কামাল ইয়াসীন :
দফতরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত-সৌমেন কীর্তনের ঢোলের বাদ্য বৃন্দাবন পর্যন্ত পৌঁছাতে দিলো না সরকার। ‘ইলিয়াস-গুম' নাটকের সুটিং করতে গিয়ে পিতা-পুত্র তীর্থস্থানে পৌঁছুতে পারলেন না। বিএনপি'র কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলীকে উদ্ধার করার উদ্দেশ্যে হরতাল পালন করতে গিয়ে বিরোধী দল মামলায় জড়িয়ে পড়েছে। এই মামলাকে কেন্দ্র করেই আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুবুল আলম হানিফ তাচ্ছিল্যের সাথেই মন্তব্য ছুঁড়ে দিয়েছেন ‘এক মামলাতে বিএনপি ঠান্ডা'। আওয়ামী লীগের সুরঞ্জিত-সৌমেন আন্দোলন ডিলিট করতে গিয়ে ‘ইলিয়াস আলী গুম' আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। ওদিকে ইলিয়াস আলী গুম আন্দোলন ক্রমশ শিথিল হয়ে আসছে। সরকারি দমন-পীড়নের নয়া কৌশলের শিকার দেশের মানুষ। বিরোধী দল তথা জনসাধারণকে কোণঠাসা করতে গিয়ে সরকারি দল নিত্য-নতুন অভিনব কায়দার জন্ম দিচ্ছে। দেশের মানুষ কোনদিকে যাবে, কোন পথ বেছে নেবে তা জনতাকে ঠাহর করার কোন সুযোগই দিচ্ছে না সরকারের দল আওয়ামী লীগ। প্রায় প্রতিদিনই নতুন নতুন আতঙ্কিত ইস্যু তৈরী হচ্ছে।
ওদিকে সরকারের শাসন ব্যবস্থার ভারসাম্যতা সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে সরকার আত্মস্বীকৃত ক্রিমিনালে পরিণত হয়েছে। তাই তো যোগাযোগ ও রেল মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের নিজ স্বীকারোক্তিতেই বলেছেন- ‘সুইপার, মালী নিয়োগেও এখন ঘুষ দিতে হয়, দুর্ভাগ্য'। তবে দুর্ভাগ্য কার তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মন্ত্রী উল্লেখ করে বলেন ‘এটা দেশের জন্য দুর্ভাগ্য'। কিন্তু চাকরির প্রত্যাশায় সুদের উপর টাকা নিয়ে চাকরি নিতে গিয়ে হতভাগা চাকরিপ্রার্থীরা যে দুর্ভাগ্যের শিকার হয়ে আতঙ্কে রয়েছেন তা মন্ত্রী মহোদয় উল্লেখ করেননি। যখন সংবাদপত্রে পড়তে হয়, ‘রেলওয়ের চাকরির আশায় সুদে টাকা নিয়ে ঘুষ দিয়েছি'... আতঙ্কে শতশত প্রার্থী'। আবার অন্য শিরোনামে যখন বেহায়ার মত অগত্যা পড়তে হয় ‘রেলওয়ের ১৬৭৪ পদে প্রার্থীরা লাখ লাখ টাকা দিয়ে বিপাকে', ‘স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের (এলজিইডি) প্রধান প্রকৌশলী ও চার প্রকল্প পরিচালকসহ ১৮ জন প্রকৌশলীর দুর্নীতির তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন'সহ দুর্নীতিবাজদের দুর্নীতির নানা খবর আর ওদের খপ্পরে পড়ে চাকরি প্রত্যাশী এবং সেবা নিতে আশা সেবা প্রার্থীদের এমন সংবাদে আর বিচলিত হই না। শুধু আমি কেন আমার মত অনেকেই আজ আর বিচলিত হন না। কারণ দুর্নীতি, দুর্নীতিবাজ ও ওদের লালসার শিকারে এমন নোংরা সংবাদ প্রায় প্রতিদিনই আমাদের পাঠকদের গলধঃকরণ করতে হয়। ওই সংবাদগুলো আমাদের প্রতিদিনের পাঠ যেন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। অর্থাৎ সংবাদপত্র পড়তে হলে ওগুলো পড়তেই হবে।
বগুড়া জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার ভূমি অফিসের নামজারী পদের কর্মচারী শহিদুল ইসলামকে ঘুষসহ হাতেনাতে আটক করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন। সংবাদটি পড়ে ভেবেছিলাম, সম্ভবত সরষের মধ্যে থেকে ভূত বেরিয়ে গেছে। ওই একই দিনে আবার যখন একই পত্রিকায় পড়তে হয় ‘দুর্নীতির তদন্তের চাকা থামিয়ে দিতে আওয়ামী সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রীরা চাপ অব্যাহত রেখেছেন অথবা রেলের অর্থ কেলেঙ্কারীর ঘটনা তদন্ত না প্রহসন? তখন আবার আগের মতই মনে হয় সরষের মধ্যে ভূত ঢুকেনি বরং ভূতের মধ্যে আরেক ভূত ঢুকেছে।
সংবাদপত্রে দুর্নীতি বিষয়ক এবং সরকারের অনভিপ্রেত সংবাদ এতটাই ছাপা হচ্ছে যে, তা সরকারের গলা অবধি পৌঁছে গেছে। সমস্যা নিরসনের তো বালাই নেই। যখনি একটা সমস্যা চরম আকার ধারণ করতে যাচ্ছে বা বিশেষ কোন ব্যধিতে সরকার আক্রান্ত হচ্ছে বা সরকার পতনের অবশ্যম্ভাবী উপাদানগুলো এসে গেছে তখন তা নিরসন না করে বরং কৌশলে অন্য একটি ঘটনার কৃত্রিম জন্ম দিয়ে গণদৃষ্টির পরিবর্তন ঘটাতে ভিন্নখাতে স্লেলাগান চালু করে আগের সমস্যা পাবলিককে ভুলিয়ে দেয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ক্ষমতাসীন দল। দফতরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত রেলমন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে তাকে নিয়ে ও তার ছেলে সৌমেনকে নিয়ে দুর্নীতির যে ঢোল বেজে উঠেছিল, তাতে শীর্ষ আওয়ামী লীগাররা জেনেই গিয়েছিলেন গর্ভের সন্তান গর্ভেই নষ্ট হয়ে যাবে, ভূমিষ্ট হতে পারবে না অর্থাৎ অন্যান্য দুর্নীতি, খুন, গুম, চুরি, ডাকাতি, অবিচার-ব্যাভিচার দূরের কথা সুরঞ্জিত সৌমেন পিতা-পুত্রদ্বয়ের কীর্তনই মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই সরকারের পতন ঘটিয়ে ছাড়বে। আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল সাংবাদিকদের প্রকাশ্যে বলেছেন, ‘সুরঞ্জিতের ঘটনায় সভ্য সমাজে যাওয়া যায় না'। কিন্তু আব্দুল জলিল নয়, গুপ্ত সাহেবদের নিজ দল নিজ সরকার এমন কী নিজ জন্মভূমি সুনামগঞ্জ থেকেও ওই গলিত পদার্থকে সরানোর প্রস্তাব আসছিল। ঠিক এমন সময়ে সরকার সুরঞ্জিত-সৌমেন স্লোগানের পরিবর্তন এনে পাবলিকের মুখে-মুখে সেট করে দিলেন ‘ইলিয়াস গুম' নামের নতুন আইটেম। জনসাধরণ বর্তমানে সরকারের দেয়া ওই ঢাকই পেটাচ্ছেন। মাঝখানে সুরঞ্জিতের দফতরবীহিন মন্ত্রিত্বে আর কেউ হস্তক্ষেপ করার সুযোগই পেলেন না। বেঁচে গেলেন দুর্নীতিবাজ সৌভাগ্যবান পিতা-পুত্র।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) অনেক আগে থেকেই তাদের নিজস্ব টিআইবি ব্যানার থেকে বলে আসছে দুর্নীতিতে বাংলাদেশ শীর্ষস্থান দখল করে নিয়েছে। অবশ্য ওই কথা বলতে গিয়ে টিআইবি'কে অনেক গঞ্জনা শুনতে হয়েছে। উপরন্তু সরকার তার প্রকাশিত তথ্যসমূহকে বেঠিক, অসত্য, মনগড়া আখ্যা দিয়ে তাকে অকার্যকর করার চেষ্টা করেছে বারবার। যা আজ অবধি অভিন্নভাবেই অগ্রসর হচ্ছে। বাংলাদেশের জনসাধারণ টিআইবি'র এমন তথ্য প্রকাশকে অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়ে আসছে, কারণ এটি একটি বাস্তবভিত্তিক প্রকাশনা। তাই ভুক্তভোগী মানুষেরা মনে-প্রাণে ট্রান্সপারেন্সি'কে সাদরে মানসিকভাবে গ্রহণ করেছে। সরকার যেখান থেকে, যেভাবে, যেমন করেই কথা বলুক না কেন বাস্তব উদ্ভূত পরিস্থিতিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। ওদিকে গুমের ঘটনা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাষ্ট্রের এই ভয়ঙ্ককর ‘গুম' পদ্ধতিতে প্রভাবিত হয়ে দেশের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসী চক্রান্তবাজরা এই সংস্কৃতিকে গ্রহণ করলে পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াবে, সরকার সেটা ভাবছে না কেন? অপহরণ বা গুমের ঘটনায় সরকারের আইন-শৃংখলা বাহিনী জড়িত মর্মে অনেকেই সন্দেহ পোষণ করছেন। যদি তাই হয় তাহলে স্বয়ং সরকারই দেশের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টি করছে। সেই ক্ষেত্রে সরকার একজন দাগী ভয়ংকর চিহ্নিত সন্ত্রাসী ভূমিকা পালন করছে। সামাজিক অস্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক বিপর্যয়, রাজনৈতিক উত্তাপ, যুদ্ধাপরাধ ইস্যুগুলোকে অবলম্বন করে শত্রু বিনাশ তৎপরতায় বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এতটায় লিপ্ত হয়ে পড়েছে যে, এখানে দেশি-বিদেশী কোন নাগরিকই নিরাপদ নন। যে কোন মুহূর্তে যে কোন মানুষ অপহরণ বা গুমের শিকার হতে পারেন।
রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থার দিকে লক্ষ্য রেখেই সৌদি দূতাবাস ও যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দূতাবাস তাদের নিজ-নিজ নাগরিকদের চলাচলের ক্ষেত্রে সতর্কতার পরামর্শ দিয়েছে। উল্লেখ্য, সৌদি দূতাবাসে কর্মরত সৌদি নাগরিক খালাফ-আল-আলী হত্যাকান্ডের পরপরই বাংলাদেশে অবস্থিত বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দূতাবাসগুলো তাদের নিজস্ব নিরাপত্তার ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তায় ভুগছে। তার উপর অহরহ দেশী মানুষের গুম অপহরণে বিদেশীরা যারা বাংলাদেশে অবস্থান করছেন, তারা সঙ্গত কারণেই উৎকণ্ঠিত ! সমূহ বিপদের আশংকা দেখা দিতে পারে বিধায় বিশ্ব ব্যাংক, এডিবি, আইডিবি, জায়কাসহ অন্যরাও তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাবধানে চলাচলের পরামর্শ দিয়েছেন। সেই সাথে বিনিয়োগ কারীরাও স্বত:স্ফূর্তভাবে নিজেদের হাত গুটিয়ে নিচ্ছেন।
যে কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, দেশি হোক অথবা বিদেশী নাগরিক হোক, সাবধানে চলাচল করতে হবে কেন? দেশে কী যুদ্ধবিগ্রহ চলছে? নাকি দেশের মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে, না বাংলাদেশকে অন্য দেশ আক্রমণ করেছে(?) না নিজেরা আক্রান্ত হয়েছে? দেশের অভ্যন্তরে খানা-খন্দকের কাজও চলেনি। জনজীবনে এই অনাকাঙ্ক্ষিত ভীতিকর জটিল পরিস্থিতির অবসান হবে কবে, কখন? কখন আমরা রাস্তা-ঘাটে নিশ্চিন্তে চলাচল করে নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পারবো! আমরা কবে থেকে আর অপহরণ হবো না, গুম হবো না, হত্যাকান্ডের শিকার হবো না? নদীতে কিংবা ট্রেনে অথবা গাছে ঝুলে আর নাটকীয় হত্যার শিকার হতে চাই না। নিরাপত্তার এই গ্যারান্টি সরকার আমাদেরকে কেন দিতে পারছে না? বর্তমান সরকার জনসাধারণের ভোটে নির্বাচিত সরকার, তারপরও আমরা বারবার এমন নির্মম পরিহাসের শিকার হচ্ছি কেন?
যদি বলা যায় এমন পুঁতি গন্ধময়, আর নারকীয় ধ্বংসলীলার শাসনের অবসান হোক এই প্রতিবাদ করতে গিয়েই সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এবং সব শেষে সংসদ সদস্য পদ থেকেও স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করলেন তরুণ সংসদ সদস্য তানজিম আহমেদ সোহেল (তাজ)। সোহেল তাজ তার নির্বাচনী এলাকা কাপাসিয়ার জনসাধারণের উদ্দেশ্যে তথা দেশবাসীকে জানিয়েছেন, ‘সব কথা জনসম্মুখে বলা যায় না, সম্মান রক্ষায় পদত্যাগ'। এমন কী ঘটনা ঘটেছে আওয়ামী লীগ সরকারের নেপথ্যে ও অন্দরমহলে যা সোহেল তাজ মান-সম্মান রক্ষার তাগিদে বলতে চাচ্ছেন না। সরকারের বাহ্যিক শাসন ব্যবস্থা আমরা ভোগ করছি। ভেতরে আরও কত হৃদয়বিদারক রাজনৈতিক চক্রান্তমূলক পরিকল্পনা রয়েছে, যা সোহেল তাজের মত একজন নিখাঁদ আওয়ামী লীগার পদত্যাগ করে এর প্রতিবাদ করলেন। সরকার এসব ক্ষেত্রে আইওয়াস ব্যবহার করছে। কিন্তু শুধু আইওয়াস দিয়ে চলবে না, সকল ক্ষেত্রে মাইন্ড ওয়াস এবং অ্যাকটিভ ওয়াস অ্যাকশন প্রয়োগ করে যাবতীয় অনাকাঙ্ক্ষিত নোংরামি দূরীভূত করে আমদের নিজস্ব সমাজকে বসবাসের উপযোগী করে ফিরিয়ে দিন নিরাপদ, সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন