সোমবার, ২৮ মে, ২০১২

জেনারেল জিয়া স্মরণে

জেনারেল জিয়া স্মরণে

॥ মে. জে. (অব:) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীক ॥

মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। স্বনির্ভর আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার শহীদ জিয়াউর রহমান বীর উত্তম বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের একজন এবং নিজ গুণেই ইতিহাস তাকে আখ্যায়িত করেছে মহান হিসেবে। তার জীবদ্দশায় দেশের সঙ্কটকালে জাতীয় নেতারা যখন দ্বিধা ও সংশয়ের মধ্যে ছিলেন, ঠিক তখন তার সময়োচিত ও বীরোচিত ভূমিকা জাতিকে সঠিক দিকনির্দেশনা দিয়েছিল। 
জাতির প্রতিটি সঙ্কটময় মুহূর্তেই তিনি বারবার মাথা উঁচু করে নির্ভয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। বিপর্যস্ত জাতিকে রা করেছেন সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে। ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ তৎকালীন চট্টগ্রাম মহানগর থেকে অল্প দূরে অবস্থিত কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত এই মহান নেতার কণ্ঠনিঃসৃত বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণায় সে দিন দিশেহারা জাতি দিকনির্দেশনা পেয়েছিল এবং মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার সাহস ও প্রেরণা পেয়েছিল। শুধু স্বাধীনতার ঘোষণা উচ্চারণ করেই তিনি থেমে থাকেননি, দেশের মুক্তির জন্য হানাদারদের বিরুদ্ধে সেক্টর কমান্ডার ও জেড ফোর্সের অধিনায়ক হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। নিজের জীবন বাজি রেখে দেশের জন্য তথা মাতৃভূমির জন্য সক্রিয় ভূমিকা পালন শুরু করেছিলেন এবং সেটা অব্যাহত ছিল তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণার মাধ্যমেই তার এই সাহসী পদেেপর যাত্রা শুরু হয়েছিল। সেখানেও তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন, মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের কথা বলেছিলেন। স্বাধীনতাযুদ্ধে তার এই অতুলনীয় ভূমিকা ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছে। 
মুক্তিযুদ্ধের পরে ১৯৭২ সালের প্রথম সাড়ে তিন মাস জিয়াউর রহমান কুমিল্লা সেনানিবাসে অবস্থিত ৪৪ পদাদিক ব্রিগেডের ব্রিগেড কমান্ডার ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন জেড ফোর্সই পরবর্তীকালে স্বাধীনতার পর ৪৪ পদাদিক ব্রিগেডে রূপান্তর হয়েছিল। মধ্য এপ্রিল ১৯৭২ থেকে ২৪ আগস্ট ১৯৭৫ পর্যন্ত জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উপ-সেনাপ্রধান ছিলেন। এরপর তিনি সেনাপ্রধান নিযুক্ত হন, সেনাপ্রধান হিসেবেই উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে নিযুক্ত হন; একপর্যায়ে তিনি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হন এবং সর্বশেষ পর্যায়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হন । রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর একসময় তিনি গণভোটের মাধ্যমে সাংবিধানিকভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং পরবর্তীকালে রাজনৈতিক দল গঠনের পর পুনর্নির্বাচিত হন।
তার রাজনৈতিক চিন্তাধারা সম্বন্ধে অল্প কথায় বলা যায়Ñ তিনি বহুদলীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন, তরুণ প্রজন্মকে সুযোগ দেয়ার পে ছিলেন, মাঠে-ময়দানে অগণিত মেধাবী আপাতদৃষ্টিতে অরাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির ব্যক্তিকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন করায় আগ্রহী ছিলেন এবং গুটিকয়েক পেশাদার রাজনীতিবিদের পুরো রাজনৈতিক অঙ্গনকে দখল করে রাখার যে প্রবণতা, সেটা ভাঙতে চেয়েছিলেন। প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড বা চিন্তাভাবনায় তার গতিশীলতা বা ডায়নামিজম ছিল, উদ্যোগ-প্রবণতা বা ইনিশিয়েটিভ প্রচুর ছিল। মানসিকভাবে ও শারীরিকভাবে তিনি প্রচুর পরিশ্রম করতে পারতেন। এর অসংখ্য উদাহরণ এ দেশের মানুষের অজানা নয়। 
রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে এক যুগান্তকারী অবদান রাখেন। কারণ ১৯৭৫ সালের আগস্টে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার আগে তিনি বাকশালের একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলেন। তিনি দেশের সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করেছিলেন। সরকারের মালিকানাধীন চারটি দৈনিক পত্রিকা ছাড়া সব সংবাদপত্র প্রকাশনাও বাতিল করেছিলেন। বাকশালের সেই শ্বাসরুদ্ধকর দুঃশাসনের কবল থেকে জাতিকে মুক্তি দিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান, ১৯৭৬ এবং তার পরবর্তী সময়ে। চতুর্থ সংশোধনী তথা একদলীয় শাসনব্যবস্থা বাতিল করেছেন। তার উদ্যোগে প্রবর্তিত হয়েছিল বহুদলীয় গণতন্ত্র। 
সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী ছিল জিয়ার আরেকটি বড় অবদান। এর মাধ্যমেই সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ এবং আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থার বিধান যুক্ত হয়েছিল। মুসলিমপ্রধান দেশে ধর্মভিত্তিক দল গঠন করার অধিকারও তিনিই দিয়েছিলেন। জাতীয়তাবাদী রাজনীতির প্রর্বতন ছিল জিয়ার আরেকটি বড় অবদান। এই রাজনীতিকে এগিয়ে নেয়ার উদ্দেশ্যে তিনি বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অর্থনৈতিক েেত্র সমৃদ্ধি ঘটিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। সমাজতন্ত্রের নামে রাষ্ট্রীয় সম্পদের যথেচ্ছ লুটপাট বন্ধ করতে সংবিধানে তিনি অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য সমাজতন্ত্রের বিধান যুক্ত করেছিলেন। এর ফলেই দেশে মুক্তবাজার অর্থনীতি চালু হয়েছিল, জাতীয় পুঁজির বিকাশ ঘটতে শুরু করেছিল। দুর্ভিরে দেশ ও তলাবিহীন ঝুড়ির দুর্নাম ঘুচিয়ে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের পথে পা বাড়িয়েছিল। আমাদের পাশের দেশ ভারতের আধিপত্যবাদী নীতি ও কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে দেশপ্রেমিক জিয়া বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে গেছেন। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশের বীর সেনাবাহিনী সীমান্তে চলমান নাশকতা (১৯৭৫ সালের শেষ অংশ থেকে ১৯৭৮ সালের মধ্যবর্তী সময় পর্যন্ত) প্রতিহত করেছিল। আওয়ামী-বাকশালী সরকারের পেটোয়া বাহিনীর ভূমিকা পালনকারী রীবাহিনীর বিলুপ্তি ঘটিয়ে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে সেনাবাহিনীকে ধ্বংসের পরিণতি থেকে রা করেছেন। জিয়ার পররাষ্ট্রনীতি ছিল অত্যন্ত ফলপ্রসূ। ভারতের পরামর্শে ধর্মনিরপেতা ও সমাজতন্ত্রের নীতি অবলম্বন করতে গিয়ে বাংলাদেশ বিশেষ করে মুসলিম বিশ্ব থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। জিয়া সে অবস্থার অবসান ঘটিয়ে, বাংলাদেশকে অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কান্ট্রিজ বা ওআইসির একটি গুরুত্বপূর্ণ সদস্যে রূপান্তর করেন। 
জেনারেল জিয়াউর রহমানের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল কয়েকটি আঙ্গিক। প্রথমত, তিনি দারুণ পরিশ্রমী ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৪ ঘণ্টা ঘুমাতেন কি না সন্দেহ। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উপপ্রধান থাকাকালে শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রম করতেন যুগপৎ। পরো বা প্রত্য রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পাওয়ার পর তিনি সারা দেশ সফর করতে গিয়ে যেমন মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটেছেন, তেমনি গাড়িতে চড়েছেন অথবা হেলিকপ্টার ব্যবহার করেছেন। দিনের আলোয় বহিরাঙ্গনে ব্যস্ত থাকার পর, সন্ধ্যার পর রাত ২টা-৩টা পর্যন্ত দাফতরিক কাজে ব্যস্ত থাকতেন। এরই মধ্যে রাজনৈতিক দল গুছিয়েছেন, প্রতিরা নিয়ে চিন্তা করেছেন, প্রশাসনিক আদেশ-নির্দেশ দিয়েছেন, উন্নয়নমূলক চিন্তায় অন্যদের অংশীদার করেছেন। দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য ছিল যে তিনি অতি প্রশংসা পছন্দ করতেন না। যেন কোনো বক্তা অতি প্রশংসার সুযোগ না পান সে জন্য আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক সর্বপ্রকারের আলোচনা বা সভা-সমিতিতে ‘সম্বোধন পর্ব’ অতি সংপ্তি রাখতেন। তৃতীয় বৈশিষ্ট্য ছিল, টু দি পয়েন্টে কথা বলা তথা বাহুল্য বাদ দিয়ে আলোচনায় যাওয়া। চতুর্থ বৈশিষ্ট্য ছিল খাওয়াদাওয়ায় মিতব্যয়িতা ও সরলতা। তিনি দেশের বিভিন্ন স্থানে সফর করার সময় যেন অনেক পয়সা খরচ করে ভূরিভোজনের আয়োজন করা না হয় সে ব্যাপারে অতি সচেতন থাকতেন। অনেক ধরনের খাদ্যদ্রব্য টেবিলে অনুমতি দিতেন না। সর্বশেষ উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল, শয়নে-স্বপনে বাংলাদেশ নিয়ে চিন্তা করতেন; কী করে দেশের অগ্রগতি করানো যায়। তিনি দেশের তাৎণিক সমস্যা বা চলমান পরিস্থিতি সম্বন্ধে চিন্তা করতেন ও বলাবলি করতেন, তেমনই এক যুগ বা দুই যুগ পরের সম্ভাব্য পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে সরকারি নীতিমালা প্রস্তুত করার তাগাদা দিতেন। 
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে তথা প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল এটা সত্য। সরকার ও অগণিত মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে সেতুবন্ধ ছিলেন প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানী এবং সেক্টর কমান্ডারগণ। জেনারেল জিয়াউর রহমান সেই মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীনই একজন সেক্টর কমান্ডার ও ফোর্স কমান্ডার হিসেবে মুক্তিযোদ্ধা ও দেশবাসীর কাছে প্রিয় হয়ে ওঠেন। কিন্তু গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ পুনর্জীবন লাভ করে ১৯৭৫ সালের নভেম্বরের ৭ তারিখে এবং সেই দিনে জাতির ত্রাণকর্তা তথা জাতীয় ঐক্যের প্রতীক তথা গণতান্ত্রিক বাংলাদেশকে নবজীবন দানকারী জাতীয় নেতা ছিলেন জিয়াউর রহমান। 
১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে নির্মমভাবে তাকে হত্যা করা হয়। আগামীকাল সেই ৩০ মে শহীদ জিয়ার শাহাদতবার্ষিকী। তার শাহাদতের সংবাদে সে দিন গোটা জাতি শোকাভিভূত হয়ে পড়েছিল। এর বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল শেরেবাংলা নগরে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নামাজে জানাজায় লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতির মধ্য দিয়ে। শোকাবহ এই দিনটিতে দেশের মানুষ শ্রদ্ধাভরে তাকে স্মরণ করে এবং করবে। 
লেখক : গবেষক ও চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
www.kallyan-ibrahim.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন