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়েন। বাপের বয়সের মানুষ বড় বিব্রতবোধ করছিলাম। টেনে তুলে জিজ্ঞেস করতেই সন্তানহারা পিতার মতো কাঁদতে কাঁদতে আকুল হয়ে বলল, ‘আপনার টাকায় ধান বুনেছিলাম। সব ধান পেকেছে। একদিন ২৫-৩০ মণ কেটে বাড়িতেও নিয়েছি। এখন নাজির সাহেব বলছেন, আমি ধান নিতে পারব না। তিনি নিবেন। ধান মাড়ানো হলে সেখান থেকে অর্ধেক দেবেন। আমি এত কষ্ট করে ধান ফলালাম এখন নাজির সাহেব নিয়ে যাবে কোনো বিচার পাব না। আপনি একটা কিছু করেন।’ সে যে কী কান্না! না দেখলে কেউ বুঝতে পারবে না। রাতেই নাজিরকে ডাকলাম। সব নাজিররা যেমন হয় তিনিও তেমন ছিলেন। একজন নাজির সারা জীবন একই জায়গায় থাকেন। চাকরিটা ছোট হলেও মতা অনেক। অনেক ডিসিই জানেন না তার জেলায় কোথায় কী আছে কী নেই। কিন্তু নাজিরের সব নখদর্পণে। ডিসিরা চাইলে নাজিররা পারেন না এমন কোনো কাজ নেই। বলতে গেলে সিন্দুরে পোকার কলিজা অথবা বাতাসের ডগা এনে দিতে পারেন। নাজিরের চাকরি করতে হলে সবার আগে ‘জি হুজুর’, মানে পো ধরা শিখতে হয়। গরিব পিয়ন ধান বুনেছেন সেটা নিতে গেছেন কেন জিজ্ঞেস করলে বিনয়ের অবতার সেজে জবাব দিলেন ডিসি সাহেব বলেছেন, গরিব মানুষ ওর ধান তুলতে অসুবিধা হবে তাই সরকারিভাবে উঠিয়ে ওকে যেন অর্ধেক দিয়ে দেই। আমার এখানে কী করার আছে? সব ডিসি স্যারের হুকুম। পরদিন সকালেই চলে আসতে চেয়েছিলাম। বিষয়টা বোঝার জন্য একটু দেরি করে রওনা হব বলে ঠিক করলাম। ফোন করলাম ডিসি সাহেবকে। তিনি খুব অমায়িক ভদ্র মানুষ। বললেন, সকালে একসাথে নাশতা খান। যদি আমার বাড়িতে আসেন তাহলে খুব খুশি হব। জনাব মোহাম্মদ আলী ছিলেন তখন ফরিদপুরের ডিসি। ক’দিন পরই তিনি তোমার পিএস হয়েছিলেন। জনাব মোহাম্মদ আলীর আগে খুব সম্ভবত জনাব ফরাসউদ্দিন তোমার পিএস ছিলেন। লোক হিসেবে তিনি অসাধারণ। যেমন পণ্ডিত তেমনি ভালো মানুষ। এখনকার মতো হালকা নন। তখন যে পদে যার যতটুকু যোগ্যতা থাকা দরকার তার পুরোমাত্রাই ছিল। সকালে গোলাম মোহাম্মদ আলীর বাসায় নাশতা খেতে। মানুষটা দেখতে যেমন সুন্দর, ব্যবহারও ছিল অমায়িক। জিজ্ঞেস করলাম পিয়নের ধান নাজিরের নিয়ে যাওয়ার কথা। বললেন, হ্যাঁ, ব্যাপারটা শুনেছি। নাজির বলছিলেন, গরিব পিয়নটা অর্থাভাবে ধান কাটতে পারছেন না। তাই নাজির সরকারিভাবে ধান কেটে যতটা সম্ভব দিতে চেয়েছেন। তুমি এখন বোঝ। ডিসি আর নাজিরের কথায় পার্থক্য কোথায়? ডিসি সাহেবকে বললাম, এটা মোটেই ঠিক হচ্ছে না। সরকারি নীতিমালা অনুসারে সরকারি জায়গায় যে যা বুনবে সে ফসল সে ভোগ করবে। পিয়ন বুনেছেন পিয়নই ষোলো আনা পাবেন। জিজ্ঞেস করলাম, ‘সার্কিট হাউজের জায়গাটি কার?’ বললেন, ‘পূর্ত মন্ত্রণালয়ের। ডিসি তার জিম্মাদার।’ বললাম, ‘পিয়নের ধান পিয়নকে নিতে বলতে পারেন কি না।’ ভদ্রলোক বললেন, ‘আপনি বললে না করি কী করে। কিন্তু একবার বলে ফেলেছি। এখন অন্য রকম বললে সম্মান থাকে না।’ বললাম, ‘ঠিক আছে, পূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে যদি বলে।’ তিনি বললেন, ‘আমার দিক থেকে কোনো আপত্তি নেই। আর আমিও চাই পিয়নের ধান পিয়ন নিক।’ ‘ঠিক আছে।’ মাগুরার সোহরাব হোসেন তখন ছিলেন ত্রাণ পুনর্বাসন ও পূর্তমন্ত্রী। ডিসির বাড়ি থেকে ফোন করলাম। পেয়েও গেলাম সহজে। পূর্তমন্ত্রী সোহরাব হোসেন দেখতে খুবই কালো। মাগুরার সোহরাব হোসেন আর চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী দেখতে প্রায় একই রকম। গায়ের রঙ কালো হলেও মানুষ হিসেবে ছিলেন দিলখোলা। তাদের অন্তর ছিল ধবধবে সাদা। অমন পরিষ্কার হৃদয়ের মানুষ খুব একটা পাওয়া যায় না। স্বাধীনতার পর জাহাঙ্গীর স্মৃতি সেবাশ্রমের জন্য যখন যা চেয়েছি ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে দিয়েছেন। তালিকার কোনো জিনিস বাদ দেননি। এমনকি কখনো পরিমাণও কমাননি। কোনো একবার নাকি ডিজি রিলিফ কিছু কমিয়ে দিতে অনুরোধ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘কাদের সিদ্দিকীর লেখার ওপর কলম ধরব তা কী করে সম্ভব।’ কথাটা নিজে শুনিনি। ওটা আশপাশ থেকে শোনা। ’৭৩-এ সোহরাব হোসেনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হয়েছিল। তাকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দিতে নানা অভিযোগ আনা হয়েছিল। সেসব অভিযোগের ওপর ভিত্তি করে তুমি তিন সদস্যের এক তদন্ত কমিটি গঠন করেছিলে। কমিটির নেতা ছিলেন খাদ্যমন্ত্রী ফণী ভূষণ মজুমদার। যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মনি ভাই এবং আবদুর রাজ্জাক ভাই। আমি এসবের কিছুই জানতাম না। হঠাৎ একদিন ডাক পেয়ে তার বাসায় যাই। তিনি সব কিছু খুলে বলেন, ‘ভাই, স্বাধীনতা যুদ্ধে সব কিছু হারিয়েছি। এখন দুর্নীতির অভিযোগে মন্ত্রিত্ব গেলে বেঁচে থাকার কোনো অর্থ থাকে? কয়েকজন নেতা ষড়যন্ত্র করে আমাকে শেষ করতে চায়। ফণীদার বাড়িতে মিটিং হচ্ছে। কালকের মধ্যেই মন্ত্রিত্ব যাবে। তোমার যদি কিছু করার থাকে করতে পারো।’ সোহরাব ভাইয়ের বাড়ি থেকে ফণীদার বাড়ি গিয়েছিলাম। কেউ কোনো বাধা দিলো না। আর তখন কেউ কোনো বাধা দিতও না। ফণীদার ঘরে গিয়ে দেখি মনি ভাই আর রাজ্জাক ভাই কথা বলছেন। ফণীদা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী কাদের, তুমি এ সময়?’ বললাম, ‘সোহরাব ভাইয়ের বাড়ি গিয়েছিলাম তার নাকি মন্ত্রিত্ব যাচ্ছে।’ ফণীদা বললেন, ‘তাকে নিয়েই তো আলোচনা করছি।’ বললাম, ‘ভালো। দুর্নীতির অভিযোগে কাল সোহরাব ভাইয়ের মন্ত্রিত্ব গেলে পরশু দিন আরেকজনের যাবে, তারপর পুরো মন্ত্রিসভা নিয়েই টানাটানি হবে। সোহরাব ভাইয়ের গায়ের রঙ কালো হলেও ভেতরটা জ্বলজ্বলে উজ্জ্বল আলোকিত। একটু চিন্তাভাবনা করবেন।’ মনি ভাই ও রাজ্জাক ভাই আমাকে ভীষণ স্নেহ করতেন। মনি ভাই বললেন, ‘এই কাদের, তুই আবার এর মধ্যে জড়াতে গেলি কেন?’ বললাম, ‘জড়াতে যাইনি। সোহরাব ভাইয়ের সাথে বহু দিন ধরে জড়িয়েই আছি।’ রাজ্জাক ভাই উঠে এসে বললেন, ‘এই তুই কী করে সোহরাব ভাইয়ের প?ে’ বললাম, ‘আমি কোনো প-েবিপে না, সোহরাব ভাই ভালো মানুষ তাই বলতে এসেছিলাম।’ উঠে দাঁড়াতেই ফণীদা বললেন, ‘কাদের তুমি একটু নেতার কাছে যাও। এখানে যা বললে নেতাকেও তাই বলো গিয়ে। দেখো রাস্তা একটা বের হয়ে যাবে।’ আমার বাসার কাছেই গণভবনে তুমি থাকতে। সময়টা খেয়াল নেই। দেখেই বললে, ‘কী রে, কী মনে করে এসেছিস?’ বললাম, ‘সোহরাব ভাই ডেকে পাঠিয়েছিলেন। তার নাকি মন্ত্রিত্ব যায়। আমার চোখে সোহরাব ভাই খুবই ভালো মানুষ।’ তুমি বললে, ‘আরে ও দেখতে কালো হলে কী হবে ওর ভেতরটা বড় সাদা। কিছু মানুষ ওকে নিয়ে নানা কথা বলছে। তাই ফণীদাকে, মনি ও রাজ্জাককে তদন্ত করে রিপোর্ট দিতে বলেছি।’ বললাম, ‘মনি ভাই আর রাজ্জাক ভাই তো তার ঘোর বিরোধী।’ তুমি বলেছিলে, ‘আরে পাগল তা জানি।’ বলেছিলাম, ‘তা যদি জানো তদন্ত করতে দিলে কেন? কাল সোহরাব হোসেনের মন্ত্রিত্ব যাবে। পরশু আরেকজনের। তারপর তোমাকে ধরে টান দেবে।’ মাথায় হাত দিয়ে বলেছিলে, ‘আরে থাম, বুঝেছি।’ সাথে সাথে ফণীদা, শেখ ফজলুল হক মনি ও রাজ্জাক ভাইকে ডেকে পাঠিয়েছিলে। বলেছিলে, ‘আর তদন্ত-ফদন্ত করতে হবে না। লিখে দাও কোনো অভিযোগের ভিত্তি নেই।’ সোহরাব হোসেন কাহিনী সেখানেই শেষ। সেই সোহরাব ভাইকে ফরিদপুরের ডিসি মোহাম্মদ আলীর বাড়ি থেকে ফোন করে অনেক কষ্টে পেয়েছিলাম। সোহরাব ভাইকে সব খুলে বললে তিনি ডিসি মোহাম্মদ আলীকে তুনি সব ধান পিয়নকে দিয়ে দিতে বললেন। তোমাকেও ফোন করেছিলাম, সব কথা শুনে মোহাম্মদ আলীকে বলেছিলে, ‘কাদের সীমার বাইরে কথা বলে না। ওর কথা রা করার চেষ্টা করো।’ ফরিদপুর সার্কিট হাউজের পিয়ন কাহিনী ওখানেই শেষ। নাজিরের বাড়িতে নেয়া সব ধান ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন, যা ভারত-পাকিস্তান আমলে আর কখনো ঘটেনি। জেলার নাজিররাই সার্কিট হাউজের মালিক-মোক্তার। এনডিসি আর নাজির মিলে জেলা চালান। এনডিসি জুনিয়র অফিসার হন বলে অনেক েেত্র নাজিরদের এক দাঁতের বুদ্ধিও রাখেন না। নাজিররা খুব বুদ্ধিমান হন। তারা জানেন পানিতে বাস করে কুমিরের সাথে লড়াই করা কোনো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। তাই তারা অমন করেনও না। ফরিদপুরের নাজিরও করেননি। এখন ফরিদপুর সার্কিট হাউজ আঙিনা নতুন নতুন নানা ইমারতে ভরে গেছে। ২৫-৩০টির বেশি রুম হবে। বিএনপির মন্ত্রী, জমিদার পরিবারের সন্তান চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ নিশ্চয়ই সার্কিট হাউজ সম্প্রসারণে ভূমিকা রেখেছেন। পুরনো ভবনটি ভেঙে না ফেলায় বেশ ভালো লেগেছে। আর বিশেষ করে দু-তিন বছর পর ফরিদপুর গিয়ে সেই পুরনো ভবনে সিট পেয়ে খুব খুশি হয়েছিলাম। (চলবে)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন