সোমবার, ২৮ মে, ২০১২

কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা ও আওয়ামী লীগের ডিগবাজি



মো. নূরুল আমিন
স্বাধীনতা উত্তরকালে বিশেষ করে নববই-এর দশকের শুরুতে স্বৈরাচারের পতন এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের পর থেকে বিগত দুই দশকেরও অধিক সময় ধরে যে ইস্যুটি বাংলাদেশের মানুষকে সবচেয়ে বেশি পীড়া দিয়ে এসেছে তা হচ্ছে নির্বাচন পদ্ধতি, সরকার গঠনের জন্য কিভাবে, কার অধীনে জনগণ তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করবেন।
১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে সর্বপ্রথম জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের আমলে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এর আগে ১৯৭০ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের সামরিক শাসক ও প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডারের আওতায় নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের আওয়ামী লীগ সদস্যরা বাংলাদেশ আইন পরিষদের সদস্য হিসেবে কাজ করেন এবং সংবিধান প্রণয়নের কাজ সম্পন্ন করেন। বলাবাহুল্য, আইনসভার গণপরিষদে ১৯৭২ সালের ১৪ ডিসেম্বর সংবিধান গৃহীত ও সত্যায়িত হবার পর এই সংবিধান মোতাবেকই ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচন যেমন অবাধ হয়নি তেমনি সুষ্ঠুও হয়নি। জাতীয় লীগ প্রধান প্রবীণ রাজনীতিবিদ অলি আহাদের ভাষায়, ‘এই সাধারণ নির্বাচনে প্রশাসনিক ক্ষমতার মারাত্মক অপব্যবহার' চরম দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ, মিডিয়া ক্যু, দলীয় বাহিনীর যথেচ্ছ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার ও ঢালাও হুমকির সহায়তায় প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৯৩টি আসন দখল করেন। ফলাফলে জঘন্য কারসাজি ও কারচুপি, মিডিয়া ক্যু, ব্যালট বাক্স এমনকি প্রিজাইডিং অফিসারদের ছিনতাই, অপহরণ ছিল এই নির্বাচনের প্রধান বৈশিষ্ট্য। প্রতিদ্বনদ্বী রাজনৈতিক কণ্ঠকে স্তব্ধ করার সরকারি তৎপরতা ছিল ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন, জেল-জুলুম এবং সরকারি দলের নেতাকর্মীদের দুর্নীতি, লুণ্ঠন ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, মানবাধিকার এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে দেশবাসী জীবন ও রক্ত দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের আচরণ এবং প্রথম নির্বাচনে সেই গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের দুর্দশা দেখে মানুষ হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং দলটির উপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়। বিষয়টি অাঁচ করতে পেরে পরবর্তী নির্বাচনে ব্যাপক ভরাডুবির লাঞ্ছনা থেকে মুক্তি পাওয়া ও ক্ষমতার মসনদ টিকিয়ে রাখার জন্য ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে এসে আওয়ামী লীগ দেশের সকল রাজনৈতিক দল ও চারটি দলীয় ও সরকারি পত্রিকা ছাড়া সকল পত্র-পত্রিকা বেআইনি ঘোষণা করে একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠা করে এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে আজীবন রাষ্ট্রপতি এবং বিদ্যমান জাতীয় সংসদকে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী অনুযায়ী ঐ বছরের ২৫ জানুয়ারি থেকে ৫ বছরের বৈধতা দিয়ে অতিরিক্ত দুই বছরের মেয়াদ প্রদান করা হয়। এটা ছিল ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য আওয়ামী লীগের স্বৈরাচারী প্রয়াসের একটি অংশ, গণতন্ত্র প্রয়াসী লাখ লাখ শহীদের লাশের প্রতি ছিল এটি একটি অবমাননা। এই অবস্থায় আওয়ামী লীগেরই কিছুসংখ্যক শীর্ষ নেতার প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এক সেনা অভ্যুত্থানে শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন এবং জেনারেল জিয়াউর রহমানের আমলে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনর্বহাল হয় এবং মানুষ তাদের মৌলিক অধিকার ফেরত পায়। জেনারেল জিয়ার আমলে অনুষ্ঠিত সংসদ ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহের নির্বাচনের ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য কোন আপত্তিও উত্থাপিত হয়নি। তবে জেনারেল এরশাদের আমলে অনুষ্ঠিত নির্বাচনসমূহে ব্যাপক কারসাজি, কারচুপি, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, ভুয়া ভোট এবং পেশীশক্তির বলে ভোটকেন্দ্র দখল ও অস্ত্রবাজি পরিলক্ষিত হয়। এই সময় সরকার ও সরকারি দল ব্যাপকভাবে মিডিয়া ক্যুর আশ্রয় নেয়। এমনও দেখা গেছে যে, ক্ষমতাসীন দল সরকারি প্রশাসন ও আইনশৃক্মখলা বাহিনীর পৃষ্ঠপোষকতায় দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীদের ভাড়া করে এনে নির্বাচন কেন্দ্রমুখী সকল রাস্তায় বোমাবাজি ও অস্ত্র প্রদর্শনীর মাধ্যমে ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে আসা এবং ভোটারবিহীন ভোটকেন্দ্রে দলীয় ক্যাডাররা ব্যালট পেপারে সীল মেরে বাক্স ভর্তি করে সরকারি দলের বিশেষ প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণা করেছে। কারচুপি, সন্ত্রাস, নৈরাজ্যের এই নির্বাচন নিয়ে ব্যাপকতা তখন এতই বিস্তৃত হয়ে পড়েছিল যে, বিরোধী দলসমূহ জেনারেল এরশাদের অধীনে কোন প্রকার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায় এবং ঐ পর্যায়ে নির্বাচনকে অবাধ ও নিরপেক্ষ এবং সরকারি প্রভাবমুক্ত করে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার জন্য বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর তরফ থেকে প্রথমবারের মতো কেয়ারটেকার সরকারের ফর্মুলা পেশ করা হয়। এই ফর্মুলাটি পরবর্তীকালে জনপ্রিয় হয়ে উঠে এবং ৯০-এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। জেনারেল এরশাদের পতনের পর প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ১৯৯১ সালে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনটি ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন আন্দোলনের প্রথম সাফল্য। কিন্তু সংবিধান সংশোধন করে এই ব্যবস্থাটিকে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতায় রূপান্তরিত না করায় জটিলতা দেখা দেয় এবং বিএনপি সরকারের অধীনে মাগুরার উপনির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির প্রেক্ষাপটে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠে। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতসহ বিরোধীদলগুলো এই সময় ঐক্যবদ্ধভাবে এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। কেয়ারটেকার ব্যবস্থার মূল প্রবক্তা জামায়াত হলেও আওয়ামী লীগ এই ব্যবস্থাটিকে তার মূল কর্মসূচির অংশ বানিয়ে নেয়। শেখ হাসিনা ও তার দলীয় নেতৃবৃন্দ এর মূল প্রবক্তায় পরিণত হন।
এই আন্দোলনেরই এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমদ ‘‘কেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রয়োজন’’ এই শিরোনামে দৈনিক ভোরের কাগজে একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন। এ নিবন্ধটির প্রথম কিস্তি ২৩/১০/৯৪ এবং শেষ কিস্তি ২৪/১০/৯৪ তারিখে প্রকাশিত হয়েছিল। নিরপেক্ষ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি নিয়ে তিনি  তাদের আন্দোলনের যৌক্তিকতা উল্লেখ করতে গিয়ে বলেছিলেন :
‘‘আজকে যদি দেশ ও জাতির স্বার্থকে সব কিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দিয়ে আমরা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আগামী ৩/৪/৫টা নির্বাচন অনুষ্ঠানের একটা সাংবিধানিক ভিত্তি দাঁড় করাই তা হলে আমার মনে হয় আমরা একটা সিস্টেমে যেতে পারবো অর্থাৎ আমাদের এই আন্দোলন হচ্ছে সাংবিধানিক একটি ভিত্তি দাঁড় করানোর জন্য। আজকাল যারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসেন তারা দ্বিতীয়বার কিভাবে বিজয়ী হবেন, তৃতীয়বার কিভাবে বিজয়ী হবেন, চতুর্থবার কিভাবে ক্ষমতায় থাকবেন সে লক্ষ্যকে সামনে নিয়ে প্রশাসনকে দলীয়করণ করেন। তারা দলকে দুর্নীতির মধ্যে নিমজ্জিত করেন। দলীয়করণের মাধ্যমে প্রশাসনকে নষ্ট করেন। দলতত্ত্ব কায়েম করতে গিয়ে এমনভাবে দুর্নীতির আশ্রয় নেন, সরকার তখন আর জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে চান না। অথচ সংসদীয় গণতন্ত্রের মূলকথা জবাবদিহিতা। আজকে পার্লামেন্টে আমরা যখন দুর্নীতির প্রশ্ন তুলি, অন্যান্য প্রশ্ন উত্থাপন করি কিন্তু তার কোনও অর্থবহ আলোচনা হয় না। সেখানে কোনও জবাবদিহিতা নেই। কারণ এ সরকার মনে করে আগামী নির্বাচন যেহেতু তাদের অধীনে হবে, সেহেতু বাংলাদেশের মানুষ তাকে প্রশ্ন করবে না ক্ষমতায় গিয়ে ভাল করেছে কি করেনি, ওয়াদা রক্ষা করেছে কি করেনি। কিন্তু কোন সরকার যদি দেখে নির্বাচনের ৯০ দিন আগে একটি নিরপেক্ষ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে তাকে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে তা হলে অবশ্যই সে সরকার জনগণের কল্যাণের জন্য নিজেকে নিয়োজিত করবেন। কারণ তখন সরকার দুর্নীতির আশ্রয় নিতে, নিজের পরিবার-পরিজনকে বিত্তশালী করতে প্রশাসনকে দলীয়করণ করতে ভয় পাবেন এবং এমন কতগুলো কাজ সরকার করবেন যা ভাল কাজ হিসেবে বিবেচিত হবে। যার ফলে জনগণ তাকে ভোট দেবে। এই লক্ষ্যকে সামনে নিয়েই নিরপেক্ষ, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রশ্ন আমরা তুলেছি।’’
কেয়ারটেকার সরকারের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনাও এক ও অভিন্ন মত পোষণ করেছেন। আশির দশকের শেষ ভাগ এবং নববইয়ের দশকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত তিনি এই সরকারের পক্ষে অনুষ্ঠিত সভা-সমাবেশ, সাংবাদিক সম্মেলন সর্বত্র একটি কথাই বলেছেন এবং তা হচ্ছে দলীয় সরকারের অধীনে কখনো নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হতে পারে না। ক্ষমতাসীন দল প্রশাসনকে দলীয়করণ করে সর্বদাই ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টা করে এবং নির্বাচনকে প্রভাবিত করে তার ফলাফল নিজেদের অনুকূলে আনে। তিনি সর্বদা এ কথাই বলেছেন যে, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হলে অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের বিকল্প নাই এবং কেয়ারটেকারের অধীনে ছাড়া নির্বাচন কখনো অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হতে পারে না। তিনি সর্বদা জোর দিয়ে বলেছেন, কেয়ারটেকার সরকারের যেহেতু ক্ষমতায় যাবার অভিলাষ নেই সেহেতু এই ব্যবস্থাই নিরপেক্ষ নির্বাচনের একমাত্র গ্যারান্টি। ১৯৯৪ সালের ১৫ জুন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী এবং আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের জাতীয় দৈনিক ও সংবাদ সংস্থার সম্পাদকদের সাথে এক মতবিনিময় সভায় মিলিত হয়েছিলেন। এতে তার দলীয় নেতাদের মধ্যে জনাব আব্দুল মান্নান, তোফায়েল আহমদ, আমীর হোসেন আমু ও অধ্যাপক আবু সাইয়িদ উপস্থিত ছিলেন। এতে দৈনিক ইত্তেফাক, ইনকিলাব, বাংলার বাণী, বাংলাদেশ অবজারভার, ফাইন্যানসিয়াল এক্সপ্রেস, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা এবং ইউএনবি'র প্রধান সম্পাদক/সম্পাদকরা অংশগ্রহণ করেছিলেন। ১৬-০৬-১৯৯৪ তারিখে দৈনিক ইত্তেফাকের রিপোর্ট অনুযায়ী, মতবিনিময়কালে শেখ হাসিনা বলেছিলেন যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে আমি প্রধানমন্ত্রী হব এই ভয়ে ভীত হবার কিছু নেই। প্রয়োজনে আমি নির্বাচন করবো না। তবুও যতদিন গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ না করবে ততদিন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হওয়া উচিত। তিনি বলেছেন, রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকলে নির্বাচন কমিশন যত শক্তিশালী হোক না কেন তাতে নির্বাচন নিরপেক্ষ হতে পারে না। এরপর গঙ্গা-যমুনায় অনেক পানি গড়িয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পরিচালিত কেয়ারটেকার সরকার আন্দোলন অহিংস থাকেনি। সহিংসতায় রূপ নিয়েছিল। হরতাল, অবরোধ ও অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে সারা দেশকে অচল করে দেয়া হয়েছিল। বন্দর অচল হবার ফলে আমদানি-রফতানি এবং বৈদেশিক বাণিজ্যে স্থবিরতা এসেছিল। যানবাহন তথা বাস, ট্রাক, ট্রেন ও দোকানপাটে অগ্নিসংযোগ হরতাল-অবরোধ ও অসহযোগের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল। এই আন্দোলনে হাজার হাজার কোটি টাকার অর্থনৈতিক ক্ষতি ও সম্পদ হানি ছাড়াও সারাদেশে মোট ৭১ ব্যক্তি প্রাণ হারিয়েছে এবং পুলিশ ও দলীয় সন্ত্রাসীদের হাতে আহত ব্যক্তির সংখ্যা ছিল কয়েক সহস্র। এই সম্পদ ও প্রাণের বিনিময়ে ১৯৯৬ সালে দেশে রাজনৈতিক দলগুলো পারস্পরিক হানাহানি ও হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থাকে সংবিধানে অঙ্গীভূত করে  নেয় এবং এই ব্যবস্থার অধীনে অনুষ্ঠিত তিনটি নির্বাচনের মধ্যে দুটিতে শেখ হাসিনার দল এবং একটিতে বিএনপি ক্ষমতাসীন হয়।
সন্দেহ নেই সর্বশেষ কেয়ারটেকার সরকার ও তার অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনটি ছিল প্রহসনমূলক। সাংবিধানিক বিধান মেনে এই কেয়ারটেকার সরকারটি গঠিত হয়নি এবং তা ছিল এক এগারোর সেনাসমর্থিত কেয়ারটেকার সরকার। এই সরকারকে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা স্বয়ং তার আন্দোলনের ফসল তথা আওয়ামী লীগের ‘সন্তান বলে' ঘোষণা দিয়েছিলেন। এই সন্তানের বদৌলতে এবং প্রতিবেশী দেশের টাকার বস্তা, পৃষ্ঠপোষকতা ও পরামর্শের বলে ক্ষমতায় এসে তিনি কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থাটিকে বাতিল করে সংবিধান সংশোধন করেছেন এবং দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করেছেন। তার দল এবং জোটের জনসমর্থনহীন কয়েকটি রাজনৈতিক দল ছাড়া দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সমর্থনপুষ্ট রাজনৈতিক দলগুলো সরকারের এই পদক্ষেপকে মেনে নেয়নি। তারা বলেছেন যে, নির্দলীয়, নিরপেক্ষ কেয়ারটেকার সরকার ছাড়া দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিতব্য কোন নির্বাচনে তারা যাবেন না এবং নির্বাচন হতেও দিবেন না। মহাজোট সরকারের অত্যাচারে অতিষ্ঠ দেশবাসী এখন তাদের পেছনে রয়েছে। আওয়ামী লীগ প্রধান কেয়ারটেকার সরকার বাতিল করার পেছনে যে যুক্তি প্রদর্শন করছেন তা হচ্ছে এই ব্যবস্থাকে বেআইনী ঘোষণা করে প্রদত্ত উচ্চ আদালতের রায়। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে এই যে, যে রায়কে অজুহাত বানিয়ে এই ব্যবস্থাটিকে বাতিল করা হয়েছে সেই রায়টি অদ্যাবধি লিখিত ও স্বাক্ষরিত হয়নি। রায়ের যে সারাংশ আদালতের তরফ থেকে পড়ে শোনানো হয়েছিল তার দুটি অংশ ছিল। প্রথম অংশে বলা হয়েছিল যে, কেয়ারটেকার সরকারের ধারণা গণতান্ত্রিক নীতিমালার পরিপন্থী এবং এই প্রেক্ষিতে তা বাতিলযোগ্য। দ্বিতীয় অংশে বলা হয়েছিল বিদ্যমান অবস্থায় আরো দুটি জাতীয় নির্বাচন এই ব্যবস্থার অধীনে হতে পারে। সরকার রায়ের লিখিত কপির অপেক্ষা না করে সংক্ষিপ্ত ও মৌখিক রায়ের প্রথমাংশ গ্রহণ করে তাড়াহুড়া করে কেয়ারটেকার ব্যবস্থা বাতিল করায় জনগণের মধ্যে এই ধারণা জন্মেছে যে, সরকারের এই পদক্ষেপটি ছিলো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এবং তারা ক্ষমতায় এসে চিরদিন ক্ষমতায় থাকার ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করার জন্য এ ধরনের একটি সুযোগের জন্য ওঁৎ পেতে ছিলেন। এই সুযোগটি কিভাবে এসেছে সে সম্পর্কেও নানা প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে। দৈনিক ডেইলী স্টার পত্রিকার একটি রিপোর্টের বরাত দিয়ে মার্কিন স্টেট ডিপার্টম্যান্ট থেকে সম্প্রতি প্রকাশিত মানবাধিকার বিষয়ক এক রিপোর্টে বিচারবিভাগ দলীয়করণের একটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে যে, কেয়ারটেকার ব্যবস্থা বাতিল ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে উচ্চ আদালতের রায় প্রকাশিত হবার অব্যবহিত পূর্বে সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে দশ লাখ সাঁইত্রিশ হাজার টাকার একটি তহবিল গ্রহণ করেছিলেন। রিপোর্ট অনুযায়ী জনাব হকের সাথে হাইকোর্টের আরো কয়েকজন বিচারপতিও অনুরূপ তহবিল গ্রহণ করেছেন। তাদের এই তহবিল গ্রহণের সাথে রুলিং ও রায় দেয়ার বিষয়টি সম্পৃক্ত ছিল যা সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীকে সহজতর করেছে বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। আবার এও জানা গেছে যে, যে সম্প্রসারিত বেঞ্চে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার উপর মামলাটি নিত্তি হয়েছে সে বেঞ্চের সদস্য বিচারপতিরা ঐকমত্যের ভিত্তিতে রায় দেননি। বাতিলের পক্ষে এবং বিপক্ষে সমানসংখ্যক বিচারপতি থাকায় সভাপতিত্বকারী বিচারপতি তথা মাননীয় প্রধান বিচারপতি কাস্টিং ভোট দিয়ে রায়টিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে পরিণত করেছেন। তবে রায়টি যেহেতু এখনো পর্যন্ত লিখিত আকারে পাওয়া যায়নি সেহেতু বিস্তারিত জানার জন্য দেশবাসীকে আরো অপেক্ষা করতে হবে বলে মনে হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কেয়ারটেকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের বিরোধী দলীয় দাবি সম্পূর্ণভাবে এখন প্রত্যাখ্যান করছেন। এই ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য অতীতে তিনি কি বলেছেন, কি করেছেন সম্ভবত তিনি এখন তার সবকিছুই ভুলে গেছেন। যেমন তার সরকার ভুলে গেছেন ২০০৮ সালের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলোও। তিনি কয়েকদিন আগে আবারো জোর দিয়ে বলেছেন যে, আগামী সংসদ নির্বাচন আওয়ামী লীগের দলীয় সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠিত হবে। এবং বলেছেন যে, নির্বাচন কমিশন হবে সম্পূর্ণভাবে স্বাধীন এবং প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহ এই কমিশনের অধীনেই ন্যস্ত থাকবে। তার বর্তমান যুক্তির সাথে অতীতের অবস্থান ও যুক্তির কোন মিল নেই। তিনি বিগত কেয়ারটেকার সরকারকে ডেমন (Demon) বা অসুর বলে আখ্যায়িত করেছেন। কিন্তু এই অসুর যে তাদেরই আন্দোলনের ফসল এবং তাদেরই সন্তান এ কথাটি কি বারবার তারা ঘোষণা করেননি? আবার আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান মহাজোট সরকার বর্তমানে যে শাসন কায়েম করেছেন তাতো ১/১১'র সেনা সমর্থিত Demon সরকারের ধারাবাহিকতা মাত্র।  এই সরকারের সাথে Democracy বা গণতন্ত্রের কোনো সম্পর্ক নেই। এইটাকে দেশের মানুষ Demoncracy বলেই জানে যা অসুরতন্ত্রের ইংরেজি প্রতিশব্দ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে যারা অসুরের জন্মদাতা বা জন্মদাত্রী তাদের কি বলা হবে? দেশবাসী বিষয়টি বিবেচনা করে দেখতে পারেন। ১/১১'র কেয়ারটেকার সরকার আওয়ামী লীগের সন্তান হলেও প্রধানমন্ত্রী তাকে চক্ষুশূল মনে করেন এ জন্যই যে, এই সরকারই তাকে এবং অন্য রাজনীতিবিদদের গ্রেফতার করে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে বিচারের আওতায় আনতে চেয়েছিলেন। ঐ সরকার তাকে দেশের নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক আখ্যায়িত করে প্রেসনোট জারি করেছিল। যদিও অজ্ঞাত কারণে পরে তা প্রত্যাহার করা হয়েছিল। এই সরকারই আবার তাকে এবং বিএনপি নেত্রী বেগম জিয়াকে দেশান্তরী করতে চেয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন যে, রাস্তায় রাজনৈতিক প্রতিদ্বনদ্বীদের সাপের মতো পিটিয়ে হত্যা করা, বাস-ট্রেন, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট, হরতাল, অবরোধ ও অসহযোগের নামে দেশব্যাপী নৈরাজ্য সৃষ্টি এবং প্রেসিডেন্ট ভবনে প্রাত্যহিক বাজার ও অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া প্রভৃতি খুব ভালো কাজ ছিল না। এই কাজগুলো তার দল করেছে এবং এজন্য তারা কেউই অনুতপ্ত হননি। দলীয় নেতা-কর্মীদের বিচারের সম্মুখীনও করা হয়নি। এখন যখন হরতালে অদৃশ্য শক্তির ইঙ্গিতে দু'একটি গাড়ি জ্বলে কিংবা ককটেল নিক্ষিপ্ত হয় তখন অগ্নিসংযোগ ও নৈরাজ্য সৃষ্টির পিতা আওয়ামী লীগের দলীয় সরকার বিরোধী দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করে জেলে পুরেন। তখন সম্ভবত তাদের কিছুটা হলেও বিবেকের দংশন অনুভব করা প্রয়োজন। যে কাজ আমার জন্য বৈধ, সে কাজ অন্যের জন্য অবৈধ হতে পারে না। যদি অবৈধ হতে হয় তা সকলের জন্যই অবৈধ হতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী কেয়ারটেকার সরকারকে অসুর আখ্যায়িত করা ছাড়াও এ সরকার কর্তৃক ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ তুলেছেন এবং বলেছেন যে, এর প্রেক্ষিতে কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন কাম্য নয়। তিনি ২০০১ সালে বিচারপতি লতিফুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত কেয়ারটেকার সরকারের তীব্র সমালোচনা করেছেন। বলেছেন যে, এই সরকার ক্ষমতায় এসে রাতারাতি ১৩ জন সচিবকে চাকরিচ্যুত করেছেন। চাকরিচ্যুতির অভিযোগটি আসলে সত্য নয়। বিচারপতি লতিফুর রহমান দায়িত্ব গ্রহণ করে নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে ১৩ জন সচিবকে বদলি করেছিলেন যাদের পূর্ববর্তী সরকার তথা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে প্রভাব খাটিয়ে নির্বাচনী ফলাফল হারভেস্ট করার পরিকল্পনা করেছিলেন। শুধু ১৩ জন সচিব নয়, তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার দলীয় আনুগত্যের বিষয়টি বিবেচনা করে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে শুরু করে উপজেলা, জেলা, বিভাগ, মন্ত্রণালয় এবং দপ্তর-অধিদফতরসমূহে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পোস্টিং দিয়ে এমন একটি আবহের সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন যাতে নির্বাচনকে প্রভাবিত করে সহজে তারা জিততে পারেন। কিন্তু বিচারপতি লতিফুর রহমানের নেতৃত্বাধীন কেয়ারটেকার সরকার আওয়ামী লীগের এই জালটি ছিঁড়ে ফেলায় তারা দলটির শত্রুতে পরিণত হন। এখানে শুধু ১৩ সচিবের বদলির বিষয়টি ছিল না। তাদের বদলি করার প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগপন্থী আরো চারজন চুক্তিভিত্তিক সচিব প্রধান উপদেষ্টাকে ডিঙ্গিয়ে প্রোটকল ভেঙ্গে প্রেসিডেন্টের কাছেও ধরনা দিয়েছিলেন এবং এই চারজনের সকলেই ছিলেন আওয়ামী লীগে সক্রিয়। একজন এখনো বর্তমান সরকারের উপদেষ্টা  (ড. মশিউর রহমান) হিসেবে কাজ করছেন। কাজেই চিহ্নিত দলীয় লোকদের সরিয়ে বিচারপতি লতিফুর রহমান নিরপেক্ষ কর্মকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে নির্বাচনকে নিরপেক্ষ করার যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন তাতে কোন অন্যায় বা পক্ষপাতিত্ব ছিল না। কোন বিশেষ দলকে বিশেষ সুবিধা না দিয়ে সকল দলকে সমান সুযোগ দেয়া, কেয়ারটেকার দর্শনের এটিইতো মূলকথা। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অনির্বাচিত সরকারের স্থান নেই। কেয়ারটেকার আন্দোলনের সময় তিনি নিজেই এর জবাব দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন যে, এটি ৯০ দিনের একটি সাময়িক ব্যবস্থামাত্র এবং গণতন্ত্রকে সুসংহত করার জন্য এটা প্রয়োজন। এখন তিনি তার বিপরীত কথা বলছেন। তার সরকারে অনির্বাচিত মন্ত্রী এবং উপদেষ্টা আছেন যারা নির্বাচিত মন্ত্রীদের চেয়ে বেশি প্রভাবশালী। আবার স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহের বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তিনি দলীয় লোকদের চেয়ারম্যান ও নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্ব দিয়ে রেখেছেন। উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদের গত তিন বছর ধরে কাজ করতে দেয়া হচ্ছে না। তারা নির্বাচিত প্রতিনিধি। জেলা পরিষদে অনির্বাচিত আওয়ামী লীগ নেতারাই এখন চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। সরকারের কাছে এর জবাব কি? তারা গোটা প্রশাসন, আইন-শৃক্মখলা বাহিনী, বিচার বিভাগ- শিক্ষা বিভাগ, সর্বত্র দলীয়করণের যে জাল বিস্তৃত করে রেখেছেন, তাতে আগামী নির্বাচন নিরপেক্ষ হতে পারে না। দেশে যে সংঘাত, সংঘর্ষের পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে তা থেকে উদ্ধারের জন্য কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থার বিকল্প আর কিছু থাকতে পারে বলে আমি মনে করি না। আর যদি সরকার অব্যাহতভাবে গণদাবি প্রত্যাখ্যান করতে থাকেন তাহলে দেশের মানুষ আওয়ামী লীগের প্রতারণা থেকে মুক্ত হবার পথ অবশ্যই বেছে নেবেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন