বাংলাদেশের
রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল হয়ে উঠেছে। একদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের
দাবি অপরদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অস্বীকার—এই পরস্পরবিরোধী অবস্থানে
দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সংঘাতের দিকেই এগোচ্ছে। এই পটভূমিতে দেশের
অন্যান্য দল, নাগরিক সমাজ, মিডিয়া ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন এমনকি বিদেশি
বন্ধুরাও দুই দলকে সংলাপে বসে এই জটিলতা অবসানে একটা সমঝোতায় পৌঁছানোর জন্য
আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু সরকার এ ব্যাপারে এখনো ইতিবাচক কোনো সাড়া দেয়নি।
সামনে আরও হরতালের কর্মসূচি, বিএনপির ভাষায়, আরও কঠোর কর্মসূচি আসতে পারে
বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
এ রকম অবস্থায় দেশের পরিস্থিতি ক্রমশ অনিশ্চিত হয়ে উঠেছে। যাঁরা দেশের রাজনীতি বিশ্লেষণ করেন তাঁরাও প্রায় সবাই দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি সম্পর্কে কোনো আশাবাদী মন্তব্য করতে পারছেন না। সমঝোতা না হলে দেশে একটা বড় রকমের সংঘাত হতে পারে বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন।
অথচ এই সংঘাত এড়ানোর একটা বড় উপায় ছিল সংলাপ। দীর্ঘমেয়াদি সংলাপের মাধ্যমে উভয় পক্ষ কিছুটা ছাড় দিলে সমঝোতার একটা পথ পাওয়া যেতে পারে। আর দুই বড় দলের মধ্যে সমঝোতা হলে তার ভিত্তিতে সংবিধান সংশোধন করা কয়েক মিনিটের ব্যাপার মাত্র।
কিন্তু সেই বহুল প্রত্যাশিত সংলাপের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী বা তাঁর দলকে এখনো প্রচণ্ডভাবে অনাগ্রহী বলেই মনে হয়। গণতন্ত্রে বা সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেতাকে যে নানা সংকটে ও ইস্যুতে প্রায়ই আলোচনায় বসতে হয় তা আমাদের প্রধানমন্ত্রীর অজানা থাকার কথা নয়। তবুও প্রধানমন্ত্রী আলোচনা বা সংলাপকে উপেক্ষা করতে পারছেন। বলা হয়, বাংলাদেশে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার রয়েছে। এটা কাগুজে কথা। বাস্তবে বাংলাদেশে যেভাবে সংসদ ও মন্ত্রিসভা কাজ করছে তা ‘রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি’র একটি নিকৃষ্ট সংস্করণ। এ ব্যাপারে প্রধান বিরোধী দলও কম দায়ী নয়।
কোনো সরকারে একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে সেই সরকারের কাছ থেকে দায়িত্বশীলতা আশা করা বৃথা। বাংলাদেশে আমরা এখন প্রায় সে রকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছি।
একটা কথা আমার প্রায়ই মনে জাগে। যদি শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে সরকার গঠন করার মতো সিট না পায়, তাহলে শেখ হাসিনা কাকে বা কাদের দায়ী করবেন? মন্ত্রিসভাকে? সাংসদদের? আমলাদের? কাউকেই দায়ী করার কোনো সুযোগ নেই। কারণ সবাই দেখতে পেয়েছেন, মহাজোট সরকার কেবল একজনের নির্দেশেই পরিচালিত হয়েছে। এই অদক্ষ মন্ত্রিসভা (কচিকাঁচার মন্ত্রিসভা—আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী) তিনিই গঠন করেছেন। দক্ষ ও অভিজ্ঞ আওয়ামী লীগ নেতাদের তিনিই দূরে সরিয়ে রেখেছেন। মন্ত্রী ও উপদেষ্টাদের মধ্যে তিনিই দ্বন্দ্ব লাগিয়ে রেখেছেন। ছোট-বড় সব সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরকে অতিরিক্ত ক্ষমতা দিয়ে তিনি কার্যত মন্ত্রণালয়কে অকার্যকর করে রেখেছেন। মাধ্যমিক পরীক্ষার রেজাল্টও বেচারা শিক্ষামন্ত্রী ঘোষণা করতে পারেন না!
এসব দৃশ্য বা ঘটনাপ্রবাহ সচেতন মানুষ দেখেছে। এগুলো বিএনপির অপপ্রচার নয়। টিভিতে দেখা ও পত্রিকায় পড়া ঘটনা। কাজেই নির্বাচনে পরাজিত হলে প্রধানমন্ত্রী কাকে দায়ী করবেন তা দেখার জন্য আমার খুব কৌতূহল। অবশ্য পরাজিত হবেন এমন কোনো কথা নেই। বিপুল ভোটে আওয়ামী লীগ আবার জয়ী হতে পারে। দেশের মানুষ যদি এ রকম ‘শাসন’ পছন্দ করে তাহলে তারা আওয়ামী লীগকে ভোট দিতেই পারে। জনগণের ইচ্ছাকে দমিয়ে রাখার শক্তি কারও নেই।
অনেকে মনে করেন, দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা চাপ সৃষ্টি করলেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংলাপে বসতে বাধ্য হবেন। এখানে একটা কথা স্পষ্ট করা দরকার। সংলাপে বসতে দুই দলের কারও তেমন আপত্তি নেই। শুধু একটি শর্ত তাঁদের রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর শর্ত: সংলাপে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যু’ আলোচ্য বিষয় হতে পারবে না। কারণ, এটা মৃত বিষয়। এই ইস্যু সংবিধান থেকেই বাদ দেওয়া হয়েছে।
বেগম খালেদা জিয়ার শর্ত: সরকার যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুটি মেনে নেয় তাহলে তাঁরা সংলাপে বসতে রাজি।
সেই পুরোনো প্রবাদটির কথা পাঠকের মনে পড়তে পারে। ‘সালিস মানি, কিন্তু তালগাছটি আমার।’
এ রকম অবস্থায় কারা প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেত্রীকে প্রভাবিত করতে পারবেন?
অনেকে মনে করেন, বিভিন্ন পেশার নেতৃস্থানীয় মানুষেরা সংঘবদ্ধ হয়ে প্রধানমন্ত্রীর ওপর চাপ সৃষ্টি করলে প্রধানমন্ত্রী বিতর্কিত সব বিষয় নিয়ে সংলাপে বসতে আগ্রহী হবেন।
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি সম্পর্কে যাঁদের পরিষ্কার ধারণা নেই তাঁরা এ রকম প্রস্তাব দিতে পারেন। তবে বাস্তবতা খুব ভিন্ন চিত্র।
বাংলাদেশের বিভিন্ন পেশার নেতারা দলীয় পরিচয়ে বিভক্ত। প্রায় সব পেশার নেতারাই দুই প্রধান দল বা তাঁদের দলের সরকারের কাছ থেকে নানা অনুগ্রহ নিয়ে থাকেন। তাঁরা দলের সেবাদাস। দলের নেত্রী বা প্রধানমন্ত্রীর মন জুগিয়ে কথা বলাই তাঁদের প্রধান কাজ। প্রত্যক্ষ রাজনীতি না করলেও তাঁদের আচরণ ও কথাবার্তা দলের ক্যাডারদের মতোই। তাঁরা শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি করার মতো নৈতিক জোর রাখেন না। তাঁরা সরকার বা দল থেকে নানা সুবিধা আদায়ে ব্যস্ত। শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়া পছন্দ করবেন না, এমন কোনো কথা তাঁরা কখনো বলবেন কি না আমার সন্দেহ হয়। কাজেই পেশাজীবী নেতাদের দ্বারা এই সংকটে কোনো ইতিবাচক ভূমিকা আশা করা যায় না।
এই সংকট নিরসনে নেতৃত্বস্থানীয় ও সম্মানিত বুদ্ধিজীবীদের কাছেও অনেকের প্রত্যাশা রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে দলনিরপেক্ষ সৎ বুদ্ধিজীবী (নেতৃত্বস্থানীয়) নেই বললেই চলে। সুযোগ পেলে তাঁরা নেত্রীর যেভাবে বন্দনা করেন, তা যেকোনো রুচিশীল মানুষকে পীড়িত করবে। তাঁদের বন্দনার ভাষা যাঁরা নিজের কানে শোনেননি তাঁরা বিশ্বাসও করতে পারবেন না।
নিঃসন্দেহে তাঁরা খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক। দেশের জন্য তাঁদের অবদান অসামান্য। কিন্তু তাঁরা পোষমানা দলীয় বুদ্ধিজীবী! পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত সাহিত্যিক (প্রয়াত) অন্নদা শঙ্কর রায়ের মতো বিবেকবান, নির্লোভ ও সাহসী বুদ্ধিজীবী বাংলাদেশে নেই বললেই চলে। যে দু-একজনের কথা অনেকের মনে পড়বে তাঁরা দেশের চলমান রাজনৈতিক সংকট সম্পর্কে প্রায় কখনো কোনো কথাই বলেন না। এ ধরনের নীরব বুদ্ধিজীবীদের কাছ থেকে কোনো গঠনমূলক ও ইতিবাচক ভূমিকা আশা করা বৃথা।
একজন প্রখ্যাত কলামিস্ট বাংলাদেশের দুজন ‘বিশিষ্ট নাগরিকের’ কাছে আশা করেছেন, তাঁরা যেন তাঁদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি কাজে লাগিয়ে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে দুই নেত্রীকে সংলাপে বসাতে চাপ দেন।
এই দুজন বিশিষ্ট নাগরিকের অন্তত একজন চলমান রাজনীতি নিয়ে কোনো কথা না বলেই সরকারের কাছে যেভাবে অপদস্থ ও অপমানিত হয়েছেন এবং হচ্ছেন তাতে মনে হয় না দেশের রাজনীতি নিয়ে কথা বলা বা কোনো ভূমিকা রাখা তাঁর জন্য উপযুক্ত কাজ হবে। রাজনীতি নিয়ে কথা বললে তিনি আরও অপদস্থ হতে পারেন বলে আশঙ্কা হয়। অতএব, দেশের সমস্যা রাজনীতিবিদদেরই সামলাতে হবে। এই দুই বিশিষ্ট নাগরিকের কাছ থেকে কোনো রাজনৈতিক ভূমিকা আশা না করাই শ্রেয়। আরও একটি কথা মনে রাখা দরকার। যে দুজন বিশিষ্ট নাগরিকের কথা বলা হচ্ছে, তাঁদের প্রতি শেখ হাসিনা বা বর্তমান সরকারের কোনো আস্থা বা শ্রদ্ধা নেই। এ কারণেও রাজনৈতিক অঙ্গনে তাঁদের কোনো ভূমিকা পালনের সুযোগ নেই।
ভূমিকা পালন করতে পারে মিডিয়া। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া। যদি মিডিয়ার মালিকেরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারেন। যদি তাঁরা একমত হন যে সংলাপ ও সংলাপের মাধ্যমে নির্বাচনকালীন সরকারপদ্ধতি সম্পর্কে দুই দলকে একটা সমঝোতায় আসতেই হবে। সংবাদপত্র যদি সংলাপ ও সমঝোতার পক্ষে পরিকল্পিতভাবে প্রতিদিন লেখা প্রকাশ করে, টিভিতে নানা অনুষ্ঠান প্রচার হয়, তার একটা প্রভাব দুই দলের ওপরই পড়তে পারে। এ ছাড়া সংলাপের বিপক্ষে বা কোনো একটা বিতর্কিত বক্তব্য দুই দলের নেতারা যখন বক্তব্যে বলবেন তা খুব দায়সারাভাবে প্রচার করেও নেতাদের নিরুৎসাহিত করা যায়।
বাংলাদেশে সরকার ও জাতীয় সংসদের পর মিডিয়াই সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। এখনো আমাদের মিডিয়া অনেকটা স্বাধীন। মিডিয়ার একটা বড় অংশ যদি দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটা ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারে তাহলে বর্তমান সংকট দূর করার লক্ষ্যে কিছুটা অগ্রগতি হতে পারে।
বাংলাদেশের রাজনীতি অত্যন্ত নিম্নমানের। গ্রাম্য রাজনীতিও বলা যায়। যাঁরা এখানে রাজনীতি করেন, বর্তমান সমস্যা তাঁদেরই সৃষ্টি। তাঁদেরই এই সমস্যার সমাধান করতে হবে। সম্মানিত, বিদগ্ধ, রুচিবান, মননশীল ব্যক্তিদের এই নোংরা রাজনীতিতে না জড়ানোই ভালো হবে। আমার ধারণা, এই গ্রাম্য ও দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতিতে তাঁরা তেমন কিছু করতেও পারবেন না। কারণ শিক্ষিত ও সম্মানিত ব্যক্তিদের প্রতি এই অপরাজনীতির নেতাদের অনাস্থা ও অশ্রদ্ধা রয়েছে।
অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন, তাহলে দেশের জন্য তাঁদের কি কিছু করণীয় নেই? দায়িত্ব নেই?
নিশ্চয় আছে। তবে সেই দায়িত্ব পালনের সুযোগ ও পরিবেশ থাকতে হবে। বাংলাদেশে এখন সেই সুযোগ নেই। অপরাজনীতি সবকিছু দখল করে ফেলেছে। এখানে সুবচনেরও স্থান নেই। বাংলাদেশ দল ও দলকানাদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। দলের সঙ্গে যাঁরা কণ্ঠ মেলাতে পারবেন না তাঁদের কোনো মূল্য নেই এ দেশে।
তাহলে সংলাপের কী হবে? সংলাপের কী হবে তা দুই দল ও দুই নেত্রীই ভালো জানেন। তাঁদের সুমতি হলে সংলাপ হবে। সমঝোতা হবে। সুমতি না হলে দেশে সংঘাত হবে। অনেক মানুষ মারা যাবে। সম্পত্তির ক্ষতি হবে। মানুষের মূল্যবান সময় নষ্ট হবে। আর আমরা সাধারণ মানুষ তা চোখ মেলে দেখতে থাকব। কারণ আমরা অসহায়। আমরা দুই দলের কাছে জিম্মি। আমরা অসংগঠিত। এই জিম্মিদশা থেকে আমাদের কে মুক্তি দেবেন কে জানে। হয়তো শুধু সৃষ্টিকর্তাই জানেন।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়নকর্মী।
এ রকম অবস্থায় দেশের পরিস্থিতি ক্রমশ অনিশ্চিত হয়ে উঠেছে। যাঁরা দেশের রাজনীতি বিশ্লেষণ করেন তাঁরাও প্রায় সবাই দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি সম্পর্কে কোনো আশাবাদী মন্তব্য করতে পারছেন না। সমঝোতা না হলে দেশে একটা বড় রকমের সংঘাত হতে পারে বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন।
অথচ এই সংঘাত এড়ানোর একটা বড় উপায় ছিল সংলাপ। দীর্ঘমেয়াদি সংলাপের মাধ্যমে উভয় পক্ষ কিছুটা ছাড় দিলে সমঝোতার একটা পথ পাওয়া যেতে পারে। আর দুই বড় দলের মধ্যে সমঝোতা হলে তার ভিত্তিতে সংবিধান সংশোধন করা কয়েক মিনিটের ব্যাপার মাত্র।
কিন্তু সেই বহুল প্রত্যাশিত সংলাপের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী বা তাঁর দলকে এখনো প্রচণ্ডভাবে অনাগ্রহী বলেই মনে হয়। গণতন্ত্রে বা সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেতাকে যে নানা সংকটে ও ইস্যুতে প্রায়ই আলোচনায় বসতে হয় তা আমাদের প্রধানমন্ত্রীর অজানা থাকার কথা নয়। তবুও প্রধানমন্ত্রী আলোচনা বা সংলাপকে উপেক্ষা করতে পারছেন। বলা হয়, বাংলাদেশে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার রয়েছে। এটা কাগুজে কথা। বাস্তবে বাংলাদেশে যেভাবে সংসদ ও মন্ত্রিসভা কাজ করছে তা ‘রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি’র একটি নিকৃষ্ট সংস্করণ। এ ব্যাপারে প্রধান বিরোধী দলও কম দায়ী নয়।
কোনো সরকারে একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে সেই সরকারের কাছ থেকে দায়িত্বশীলতা আশা করা বৃথা। বাংলাদেশে আমরা এখন প্রায় সে রকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছি।
একটা কথা আমার প্রায়ই মনে জাগে। যদি শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে সরকার গঠন করার মতো সিট না পায়, তাহলে শেখ হাসিনা কাকে বা কাদের দায়ী করবেন? মন্ত্রিসভাকে? সাংসদদের? আমলাদের? কাউকেই দায়ী করার কোনো সুযোগ নেই। কারণ সবাই দেখতে পেয়েছেন, মহাজোট সরকার কেবল একজনের নির্দেশেই পরিচালিত হয়েছে। এই অদক্ষ মন্ত্রিসভা (কচিকাঁচার মন্ত্রিসভা—আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী) তিনিই গঠন করেছেন। দক্ষ ও অভিজ্ঞ আওয়ামী লীগ নেতাদের তিনিই দূরে সরিয়ে রেখেছেন। মন্ত্রী ও উপদেষ্টাদের মধ্যে তিনিই দ্বন্দ্ব লাগিয়ে রেখেছেন। ছোট-বড় সব সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরকে অতিরিক্ত ক্ষমতা দিয়ে তিনি কার্যত মন্ত্রণালয়কে অকার্যকর করে রেখেছেন। মাধ্যমিক পরীক্ষার রেজাল্টও বেচারা শিক্ষামন্ত্রী ঘোষণা করতে পারেন না!
এসব দৃশ্য বা ঘটনাপ্রবাহ সচেতন মানুষ দেখেছে। এগুলো বিএনপির অপপ্রচার নয়। টিভিতে দেখা ও পত্রিকায় পড়া ঘটনা। কাজেই নির্বাচনে পরাজিত হলে প্রধানমন্ত্রী কাকে দায়ী করবেন তা দেখার জন্য আমার খুব কৌতূহল। অবশ্য পরাজিত হবেন এমন কোনো কথা নেই। বিপুল ভোটে আওয়ামী লীগ আবার জয়ী হতে পারে। দেশের মানুষ যদি এ রকম ‘শাসন’ পছন্দ করে তাহলে তারা আওয়ামী লীগকে ভোট দিতেই পারে। জনগণের ইচ্ছাকে দমিয়ে রাখার শক্তি কারও নেই।
অনেকে মনে করেন, দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা চাপ সৃষ্টি করলেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংলাপে বসতে বাধ্য হবেন। এখানে একটা কথা স্পষ্ট করা দরকার। সংলাপে বসতে দুই দলের কারও তেমন আপত্তি নেই। শুধু একটি শর্ত তাঁদের রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর শর্ত: সংলাপে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যু’ আলোচ্য বিষয় হতে পারবে না। কারণ, এটা মৃত বিষয়। এই ইস্যু সংবিধান থেকেই বাদ দেওয়া হয়েছে।
বেগম খালেদা জিয়ার শর্ত: সরকার যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুটি মেনে নেয় তাহলে তাঁরা সংলাপে বসতে রাজি।
সেই পুরোনো প্রবাদটির কথা পাঠকের মনে পড়তে পারে। ‘সালিস মানি, কিন্তু তালগাছটি আমার।’
এ রকম অবস্থায় কারা প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেত্রীকে প্রভাবিত করতে পারবেন?
অনেকে মনে করেন, বিভিন্ন পেশার নেতৃস্থানীয় মানুষেরা সংঘবদ্ধ হয়ে প্রধানমন্ত্রীর ওপর চাপ সৃষ্টি করলে প্রধানমন্ত্রী বিতর্কিত সব বিষয় নিয়ে সংলাপে বসতে আগ্রহী হবেন।
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি সম্পর্কে যাঁদের পরিষ্কার ধারণা নেই তাঁরা এ রকম প্রস্তাব দিতে পারেন। তবে বাস্তবতা খুব ভিন্ন চিত্র।
বাংলাদেশের বিভিন্ন পেশার নেতারা দলীয় পরিচয়ে বিভক্ত। প্রায় সব পেশার নেতারাই দুই প্রধান দল বা তাঁদের দলের সরকারের কাছ থেকে নানা অনুগ্রহ নিয়ে থাকেন। তাঁরা দলের সেবাদাস। দলের নেত্রী বা প্রধানমন্ত্রীর মন জুগিয়ে কথা বলাই তাঁদের প্রধান কাজ। প্রত্যক্ষ রাজনীতি না করলেও তাঁদের আচরণ ও কথাবার্তা দলের ক্যাডারদের মতোই। তাঁরা শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি করার মতো নৈতিক জোর রাখেন না। তাঁরা সরকার বা দল থেকে নানা সুবিধা আদায়ে ব্যস্ত। শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়া পছন্দ করবেন না, এমন কোনো কথা তাঁরা কখনো বলবেন কি না আমার সন্দেহ হয়। কাজেই পেশাজীবী নেতাদের দ্বারা এই সংকটে কোনো ইতিবাচক ভূমিকা আশা করা যায় না।
এই সংকট নিরসনে নেতৃত্বস্থানীয় ও সম্মানিত বুদ্ধিজীবীদের কাছেও অনেকের প্রত্যাশা রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে দলনিরপেক্ষ সৎ বুদ্ধিজীবী (নেতৃত্বস্থানীয়) নেই বললেই চলে। সুযোগ পেলে তাঁরা নেত্রীর যেভাবে বন্দনা করেন, তা যেকোনো রুচিশীল মানুষকে পীড়িত করবে। তাঁদের বন্দনার ভাষা যাঁরা নিজের কানে শোনেননি তাঁরা বিশ্বাসও করতে পারবেন না।
নিঃসন্দেহে তাঁরা খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক। দেশের জন্য তাঁদের অবদান অসামান্য। কিন্তু তাঁরা পোষমানা দলীয় বুদ্ধিজীবী! পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত সাহিত্যিক (প্রয়াত) অন্নদা শঙ্কর রায়ের মতো বিবেকবান, নির্লোভ ও সাহসী বুদ্ধিজীবী বাংলাদেশে নেই বললেই চলে। যে দু-একজনের কথা অনেকের মনে পড়বে তাঁরা দেশের চলমান রাজনৈতিক সংকট সম্পর্কে প্রায় কখনো কোনো কথাই বলেন না। এ ধরনের নীরব বুদ্ধিজীবীদের কাছ থেকে কোনো গঠনমূলক ও ইতিবাচক ভূমিকা আশা করা বৃথা।
একজন প্রখ্যাত কলামিস্ট বাংলাদেশের দুজন ‘বিশিষ্ট নাগরিকের’ কাছে আশা করেছেন, তাঁরা যেন তাঁদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি কাজে লাগিয়ে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে দুই নেত্রীকে সংলাপে বসাতে চাপ দেন।
এই দুজন বিশিষ্ট নাগরিকের অন্তত একজন চলমান রাজনীতি নিয়ে কোনো কথা না বলেই সরকারের কাছে যেভাবে অপদস্থ ও অপমানিত হয়েছেন এবং হচ্ছেন তাতে মনে হয় না দেশের রাজনীতি নিয়ে কথা বলা বা কোনো ভূমিকা রাখা তাঁর জন্য উপযুক্ত কাজ হবে। রাজনীতি নিয়ে কথা বললে তিনি আরও অপদস্থ হতে পারেন বলে আশঙ্কা হয়। অতএব, দেশের সমস্যা রাজনীতিবিদদেরই সামলাতে হবে। এই দুই বিশিষ্ট নাগরিকের কাছ থেকে কোনো রাজনৈতিক ভূমিকা আশা না করাই শ্রেয়। আরও একটি কথা মনে রাখা দরকার। যে দুজন বিশিষ্ট নাগরিকের কথা বলা হচ্ছে, তাঁদের প্রতি শেখ হাসিনা বা বর্তমান সরকারের কোনো আস্থা বা শ্রদ্ধা নেই। এ কারণেও রাজনৈতিক অঙ্গনে তাঁদের কোনো ভূমিকা পালনের সুযোগ নেই।
ভূমিকা পালন করতে পারে মিডিয়া। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া। যদি মিডিয়ার মালিকেরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারেন। যদি তাঁরা একমত হন যে সংলাপ ও সংলাপের মাধ্যমে নির্বাচনকালীন সরকারপদ্ধতি সম্পর্কে দুই দলকে একটা সমঝোতায় আসতেই হবে। সংবাদপত্র যদি সংলাপ ও সমঝোতার পক্ষে পরিকল্পিতভাবে প্রতিদিন লেখা প্রকাশ করে, টিভিতে নানা অনুষ্ঠান প্রচার হয়, তার একটা প্রভাব দুই দলের ওপরই পড়তে পারে। এ ছাড়া সংলাপের বিপক্ষে বা কোনো একটা বিতর্কিত বক্তব্য দুই দলের নেতারা যখন বক্তব্যে বলবেন তা খুব দায়সারাভাবে প্রচার করেও নেতাদের নিরুৎসাহিত করা যায়।
বাংলাদেশে সরকার ও জাতীয় সংসদের পর মিডিয়াই সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। এখনো আমাদের মিডিয়া অনেকটা স্বাধীন। মিডিয়ার একটা বড় অংশ যদি দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটা ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারে তাহলে বর্তমান সংকট দূর করার লক্ষ্যে কিছুটা অগ্রগতি হতে পারে।
বাংলাদেশের রাজনীতি অত্যন্ত নিম্নমানের। গ্রাম্য রাজনীতিও বলা যায়। যাঁরা এখানে রাজনীতি করেন, বর্তমান সমস্যা তাঁদেরই সৃষ্টি। তাঁদেরই এই সমস্যার সমাধান করতে হবে। সম্মানিত, বিদগ্ধ, রুচিবান, মননশীল ব্যক্তিদের এই নোংরা রাজনীতিতে না জড়ানোই ভালো হবে। আমার ধারণা, এই গ্রাম্য ও দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতিতে তাঁরা তেমন কিছু করতেও পারবেন না। কারণ শিক্ষিত ও সম্মানিত ব্যক্তিদের প্রতি এই অপরাজনীতির নেতাদের অনাস্থা ও অশ্রদ্ধা রয়েছে।
অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন, তাহলে দেশের জন্য তাঁদের কি কিছু করণীয় নেই? দায়িত্ব নেই?
নিশ্চয় আছে। তবে সেই দায়িত্ব পালনের সুযোগ ও পরিবেশ থাকতে হবে। বাংলাদেশে এখন সেই সুযোগ নেই। অপরাজনীতি সবকিছু দখল করে ফেলেছে। এখানে সুবচনেরও স্থান নেই। বাংলাদেশ দল ও দলকানাদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। দলের সঙ্গে যাঁরা কণ্ঠ মেলাতে পারবেন না তাঁদের কোনো মূল্য নেই এ দেশে।
তাহলে সংলাপের কী হবে? সংলাপের কী হবে তা দুই দল ও দুই নেত্রীই ভালো জানেন। তাঁদের সুমতি হলে সংলাপ হবে। সমঝোতা হবে। সুমতি না হলে দেশে সংঘাত হবে। অনেক মানুষ মারা যাবে। সম্পত্তির ক্ষতি হবে। মানুষের মূল্যবান সময় নষ্ট হবে। আর আমরা সাধারণ মানুষ তা চোখ মেলে দেখতে থাকব। কারণ আমরা অসহায়। আমরা দুই দলের কাছে জিম্মি। আমরা অসংগঠিত। এই জিম্মিদশা থেকে আমাদের কে মুক্তি দেবেন কে জানে। হয়তো শুধু সৃষ্টিকর্তাই জানেন।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়নকর্মী।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন