মাহবুবুর রহমান | তারিখ: ৩০-০৫-২০১২
আজ জিয়াউর রহমানের ৩১তম শাহাদাতবার্ষিকী। ৩১ বছর আগে এই দিনটিতে এক গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয় জিয়াকে। ঘৃণ্য ঘাতকেরা স্টেনগানের একঝাঁক বুলেটে চিরদিনের জন্য স্তব্ধ করে দেয় এক মহান রাষ্ট্রনায়ককে, এক নিয়তি-নির্মাতা যুগস্রষ্টাকে। জাতির ভাগ্যে লেপে দেয় এক অমোচনীয় কালিমা, যা কখনো অপসৃত হওয়ার নয়। দুর্ভাগ্য বাংলাদেশের।
একাত্তরের মার্চের সেই অগ্নিঝরা দিনগুলোতে সবচেয়ে কঠিন সময় যারা পার করেছে, চরম মানসিক বিপর্যয়ে ভুগেছে, যন্ত্রণাকাতর থেকেছে, তারা নিশ্চিতভাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙালি ইউনিটগুলোর বাঙালি সেনা কর্মকর্তা ও সেনাসদস্য। এ এক দুঃসহ দুঃসময়, এক কঠিন অগ্নিপরীক্ষা। তারা প্রত্যক্ষ করছে, স্বাধীনতার চেতনায় উত্তাল গোটা দেশ। অন্যায়ের বিরুদ্ধে ফেটে পড়ছে অত্যাচারিত মানুষ। টানটান উত্তেজনা। বাঙালি সেনা কর্মকর্তারা, আন্ডার কমান্ড বাঙালি সৈনিকেরা কী করবে? তারা কি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখবে তাদের ভাইয়ের মৃত্যু, মায়ের অপমান, বোনের অসম্মান এবং যখন রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে তাদের প্রিয় মাতৃভূমি? ভীষণ ঝুঁকিতে তাদের জীবন। তাদের মানসিক প্রতিক্রিয়া আঁচ করে নিরস্ত্র করার জন্য ছাউনির পাঞ্জাব ইউনিটগুলোকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং তা এক্ষুনি, এই মুহূর্তে। কঠিন সিদ্ধান্ত, জীবন-মরণের সিদ্ধান্ত। হয় বীরের মতো বিদ্রোহ, না হয় কাপুরুষের মতো সারেন্ডার। চট্টগ্রাম সেনা ছাউনির ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড ইন কমান্ড মেজর জিয়া বিদ্রোহই বেছে নিলেন। আই রিভল্ট বলে গোটা ইউনিট নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। কালুরঘাটের বেতারকেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন। ইথারে ভেসে এল, ‘আমি মেজর জিয়া বলছি। আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি...।’ মার খাওয়া মানুষ, বিভ্রান্ত জনতা, দিশেহারা জাতি সংবিৎ ফিরে পেল। গোটা জাতি, অস্ত্রধারী বাহিনী, ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, পেশাজীবী মানুষ, নারী-পুরুষ, আবালবৃদ্ধবনিতা অস্ত্র হাতে যুদ্ধে নেমে পড়ল।
এর পরের ইতিহাস রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের। শত-সহস্র গেরিলা অভিযান, রেড, অ্যাম্বুশ, শত্রুঘাঁটিতে অতর্কিত আক্রমণ, সম্মুখযুদ্ধ, অ্যাটাক, কাউন্টার অ্যাটাক, ইস্পাতকঠিন মনোবল আর মৃত্যুপণ লড়াইয়ের ইতিহাস। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রক্তের আখরে লেখা এক অনবদ্য গৌরবগাথা, এক বীর জাতির বীরত্বের কাহিনি। জাতির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জনের এক অমর আখ্যান। আমার গর্ব আমার জাতীয় সেনাবাহিনীর জন্ম মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাগৃহে। এর উত্থান ও বিকাশ মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত প্রান্তরে। এই সেনাবাহিনীই গোটা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে, ফোর্স সংগঠিত করেছে, অস্ত্র সংগ্রহ করেছে, রসদ জুগিয়েছে, অভিযান পরিচালনা করেছে, শত্রুকে পরাজিত করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছে। মেজর জিয়া ও তাঁর পরিচালিত জেড ফোর্স গোটা মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের ইতিহাসের এক বড় অধ্যায়। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে সেনাবাহিনীর পুনর্গঠনের প্রাক্কালে আমরা জিয়াকে অবমূল্যায়িত হতে দেখেছি। দুর্ভাগ্যের বিষয়, পরবর্তী সময়ে আমরা দেখেছি জাতির ভাগ্যাকাশে দুর্যোগ, রাষ্ট্রব্যবস্থায় অনেক সংকট। আমরা হারাই মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। আজ শোকাহত চিত্তে তাঁকে স্মরণ করছি। ঘটনার ক্রমবিবর্তনে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি জাতির অনেক অস্থিরতা আর অনিশ্চয়তায় সংঘটিত পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বরের সিপাহি জনতার বিপ্লব। এই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে জেনারেল জিয়া উঠে আসেন রাষ্ট্রীয় শীর্ষ নেতৃত্বের পাদপ্রদীপে।
সৈনিক জিয়া মহান। রাষ্ট্রনায়ক জিয়া মহত্তর। তিনি গণতন্ত্রের প্রাণপুরুষ। আধুনিক বাংলাদেশের স্থপতি। তাঁর ছিল সুদূরপ্রসারী দৃষ্টি। তিনি ছিলেন ভিশনারি এক স্বপ্নদ্রষ্টা। জিয়া জাতিকে একটি সত্যিকার গণতন্ত্রের শক্ত ভিত্তির ওপরে দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন। আনতে চেয়েছিলেন অর্থনৈতিক মুক্তি। দিতে চেয়েছিলেন জাতিকে সম্মান আর গৌরব; মুক্তিযুদ্ধের সেই ব্র্যাকেটবন্দী দেশগুলো—যুক্তরাষ্ট্র, গণচীন আর ভিয়েতনামের মতো।
জিয়ার রাষ্ট্রক্ষমতার সময় সংক্ষিপ্ত—পাঁচ বছরের একটু বেশি। এই স্বল্প সময়ে তিনি যুগান্তকারী সব কাজ করে গেছেন। তাঁর সঙ্গে আমি ভারতবর্ষের ইতিহাসের সেই পাঠান সম্রাট শেরশাহের অনেক মিল খুঁজে পাই। শেরশাহের শাসনভার ছিল এমনই সংক্ষিপ্ত। কিন্তু জনকল্যাণে, সাধারণ মানুষের মঙ্গলে তাঁর কীর্তিগুলো ছিল যেমন অভিনব, তেমনই অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী প্রভাবের, যা আজও তাঁর দূরদর্শিতার স্বাক্ষর বহন করে চলেছে। জিয়া জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিটি বিষয়ে একটি বড় রকমের ঝাঁকুনি দিয়ে গেছেন। রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ক্রীড়া, নারী, শিশু—সবকিছুতেই একটা বিপ্লব ঘটিয়ে গেছেন। গোটা জাতিকে তিনি একাত্তরের মতো একতাবদ্ধ করতে পেরেছিলেন। একটি দৃঢ় জাতীয় সংহতি সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। পরিচয়-সংকটে আক্রান্ত হীনম্মন্যতায় ভোগা জাতিকে তার সত্যিকারের পরিচয় এবং তার আপন স্বাধীন স্বকীয়তার পরিচিতি তিনি উন্মোচন করতে পেরেছিলেন। সে পরিচিতি বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের সংমিশ্রণে হাজার বছরের যে রসায়ন, তারই আবিষ্কার তিনি ঘটিয়ে ছিলেন। নাম দিয়েছিলেন বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। এই জাতীয়তাবাদের ওপরই প্রতিষ্ঠিত তাঁর মন, মনন ও চেতনা—তাঁর রাজনৈতিক দর্শন। তাই তাঁর প্রিয় গান, যা তিনি আপন মনে গুন গুন করে গাইতেন, ‘আমার জীবন বাংলাদেশ আমার মরণ বাংলাদেশ।’
জিয়ার বড় অবদান স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি। তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, তাঁর দূরদৃষ্টি, তাঁর বৈপ্লবিক চেতনা, বিশ্বাস ও স্বাধীনচেতা দৃঢ়চরিত্র আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। গণচীনসহ কয়েকটি বড় দেশ বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্বের হাত প্রসারিত করে—সহযোগিতায় এগিয়ে আসে। ১৯৮০ সালের জুলাই মাসে জেনারেল জিয়া গণচীন সফর করেন। আমি বেইজিংয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসে সামরিক অ্যাটাশে হিসেবে মাত্র যোগদান করেছি। জেনারেল জিয়াকে চীনা সরকার, চীনা জনগণ অভূতপূর্ব সংবর্ধনা দেয়। বিপুলভাবে সম্মানিত করে। তিনি যখন যেখানে গেছেন, প্রচুর মানুষের ভিড়। রাস্তার দুই ধারে ফুল হাতে কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা মংচিয়ালা মংচিয়ালা (বাংলাদেশ বাংলাদেশ) বলে চিৎকার করছে, আর হাত নাড়ছে। তখন এক গর্বভরা অনুভূতি আমার। মাও সে-তুংয়ের তিরোধানের পর তখন চীনের নেতৃত্বে হুয়া কুয়া ফেং। আমার সুযোগ হয়েছিল শীর্ষ বৈঠকে উপস্থিত থাকার। আমি হুয়া কুয়া ফেংকে জেনারেল জিয়ার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করতে শুনেছি। বাংলাদেশের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে চীনের পূর্ণ সহযোগিতার দৃঢ় আশ্বাস তিনি ব্যক্ত করেন।
আমার মনে পড়ে, একটি হূদয়গ্রাহী সফল সফর শেষে বেইজিংয়ের পুরোনো বিমানবন্দরে বাংলাদেশ বিমানের এয়ারক্রাফটে বিদায়ী রাষ্ট্রপতি যখন আরোহণ করতে যাচ্ছেন, সামরিক আনুষ্ঠানিক পোশাকে সজ্জিত আমি একটি চৌকস স্যালুট করি। তিনি হাত বাড়ালেন হ্যান্ডশেকের জন্য। আমার হাতে শক্ত করে চাপ দিলেন। পিকিং বিমানবন্দরের টারমেকে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রপতির সেই করমর্দনের স্পর্শ আমি আজও অনুভব করি। তিনি আমাকে বলছিলেন, ‘মাহবুব, আই অ্যাম লিভিং, ইউ উইল বি হেয়ার। চীনা ইজ আওয়ার ফ্রেন্ড। অ্যান্ড চায়না ইজ এ গ্রেট কান্ট্রি। ডেভেলপ আওয়ার রিলেশনস। প্রোমোট আওয়ার ফ্রেন্ডশিপ। রিমেম্বার, দিজ ইজ দ্য কান্ট্রি টু হুইচ উই লুক ফরওয়ার্ড। রিমেম্বার, দিজ ইজ দ্যা কান্ট্রি ইন হুইচ উই ক্যান ফুললি ট্রাস্ট।’ কে জানত, জেনারেল জিয়ার সঙ্গে সেটাই হবে আমার শেষ সাক্ষাৎ। তাঁর বিদায়বেলার কথাগুলো এখনো আমি শুনতে পাই। আমার কানে অনুরণিত হয়।
তখনো আমি বেইজিংয়ে। ১৯৮১ সালের ৩০ মের ভোরবেলা আমার বাসার টেলিফোনটি অনবরত বেজে চলেছে। এত ভোরে কখনো কেউ ফোন করে না। বুকটা ধড়াস করে উঠল। ঢাকা থেকে হবে হয়তো, কোনো দুঃসংবাদ। রিসিভার তুলতেই চীনা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ফরেন লিয়াজোঁ অফিসার কর্নেল সু চুইন ফিংয়ের পরিচিত গলা। ‘আপনি কি জানেন, আপনাদের রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াকে আজ গভীর রাতে চট্টগ্রামে হত্যা করা হয়েছে? কারা করেছে? কেন করেছে? তিনি আমাদের একজন খাঁটি বন্ধু ছিলেন...।’
আমি স্তম্ভিত। আমি বাকরুদ্ধ। আমি বিদ্যুৎস্পৃষ্ট। কর্নেল সু ওদিক থেকে বলে চলেছেন, ‘ব্রিগেডিয়ার, আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন? ব্রিগেডিয়ার, আপনি কি আমাকে শুনছেন?...।’ আমি নিশ্চুপ। আমি হতবাক। আমি নিথর।
রবীন্দ্রনাথের কবিতার দুটি লাইন আজ জিয়া স্মরণে তাঁকে নিবেদন করছি।
‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী, ভয় নাই ওরে ভয় নাই
নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান, ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।’
জিয়া মৃত্যুঞ্জয়ী। জিয়া বাংলার উত্তর আকাশের জ্বল জ্বল করা চিরভাস্বর সেই ধ্রুব নক্ষত্রটি।
লে. জেনারেল মাহবুবুর রহমান (অব.): সাবেক সেনাপ্রধান।
একাত্তরের মার্চের সেই অগ্নিঝরা দিনগুলোতে সবচেয়ে কঠিন সময় যারা পার করেছে, চরম মানসিক বিপর্যয়ে ভুগেছে, যন্ত্রণাকাতর থেকেছে, তারা নিশ্চিতভাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙালি ইউনিটগুলোর বাঙালি সেনা কর্মকর্তা ও সেনাসদস্য। এ এক দুঃসহ দুঃসময়, এক কঠিন অগ্নিপরীক্ষা। তারা প্রত্যক্ষ করছে, স্বাধীনতার চেতনায় উত্তাল গোটা দেশ। অন্যায়ের বিরুদ্ধে ফেটে পড়ছে অত্যাচারিত মানুষ। টানটান উত্তেজনা। বাঙালি সেনা কর্মকর্তারা, আন্ডার কমান্ড বাঙালি সৈনিকেরা কী করবে? তারা কি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখবে তাদের ভাইয়ের মৃত্যু, মায়ের অপমান, বোনের অসম্মান এবং যখন রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে তাদের প্রিয় মাতৃভূমি? ভীষণ ঝুঁকিতে তাদের জীবন। তাদের মানসিক প্রতিক্রিয়া আঁচ করে নিরস্ত্র করার জন্য ছাউনির পাঞ্জাব ইউনিটগুলোকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং তা এক্ষুনি, এই মুহূর্তে। কঠিন সিদ্ধান্ত, জীবন-মরণের সিদ্ধান্ত। হয় বীরের মতো বিদ্রোহ, না হয় কাপুরুষের মতো সারেন্ডার। চট্টগ্রাম সেনা ছাউনির ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড ইন কমান্ড মেজর জিয়া বিদ্রোহই বেছে নিলেন। আই রিভল্ট বলে গোটা ইউনিট নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। কালুরঘাটের বেতারকেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন। ইথারে ভেসে এল, ‘আমি মেজর জিয়া বলছি। আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি...।’ মার খাওয়া মানুষ, বিভ্রান্ত জনতা, দিশেহারা জাতি সংবিৎ ফিরে পেল। গোটা জাতি, অস্ত্রধারী বাহিনী, ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, পেশাজীবী মানুষ, নারী-পুরুষ, আবালবৃদ্ধবনিতা অস্ত্র হাতে যুদ্ধে নেমে পড়ল।
এর পরের ইতিহাস রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের। শত-সহস্র গেরিলা অভিযান, রেড, অ্যাম্বুশ, শত্রুঘাঁটিতে অতর্কিত আক্রমণ, সম্মুখযুদ্ধ, অ্যাটাক, কাউন্টার অ্যাটাক, ইস্পাতকঠিন মনোবল আর মৃত্যুপণ লড়াইয়ের ইতিহাস। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রক্তের আখরে লেখা এক অনবদ্য গৌরবগাথা, এক বীর জাতির বীরত্বের কাহিনি। জাতির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জনের এক অমর আখ্যান। আমার গর্ব আমার জাতীয় সেনাবাহিনীর জন্ম মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাগৃহে। এর উত্থান ও বিকাশ মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত প্রান্তরে। এই সেনাবাহিনীই গোটা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে, ফোর্স সংগঠিত করেছে, অস্ত্র সংগ্রহ করেছে, রসদ জুগিয়েছে, অভিযান পরিচালনা করেছে, শত্রুকে পরাজিত করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছে। মেজর জিয়া ও তাঁর পরিচালিত জেড ফোর্স গোটা মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের ইতিহাসের এক বড় অধ্যায়। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে সেনাবাহিনীর পুনর্গঠনের প্রাক্কালে আমরা জিয়াকে অবমূল্যায়িত হতে দেখেছি। দুর্ভাগ্যের বিষয়, পরবর্তী সময়ে আমরা দেখেছি জাতির ভাগ্যাকাশে দুর্যোগ, রাষ্ট্রব্যবস্থায় অনেক সংকট। আমরা হারাই মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। আজ শোকাহত চিত্তে তাঁকে স্মরণ করছি। ঘটনার ক্রমবিবর্তনে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি জাতির অনেক অস্থিরতা আর অনিশ্চয়তায় সংঘটিত পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বরের সিপাহি জনতার বিপ্লব। এই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে জেনারেল জিয়া উঠে আসেন রাষ্ট্রীয় শীর্ষ নেতৃত্বের পাদপ্রদীপে।
সৈনিক জিয়া মহান। রাষ্ট্রনায়ক জিয়া মহত্তর। তিনি গণতন্ত্রের প্রাণপুরুষ। আধুনিক বাংলাদেশের স্থপতি। তাঁর ছিল সুদূরপ্রসারী দৃষ্টি। তিনি ছিলেন ভিশনারি এক স্বপ্নদ্রষ্টা। জিয়া জাতিকে একটি সত্যিকার গণতন্ত্রের শক্ত ভিত্তির ওপরে দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন। আনতে চেয়েছিলেন অর্থনৈতিক মুক্তি। দিতে চেয়েছিলেন জাতিকে সম্মান আর গৌরব; মুক্তিযুদ্ধের সেই ব্র্যাকেটবন্দী দেশগুলো—যুক্তরাষ্ট্র, গণচীন আর ভিয়েতনামের মতো।
জিয়ার রাষ্ট্রক্ষমতার সময় সংক্ষিপ্ত—পাঁচ বছরের একটু বেশি। এই স্বল্প সময়ে তিনি যুগান্তকারী সব কাজ করে গেছেন। তাঁর সঙ্গে আমি ভারতবর্ষের ইতিহাসের সেই পাঠান সম্রাট শেরশাহের অনেক মিল খুঁজে পাই। শেরশাহের শাসনভার ছিল এমনই সংক্ষিপ্ত। কিন্তু জনকল্যাণে, সাধারণ মানুষের মঙ্গলে তাঁর কীর্তিগুলো ছিল যেমন অভিনব, তেমনই অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী প্রভাবের, যা আজও তাঁর দূরদর্শিতার স্বাক্ষর বহন করে চলেছে। জিয়া জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিটি বিষয়ে একটি বড় রকমের ঝাঁকুনি দিয়ে গেছেন। রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ক্রীড়া, নারী, শিশু—সবকিছুতেই একটা বিপ্লব ঘটিয়ে গেছেন। গোটা জাতিকে তিনি একাত্তরের মতো একতাবদ্ধ করতে পেরেছিলেন। একটি দৃঢ় জাতীয় সংহতি সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। পরিচয়-সংকটে আক্রান্ত হীনম্মন্যতায় ভোগা জাতিকে তার সত্যিকারের পরিচয় এবং তার আপন স্বাধীন স্বকীয়তার পরিচিতি তিনি উন্মোচন করতে পেরেছিলেন। সে পরিচিতি বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের সংমিশ্রণে হাজার বছরের যে রসায়ন, তারই আবিষ্কার তিনি ঘটিয়ে ছিলেন। নাম দিয়েছিলেন বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। এই জাতীয়তাবাদের ওপরই প্রতিষ্ঠিত তাঁর মন, মনন ও চেতনা—তাঁর রাজনৈতিক দর্শন। তাই তাঁর প্রিয় গান, যা তিনি আপন মনে গুন গুন করে গাইতেন, ‘আমার জীবন বাংলাদেশ আমার মরণ বাংলাদেশ।’
জিয়ার বড় অবদান স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি। তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, তাঁর দূরদৃষ্টি, তাঁর বৈপ্লবিক চেতনা, বিশ্বাস ও স্বাধীনচেতা দৃঢ়চরিত্র আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। গণচীনসহ কয়েকটি বড় দেশ বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্বের হাত প্রসারিত করে—সহযোগিতায় এগিয়ে আসে। ১৯৮০ সালের জুলাই মাসে জেনারেল জিয়া গণচীন সফর করেন। আমি বেইজিংয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসে সামরিক অ্যাটাশে হিসেবে মাত্র যোগদান করেছি। জেনারেল জিয়াকে চীনা সরকার, চীনা জনগণ অভূতপূর্ব সংবর্ধনা দেয়। বিপুলভাবে সম্মানিত করে। তিনি যখন যেখানে গেছেন, প্রচুর মানুষের ভিড়। রাস্তার দুই ধারে ফুল হাতে কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা মংচিয়ালা মংচিয়ালা (বাংলাদেশ বাংলাদেশ) বলে চিৎকার করছে, আর হাত নাড়ছে। তখন এক গর্বভরা অনুভূতি আমার। মাও সে-তুংয়ের তিরোধানের পর তখন চীনের নেতৃত্বে হুয়া কুয়া ফেং। আমার সুযোগ হয়েছিল শীর্ষ বৈঠকে উপস্থিত থাকার। আমি হুয়া কুয়া ফেংকে জেনারেল জিয়ার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করতে শুনেছি। বাংলাদেশের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে চীনের পূর্ণ সহযোগিতার দৃঢ় আশ্বাস তিনি ব্যক্ত করেন।
আমার মনে পড়ে, একটি হূদয়গ্রাহী সফল সফর শেষে বেইজিংয়ের পুরোনো বিমানবন্দরে বাংলাদেশ বিমানের এয়ারক্রাফটে বিদায়ী রাষ্ট্রপতি যখন আরোহণ করতে যাচ্ছেন, সামরিক আনুষ্ঠানিক পোশাকে সজ্জিত আমি একটি চৌকস স্যালুট করি। তিনি হাত বাড়ালেন হ্যান্ডশেকের জন্য। আমার হাতে শক্ত করে চাপ দিলেন। পিকিং বিমানবন্দরের টারমেকে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রপতির সেই করমর্দনের স্পর্শ আমি আজও অনুভব করি। তিনি আমাকে বলছিলেন, ‘মাহবুব, আই অ্যাম লিভিং, ইউ উইল বি হেয়ার। চীনা ইজ আওয়ার ফ্রেন্ড। অ্যান্ড চায়না ইজ এ গ্রেট কান্ট্রি। ডেভেলপ আওয়ার রিলেশনস। প্রোমোট আওয়ার ফ্রেন্ডশিপ। রিমেম্বার, দিজ ইজ দ্য কান্ট্রি টু হুইচ উই লুক ফরওয়ার্ড। রিমেম্বার, দিজ ইজ দ্যা কান্ট্রি ইন হুইচ উই ক্যান ফুললি ট্রাস্ট।’ কে জানত, জেনারেল জিয়ার সঙ্গে সেটাই হবে আমার শেষ সাক্ষাৎ। তাঁর বিদায়বেলার কথাগুলো এখনো আমি শুনতে পাই। আমার কানে অনুরণিত হয়।
তখনো আমি বেইজিংয়ে। ১৯৮১ সালের ৩০ মের ভোরবেলা আমার বাসার টেলিফোনটি অনবরত বেজে চলেছে। এত ভোরে কখনো কেউ ফোন করে না। বুকটা ধড়াস করে উঠল। ঢাকা থেকে হবে হয়তো, কোনো দুঃসংবাদ। রিসিভার তুলতেই চীনা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ফরেন লিয়াজোঁ অফিসার কর্নেল সু চুইন ফিংয়ের পরিচিত গলা। ‘আপনি কি জানেন, আপনাদের রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াকে আজ গভীর রাতে চট্টগ্রামে হত্যা করা হয়েছে? কারা করেছে? কেন করেছে? তিনি আমাদের একজন খাঁটি বন্ধু ছিলেন...।’
আমি স্তম্ভিত। আমি বাকরুদ্ধ। আমি বিদ্যুৎস্পৃষ্ট। কর্নেল সু ওদিক থেকে বলে চলেছেন, ‘ব্রিগেডিয়ার, আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন? ব্রিগেডিয়ার, আপনি কি আমাকে শুনছেন?...।’ আমি নিশ্চুপ। আমি হতবাক। আমি নিথর।
রবীন্দ্রনাথের কবিতার দুটি লাইন আজ জিয়া স্মরণে তাঁকে নিবেদন করছি।
‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী, ভয় নাই ওরে ভয় নাই
নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান, ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।’
জিয়া মৃত্যুঞ্জয়ী। জিয়া বাংলার উত্তর আকাশের জ্বল জ্বল করা চিরভাস্বর সেই ধ্রুব নক্ষত্রটি।
লে. জেনারেল মাহবুবুর রহমান (অব.): সাবেক সেনাপ্রধান।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন