মঙ্গলবার, ২৯ মে, ২০১২

জিয়া সর্বাবস্থায় আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা রাখতেন



এ ম আ ব দু ল্লা হ
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা রক্ষা এবং স্বাধীন বাংলাদেশের উন্নয়ন-অগ্রগতিতে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের অবদান অবিস্মরণীয়। সেনাবাহিনীর একজন মেজর যে কী অসাধারণ মেধা, প্রজ্ঞা আর দূরদর্শিতা দিয়ে একটি জাতির স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও উন্নয়নের অগ্রদূত হিসেবে আবির্ভূত হতে পারেন তার অনন্য উদাহরণ জিয়াউর রহমান। অপরিসীম দেশপ্রেম, দুরন্ত কর্মস্পৃহা আর নিষ্ঠা দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপথ পরিবর্তন করে দিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চে দিক-দিশাহীন জাতির ভয়ানক মুহূর্ত থেকে শুরু করে আমৃত্যু দেশের প্রতিটি ক্রান্তিকালে তিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন ত্রাতা ও দিশারী হিসেবে। তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে বাংলাদেশকে ইমার্জিং টাইগারে উন্নীত করা, একদলীয় শাসনের জগদ্দল পাথর জাতির কাঁধ থেতে সরিয়ে বহুদলীয় গণতন্ত্র, বাক-ব্যক্তি স্বাধীনতা ও অবাধ রাজনীতির পথ সুগম করা, বিচার বিভাগ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেয়া, বাংলাদেশকে বিশ্ব মানচিত্রে একটি মর্যাদাশীল জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা শহীদ জিয়ার অসাধারণ কীর্তির অন্যতম। সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মহীনতার মূলনীতি বাদ দিয়ে মহান স্রষ্টা আল্লাহর ওপর অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস এবং শুরুতে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম সংযোজন জিয়াউর রহমানকে এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের হৃদয়ের গহীনে স্থান দিয়েছে। সস্তা বাহবা কুড়ানো কিংবা রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের উদ্দেশ্যে জিয়া এটা করেননি, তার প্রমাণ মেলে জিয়ার নাতিদীর্ঘ কর্মময় জীবনে এবং জবানে।
মূলত প্রশ্নাতীত ব্যক্তিগত সততা এবং মহান আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা ও দৃঢ় বিশ্বাসই ছিল জিয়াউর রহমানের দুর্গম পথ চলার পাথেয়। ব্যক্তিগত জীবনে যেমন জিয়াউর রহমান ধর্ম-কর্মের অনুসারী ছিলেন, তেমনি রাষ্ট্র পরিচালনার মূলমন্ত্র হিসেবে তিনি আল্লাহ ও তাঁর মনোনীত ধর্মের প্রতি ছিলেন গভীর আস্থাশীল। তার দৈনন্দিন জীবন আর প্রতিটি বক্তব্য ও নির্দেশনায় ধর্মের প্রতি তার অনুরাগ প্রকাশ পেয়েছে সুস্পষ্টভাবে।
জিয়াউর রহমান প্রতিটি কাজ এবং বক্তৃতা শুরু করতেন আল্লাহর নাম নিয়ে । স্বাধীনতার যে ঘোষণা দিয়েছেন তারও শেষ বাক্যটি ছিল ‘ইনশাআল্লাহ বিজয় আমাদের অবধারিত’। রণাঙ্গনে প্রত্যক্ষ লড়াই ও যুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়ার সময় যারা তার সঙ্গী ছিলেন তারা তাদের লেখনী ও বক্তব্যে জানিয়েছেন, জীবনবাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধ করার প্রতিটি মুহূর্তে জিয়াউর রহমান অন্যদের নিয়ে আল্লাহর সাহায্য কামনা করতেন এবং নিয়মিত ধর্মীয় বিধি-নিষেধ পালন করতেন।
স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক ট্রাজেডির পর ৬ নভেম্বর পর্যন্ত টালমাটাল পরিস্থিতি এবং ৩ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ কর্তৃক বন্দী হওয়া এবং ঐতিহাসিক ৭ নভেম্বরে সিপাহি-জনতার আরেক অবিস্মরণীয় বিপ্লবে জাতির হাল ধরার প্রতিটি মুহূর্তে জিয়াউর রহমানের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে মহান আল্লাহর ওপর ভরসা। এই ক্রান্তিকালেও জিয়াউর রহমান সিপাহি-জনতার মিলিত আকাঙ্ক্ষার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে দায়িত্ব নিতে একরকম বাধ্য হয়েছিলেন। এ সময় জাতির উদ্দেশে জিয়া যে ভাষণ দিয়েছিলেন তা তিনি শেষ করেন ‘আল্লাহ আমাদের সকলের সহায় হোন’ বলে।
পরবর্তীকালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে জিয়াউর রহমান প্রথম যে ভাষণ দেন তার পুরোটায় দেশপ্রেম, স্বনির্ভর বাংলাদেশ গঠনের স্বপ্ন, বিশ্ব দরবারে জাতি হিসেবে আমাদের মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার প্রত্যয়ের সঙ্গে সেই আল্লাহর ওপর প্রগাঢ় ঈমানের কথা তিনি দৃঢ়চিত্তে ঘোষণা করেন। ১৯৭৭ সালের ২২ এপ্রিল দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত তার সেই ভাষণে বলেন, ‘আল্লাহর ওপর অবিচল ঈমানই আমাদের শক্তি ও সাহস যোগাবে’।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে সুখি-সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশ গড়ার যে ১৯ দফা রূপকল্প তিনি ঘোষণা করেন তাতে ইসলামী মূল্যবোধের ওপর জোর দেন এবং মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বিশেষভাবে জোরদার করার কথা বলেন। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়ে তিনি বলেন, মাদরাসা শিক্ষাকে যুগোপযোগী করে গড়ে তোলা হবে। বক্তব্যটি তিনি শেষ করেন এই বলে—‘পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালা আমাদের চলার পথে নতুন উদ্যম, শক্তি ও সাহস দান করুন।’
১৯৭৭ সালের ৩০ মে জনগণের ম্যান্ডেট নিতে গণভোট দেন জিয়াউর রহমান। সেই সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ গণভোটে প্রেসিডেন্ট জিয়ার কর্মসূচির প্রতি পূর্ণ আস্থা প্রকাশ করে দেশবাসী। গণভোটের ফলাফলের পর প্রতিক্রিয়ায় জিয়াউর রহমান একটি সচেতন, কর্মনিষ্ঠ, স্বাবলম্বী ও শক্তিশালী জাতি হিসেবে বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে সুপ্রতিষ্ঠিত করার অঙ্গীকার ঘোষণা করে বলেন, ‘আল্লাহর কাছে দোয়া করি তিনি আমাদের এই কর্মসূচির সার্থক রূপায়ণের তওফিক দিন’। একই বছর ১৪ অক্টোবর জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে জিয়াউর রহমান বলেন, ‘আমি আল্লাহ তায়ালার কাছে মোনাজাত করি, তিনি যেন জাতির এ ঐক্য, সংহতি ও দৃঢ় মনোবল অটুট রাখেন এবং তাঁর অসীম রহমতে দেশকে অগ্রগতি ও গণতন্ত্রের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছার তৌফিক দেন’।
বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ইস্পাতকঠিন গণঐক্য, জনগণভিত্তিক রাজনীতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি গঠনের যে ঘোষণা দেন তাতেও ধর্মীয় মূল্যবোধের বিষয়টি প্রাধান্য দিয়েছেন তিনি। ঘোষণায় তিনি বলেন, ‘ধর্ম-বিশ্বাস ও ধর্মপ্রিয়তা বাংলাদেশী জাতির এক মহান ও চিরঞ্জীব বৈশিষ্ট্য। নিষ্ঠুর নির্বিবেকী বৈদেশিক ও বিজাতীয় শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে দীর্ঘকালের গণসংগ্রাম বাংলাদেশী জাতীয় সমাজের উদার ধর্মবোধকে স্থিতিশীল ও মহত্তর রূপ দিয়েছে। বাংলাদেশের জনগণের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ইসলাম ধর্মাবলম্বী। এই বাস্তব সত্য, সুষ্ঠু ও উদার বৈশিষ্ট্য জাতীয় জীবনে প্রতিফলিত ও সুস্পষ্টভাবে প্রকাশিত। ইসলামের মহান শিক্ষাকে যথাযথভাবে আত্মস্থ করে তাকে জাতীয় জীবনের মূলে সংহত করতে সক্ষম হওয়ায়, বাংলাদেশী জনগোষ্ঠী সাম্প্রদায়িকতার বিষ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পেরেছে’।
বিএনপি গঠনকালে দলটির প্রতিষ্ঠাতা ধর্মীয় যে দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন, বর্তমান বিএনপির কতজন তা ধারণ করেন সে প্রশ্ন তোলা সম্ভবত অপ্রাসঙ্গিক হবে না।
বিএনপি গঠনের ঘোষণাপত্রের ২৯ নম্বর অনুচ্ছেদে জিয়াউর রহমান আরও সুস্পষ্ট করে বলেন যে, ‘ধর্ম আমাদের ঐতিহ্যের অবিভাজ্য অংশ। বাংলাদেশ বিভিন্ন ধর্মীয় মানুষের আবাসস্থল। ইসলাম এদেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ধর্ম ও জীবন-দর্শন। ইসলাম ধর্মের শিক্ষা যাতে মুসলমানদের জীবনে সম্পূর্ণরূপে প্রতিফলিত হতে পারে সে জন্য আমরা সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাব। অনুরূপভাবে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরাও যাতে নিজ নিজ জীবন বিশ্বাস অনুযায়ী ধর্ম শিক্ষা লাভ করতে পারেন সে জন্য আন্তরিক প্রচেষ্টা চালাব।’
১৯৭৯ সালের অক্টোবর মাসে বিশ্বখ্যাত সংবাদ সাময়িকী ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউর প্রতিনিধি রতনি টাস্কার বাংলাদেশ সফরকালে প্রেসিডেন্ট জিয়ার এক সাড়া জাগানো সাক্ষাত্কার নেন। ওই সাক্ষাত্কারে জিয়াউর রহমান তার ক্ষমতাসীন হওয়া, সামরিক শাসক হওয়া, সংবিধান সংশোধনসহ তার সমালোচকদের বিভিন্ন অভিযোগের খোলামেলা জবাব দেন। রতনি টাস্কার প্রশ্ন করেছিলেন— ইরান ও পাকিস্তানের ইসলামী পুনরুজ্জীবনে রাজনৈতিক-সামাজিক যে প্রভাব দেখা দিয়েছে তাতে বাংলাদেশে কী ধরনের প্রভাব পড়বে। উত্তরে জিয়াউর রহমান সাফ জবাব দেন ‘১৯৭৭ সালে আমরা শাসনতন্ত্র পরিবর্তন করে ইসলামী বিধান সংযোজন করি। আমরা জাতীয় জীবনে ধর্মকে যথাযথ গুরুত্ব দিই। আমাদের জনগণ খুব ধার্মিক। এদেশের ন্যায় এত মসজিদ অন্য কোনো মুসলিম দেশে আছে বলে আমার মনে হয় না। আমরা মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থাকে আধুনিকীকরণ করছি ও পুনর্গঠন করছি। দেশে একটি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হতে যাচ্ছে।’
বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ধর্মীয় মূল্যবোধের যে একটি নিবিড় বন্ধন রয়েছে তা খোলাসা করে বলেছেন প্রেসিডেন্ট জিয়া। ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে শাহাদাত্ বরণের ঠিক দু’মাস আগে ১ এপ্রিল দলীয় সংসদ সদস্যদের এক সভায় দেশ গঠনে জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ব সম্পর্কে দিকনির্দেশনামূলক দীর্ঘ বক্তব্য রাখেন জিয়া। সেখানে তিনি বলেন, ‘যদি কেউ বলে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ ধর্মকে অবলম্বন করে হচ্ছে না তা ভুল হবে। ধর্মবিশ্বাস বা ধর্মের প্রতি অনুরক্ত থাকা বাংলাদেশী জাতির এক মহান ও চিরঞ্জীব বৈশিষ্ট্য।’
একই সভায় জিয়াউর রহমান পরকালীন জীবনের ব্যাপারেও দলীয় এমপিদের সজাগ করেন। তিনি বলেন ‘আমাদের দর্শনের মধ্যে ধর্মীয় দর্শনও অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে। শুধু ইহজগতের কথা ভাবলেই চলবে না পরলোকের কথাও ভাবতে হবে। সুতরাং আমরা মানুষকে যে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের দর্শন দিতে চাচ্ছি তাতে তিন ধরনের খোরাক আছে। ১. ক্ষুণ্নিবৃত্তির জন্য অন্নের সংস্থানের জন্য উত্পাদন বৃদ্ধির আহ্বান। ২. স্বাবলম্বী জীবনযাপনের জন্য অনুপ্রেরণা এবং ৩. পারলৌকিক জগতের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের মাধ্যমে শান্তি অর্জনের প্রচেষ্টা। এ কারণেই আমরা বলছি, ধর্মের এলিমেন্ট যদি রাজনীতিতে না থাকে তবে সেটাও ভুল হবে।’ এ সময় জিয়াউর রহমান ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদের সমালোচনা করে বলেন, সেক্যুলার স্টেট বলে অনেক দেশের পরিচয় দেয়া হয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ ইংল্যান্ডের কথাই ধরা যাক। ’৭৭ সালে গিয়েছিলাম কমনওয়েলথ সিলভার জুবিলি উত্সবে। কথায় কথায় বাইবেল। কোনো কিছুই হয় না বাইবেল ছাড়া। তারা তাহলে সেক্যুলার হলো কোথায়? এরপর আসুন প্রতিবেশী দেশ ভারতের কথায়। সারা দুনিয়ায় সেক্যুলার স্টেট হিসেবে তারা নিজেদের পরিচয় দিচ্ছে। কিন্তু আসলে কি তাই? না, আমার মতে, ভারত সেক্যুলার নয়। একজন ভারতীয় সাংবাদিককে বলেছিলাম এ কথা। বলেছিলাম, ‘ভারতে উঠতে-বসতে চলতে-ফিরতে সব সময় হিন্দু ধর্মমত পালন করা হচ্ছে। অন্য ধর্মাবলম্বীদের যথাযথ মর্যাদা দেয়া হয় না। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় প্রতিবছর হাজার হাজার সংখ্যালঘু মারা যায়। তখন ওই সাংবাদিক ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন।’

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন