মঙ্গলবার, ২৯ মে, ২০১২

মন্তব্য প্রতিবেদন : গণতন্ত্রবিনাশী পঞ্চদশ সংশোধনী



মাহমুদুর রহমান
মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নিরঙ্কুশ এবং চিরস্থায়ী করার লক্ষ্যে ১৯৭৫ সালে সংবিধানে চতুর্থ সংশোধনী আনয়ন করেছিলেন। শান্তিপূর্ণভাবে, গণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের সব সুযোগ রহিত করার ফলেই পরবর্তী সময়ে এ দেশে ১৫ আগস্টের মতো ট্র্যাজেডি সংঘটিত হয়েছিল। ইতিহাস থেকে কোনো রকম শিক্ষা গ্রহণ না করে তার কন্যা পিতার মতো করেই সংসদে একচেটিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংবিধানের ১৫ নম্বর সংশোধনী পাস করিয়েছেন। এই সংশোধনীর ফলে আমাদের সংবিধান সর্বতোভাবে গণবিরোধী চরিত্র ধারণ করেছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিম্নশ্রেণীর চাটুকার ব্যতীত সমাজের সব অংশ দ্বারা এর মধ্যে পঞ্চদশ সংশোধনী প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। ইসলামী ও জাতীয়তাবাদী চেতনায় বিশ্বাসী নাগরিকবৃন্দের কাছে এই সংশোধনী যে গ্রহণযোগ্য হবে না, সেটা আগেই বোঝা গিয়েছিল। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, আওয়ামী লীগের আদর্শিক মিত্র বাংলাদেশের সেক্যুলার গোষ্ঠীও বর্তমান সংবিধানকে গণবিরোধী বলছেন। তাদের আপত্তি মূলত দু’টি স্থানে। প্রথমত, আল্লাহর প্রতি আস্থা মহাজোট সরকার সংবিধানের মূল নীতি থেকে বিসর্জন দিলেও সংবিধানে বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম রেখে দেয়া হয়েছে এবং দ্বিতীয়ত, ১৯৭২ সালের বাঙালি জাতীয়তাবাদ পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে পুনঃপ্রবিষ্ট করানোর ফলে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে অসন্তোষ পুনর্বার প্রজ্বলিত হওয়ার আশঙ্কায় সেক্যুলার গোষ্ঠী ক্ষুব্ধ হয়েছে। তবে সংবিধানের ধর্মীয়, জাতিগত অথবা ভাষাগত অসঙ্গতির বিষয়ে আজ আমি লিখতে বসিনি। পঞ্চদশ সংশোধনী যে ১৯৭৫ সালের চতুর্থ সংশোধনীর মতো রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক চরিত্রকে সম্পূর্ণভাবে বিনষ্ট করেছে, সেটাই আজকের মন্তব্য প্রতিবেদনের মূল বিষয়। সেই কারণে আমার আলোচনা কেবল পঞ্চদশ সংশোধনীর ৭ এবং ৪৪ অনুচ্ছেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখব।
সংবিধানের ৭ ধারার দুটো অংশ রয়েছে। ৭ (ক) ধারার শিরোনাম হলো, ‘সংবিধান বাতিল, স্থগিতকরণ, ইত্যাদি অপরাধ।’ এখানে বলা হয়েছে—
“৭ক। সংবিধান বাতিল, স্থগিতকরণ, ইত্যাদি অপরাধ। (১) কোনো ব্যক্তি শক্তি প্রদর্শন বা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বা অন্য কোনো অসাংবিধানিক পন্থায়—
(ক) এই সংবিধান বা ইহার কোনো অনুচ্ছেদ রদ, রহিত বা বাতিল বা স্থগিত করিলে কিংবা উহা করিবার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করিলে; কিংবা
(খ) এই সংবিধান বা ইহার কোনো বিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করিলে কিংবা উহা করিবার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করিলে—
তাহার এই কার্য রাষ্ট্রদ্রোহিতা হইবে এবং ঐ ব্যক্তি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে দোষী হইবে।”
আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, ভবিষ্যতে সামরিক অভ্যুত্থান প্রতিহত করার মহত্ উদ্দেশ্যেই বর্তমান প্রায় একদলীয় সংসদ এই সংশোধনী গ্রহণ করেছে। সমালোচকরা তর্ক করতে পারেন, আইন করে কোনো দেশে সামরিক অভ্যুত্থান ঠেকানো যায়নি। সব ক্ষেত্রে সংবিধান স্থগিত করেই বন্দুকধারীরা ওই কর্মটি সম্পাদন করেন। আগুয়ান ট্যাংকের সামনে এক কপি সংবিধান উঁচিয়ে ধরে বিশ্বের কোথাও সামরিক অভ্যুত্থান আটকানো যায়নি। নব্বই’র দশকে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে ইয়েলিসন ট্যাংকে আসীন হয়ে যে নাটক করেছিলেন, তার পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর সমর্থনের পাশাপাশি সম্ভবত ভদকা’র যথেষ্ট প্রভাব ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন বিভক্ত-পরবর্তী রাশিয়ার প্রথম প্রেসিডেন্ট ইয়েলিসনের মদ্যপ্রীতি নিয়ে প্রচুর মজার গল্প আছে। যাই হোক, সংবিধান দিয়ে প্রকৃতই সেনা অভ্যুত্থান প্রতিহত করা যায় কিনা, আমি সে তর্কে যাচ্ছি না। আমার মূল আপত্তি ৭ক(১)-এর ‘খ’ অংশ নিয়ে। সংবিধানের কোনো গণবিরোধী কিংবা জাতীয় স্বার্থ ক্ষুণ্নকারী অংশের বিরুদ্ধে নাগরিককে সচেতন করার যে কোনো উদ্যোগকে সরকার ইচ্ছা করলেই রাষ্ট্রদ্রোহিতারূপে গণ্য করতে সক্ষম হবে, এ জাতীয় অনুচ্ছেদ কেবল একটি ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রের সংবিধানেই থাকতে পারে। আওয়ামী লীগের মতো চরিত্রগতভাবে ফ্যাসিবাদী দলের নীতিনির্ধারকদের মাথা থেকেই জনগণের চিন্তা, বিবেক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণকারী এ ধরনের কালো আইন জন্মলাভ করতে পারে। এখানেই শেষ নয়। একই অনুচ্ছেদের ৭ক(২) আরও ভয়াবহ। ওই অংশটি উদ্ধৃত করা যাক—
“কোন ব্যক্তি (১) দফায় বর্ণিত—
(ক) কোন কার্য করিতে সহযোগিতা বা উস্কানি প্রদান করিলে; কিংবা
(খ) কার্য অনুমোদন, মার্জনা, সমর্থন বা অনুসমর্থন করিলে—
তাহার এইরূপ কার্যও একই অপরাধ হইবে।”
সর্বশেষ উদ্ধৃত আইনটির বাস্তবে প্রয়োগ কল্পনাতে আনার চেষ্টা করছি। ধরা যাক, বিরোধী দলের এক জনসভায় একজন বক্তা পঞ্চদশ সংশোধনীর তোঘলকী আইনের বিরুদ্ধে যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য দিলেন এবং উপস্থিত কয়েক লাখ মানুষ (বেগম খালেদা জিয়ার সাম্প্রতিক রোডমার্চগুলোতে ন্যূনতম পাঁচ লাখ কর্মী, সমর্থক, শ্রোতার সমাগম হয়েছিল) স্লোগান কিংবা করতালির মাধ্যমে সেই সমালোচনাকে সংবিধানের ভাষায় ‘অনুসমর্থন’ দিলেন। প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ মোতাবেক সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এবং আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ প্রণীত পঞ্চদশ সংশোধনী অনুযায়ী সেই জনসভায় উপস্থিত লাখ লাখ মানুষের প্রত্যেককেই সেই ‘অনুসমর্থনের’ অভিযোগে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করা সম্ভব। আমাদের তথাকথিত স্বাধীন নিম্ন ও উচ্চ আদালতের যে অবস্থা, তাতে অ্যাটর্নি জেনারেল মামলা পরিচালনা করলে সর্বোচ্চ সাজা ঘোষণা করে প্রত্যেককে ফাঁসিতে ঝোলাতে সরকারের কোনো সমস্যাই হবে না। অনুচ্ছেদ ৭ক(৩) তে সর্বোচ্চ সাজার ইঙ্গিতও দেয়া হয়েছে। সেখানে বলা হচ্ছে—
“এই অনুচ্ছেদে বর্ণিত অপরাধে দোষী ব্যক্তি প্রচলিত আইনে অন্যান্য অপরাধের জন্য নির্ধারিত দণ্ডের মধ্যে সর্বোচ্চ দণ্ডে দণ্ডিত হইবে।” বাংলাদেশ পেনাল কোডে সর্বোচ্চ দণ্ড, মৃত্যুদণ্ড। অর্থাত্ কেবল বিরোধী দলের জনসভায় উপস্থিত থাকার অপরাধে বাংলাদেশের পঞ্চদশ সংশোধনীত্তোর ফ্যাসিস্ট সংবিধান অনুযায়ী এ দেশের নাগরিকদের তাত্ত্বিকভাবে মৃত্যুদণ্ড হতে পারে। কোনো যেন তেন ফ্যাসিস্টের পক্ষে এ জাতীয় ঘৃণ্য আইন প্রণয়ন সম্ভব নয়। বর্তমান শাসকশ্রেণীর মতো তাকে অবশ্যই বিকৃত মস্তিষ্ক এবং স্যাডিস্ট হতে হবে।
এবার ৭ নম্বর অনুচ্ছেদের দ্বিতীয় অংশ বোঝার চেষ্টা করছি। পঞ্চদশ সংশোধনীর ৭(খ) অনুচ্ছেদ নিম্নরূপ :
“৭খ। সংবিধানের মৌলিক বিধানাবলী সংশোধন অযোগ্য।— সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, সংবিধানের প্রস্তাবনা, প্রথম ভাগের সকল অনুচ্ছেদ, দ্বিতীয় ভাগের সকল অনুচ্ছেদ, নবম-ক ভাগে বর্ণিত অনুচ্ছেদসমূহের বিধানাবলী সাপেক্ষে তৃতীয় ভাগের সকল অনুচ্ছেদ এবং একাদশ ভাগের ১৫০ অনুচ্ছেদসহ সংবিধানের অন্যান্য মৌলিক কাঠামো সংক্রান্ত অনুচ্ছেদসমূহের বিধানাবলী সংশোধন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন, রহিতকরণ কিংবা অন্য কোনো পন্থায় সংশোধনের অযোগ্য হইবে।”
অর্থাত্ শেখ হাসিনার হুকুম অনুযায়ী পৃথিবী যতদিন থাকবে, ততদিন বাংলাদেশের এই আইন অপরিবর্তনীয়। ভবিষ্যতের সব নির্বাচিত সংসদকে বর্তমান মহাজোট সরকারের নির্দেশ মেনে চলতে হবে। ক্ষমতার মদিরা অথবা হোয়াইট ওয়াইন আকণ্ঠ পান করে একেবারে বেহেড মাতাল না হলে এভাবে ভবিষ্যতের মানুষদেরও নিয়ন্ত্রণ করার কল্পনা কারও মাথায় আসার কথা নয়।
ঊনবিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এভি ডাইসি (AV Dicey) সংসদের সার্বভৌমত্ব নিয়ে লিখেছেন, “The principle of Parliamentary sovereignty means neither more nor less than this; that Parliament thus defined has, under the English constitution, the right to make or unmake any law whatever, and, further that no person or body is recognised by the law of England as having a right to override or set aside the legislation of Parliament.”
(সংসদীয় সার্বভৌমত্বের অর্থ এর চেয়ে বেশি বা কম নয়; ইংলিশ সংবিধানে সংসদকে আইন প্রণয়ন এবং বাতিল করার পূর্ণ ক্ষমতা দেয়া হয়েছে এবং কোনো ব্যক্তি অথবা সঙ্ঘ ব্রিটিশ আইন অনুযায়ী সংসদে প্রণীত কোনো আইনকে বাতিলের ক্ষমতা রাখে না)। সংসদের আইন প্রণয়নের ক্ষমতার বিষয়ে এভি ডাইসির থিসিস থেকে মূল নীতি হিসেবে দু’টি বিষয় গ্রহণ করা যেতে পারে :
(১) জাতীয় সংসদ আইন প্রণয়নের সর্বোচ্চ সংস্থা এবং রাষ্ট্রের যে কোনো বিষয়ের ওপর আইন প্রণয়নের ক্ষমতা সংরক্ষণ করে।
(২) কোনো সংসদ অতীতের কোনো সংসদের কাছে দায়বদ্ধ নয় এবং ভবিষ্যতের কোনো সংসদের সার্বভৌম ক্ষমতাও সীমিত করতে পারে না।
এভি ডাইসির অন্য অনেক মন্তব্যের সঙ্গে পরবর্তীকালে বিশ্বের পণ্ডিত রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ দ্বিমত পোষণ করলেও উপরিউক্ত দু’টি বিষয়ে তারা প্রায় সবাই ঐকমত্যে পৌঁছেছেন। বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর ৭(খ) অনুচ্ছেদ পৃথিবীর সব সংসদীয় গণতন্ত্র চর্চাকারী রাষ্ট্রে অনুসৃত ডাইসির মতবাদের সরাসরি লঙ্ঘন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার চরম স্বৈরাচারী মানসিকতার কারণে কেবল বর্তমানের ওপরই প্রভুত্ব করতে চাচ্ছেন না, তিনি কেয়ামত পর্যন্ত বাংলাদেশের সব ভবিষ্যত্ প্রজন্মের চিন্তা-চেতনা, আদর্শকে পদানত করার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছেন। অবস্থাদৃষ্টে একাদশ শতাব্দীর অতীব অহঙ্কারী ভাইকিং রাজা ক্যানিউটের (King Canute) কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। এই রাজা নাকি মনে করতেন, প্রজারা তো নস্যি, সমুদ্রের ঢেউও তার আদেশ মেনে চলবে। হাজার বছর পরে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীও রাজা ক্যানিউটের রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। চাটুকার পরিবেষ্টিত হয়ে তিনি সম্ভবত বুঝতে পারছেন না যে, পিতার মতো পারিষদবর্গ তাকেও গণবিচ্ছিন্ন করে ক্রমেই ট্র্যাজেডির দিকে ঠেলে দিচ্ছেন।
আজীবন রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলে রাখার অসুস্থ ও উদগ্র আকাঙ্ক্ষা থেকেই যে বর্তমান সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি সংবিধান থেকে ছেঁটে ফেলেছে, সেটা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাও বুঝতে পারেন। কিন্তু সেই দুষ্কর্মটি করতে গিয়ে ৪৪ নম্বর আইনের নামে কতখানি হাস্যকর, অবাস্তব, আজগুবি ও স্ববিরোধী আইন জনগণের মাথায় যে চাপানো হয়েছে, সেটা বোধহয় এ দেশের অধিকাংশ নাগরিক এখন পর্যন্ত ঠিকমত বুঝে উঠতে পারেননি। ৪৪ নম্বর আইনের মাধ্যমে সংবিধানের ১২৩(৩) অনুচ্ছেদ সংশোধন করা হয়েছে। পাঠকের বোঝার সুবিধার্থে আলোচনার আগে আইনটি উদ্ধৃত করছি—
“৪৪। সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদের সংশোধন।—সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদের (৩) দফার পরিবর্তে নিম্নরূপ (৩) দফা প্রতিস্থাপিত হইবে, যথা—
“(৩) সংসদ-সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে
(ক) মেয়াদ-অবসানের কারণে সংসদ ভাংগিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাংগিয়া যাইবার পূর্ববর্তী নব্বই দিনের মধ্যে; এবং
(খ) মেয়াদ-অবসান ব্যতীত অন্য কোনো কারণে সংসদ ভাংগিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাংগিয়া যাইবার পরবর্তী নব্বই দিনের মধ্যে ঃ
তবে শর্ত থাকে যে, এই দফার (ক) উপ-দফা অনুযায়ী অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত ব্যক্তিগণ, উক্ত উপ-দফায় উল্লিখিত মেয়াদ সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত, সংসদ সদস্যরূপে কার্যভার গ্রহণ করিবেন না।”
উদ্ধৃত আইনটির স্ববিরোধিতার বিষয়টি এবার বিশ্লেষণের চেষ্টা করছি। বর্তমান সংসদের মেয়াদ শেষ হবে ২০১৪ সালের ২৫ জানুয়ারি। সুতরাং সংশোধিত ১২৩(৩)(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে ২৬ অক্টোবর ২০১৩ থেকে ২৪ জানুয়ারি ২০১৪-এর মধ্যবর্তী যে কোনো একদিন। শেখ হাসিনার সরকার যদি কোনো কারণে মেয়াদ পূর্ণ করতে না পারে, তাহলে অবশ্য ১২৩(৩)(খ) অনুচ্ছেদ প্রযোজ্য হবে। এ তো গেল পরবর্তী নির্বাচন কবে হবে না হবে, সে সংক্রান্ত আলোচনা। আজগুবি অংশটি আসছে, এরপর যেখানে বলা হচ্ছে বর্তমান সংসদের মেয়াদ সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচনে জয়লাভ করা নতুন সংসদ সদস্যগণ কার্যভার গ্রহণ করতে পারবেন না।
ধরা যাক, আগামী বছর ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। তার আগে তীব্র গণঅসন্তোষের কারণে পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল না হলে প্রধানমন্ত্রীসহ সম্পূর্ণ মন্ত্রিসভা এবং নবম জাতীয় সংসদের সংসদ সদস্যবৃন্দ নির্বাচনের সময় পূর্ণ ক্ষমতায় থাকবেন। এটা খুবই সম্ভব যে বর্তমান সংসদ সদস্যদের মধ্যে অন্তত একটি অংশ সেটা যতই ক্ষুদ্র হোক, আগামী নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পাবেন না। সুতরাং, তাদের জায়গায় নতুন ব্যক্তিরা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবেন। অর্থাত্ একটি নির্বাচনী এলাকায় দু’জন সংসদ সদস্য অন্তত কিছুদিনের জন্য থাকছেন। সেই কিছুদিন কতটা দীর্ঘ হবে, সেটি নির্ভর করবে একচ্ছত্র রাষ্ট্র ক্ষমতার অধিকারী মহাজোট নেত্রী শেখ হাসিনার ইচ্ছার ওপর। তিনি যদি মেয়াদের একেবারে শেষদিন পর্যন্ত ক্ষমতা ভোগ করতে চান, তাহলে ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে পরবর্তী প্রায় একমাস দু’জন সংসদ সদস্য একই এলাকার জনগণের প্রতিনিধিত্ব করবেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী ‘এক ঘর মে দো পীর’-এর এক বাস্তব প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করে উচ্চ দ্রব্যমূল্য এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের নির্যাতনে পিষ্ট জনগণকে সম্ভবত বিমলানন্দ দিতে চাচ্ছেন! আর যদি এমন হয় যে, কোনো মন্ত্রী মহাজোট থেকে মনোনয়ন পেলেন না, তাহলে তো পরিস্থিতি একেবারে সোনায় সোহাগা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি সম্পর্কে যার কিছুমাত্র ধারণা রয়েছে, তিনিই বুঝবেন মনোনয়নবঞ্চিত মন্ত্রী তার এলাকায় কেমন তাণ্ডব সৃষ্টির ক্ষমতা রাখেন। সম্প্রতি গফরগাঁওয়ে সংসদ সদস্য ক্যাপ্টেন (অব.) গিয়াসউদ্দিনকে হিন্দি সিনেমার স্টাইলে তারই এলাকার জনগণকে লক্ষ্য করে পিস্তল উঁচিয়ে গুলি করতে দেখা গেছে। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হত্যাকারীদের অন্যতম এই ব্যক্তি আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন না পেলে মেশিনগান নিয়ে যে ময়দানে নামবেন না, তার নিশ্চয়তা কোথায়? বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এর মধ্যে এই আশঙ্কার কথা ব্যক্ত করেছেন। সুতরাং, সংবিধানকে বর্তমান অবস্থানে রেখে কোনো সুষ্ঠু, পক্ষপাতহীন, শান্তিপূর্ণ নির্বাচন যে বাংলাদেশে সম্ভব নয়, সেটি পরিষ্কারভাবেই দেখা যাচ্ছে।
মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান এদেশে গণতন্ত্রকে কবর দিয়েছিলেন চতুর্থ সংশোধনী আনয়ন করে। তার সুযোগ্য কন্যা দ্বিতীয়বার গণতন্ত্র নির্বাসনে পাঠিয়েছেন পঞ্চদশ সংশোধনী গ্রহণের মাধ্যমে। তাই পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল আজ জাতীয় দাবিতে পরিণত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশাসনের চণ্ডনীতি থেকে আমার কাছে অন্তত মনে হচ্ছে না যে, তিনি জনদাবির প্রতি কোনোরকম শ্রদ্ধা দেখাবেন। বিরোধী দলের দুর্বল ও বিভ্রান্ত আন্দোলন তাকে ক্রমেই দুর্বিনীত করে তুলছে।
পুলিশ, র্যাব, এসএসএফের নাকের ডগায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে বাস পোড়ানো মামলায় বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব এবং দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্যবৃন্দসহ ৩৩ জন নেতাকে অভিযুক্ত করে জেলে পাঠানো সরকারের চরম অসহিষ্ণু আচরণেরই বহিঃপ্রকাশ। বিএনপি সরকারের আমলে আওয়ামী লীগের কর্মীরা শেরাটন হোটেলের সামনে বাসে আগুন দিয়ে ৭ জন যাত্রীকে পুড়িয়ে মেরেছিল। তখন দলটির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন আজকের রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান। আওয়ামী লীগের বর্তমান সরকারের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে ভবিষ্যতের কোনো সরকার কর্তৃক গাড়ি পোড়ানো এবং মানুষ হত্যার অপরাধে রাষ্ট্রপতিসহ দলের অন্যান্য নীতি-নির্ধারকের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের হওয়া বিচিত্র নয়। আইনজীবীদের কাছ থেকে শুনেছি, ফৌজদারি মামলা কখনও তামাদি হয় না। এছাড়া টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে দিনে-দুপুরে লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে মানুষ হত্যার অপরাধ তো আছেই। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর দলীয় নেতা-কর্মীদের লগি-বৈঠা নিয়ে ঢাকায় আসার নির্দেশ দিয়েছিলেন স্বয়ং শেখ হাসিনা।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফরের সময় থেকে দৃশ্যতই বিরোধীদল দাবি আদায়ে কঠোর কর্মসূচি দেয়া থেকে বিরত থাকছে। দলটি নতুন করে ক’দিন আগে গণঅনশন কর্মসূচি পালন করেছে। পাঠকের স্মরণে থাকার কথা, গত বছর জুলাই মাসেও তারা একই প্রকার কর্মসূচি পালন করেছিল। একমাত্র পার্থক্য হলো এবার অনশনস্থল ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউট চত্বরের পরিবর্তে মহানগর নাট্যমঞ্চে স্থানান্তরিত হয়েছে। এদিকে বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য ও দলের অন্যতম নীতিনির্ধারক ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ অব্যাহতভাবে বলে চলেছেন, তারা নাকি সরকারের সব নির্যাতন আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে মোকাবেলা করবেন। দলটির প্রভাবশালী নেতাদের মধ্যে একাংশ সাংবিধানিক আন্দোলনেরও থিওরি দিচ্ছেন। যে দেশে ক্ষমতাসীনরা সংবিধানকে নিয়ে রীতিমত ছেলেখেলা করছেন, নিম্ন-উচ্চ নির্বিশেষে সম্পূর্ণ বিচার বিভাগ দলীয় শৃঙ্খলে আবদ্ধ, সেই দেশে আইনি লড়াই এবং সাংবিধানিক আন্দোলনের মাজেজা বোঝার ক্ষমতা আমার নেই। এ জাতীয় বক্তব্য দিয়ে সুশীল (?) সমাজ এবং বিদেশি মুরব্বিদের কাছ থেকে বাহবা পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হবে না। বিরোধী দল হয়তো আশা করছে, মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা চাপের কাছে শেষ পর্যন্ত নতিস্বীকার করে শেখ হাসিনা সংবিধান পুনর্বার সংশোধনে সম্মত হবেন। আমি সবিনয়ে তাদের প্রফেসর ইউনূস উপাখ্যান স্মরণে আনতে অনুরোধ করছি।
মার্কিন পত্রিকা ‘ইউএসএ টুডে’তে প্রদত্ত সাক্ষাত্কারে হিলারি ক্লিনটন তার অতি পছন্দের ব্যক্তিদের তালিকায় প্রফেসর ইউনূসকে শীর্ষে রেখেছেন। হিলারি ক্লিনটনের ব্যক্তিগত অনুরোধ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রতিটি পশ্চিমা রাষ্ট্রের চাপকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বর্তমান সরকার বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ীকে কারাগারে পাঠানো ছাড়া সর্বপ্রকারে অব্যাহত হয়রানি করে চলেছে। হিলারি ক্লিনটনের কাছে প্রফেসর ইউনূসের চেয়ে বিএনপি অধিকতর প্রিয়, এমন অবাস্তব কল্পনা মূর্খদের পক্ষেই করা সম্ভব। সুতরাং, আন্দোলন শিকেয় তুলে রেখে মার্কিন চাপের সফলতার আশায় বিরোধী দল ঘরে বসে থাকলে তার পরিণতি আইন প্রতিমন্ত্রীর হুমকি মোতাবেক প্রকৃতই ‘ভয়াবহ’ হওয়া অসম্ভব নয়। মামলার ভয়ে আন্দোলনের মাঠ থেকে পলায়নের মেরুদণ্ডহীন কৌশল শেষ পর্যন্ত বিরোধী নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার গ্রেফতারের কারণও হতে পারে। ভুলি কী করে, বর্তমান সরকারই ২০১০ সালে ঈদের মাত্র দু’দিন আগে অত্যন্ত নির্মমভাবে তাকে গৃহহীন করেছিল।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অচলাবস্থা প্রসঙ্গে গত সপ্তাহে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনার বক্তব্য উদ্ধৃত করে আজকের মন্তব্য প্রতিবেদন সমাপ্ত করব। বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, “তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি নিয়ে আমার কোনো চিন্তা-ভাবনা নেই, আমরা মনে করি, গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলগুলো নিজেরাই পথ খুঁজে বের করবে, যাতে গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ তৈরি হয়, নাম যাই হোক না কেন। তবে বাংলাদেশে রাজনৈতিক মতপার্থক্য দূর করতে হিলারি ক্লিনটনের মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালনের কোনোই সম্ভাবনা নেই। এ সমস্যা স্থানীয়, সমাধানও স্থানীয়ভাবেই করতে হবে। আপনাদের রাজনৈতিক সমস্যা আপনাদেরই মেটাতে হবে। বিদেশিদের পেছনে ছোটার প্রয়োজন নেই।” মার্কিন রাষ্ট্রদূত যথেষ্ট প্রাঞ্জলভাবে তার রাষ্ট্রের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন। বিএনপি’র ভবিষ্যত্ মন্ত্রিসভার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ প্রত্যাশীরা ড্যান মজিনার বার্তাটি ধরতে পেরেছেন কীনা, সেটি অবশ্য আমার জানা নেই।
ই মেইল : admahmudrahman@gmail.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন