শনিবার, ২৬ মে, ২০১২

তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি নিয়ে সন্দেহ


॥ এস এম ফজলে আলী ॥


বাংলাদেশ-ভারতের ৫৪টি আন্তর্জাতিক অভিন্ন নদী আছে। তিস্তা তার মধ্যে অন্যতম। বহুকাল ধরে তিস্তা বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকার জমি উর্বরা করে এসেছে কোনো বাধা ছাড়াই। কিন্তু বর্তমান চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। ভারতের হস্তক্ষেপে তিস্তা নদীতে শুষ্ক মওসুমে পানি পাওয়া যাচ্ছে না। নদীটি নাব্যতা হারাতে বসেছে।
এ নদীর উৎপত্তি সিকিমের সোহামো লেক থেকে। পশ্চিমবঙ্গের উত্তর অংশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে নীলফামারীর ডিমলা উপজেলা হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। মোট দৈর্ঘ্য ৩১৫ কিলোমিটার। তিস্তা লালমনিরহাট জেলা হয়ে প্রবাহিত হয়ে গাইবান্ধার ফুলছড়িঘাটে এসে যমুনা নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। ব্রিটিশ সার্ভেয়ার রেনাল এ নদীর ম্যাপ তৈরি করেছিলেন ১৭৬৪-১৭৭৭ সালে। যদিও গতিপথের অনেক পরিবর্তন হয়েছে, তবুও পাললিক ভূমির কারণে এ নদী বাংলাদেশে একটা বড় অঞ্চলের জন্য ‘লাইফ ব্লাড’র রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া এ নদীর পানির ওপর নির্ভরশীল। উত্তরাঞ্চল দেশের শস্যভাণ্ডার হিসেবে গণ্য হয়ে এসেছে। এর প্রধান কারণ, এ অঞ্চলে প্রচুর ইরি-বোরো ধানের চাষ হয়। বন্যার কারণে আমন ধানের যেমন মার খাওয়ার আশঙ্কা থাকে, ইরি-বোরোতে সে আশঙ্কা থাকে না। তাই দেশের ফসল প্রধানত জোগায় এ অঞ্চল। এ দিকে লক্ষ্য রেখেই শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সত্তর দশকের শেষ দিকে এ অঞ্চলে নিয়মিত পানিসেচের জন্য তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্প হাতে নেন। তিনি বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের কড়া শর্তের ঋণ বাদ দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি বন্ধুপ্রতীম মুসলিম দেশ থেকে অর্থের ব্যবস্থা করেই ব্যারাজ নির্মাণ করান। আশির দশকের প্রথম দিকে এটি চালু করে উত্তরাঞ্চলে কৃষিতে বিপ্লব এনেছিলেন। আরো শ্লাঘার কথাÑ প্রকল্পটির প্লানিং, ডিজাইন ও নির্মাণকাজ বাংলাদেশের প্রকৌশলীরাই করেছেন। এর জন্য বিদেশী বিশেষজ্ঞের কোনো সহায়তা নেয়া হয়নি। ফলে দেশের অন্যান্য প্রকল্পের চেয়ে বৃহৎ এই প্রকল্পে খরচ হয়েছে কম। এ প্রকল্পের কারণে উত্তরাঞ্চলের কৃষকদের স্বাচ্ছন্দ্য ফিরে আসে। কিন্তু প্রতিবেশী ভারত তা সহ্য করতে পারেনি। তারা ফারাক্কা বাঁধের মতো তিস্তাকে পানিশূন্য করার জন্য নীলফামারীর ডোমার থেকে ১০০ কিলোমিটার উজানে, জলপাইগুড়ির গজলডোবায় বিরাট বাঁধ দিয়ে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার শুরু করে। তিস্তা আন্তর্জাতিক নদী হওয়া সত্ত্বেও ভাটির বাংলাদেশের সাথে আলোচনার তোয়াক্কাই করল না ভারত। বিধান হলো, আন্তর্জাতিক নদীর পানি বণ্টন করতে হলে যেসব দেশের ওপর দিয়ে নদীটি প্রবাহিত, সেসব দেশে সমতার ভিত্তিতে সে নদীর পানি ব্যবহার করবে। ইউরোপের দানিয়ুব নদী ১৩টি রাষ্ট্রের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত এবং তারা সবাই সমতার ভিত্তিতে এর পানি ব্যবহার করছে। হোয়াংহো নদীর পানি কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, লাওস জাতিসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে সবাই ব্যবহার করে উপকৃত হচ্ছে। একইভাবে নীল, আমাজান, সিন্ধু নদসহ বিশ্বের বহু নদীর পানি প্রতিবেশী দেশগুলো ব্যবহার করে আসছে। কিন্তু ভারত একমাত্র দেশ, যে আন্তর্জাতিক নদীর পানি এককভাবে গ্রাস করছে। তারা আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে ব্রহ্মপুত্র ও গঙ্গার পানি প্রত্যাহার করে নিতে চায়। এর পরিণামে বাংলাদেশে মরুকরণ প্রক্রিয়া ভয়াবহ হয়ে উঠবে। অথচ আওয়ামী লীগ সরকার ভারতকে তুষ্ট করার জন্য একের পর এক চুক্তি করে যাচ্ছে, যা দেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এসে তিস্তা চুক্তি করতে পারেননি পাতানো খেলার কারণে। অনেক অভিজ্ঞজন ও বিশেষজ্ঞ মনে করেন, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি এ চুক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন ভারতের চাণক্য নীতির কারণে।
ভারতের এক হাইকমিশনার এক সভায় দাবি করেন, ফারাক্কা পয়েন্টে ভারত বাংলাদেশকে তার প্রাপ্য অপেক্ষা বেশি পানি দিচ্ছে। তবে ফারাক্কা পয়েন্টে পানির প্রাপ্তি গঙ্গার সব পানির মাত্র ৩৩%। তাই এ পানির ৬০% বাংলাদেশকে দিলে তাতে আমাদের লাভ কী? শুষ্ক মওসুমে আমাদের দেশ মরুভূমিতে পরিণত হচ্ছে পানির অভাবে। আর তিনি শুভঙ্করের ফাঁকি দিয়ে বলতে চান বাংলাদেশকে ভারত অধিক পানি দিচ্ছে। তাদের চাণক্যনীতি সব জায়গায় খাটাতে চান। কিন্তু বাংলাদেশেও যে কিছু পানিবিশেষজ্ঞ আছেন, তা তারা বোধহয় বেমালুম ভুলে যান। 
মমতা তিস্তা ব্যারাজ চুক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার যেসব ‘কারণ’ তুলে ধরেছেন, তা যেমন অস্পষ্ট তেমনি অবাস্তব। তিনি পশ্চিমবঙ্গের পানিসম্পদ বিভাগের প্রধান প্রকৌশলীর নেতৃত্বে একটি টিমের মাধ্যমে যে সার্ভে করিয়েছেন, তাতে বলা হয়েছেÑ ১. বাংলাদেশ ভূগর্ভস্থ পানি অতিরিক্ত ব্যবহার করছে। তাতে ভারতীয় অংশের পানির স্তর অনেক নিচে নেমে যাচ্ছে। ২. তিস্তা প্রকল্প এলাকার তিন লাখ ৪২ হাজার হেক্টর জমির মধ্যে মাত্র এক লাখ ৬০ হাজার হেক্টর সেচের জন্য ভারত পানি দেবে। এই প্রতিবেদন ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে দেয়া হয়েছে। এসব প্রস্তাবে বাংলাদেশ রাজি হতে পারে না আন্তর্জাতিক পানিসম্পদ ব্যবহারের বিধিবিধান অনুসারে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বিবেচনা করলে ভারত ও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তিস্তা নদীর পানি বন্টনে অববাহিকাভিত্তিক বিবেচনা করতে হবে। এতে বাংলাদেশ তিস্তা নদীর মোট প্রবাহের ৫০ ভাগ দাবি করা যৌক্তিক। নদীর প্রবাহ ঠিক রাখার জন্য ২০ ভাগ পানি সংরক্ষণ করার পর ভারত ও বাংলাদেশ ৮০ ভাগ পানির অর্ধেক হিসেবে ভাগাভাগি করতে পারে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বাংলাদেশকে মাত্র ২৫ ভাগ পানি দিতে রাজি। অর্থাৎ নদীর প্রবাহের জন্য ২০ ভাগ সংরক্ষিত রাখলে বাংলাদেশ পাবে মাত্র ৫ ভাগ, যা একটি অবাস্তব প্রস্তাব।
তিস্তা নদীর পানির ব্যবহার নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের দেনদরবার ১৯৫২ সাল থেকেই হয়ে আসছে। ১৯৮৩ সালে উভয় দেশের মন্ত্রীপর্যায়ে চুক্তি হয় যে, তিস্তা নদীর পানির ৩৬% বাংলাদেশ পাবে এবং ভারত পাবে ৩৯%। প্রবাহের জন্য ২৫% পানি সংরক্ষিত থাকবে। পরে উভয় দেশের বিশেষজ্ঞ ও জেআরসির মতবিনিময় সভায় এরূপ ধারণার উদ্ভব হয় যে, ভারত-বাংলাদেশ উভয়ই ৪০% পানি নেবে। আর নদীপ্রবাহের জন্য ২০% পানি সংরক্ষিত থাকবে। মনমোহন সিংয়ের গত সেপ্টেম্বরে ঢাকা সফরের সময় এই রূপরেখায় তিস্তাচুক্তি হওয়ার কথা শেখ হাসিনার উপদেষ্টা ড. রিজভী মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচার করেন। কথা ছিল, মনমোহন সিংয়ের সফরসঙ্গী হবেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা। কিন্তু যখন তিনি উপরিউক্ত তথ্য জানতে পারলেন, তখন মনমোহনের সফরসঙ্গী হতে অস্বীকার করেন। এভাবে বুঝিয়ে দেন, বাংলাদেশকে ২৫%-এর বেশি পানি দিলে সে চুক্তি পশ্চিমবঙ্গ সরকার মানবে না। মনমোহনের নড়বড়ে জোট সরকার তিস্তা চুক্তি করতে আর সাহস পায়নি। কারণ তাহলে মমতার তৃণমূল কংগ্রেস দল কেন্দ্রীয় সরকার থেকে তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করে নেবে।
আগেই বলেছি, মমতা ব্যানার্জির বিশেষজ্ঞরা যে প্রশ্ন তুলেছেন, তার ভিত্তি নেই। নদীর অববাহিকা এলাকার ভূগর্ভস্থ পানি নির্ভর করেÑ সেখানে কী পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়, তা এবং বন্যার পানির ওপর। বাংলাদেশ গভীর নলকূপের মাধ্যমে যে পানি উত্তোলন করে তার মাত্রা এখানকার বৃষ্টিপাতের চেয়ে অনেক কম। পশ্চিমবঙ্গ সরকার বাংলাদেশকে নির্দেশ দিতে পারে না, সে কতটুকু এলাকায় তিস্তার পানি ব্যবহার করবে। এটা বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থে ব্যাপার। পানি প্রাপ্তির ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশ নিজ এলাকায় সেচ কার্য চালাবে।
কথা হলো, তিস্তা নদীর পানির বণ্টন কিভাবে হবে? বাংলাদেশ অবশ্য দাবি করবে তিস্তা নদীর মোট প্রবাহের ৪০ ভাগ পানি। সেখানে যদি ভারত বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের পানির ৪০ ভাগ দিতেও রাজি হয়, বাংলাদেশের জন্য তা গ্রহণযোগ্য হবে না। গঙ্গা নদীর পানির ভাগাভাগি ফারাক্কা পয়েন্টে প্রাপ্ত পানির ওপর নির্ভর করে। হাসিনা সরকার ভারতের সাথে ৩০ বছরের চুক্তি করেছে গ্যারান্টি কজ ছাড়াই। আর ভারত গঙ্গার উজানে ৩০টি বাঁধ দিয়ে পানি প্রত্যাহার করায় ফারাক্কা পয়েন্টে প্রত্যাশার এক-তৃতীয়াংশ পানিও পাওয়া যাচ্ছে না। কাজেই তার অর্ধেক বা তারও বেশি বাংলাদেশকে দিলেই বা কী? মূল পানিপ্রবাহের এক-তৃতীয়াংশ পানিও বাংলাদেশ শুষ্ক মওসুমে পাচ্ছে না। ফলে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল মরুকরণের দিকে ধাবিত হচ্ছে। বাংলাদেশের বৃহৎ সেচ প্রকল্প জি-কে প্রজেক্ট অকার্যকর হয়ে যাচ্ছে। সেখানে পানির সঙ্কটে গভীর নলকূপ বসিয়ে সেচের কাজ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। নদীর নাব্যতা হারিয়ে যাওয়ায় অসংখ্য চর জেগে উঠছে। বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরবন অতিরিক্ত লবণাক্ততায় মরে যাচ্ছে। পদ্মার ইলিশ ও অন্যান্য মাছ প্রায় দু®প্রাপ্য। নদীর লবণাক্ততা উজানে নগরবাড়ী ঘাট পর্যন্ত পৌঁছেছে।
একই কার্যক্রম ভারত তিস্তা নদীতে শুরু করেছে। ভারত তিস্তার পানি প্রত্যাহার করছে। ভারত আরো পাঁচ-ছয়টি ড্যাম তৈরির পরিকল্পনা করছে। তিস্তা নদীর সাথে যেসব উপনদী সংযুক্ত, সেগুলোতে ৪১টি বাঁধ দিয়ে (৩০টি সিকিমে ও ১১টি পশ্চিমবঙ্গের অংশে) মোট পাঁচ হাজার মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা করছে। আগামী ১০ বছরে তা বাস্তবায়িত হবে। তাহলে দুই দেশের সীমান্তে তিস্তা নদীতে পানি পাওয়া যাবে সামান্য। তার ৬০ ভাগ দিলেও হয়তো আমাদের তিস্তা প্রজেক্ট বাঁচিয়ে রাখা যাবে না। সমগ্র তিস্তা নদীতে যে পানি (উৎপত্তিস্থল থেকে বাংলাদেশের সীমান্ত পর্যন্ত) পাওয়া যাবে, তার ৪০ ভাগ বাংলাদেশের জন্য নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকার, এবং ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার তা মেনে নেবে না। তাই তিস্তা চুক্তি আদৌ হবে কি না, সে ব্যাপারে ব্যাপক সন্দেহ। আর যেনতেনভাবে সরকার যদি ভারতের সাথে তিস্তাচুক্তি করে, তা হবে আত্মঘাতী।
মহাজোট সরকার বাহবা নেয়ার চেষ্টা করছে এই বলে, যেহেতু ভারত তিস্তাচুক্তি করেনি, তাই তার সরকারও চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দর ভারতের ব্যবহারের জন্য চুক্তি করেনি। আসলে সরকার এ দু’টি বিষয় এক করে দেখতে পারে না। তিস্তা নদীর পানির ওপর বাংলাদেশের দাবি আন্তর্জাতিক আইনেই স্বীকৃত। তাই তার বিনিময়ে সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের চুক্তি হতে পারে না। তবে ভারত যদি বাংলাদেশের জন্য ভুটান ও নেপালে ট্রানজিট দিতে রাজি হয় এবং বন্দর ব্যবহারের জন্য আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী শুল্ক ও আনুষঙ্গিক ট্যাক্স দিতে রাজি থাকে এবং বাস্তবে তা কার্যকর হয়, তবে এ ব্যাপারে ন্যায়সঙ্গত চুক্তি হতে পারে। তবে বর্তমান সরকারের মন্ত্রিপরিষদ এবং প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান ও ড. রিজভীর মতো লোকেদের ভারতের প্রতি নতজানু নীতির কারণে এটা আশা করা যায় না। 
লেখক : প্রকৌশলী, পানি বিশেষজ্ঞ ও সমাজ গবেষক

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন