শনিবার, ২৬ মে, ২০১২

রেটোরিক কেউ পছন্দ করে না


এম আবদুল হাফিজ
রাজনীতিতে রেটোরিক বা বাগাড়ম্বর ক্ষমতাসীনদেরই বিশেষ অধিকার। তারা পদাধিকারবলে আরও অনেক সুবিধা ভোগ করেন, যাতে বিরোধীদলীয়দের অংশীদারিত্ব নেই। ক্ষমতাসীনদের আচরণ-উচ্চারণ নিয়ে কদাচিৎ কেউ কোনো প্রশ্ন তোলে। রাজনীতির দ্বন্দ্বে ঐতিহ্যগতভাবেই বিরোধী দল দুর্বল পক্ষ এবং সেভাবেই তা তাদের চেতনায় রেখে রাজনীতি পরিচালিত হয়। বিগত নির্বাচনে পরাজয়ের প্রচণ্ড ধাক্কা সামলে ওঠার অব্যবহিত পরই রাজনীতির অঙ্গনে দলটি সরব হয়ে ওঠে এবং মূল মঞ্চে তার উত্তরণ ঘটে। সংসদে মাত্র ক'জন সদস্য নিয়ে কী করতে পারবে তার হিসাব-নিকাশ করেই বিএনপি রাজপথেই অধিক সক্রিয় হতে চেষ্টা করে।
একথা স্বীকার করতেই হবে যে, বিগত সাড়ে তিন বছরের আওয়ামী শাসনামলে অন্তত রাজপথে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট তাদের ভিত পাকা করে ফেলেছে। জোটনেত্রী খালেদা জিয়ার জনপ্রিয়তা তো ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী সমর্থক ঝড়েও অক্ষত ছিল। সংসদে না হলেও দেশের জনগোষ্ঠীর মধ্যে দলটি সমর্থনের সমতা রক্ষা করতে পেরেছিল। এ সত্ত্বেও বিএনপির বিগত মেয়াদের রেকর্ড ভালো ছিল না। তবু শুধু আওয়ামীদের অকল্পনীয় দুঃশাসনের কারণে বিএনপি তার হাতছাড়া রাজনৈতিক পরিসরের অনেকটাই পুনর্দখলে সমর্থ হয়।
বিএনপি তার সত্বর পুনরুত্থানে দুঃসাহসিক হয়ে কিছু ভুল পদক্ষেপে প্রবৃত্ত হয়। দলটি কিছু বাগাড়ম্বর ও আলটিমেটামের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে, যা রাজনীতিতে এমনকি ক্ষমতাসীনদের জন্যও ভালো নয়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তথা মহাজোটকে তা মানালেও এবং তারা সে ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা রাখলেও বিরোধী দলের জন্য এ পর্যায়ে তা মোটেই যৌক্তিক নয়। স্মরণ করা যেতে পারে, আওয়ামী লীগ একইভাবে বিএনপির শাসনামলে সরকার পতনের আলটিমেটাম দিয়েছিল এবং নির্বুদ্ধিতা ও শূন্যগর্ভ আস্ফালনের জন্য আওয়ামী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল জলিল হাস্যাস্পদ হয়েছিলেন।
রাজনীতিকদের মধ্যে বড় বড় বুলি আওড়ানোর প্রবণতা থাকে। তাছাড়া নিজেদের বড়ত্ব এবং শক্তি জাহির করার একটি প্রচ্ছন্ন ঝোঁক প্রায় সময়ই অনভিপ্রেত পরিণতিতে পেঁৗছায়। বিএনপির সামান্য ক'জন নেতা যারা এখনও কারামুক্ত তাদের প্ররোচণামূলক ভাষণ ও আচরণ সরকারকে ক্ষেপিয়ে তুলছে এবং দলকে অনিশ্চিত অবস্থার মুখোমুখি করছে।
১০ জুনের আলটিমেটামসহ বিএনপির অযাচিত হুংকার_ প্রয়োজনে তারা একদফার আন্দোলন তথা সরকার পতনের আন্দোলনের সূচনা করবে। অথচ বিএনপি জানে, নির্বাচিত একটি সরকারের পতন হয় না। যেমন দুর্ধর্ষ আন্দোলনকারী আওয়ামী লীগও তাদের একই প্রকার হুংকার সত্ত্বেও বিগত মেয়াদের বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকারকে উৎখাত করতে সমর্থ হয়নি। নির্বাচিত কোনো সরকারের মেয়াদ পূর্তির আগে পতন হওয়া উচিতও নয়। তেমনটি হলে সত্যিকার অর্থেই রাষ্ট্র নৈরাজ্যে নিপতিত হয়। তাই সব দলেরই রাজনীতিতে সংযম ও ধৈর্যের প্রয়োজন। ক্ষমতাসীন সরকার নির্বাচনের প্রাক্কালে এমনই বাড়াবাড়ি করে থাকে_ হার্ডলাইনে যায়, যদিও আখেরে কোনো লাভ হয় না। জনগণ একবার বিরূপ হলে তার প্রকাশ চলমান ঘটনাপ্রবাহে কোনো না কোনোভাবে প্রতিফলিত হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট নির্বাচনে আওয়ামীদের ওয়াশ আউটে জনরোষ এবং বিরাগের ক্ষুদ্র স্ফুলিঙ্গ পরিলক্ষিত হলো। এর জন্য কোনো আলটিমেটামের দরকার হয়নি। তবে সরকারের যে কোনো দুরভিসন্ধি বাস্তবায়নের পথে অহিংস কার্যক্রম নেওয়া যেতে পারে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, সরকারের মহামারীসদৃশ দুর্নীতি ও অনিয়ম সম্পর্কে জনগণকে সচেতন রাখা। হুমকি-ধমকি, শাসানো রাজনীতির কোনো গ্রহণযোগ্য নীতি নয়। এমনিতেই এমনকি অর্থমন্ত্রী স্বীকৃত সর্বব্যাপী দুর্নীতির প্রসার যে দুর্গন্ধ ছড়িয়েছে সুরঞ্জিত বাবুদের বদৌলতে তা এখন সর্বজনবিদিত। দুর্নীতির একটি কুকীর্তি ঢাকতে গেলে আরেকটি বেরিয়ে পড়ছে। সংবাদপত্রে প্রতিবেদন অনুযায়ী এখন নাকি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন আওয়ামী ক্যাডারদের সঙ্গে মিলেমিশে প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি করে। ভোগবাদে আসক্ত আওয়ামী পরিবারের অন্তর্ভুক্ত নব্য ধনীদের চাহিদার অন্ত নেই। যাদের একটি ফ্ল্যাট আছে তারা আরও চায়, যাতে পরিবারের প্রতিটি সদস্য স্বতন্ত্রভাবে থাকতে পারে।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, আওয়ামী ফন্দি ও চাতুর্য তাদের গলার ফাঁস হবে এবং বিএনপি তার স্বাভাবিক উত্থানের ধারা ধরে রাখতে পারবে। কিন্তু তাদের রেটোরিক লোকে পছন্দ করবে না, বিশেষ করে সরকার পতনের হুংকার। জনগণ একটি ক্ষমতাসীন দলকে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ম্যান্ডেট দেয়। সে সময় উপনীত হওয়ার আগে তাদের টেনে নামানোর চেষ্টা জনগণের রায়ের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শনেরই শামিল।

ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম আবদুল হাফিজ : সাবেক মহাপরিচালক বিআইআইএসএস ও কলাম লেখক

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন