শনিবার, ২৬ মে, ২০১২

জাতীয় কবি নজরুলকে সুপরিকল্পিতভাবে অবহেলা করা হচ্ছে


আসিফ আরসালান

এতোদিন পর্যন্ত লিখেছি সরকারের অপশাসন এবং কুশাসনের খবর ও তথ্য পাঠক ভাইদের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য। আজ এই লেখাটি লিখতে চেয়েছিলাম প্রধানত বিরোধী দল অর্থাৎ বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের নেতৃবৃন্দের উদ্দেশে। ইদানীং সংলাপ বা আলোচনার জন্য প্রধান বিরোধী দলের বাইরে থাকা নেতৃবৃন্দ এমন ব্যাকুলতা প্রকাশ করছেন যে সেটি তাদের আন্তরিক সমর্থকদের কাছেও রীতিমত বিব্রতকর ঠেকছে। অথচ শাসক দল আওয়ামী লীগ বিরোধী দলের সংলাপের এই আন্তরিকতা বা আকুলতাকে রীতিমত পরিহাস করছে। প্রধান বিরোধী দলের যারা সাধারণ সমর্থক তারা মনে করছেন যে দমন নীতি দেখে তারা ভয় পেয়েছেন। এই বিষয়টি নিয়ে আরো কথা বলতে চেয়েছিলাম। এর মধ্যে টিভিতে একটি খবর দেখলাম। ফলে টপিক বদলে ফেললাম।
গত ২৪ তারিখে উদ্বোধন করা নতুন টিভি চ্যানেলটির নিউজ দেখছিলাম পরদিন ২৫ মে সন্ধ্যা ৭টা ৩০ মিনিটে। ২৫ মে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১১৩ তম জন্ম জয়ন্তী এবং তাঁর ‘বিদ্রোহী' কবিতার ৯০তম বার্ষিকী। সোজা কথায় ৯০ বছর আগে কবি নজরুল ইসলাম বিদ্রোহী কবিতাটি রচনা করেন। নজরুল ইসলাম তো আমাদের জাতীয় কবি। সেই কবিকে জাতি কি ভাবে স্মরণ করছে এবং কবির কবিতা এবং সঙ্গীত ও রচনা সমগ্র জাতির মাঝে কি ভাবে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে সে ব্যাপারে অতি ক্ষুদ্র একটি রিপোর্ট সম্প্রচার করেছে নব উদ্বোধিত এই চ্যানেলটি। এব্যাপারে অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের সাক্ষাৎকার নিয়েছে ঐ টিভি চ্যানেলটি। সেই সাক্ষাৎকারে তিনি এমন একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করলেন যেটি শুনে আমি শুধুমাত্র হতভম্বই হইনি, রীতিমত আক্কেল গুড়ুম। সেই কথাগুলি আপনাদেরকে জানিয়ে দেয়ার জন্য এই গৌরচন্দ্রিকার অবতারণা। অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বললেন যে স্কুলের পাঠ্য পুস্তকে নজরুল ইসলাম নাই। কলেজের পাঠ্য পুস্তকেও নজরুল নাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স শ্রেণীতে মোট ২২০০ মার্কের মধ্যে নজরুলের ওপর মার্ক মাত্র ১৬। প্রিয় পাঠক, কথাটি আমার এখনো বিশ্বাস হতে চাচ্ছে না। এটি কি ভাবে সম্ভব? আমি অনেক বছর আগে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়েছি। তখন অনার্স ছিল ৩ বছরের কোর্স। এখন অনার্স ৪ বছর এবং এম এ ১ বছরের কোর্স। নতুন বিন্যাসে টোটাল মার্কস কত সেটি আমার জানা নাই। বিষয়টি জেনে নেয়ার জন্য দু'এক জায়গায় চেষ্টা  করলাম। তারপরেও বিষয়টি আমার কাছে স্পষ্ট হয়নি। তারপরেও বলছি, জাতীয় কবির ওপর মাত্র ১৬ মার্ক- এটি কি ভাবে হতে পারে? কিন্তু যেহেতু অধ্যাপক রফিকুল ইসলামকে নজরুলের ওপর একজন অথরিটি হিসাবে বিবেচনা করা হয় তাই অন্তত এই ১৬ মার্কের ব্যাপারটি সত্য বলেই মনে হয়।
 এরপর টেলিভিশনের ক্যামেরাটি ঘুরেফিরে জুম করল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি জায়গায় যেখানে ছাত্রছাত্রীরা এক সাথে জটলা পাকিয়ে আড্ডা মারছে। একজন ছাত্রকে টেলিভিশনের রিপোর্টার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘আচ্ছা ভাই তুমি নজরুলের ৫টি কবিতার নাম বল।’’ ছেলেটি বহুত কসরৎ করে হাতে গুনে মাত্র ৩টি কবিতার নাম বলতে পারল। তারপর ক্যামেরা এসে স্থির হলো একজন চটপটে ছাত্রীর ওপর। তাকেও করা হলো একই প্রশ্ন। এই স্মার্ট ছাত্রীটি প্রথমে মাত্র ১টি কবিতার নাম বলতে পারল। সেটি হলো ‘বিদ্রোহী'। তার পুরুষ বন্ধু তাকে বলে দিলো আরেকটি নাম। সেটি হলো ‘সাম্যবাদ'। বিদ্রোহী নামটি সে কেমন করে মনে রাখলো, জিজ্ঞাসা করলে ছাত্রীটি উত্তর দিলো,‘‘রাতে বাসায় টেলিভিশনে শুনলাম, আগামী কাল (শুক্রবার) নাকি বিদ্রোহী কবিতা রচনার ৯০ তম বছর। তাই বুঝতে পারলাম যে বিদ্রোহী বলে কাজী নজরুল ইসলামের একটি কবিতা আছে।’’ যদিও সংক্ষিপ্ত রিপোর্ট, তবুও সেই রিপোর্টে বলা হলো যে সরকারী টেলিভিশনে নেহায়েত ব্যালান্স করার জন্য কিছু কিছু নজরুল সংগীতের অনুষ্ঠান করা হয়। কিন্তু প্রাইভেট চ্যানেলগুলোতে কালে-ভদ্রে নজরুলকে স্মরণ করা হয়।
একজন গানের সিডি বিক্রেতা জানালেন, তার দোকানের শত শত সিডির মধ্যে নজরুল সংগীতের সিডি দিনে ২টিও বিক্রি হয় কিনা সন্দেহ। কেন বিক্রি হয় না তার উত্তরে তিনি জানালেন, নজরুলের গান তো আর শোনা যায় না, তাই পাবলিকের সে ব্যাপারে কোরো ইন্টারেস্ট নাই।
এই ছিলো নব উদ্বোধিত ঐ টেলিভিশন চ্যানেলের রিপোর্টের বিষয়বস্তু। বাস্তব অবস্থা মনে হয় এর চেয়েও খারাপ। সেই যে আদ্যি কালে নজরুল শিল্পী  ফিরোজা বেগমের নাম শুনেছিলাম তারপর তো বাংলাদেশে নজরুল সংগীতের ওপর তেমন কালজয়ী শিল্পীর আর সাক্ষাৎ মেলেনি। রুনা লায়লা বা সাবিনা ইয়াসমিন আধুনিক গান গেয়ে যে উচ্চতায় উঠেছেন, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা বা পাপিয়া সারওয়ার রবীন্দ্র সংগীতে যে হাইটে উঠেছেন ফিরোজা বেগমের পর নজরুল সংগীত গেয়ে আর কেউ কি সেই হাইটে উঠেছেন? তবুও জেনে খুশি হলাম যে পশ্চিম বঙ্গের মুখ্য মন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী ফিরোজা বেগমকে কলকাতায় আনুষ্ঠানিকভাবে নজরুল পদক দেবেন। বাংলাদেশে নজরুল সংগীতে এখন একটি আলোচিত নাম ফেরদৌস আরা। কিন্তু তাকেও তো এখন আধুনিক গানের সম্ভার নিয়ে প্রায়শই টেলিভিশনের পর্দায় হাজির হতে দেখা যাচ্ছে। কেন আজ নজরুল সংগীত তথা সামগ্রিক ভাবে নজরুল সাহিত্যের এমন দৈন্য দশা?
\দুই\
এই প্রশ্নের উত্তর বলিষ্ঠভাবে দিয়েছেন সাবেক সচিব আসাফ উদ্দৌলা। গত শুক্রবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে অনুষ্ঠিত নজরুল জয়ন্তীর এক আলোচনা সভায় তিনি যে বক্তব্য রাখেন সেটি ‘দৈনিক সংগ্রাম'সহ ঢাকার দু'টি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ‘দৈনিক সংগ্রামের' রিপোর্ট মোতাবেক জনাব আসাফ উদ্দৌলা বলেন, সরকারের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে জাতীয় কবি নজরুলকে ভুলতে বসেছে নতুন প্রজন্ম। বিজাতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের কারণে আজ হারিয়ে যাচ্ছেন নজরুল। তাঁর মতে বিদ্রোহী কবিকে বাঁচিয়ে রাখতে প্রতিটি পরিবারে নজরুল চর্চা বাড়াতে হবে। বছরে ২ দিন অনুষ্ঠান করে নজরুলকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা যাবে না। তিনি অভিযোগ করেন যে সরকার নজরুলকে নিয়ে তামাশা করছেন। বছরে মাত্র ২ দিন তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্মরণ করা হয়। ফুল দিয়ে তাকে ‘পূজা' করা হয়। তিনি বলেন, জাতীয় কবিকে পূজা নয়, হৃদয়ে স্থান দিতে চাই। সরকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে দুই বাংলায় অনুষ্ঠান করে। তিনি বলেন, প্রাথমিক স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পাঠ্য বইয়ে তাঁর কোনো স্থান নাই। তিনি বৈষম্যের শিকার। জনাব আসাফ উদ্দৌলা অভিযোগ করেন যে এক শ্রেণীর মুসলিম নামধারী হিন্দু নজরুলকে জাতীয় কবি হিসাবে মানতে নারাজ। কবির ১২৫ টি নাটক থাকা সত্ত্বেও নাট্যাঙ্গনে তারা নজরুলকে খুঁজে পায় না। তিনি আরো বলেন, রবীন্দ্রনাথ মুসলমানদের জন্য কোনো কবিতা লেখেননি। অথচ নজরুল হিন্দু ধর্ম নিয়ে যেমন লিখেছেন, তেমনি ইসলাম ধর্ম নিয়েও লিখেছেন। তার মতে বিদেশী কবির কবিতা জাতীয় সংগীত হিসাবে নির্বাচন কারা দুঃখজনক। বিদেশী সংস্কৃতির আগ্রাসনের শিকার হয়ে নজরুল হারিয়ে গেছেন। অধ্যাপক ড. এস এম লুৎফর রহমান বলেন, নজরুল আজ নানাবিধ ষড়যন্ত্রের শিকার। আমাদের অবস্থা আজ সিকিমের মতো। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে হলে নজরুল চর্চা বাড়াতে হবে।
গত শনিবার আরেকটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত রিপোর্ট মোতাবেক জনাব আসাফ উদ্দৌলা বলেন, আমরা নজরুলকে উপেক্ষা করি। তাঁকে বড় করে দেখি না। পাশের দেশের কবিকে বড় করে দেখার একটি প্রবণতা আমাদের রয়েছে। পাশের বাড়ির সোনার খনি দেখে তো আমার আনন্দিত হওয়ার কিছু নাই। আমাদের কবিকে আমাদেরই মর্যাদা দিতে হবে। রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা রবীন্দ্রনাথকে ভালবাসতে পারি, কিন্তু পূজা করতে পারি না। গত দেড় বছর ধরে আমরা দেখলাম, রবীন্দ্রনাথকে পূজা করা হচ্ছে বাংলাদেশে। তার সার্ধ শত বার্ষিকী পালন করা হচ্ছে ১ বছর ধরে। আজ নজরুলের জন্মবার্ষিকী পালন করা হচ্ছে ১ দিন কি ২ দিনের অনুষ্ঠানে। রবীন্দ্রনাথকে ১ বছর ধরে পালন, আর নজরুলকে এক দু'দিনের জন্য পালন। মানুষ বোঝে, নজরুলের ক্ষেত্রে কোনো আন্তরিকতা নাই। শুধুমাত্র দায়সারাভাবে তার জন্মবার্ষিকী পালন করা হচ্ছে। মানুষকে বোকা ভাবার কোনো কারণ নাই। তারা সবই বুঝতে পারছেন। তিনি আরো বলেন, রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলের গান নিয়ে একটি কাস্ট বা শ্রেণী সিস্টেম প্রবর্তন করা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের গানকে বলা হচ্ছে রবীন্দ্র সংগীত। আর নজরুলের গানকে বলা হচ্ছে নজরুলগীতি। তাঁর মতে রবীন্দ্রনাথের গানকে পুরুষ মানুষের গান মনে হয় না। এতো নরম, এতো সংগোপন। কিন্তু নজরুলের গানে, নজরুলের কবিতায় পৌরুষ রয়েছে, যা আর কোনো কবির গানে পাওয়া যায় না।
বিশ্ব সাহিত্য পর্যালোচনা করে তিনি বলেন, আমেরিকা এবং ইংল্যান্ড উভয় দেশের মানুষই ইংরেজী ভাষায় কথা বলে। শেক্সপিয়ারের রচনাবলী ইংরেজি ভাষায় লেখা। কিন্তু তাঁর জন্ম ইংল্যান্ডে। শুধুমাত্র ইংরেজি ভাষায় অমর সাহিত্য রচনা করেছেন বলে আমেরিকা শেক্সপিয়ারকে মাথায় তুলে নাচে না। ইংরেজি সাহিত্যের আরেক দিকপাল রবার্ট ফ্রস্ট। কিন্তু তাঁর জন্মস্থান আমেরিকা। ইংল্যান্ডে রবার্ট ফ্রস্টকে ঘটা করে সেলিব্রেট করা হয় না। অথচ আমাদের এখানে ভিনদেশী রবীন্দ্রনাথকে সারা বছর মাথায় তুলে নাচা হয়।
 নজরুল কেন আজ অবহেলিত এবং উপেক্ষিত তার কারণ মোটামুটি সাবলীলভাবেই বর্ণনা করেছেন জনাব আসাফ উদ্দৌলা। এছাড়া আরো অনেকগুলো কারণ রয়েছে। একটি মাত্র আলোচনা সভায় জনাব আসাফ উদ্দৌলা আর কত কথা বলবেন? সেখানে তো আরো অনেক বক্তা ছিলেন। তাদের জন্যও তো সময় রাখতে হয়েছে।
 একটি কথা বলে আজকে এই আলোচনা শেষ করতে চাচ্ছি। সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে অর্ধ শতাব্দী আগে সুপরিকল্পিতভাবে রবীন্দ্রনাথকে এই বাংলাদেশে হাইলাইট করা হয়েছে। তখন নজরুলকেও হাইলাইট করা হয়েছে তাঁর দুটি বৈপ্লবিক কবিতার জন্য। একটি হলো ‘বিদ্রোহী', আরেকটি হলো ‘কারার ঐ লৌহ কপাট'। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে এদেশে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদী চক্র সুপরিকল্পিতভাবে নজরুলকে সাংস্কৃতিক জগত থেকে নির্বাসনে পাঠাচ্ছে। ২০১২ সালে সেই নির্বাসন ষোল কলায় পূর্ণ হবে বলে সচেতন মানুষ মনে করেন। সেক্যুলারিস্টদের ঐ চক্রান্ত ভাঙ্গতে হলে ‘কারার ঐ লৌহ কপাট' গান দিয়েই সেটি ভাঙ্গতে হবে।
Email: asifarsalan15@gmail.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন