শনিবার, ২৬ মে, ২০১২

প্রবীণ ভাবনা এবং এবারের বাজেট




ম ন জু আ রা বে গ ম
দেশের মোট জনগোষ্ঠীর একটি বিরাট অংশ প্রবীণ। এ দেশ, জাতি ও সমাজকে যারা অনেক কিছু দিয়ে গেছেন, এ দেশের জন্য যাদের অবদান অপরিসীম, যারা দেশ-সমাজ গড়ার কারিগর ছিলেন, জীবনের একটি পর্যায়ে এসে সমাজ-সংসার তাদের কথা আর তেমন করে ভাবে না। তাদের মনে করা হয় সমাজ-সংসারে অপাঙ্ক্তেয় বা বোঝা। একসময় যে মানুষটি সংসারে ছিলেন অপরিহার্য, জীবনের একটি পর্যায়ে এসে তিনি হয়ে গেছেন অপ্রয়োজনীয়। অথচ আমরা এই চরম বা¯—বতাকে ভুলে যাই যে বেঁচে থাকলে প্রতিটি মানুষকেই বার্ধক্যের ¯^াদ গ্রহণ করতে হবে। বর্তমান বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০ ভাগ অর্থাৎ সারা বিশ্বে প্রবীণের সংখ্যা প্রায় ৮০ কোটি। বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭ শতাংশ প্রবীণ। সংখ্যাগত দিক থেকে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ (সম্প্রতি জাতীয় প্রেস ক্লাবে প্রবীণ হিতৈষী সংঘের সংবাদ সম্মেলনের তথ্যানুযায়ী)। এর তিন-চতুর্থাংশই গ্রামীণ দরিদ্র, অসহায়। পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে তারা উপে¶িত, অবহেলিত। গ্রামের অধিকাংশ প্রবীণ বেঁচে আছেন ভি¶াবৃত্তির ওপর নির্ভর করে। ১৯৫০ সালে বিশ্বে এ সংখ্যা ছিল মাত্র ২০ কোটি। ২০২৫ সালে দাঁড়াবে প্রায় ১২০ কোটিতে এবং বাংলাদেশে হবে ১০ শতাংশ বা ২ কোটি। জাতিসংঘ এশিয়া-প্রশাš— মহাসাগরীয় অঞ্চলের ৬০ বছরের বেশি বয়সী মানুষকে ‘প্রবীণ’ বলে চিহ্নিত করেছে। কিন্তু বা¯—বে আমাদের দেশের বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ মানুষের বয়স ৫০ হলেই তাদের প্রবীণ বলে মনে করা হয়। বাংলাদেশের এ বিশাল প্রবীণ জনগোষ্ঠী আর্থ-সামাজিকভাবে উপে¶িত, অবহেলিত।
দেশে সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য ১৯২৫ সালে ব্রিটিশ প্রবর্তিত অবসরকালীন পেনশন ভাতাই ছিল একমাত্র ভরসা। ১৯৯৮ সালে তদানীš—ন সরকার প্রথম বয়স্কভাতা কর্মসূচি চালু করে। প্রাথমিক পর্যায়ে ৪ লাখ ১৫ হাজার দুস্থ গ্রামীণ প্রবীণকে মাসিক ১০০ টাকা হারে ভাতা প্রদানের জন্য মোট ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। বর্তমানে ভাতার পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে ৩০০ টাকা এবং গ্রহীতার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৫ লাখে। বরাদ্দের পরিমাণ ৯০০ কোটি টাকা। প্রবীণদের সংখ্যা ক্রমাš^য়ে বৃদ্ধি পেলেও বিগত দুই বছরে জাতীয় বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ বাড়েনি।
১৯৮২ সালে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় প্রথম প্রবীণ বিশ্ব সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। ১০ বছর মেয়াদি আš—র্জাতিক ভিয়েনা কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় এবং ১৯৯১ সালের ১ অক্টোবর নিয়মিতভাবে আš—র্জাতিক প্রবীণ দিবস পালনের ঘোষণা দেয়া হয়। আমাদের দেশে এ দিবসটি পালিত হলেও তেমনভাবে পালন বা প্রবীণদের সাহায্য-সহযোগিতার জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে তেমন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না। আগামী ৭ জুন ২০১২-১৩ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা হতে যাচ্ছে। এবারের বাজেটে প্রবীণদের উন্নয়ন ও কল্যাণার্থে যাতে প্রয়োজন অনুযায়ী বরাদ্দ থাকে এবং সরকারি উদ্যোগে গ্রাম ও শহর পর্যায়ে আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসংবলিত প্রবীণ নিবাস তৈরির পরিকল্পনা, আধুনিক মানসম্মত পৃথক হাসপাতাল, যাতায়াতের জন্য পৃথক পরিবহন সুবিধা প্রদানের ব্যবস্থা যাতে করা যায় সেদিকে সরকারের সুদৃষ্টি রাখা অত্যš— প্রয়োজন। বিশ্বজুড়ে বিশেষ করে ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোয় বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এসব দেশে সামাজিক বন্ধন আমাদের দেশের মতো এত সুদৃঢ় না হওয়ায় ছেলেমেয়েরা ১৮ বছর বয়সী হলেই বাবা-মার সান্নিধ্য থেকে দূরে চলে যায়। সš—ানরা তাদের জীবনের সুখ-¯^াচ্ছন্দ্য আর আরাম-আয়েশ নিয়ে ব্যতিব্য¯— হয়ে পড়ে। আমাদের দেশেও এর হাওয়া লেগেছে। দেশে যৌথ পরিবারের সংখ্যা দ্র“ত হ্রাস পাচ্ছে। যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সেই সঙ্গে নারীর ঘরের বাইরে কর্ম¶েত্রে প্রবেশের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় প্রবীণরা আগের মতো আর সেবা-সহায়তা সংসারে তেমনভাবে পাচ্ছেন না। স্ত্রী-সš—ান ছাড়াও পরিবারে আরও অনেক সদস্য আছেন, এ কথা অনেক ¶েত্রে তারা ভুলতে বসেছেন। প্রবীণদের দিকে নজর দেয়ার সময় তাদের নেই। 
বিজ্ঞান মানুষকে অনেক যান্ত্রিক ও বাণিজ্যিক মনোভাবাপন্ন করেছে। মানুষ অর্থ-বৈভবের সন্ধানে ছুটে চলেছে পৃথিবীর এক প্রাš— থেকে অপর প্রাšে—। সš—ানরা সুস্থ পারিবারিক পরিবেশে বেড়ে উঠতে না পারায় তাদের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধের অব¶য় পরিল¶িত হচ্ছে। ফলে প্রবীণরা অবহেলিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। অথচ কয়েক দশক আগেও বৃদ্ধ বাবা-মায়েরা সš—ানদের ওপর নির্ভরশীল থাকতেন। সভ্যতার ক্রমবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে মানুষ বড় বেশি যান্ত্রিক ও আÍকেন্দ্রিক হয়ে যাওয়ায় আজকাল পরিবারের সদস্যরা পরিবারকে সময় দিতে পারেন না। এ কারণে প্রবীণদের জন্য আধুনিক মানসম্মত নিবাস তৈরির প্রয়োজনীতা দেখা দিয়েছে প্রবলভাবে। এ দেশেরই একজন প্রয়াত খ্যাতিমান চিকিৎসক ড. এ কে এম আবদুল ওয়াহেদ নিজের প্রচেষ্টায় ১৯৬০ সালে ধানমÊির নিজ বাড়িতে মেধা ও শ্রম দিয়ে ‘প্রবীণ হিতৈষী সংঘ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন, যা পরবর্তীকালে মহানগরীর আগারগাঁওয়ে স্থানাš—রিত হয়। সম্প্রতি এ প্রবীণ নিবাসটি আমার পরিদর্শনের সুযোগ হয়। এ নিবাসে উচ্চশি¶িত ও পদস্থ বেশ ক’জন প্রবীণের (মহিলা ও পুর“ষ) সঙ্গে আলাপ হয়। জানা যায়, ১৯৯৩-৯৪ অর্থবছরে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সরকার এ সংঘকে ৯ কোটি টাকা অনুদান প্রদান করে। এ অর্থে দেশের পাঁচটি বিভাগীয় শহরে প্রবীণদের জন্য ¯^াস্থ্য ক্লিনিক এবং আগারগাঁওয়ে সরকারি অনুদানে পরিচালিত চারতলাবিশিষ্ট প্রবীণ হাসপাতাল ও ছয়তলাবিশিষ্ট একটি প্রবীণ নিবাস স্থাপন করা হয়। এ প্রবীণ নিবাস ও হাসপাতালটি বিভিন্ন ধরনের সেবা প্রদানের উদ্দেশ্যে স্থাপিত হলেও প্রবীণরা তাদের কাক্সি¶ত সেবা পাচ্ছেন না বলে জানা যায়। অর্ধ শতাব্দীরও বেশি পুরনো এ প্রতিষ্ঠানটি যথাযথভাবে পরিচালনার জন্য কোন নীতিমালা বা যুগোপযোগী কোন সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়নি। ১৯৯৮ সালে ৫০ শয্যাবিশিষ্ট এ প্রবীণ হাসপাতালটি চালু হয়। যতদূর জানা যায়, প্রবীণ হাসপাতালে প্রবীণ রোগীর চেয়ে যুবক ও শিশু সংখ্যাই বেশি। প্রবীণ সংঘের নীতিমালা থাকলেও তা মানা হয় না। নীতিমালা অনুযায়ী কোন নিবাসী সংঘের সদস্য হতে পারবেন না লেখা থাকলেও এ নিয়ম মানা হচ্ছে না। ফলে যে মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি স্থাপিত হয় তা সফলভাবে বা¯—বায়ন হচ্ছে না। ২০০৭ সালে প্রবীণবিষয়ক জাতীয় নীতিমালা চ‚ড়াš— হলেও আজ পর্যš— তা বা¯—বায়ন হচ্ছে না বলে জানা যায়। বিশ্ব ¯^াস্থ্য সংস্থা, ইউএনএফপিএসহ বিভিন্ন সংস্থা থেকে আর্থিক সাহায্য নিয়ে হাসপাতাল ও প্রবীণ নিবাসটি চলছে বলে জানা যায়। ১০০ নিবাসীর এখানে থাকার ব্যবস্থা থাকলেও প্রয়োজনীয় আধুনিক সুযোগ-সুবিধার অভাবে এ নিবাসে বর্তমানে মাত্র ৪৮ নিবাসী আছেন। ¯^াস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে বছরে এ প্রতিষ্ঠানটিকে ৭০ লাখ টাকা অনুদান প্রদান করা হলেও গুণগতমান বৃদ্ধি বা কোন উন্নতি পরিল¶িত হয়নি।
প্রবীণদের কল্যাণ এবং সেবা-সহায়তা প্রদানের বিষয়টি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য সরকারি ও বেসরকারিভাবে সংশি­ষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। পাঠ্যপু¯—কে প্রবীণকল্যাণ ও পরিচর্যা সম্পর্কিত বিষয় অš—র্ভুক্ত করে ছোটবেলা থেকেই পরিবার ও বিদ্যালয়গুলোর মাধ্যমে দায়িত্ববোধ জাগ্রত করতে হবে। প্রচারমাধ্যমগুলো এ ব্যাপারে সক্রিয় ও অগ্রণী ভ‚মিকা পালন করতে পারে এবং সেই সঙ্গে পত্রপত্রিকায় ‘প্রবীণদের কলাম’ নামে একটি অংশ বরাদ্দ রেখে তাদের ব্যাপারে সবাইকে উৎসাহিত করা যেতে পারে। প্রবীণরা এ সমাজের একজন। তারা কারও বোঝা নন, এ সত্য উপলব্ধি করতে হবে আমাদের সবাইকে।
মনজু আরা বেগম : সহসাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন