মঙ্গলবার, ২৯ মে, ২০১২

জিয়াউর রহমান :এক ব্যতিক্রমী রাষ্ট্রনায়ক



 মো. আনোয়ার হোসেন 
জি য়াউর রহমান। বীর মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার, সেনাবাহিনী প্রধান এবং রাষ্ট্রপতি, গণমানুষের অবিসংবাদিত নেতা। জাতির ক্রান্তিলগ্নে তিনি ধূমকেতুর ন্যায় আবির্ভূত হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি অনেক নেতার মতো অন্ধকারের অতল গহ্বরে হারিয়ে যাননি। এদেশের মানুষের মনের মণিকোঠায় স্থায়ী আসনে অধিষ্ঠিত হয়ে আছেন। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানী বাহিনী যখন নিরীহ বাঙালি হত্যায় লিপ্ত, তখন তার নেতৃত্বে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণা দেন এবং সামনের সারিতে থেকে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। তার কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ স্বাধীনতার পর সরকার তাকে ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত করে।
১৯৭৫-এ ঘটে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন। যার ধারাবাহিকতায় জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের রাজনীতির দৃশ্যপটে আবির্ভূত হন। ১৯৭৬ সালের ১৯ নভেম্বর জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রীয় দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং সংবিধানে সংশোধনী এনে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ সংযোজন করেন। সংবিধানের ৮(১) অনুচ্ছেদে সমাজতন্ত্রকে ‘অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার’রূপে সংজ্ঞায়িত করা হয়। সংবিধানের ২৫ অনুচ্ছেদে যোগ করা হয়-‘ইসলামী সংহতির ভিত্তিতে মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন, সংরক্ষণ ও জোরদার করার প্রয়াস চালাবে।’ জিয়াউর রহমান বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের তত্ত্ব প্রদান করেন এবং জনপ্রিয় করে তোলেন। তিনি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ এবং জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ-সংস্কৃতি নির্বিশেষে সকল নাগরিকের ঐক্য ও সংহতির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণের পর পরই জিয়াউর রহমান দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারে আত্মনিয়োগ করেন ও পুলিশ বাহিনীকে শক্তিশালী করেন। পুলিশের সংখ্যা দ্বিগুণ করে তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যেও পেশাগত শৃঙ্খলা উন্নয়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারে যথেষ্ট সফল হলেও বেশ কয়েকটি সেনা বিদ্রোহ এবং সামরিক অভ্যুত্থান মোকাবেলা করতে হয় তাকে। নির্বাচন ব্যবস্থা পুনর্বহাল ও মুক্ত রাজনীতি চালুর পদক্ষেপ হিসেবে নিষিদ্ধ ঘোষিত রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের কার্যক্রম পুনরুজ্জীবিত করার সুযোগ দেন। একইভাবে, সংবাদপত্রের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন, সংবাদ মাধ্যমে তথ্যের অবাধ প্রবাহ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জিয়াউর রহমান উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে প্রধান করে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) প্রতিষ্ঠা করেন। ছয়টি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গঠিত জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এ নির্বাচনে তিনি ৭৬.৬৭% ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি গঠিত হয়।
বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের উত্সাহ প্রদান এবং কৃষকদের ব্যাপকহারে ভর্তুকি প্রদানের মাধ্যমে কৃষি উন্নয়ন ত্বরান্বিতকরণের উপযোগী একটি নতুন উন্নয়ন কৌশল গ্রহণ করেন। এই নীতির অধীনে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প-কারখানা পূর্বতন মালিকদের নিকট হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করেন। জিয়াউর রহমানের ১৯-দফা কর্মসূচি ছিল সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার দিক নির্দেশনা। দ্বিতীয় কার্যক্রম ছিল সমাজ থেকে নিরক্ষতা দূর করা, যেন প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক উভয় প্রকার শিক্ষায় সর্বত্র আলোকিত পরিবেশ সৃষ্টি হয়। দেড় বছরের মধ্যে দেড় হাজারেরও অধিক খাল খনন ও পুনর্খনন করা হয়। ফলে পর পর দু’বছর খাদ্যশস্যের রেকর্ড পরিমাণ উত্পাদন বেড়ে বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধি হার বৃদ্ধি পায়। গণশিক্ষা কার্যক্রম, গ্রাম সরকারের ব্যবস্থা প্রবর্তন ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠন জনমনে গভীর রেখাপাত করে। জাতীয়তাবাদী আশা-আকাঙ্ক্ষা পুনরুজ্জীবিত করে দেশের অভ্যন্তরীণ পুনর্গঠন ব্যবস্থা শুরু করেন। অতঃপর আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিযোগী শক্তিসমূহের মধ্যে ভারসাম্য ও স্থিতিশীল সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগ নেন। পররাষ্ট্রনীতির উদ্দেশ্যসমূহ পুনর্নিধারণ করে আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে গতিশীল করার উদ্যোগ নেন। তিনি বাংলার মানুষকে খাঁটি বাংলাদেশি হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। ১৯৭৭ সালের জানুয়ারি মাসে জিয়াউর রহমান গ্রামের পর গ্রাম পায়ে হেঁটে জনসংযোগ শুরু করেন। এ দেশের কোন রাষ্ট্রপ্রধান, রাষ্ট্রনায়ক বা রাজনীতিবিদদের এমনিভাবে মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে সফর নজিরবিহীন। এর উদ্দেশ্য ছিলো-জনগণের সঙ্গে সরকারের আরো ঘনিষ্ঠ সংযোগ স্থাপন ও সমন্বয় সাধনের পথ খুঁজে বের করা। তিনি যখন এসব সফরে যেতেন সরকারি কোষাগার থেকে কোন ভাতা নিতেন না। দেশে ব্যাপকভাবে গম চাষের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়া। তিনি ‘চল চল গ্রামে চল’ শ্লোগানকে জনপ্রিয় করে তোলেন। নিজের হাতে কোদাল দিয়ে স্বেচ্ছাশ্রমে খাল খনন আর সড়ক নির্মাণের কাজে শরিক হওয়ার যে দৃষ্টান্ত তিনি রেখে গেছেন তা এদেশে অভূতপূর্ব।
জিয়াউর রহমান ছিলেন একজন ব্যতিক্রমী রাষ্ট্রনায়ক। তার চিন্তা, কর্ম এবং জীবন যাপন পদ্ধতি এ সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। গভীর দেশপ্রেমের ফলেই তার মধ্যে জাতীয়তাবাদী চিন্তা-চেতনার জাগরণ ঘটে। বাইরে খুব ফিটফাট পোশাকে থাকতেন প্রেসিডেন্ট জিয়া। কিন্তু ঘরের জিয়া, অন্দরের নিজস্ব ভবনের জিয়া অনেকবার রিপু করা, তালি দেয়া হালকা প্রিন্টের পাজামা, ঢিলে শার্ট, বার বার সেলাই-তালির অত্যাচারে জর্জরিত শার্টটির পিঠের ডানদিকে চটের মত ভারী হয়ে গেছে, তার পরেও তিনি তা ব্যবহার করতেন।
চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে হত্যাকাণ্ডের রাতে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত যেসব জিনিসপত্র ছিলো তার মধ্যে একটি পুরনো চামড়ার সুটকেস। সুটকেসটি এতোই পুরনো ছিল যে, তালাও ঠিকভাবে কাজ করতো না। একটি পুরনো অতি সাধারণ টু-ইন-ওয়ান, তালাবদ্ধ একটি পুরনো ‘ইকোলাক’ জাতীয় ব্রিফকেস, গায়ের আধছেঁড়া গেঞ্জি, ২/৩টি সাফারি সার্ট, একটি প্যান্ট, একটি ফাউন্টেন পেন, একটি সানগ্লাস। শহীদের মাথার কাছে পড়েছিল কয়েকটি ক্যাসেট, তার বিছানার পাশেই পড়েছিলো জায়নামাজ ও সাদা গোল টুপি। পৃথিবীর বহু দেশে রাষ্ট্রীয় সফরে গেছেন প্রেসিডেন্ট জিয়া। প্রচলিত রীতি-রেওয়াজ অনুযায়ী ওইসব দেশ থেকে প্রীতি-শুভেচ্ছা-সৌজন্যের নিদর্শন হিসেবে তিনি বহু উপহার পেয়েছেন। এর মধ্যে অনেকগুলো ছিল বেশ দামী। এরকম উপহার এ দেশের অতীতের রাষ্ট্রপ্রধান ও মন্ত্রীরাও পেয়েছেন। কিন্তু একটি তফাত্ ছিলো জিয়ার সঙ্গে তাদের। ব্যক্তিগতভাবে দেয়া উপহার তিনি নিজে নেননি। সব জমা দিয়েছেন বঙ্গভবনের তোষাখানায়। ‘ইরানের সম্রাজ্ঞী ফারাহ দীবা বেগম খালেদা জিয়াকে ব্যক্তিগত উপহার হিসেবে ফিরোজা পাথর বসানো একটি আংটি উপহার দিয়েছিলেন। সেই আংটিও জমা রয়েছে তোষাখানায়। প্রত্যেকটি ‘ইনভেন্টরী’ রক্ষিত আছে বঙ্গভবনে। রাষ্ট্রপতি হিসেবে পরিবারের খাদ্য বিনামূল্যে পাওয়ার অধিকার তার ছিলো, কিন্তু তিনি কোনদিন তা গ্রহণ করেননি। তিনি নিজে যখন বঙ্গভবনে খেতেন, তখন এমন সাধারণ খাবার খেতেন অনেকের সেরকম খাবার খেতে ভালো লাগতো না। প্রেসিডেন্ট জিয়ার “অফিসিয়াল জীবনধারা” সারাদিন রাতের প্রায় সবটুকু জুড়েই তিনি কাজ করেছেন।
জিয়া নিজেই ছিলেন একটি ‘ইনিস্টিটিউশন’। ১৯৮১-এর ৩০মে, রাতের শেষলগ্নে ঘাতকের নিষ্ঠুর হাত এদেশের কোটি কোটি মানুষের প্রিয় প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে তাদের কাছ থেকে চিরতরে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। হঠাত্ শোকসমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গশিখরে আমরা দেখলাম তার সমুজ্জ্বল বিদায় অভিষেক। বাংলার মানুষ ও মাটি মহান নেতার কথা চিরকাল মনে রাখবে।
লেখক :ইতিহাস গবেষক, চেয়ারম্যান,
ঐতিহ্য ফাউন্ডেশন

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন