সৈয়দ আবুল মকসুদ | তারিখ: ২২-০৫-২০১২
প্রাগৈতিহাসিক প্রত্নপ্রস্তর যুগের পাথরের তৈরি অস্ত্রফলক পাওয়া গেছে। মাটি খুঁড়ে প্রত্নতত্ত্ববিদেরা নবপ্রস্তর যুগের মৃৎপাত্রের সন্ধান পান। সুমেরীয় ও ব্যাবিলনীয় সভ্যতা এবং হরপ্পা সভ্যতার তৈজসপত্রের যে নিদর্শন পাওয়া যায়, তার মধ্যে পাথর ও ধাতুর বাটি ছিল। আদিম মানুষ তাদের প্রয়োজন মেটাতে যেসব পাত্র বানাতে শেখে, সেগুলোর মধ্যে বাটি অন্যতম।
প্রথম দিকে এবং তারপর হাজার হাজার বছর তরল খাদ্য ও পানীয় পরিবেশনে বাটি ব্যবহূত হতো। ধীরে ধীরে বাড়ে তার বহুমাত্রিক ব্যবহার। ব্যাবিলন ও হরপ্পা থেকে বাটি যখন বাংলার মাটি পর্যন্ত আসে, তখন তার ব্যবহারের পরিধি আরও বেড়ে যায়। বুদ্ধিমান ও প্রতিশোধকামী বাঙালি বাটির ব্যবহার শুধু ঘন দুধের পায়েস খাওয়ার মধ্যেই সীমিত রাখেনি। পায়েস খাওয়া থেকে চোর ধরা পর্যন্ত বিচিত্র কাজে ব্যবহূত হতে থাকে বাটি।
আজ ঘটেছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অকল্পনীয় অগ্রগতি। এখনই আবার দেশজ সনাতনবিদ্যার পুনর্ব্যবহার শুরু হয়েছে অনেক দেশে। প্রাচ্যের বহু দেশে দেখা যাচ্ছে, দেশজ পদ্ধতিতে গাছগাছড়া-লতাগুল্মের চিকিৎসাপ্রথার প্রয়োগ। যেসব দেশ মাত্র তিন বছরেই ষোলোআনা ডিজিটাল হয়ে গেছে, সেখানকার মধ্যযুগীয় মানসিকতাসম্পন্ন মানুষও বাটি চালানোর সনাতন প্রথা ফিরিয়ে আনতে বদ্ধপরিকর। ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরায় যে অপরাধীকে ধরা সম্ভব নয়, তাকে পাকড়াও করার অব্যর্থ অস্ত্র বাটি চালান।
বাটি চালান কোনো রূপকথা নয়। একসময় তা ছিল গ্রামবাংলার বাস্তবতা। ১৯৫০-৫২ সালের দিকে আমি দুটি বাটি চালানের ঘটনা দেখেছি। আমাদের এক আত্মীয়ার একটি সোনার চেন চুরি গিয়েছিল। গেঁয়ো বাটপার ধরনের একদল লোক বাটি চালান দেওয়ার ব্যবস্থা করে। বাটি ঠেলার জন্য খুঁজে বের করা হয় কথিত তুলা রাশির এক লোককে, যে আবার আরেক বাটপার। যার চেন খোয়া গিয়েছিল, তার পায়ের কাছ থেকে বাটি ছুটল। ছুটল মানে তুলা রাশিওয়ালা ঠেলতে লাগল। সে বাটি সারা গ্রাম এদিক-ওদিক ঘুরল। আমরাও বাটিওয়ালার পিছে পিছে ছুটলাম। একপর্যায়ে সে বাটি গ্রামের প্রান্তে খেতের মধ্যে কাজ করছিল এমন এক লোকের পায়ের কাছে গিয়ে থেমে গেল। কাউকে আর বলে দিতে হলো না, চেনের চোরটি কে। লোকটি ছিল নিরীহ গোছের। প্রতিবাদ করল না, তবে চেনও ফেরত দিল না। দুদিন পরে তার লাশ ঝুলতে দেখা গেল তার বাড়ির আমগাছে। তার দুদিন পর চেনটি পাওয়া গেল আসল চোরের কাছে।
সামন্ত যুগে চিহ্নিত চোর ধরতে ব্যবহূত হতো বাটি। আজ গণতন্ত্রের যুগ। আজ প্রতিপক্ষকে পাকড়াও করতে চালান দেওয়া হবে বাটি। বাটি চালান একটি বাঙালি জাতীয়তাবাদী পদ্ধতি। ডিজিটাল বাংলাদেশও থাকবে, বাটি চালানের বাংলাদেশও থাকবে পাশাপাশি। বাংলাদেশ-মার্কা গণতন্ত্রকে আমরা বলতে পারি ‘বাটি চালান গণতন্ত্র’।
বিরোধী দল ক্ষমতায় না যাওয়ার দুঃখে এবং ক্ষমতায় যাওয়ার দুরাশায় হইচই করে। যেসব নেতা হইচই করেন, পুলিশ তাঁদের পাকড়াও করে লোহার খাঁচায় পুরেছে। তাঁদের ছাড়াতে যাঁরা হইচই করবেন, তাঁদের সম্পর্কেও নাশকতার প্রমাণ পাওয়া যাবে। লোকালয়ে থাকলে তাঁদের খুঁজে বের করবে পুলিশ। ভয়ে তাঁরা বন-বাদাড়ে গিয়ে আত্মগোপন করতে পারেন। সে অবস্থায় প্রধান প্রতিমন্ত্রী ঠিকই বলেছেন, ‘আন্দোলনের জন্য ১৮ দলীয় সব নেতাকে বাটি চালান দিয়েও পাওয়া যাবে না।’
বাটি চালানপদ্ধতি চালু হলে রাষ্ট্রের ব্যয় অনেক কমে যাবে। পুলিশ বাহিনীকে আধুনিকায়ন না করলেও চলবে। গোয়েন্দাদের খাটনি কমে যাবে পনেরো আনা, যা করার বাটিই করে দেবে। বাটিই বলে দেবে, এক বাস পোড়াতে আর এক ককটেল ফাটাতে একবাক্যে হুকুম দিয়েছিলেন ৪৪ নেতা। যদিও হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে বোমা মারার হুকুমদাতা দুজনের বেশি নন।
আইয়ুব খানের জামানায় বাটি চালান দিয়ে নেতাদের ধরতে দেখেছি মোনায়েম খানকে। এবং একপর্যায়ে জেলগুলো ভরে যাওয়ার পর বাটি চালান দিয়েও আমেনা বেগম ও মিজান চৌধুরী ছাড়া আর কাউকে খুঁজে পাওয়া গেল না। কিন্তু দুই বছর না যেতেই বাটি চালান দিয়েও খানসাহেবদের লীগের একজনকেও খুঁজে পাওয়া গেল না সত্তরের নির্বাচনের দিন রাত বারোটায়। সারা দেশের লোক দেখতে লাগল অন্য লীগের লোকদের।
বঙ্গীয় বাটি দুই প্রকার: একটি দৃশ্যমান, আরেকটি অদৃশ্য। বাংলাদেশে অদৃশ্য বাটি চালান চলছে বহুদিন থেকে। জোট সরকারের প্রধান প্রতিমন্ত্রী ছিলেন বাবর সাহেব। ১০ ট্রাক অস্ত্রের মামলাই হোক বা একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনাই হোক, গোয়েন্দাদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে না দিয়ে নিজেই বাটি চালান দিলেন। বাটি গিয়ে খপ্ করে অপরাধীদের ধরে ফেলল। পরিণাম হলো এই যে এখন তিনি নিজে এবং শীর্ষ গোয়েন্দা কর্মকর্তারা রাজ অতিথি।
বাংলাদেশে বাটির বহুমুখী ব্যবহার আরও বাড়াতে হবে। বাংলাদেশের জনগণের উচিত যখন বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিরা আসবেন, তাঁদের একটি বাটি উপহার দিয়ে বলা: চোর চোর বলছেন, এইটা চালান দেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যানের প্রয়োজন এখন একটি বাটি। তদন্ত করে কাঁঠালের বস্তায় যখন কোনো দুর্নীতির প্রমাণ মিলবে না, তখন চালান দেবেন বাটি। সব দেখা হয়ে গেছে। বাটিই এখন একমাত্র ভরসা। জয় বাংলা। জয় বাংলার বাটি।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
প্রাগৈতিহাসিক প্রত্নপ্রস্তর যুগের পাথরের তৈরি অস্ত্রফলক পাওয়া গেছে। মাটি খুঁড়ে প্রত্নতত্ত্ববিদেরা নবপ্রস্তর যুগের মৃৎপাত্রের সন্ধান পান। সুমেরীয় ও ব্যাবিলনীয় সভ্যতা এবং হরপ্পা সভ্যতার তৈজসপত্রের যে নিদর্শন পাওয়া যায়, তার মধ্যে পাথর ও ধাতুর বাটি ছিল। আদিম মানুষ তাদের প্রয়োজন মেটাতে যেসব পাত্র বানাতে শেখে, সেগুলোর মধ্যে বাটি অন্যতম।
প্রথম দিকে এবং তারপর হাজার হাজার বছর তরল খাদ্য ও পানীয় পরিবেশনে বাটি ব্যবহূত হতো। ধীরে ধীরে বাড়ে তার বহুমাত্রিক ব্যবহার। ব্যাবিলন ও হরপ্পা থেকে বাটি যখন বাংলার মাটি পর্যন্ত আসে, তখন তার ব্যবহারের পরিধি আরও বেড়ে যায়। বুদ্ধিমান ও প্রতিশোধকামী বাঙালি বাটির ব্যবহার শুধু ঘন দুধের পায়েস খাওয়ার মধ্যেই সীমিত রাখেনি। পায়েস খাওয়া থেকে চোর ধরা পর্যন্ত বিচিত্র কাজে ব্যবহূত হতে থাকে বাটি।
আজ ঘটেছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অকল্পনীয় অগ্রগতি। এখনই আবার দেশজ সনাতনবিদ্যার পুনর্ব্যবহার শুরু হয়েছে অনেক দেশে। প্রাচ্যের বহু দেশে দেখা যাচ্ছে, দেশজ পদ্ধতিতে গাছগাছড়া-লতাগুল্মের চিকিৎসাপ্রথার প্রয়োগ। যেসব দেশ মাত্র তিন বছরেই ষোলোআনা ডিজিটাল হয়ে গেছে, সেখানকার মধ্যযুগীয় মানসিকতাসম্পন্ন মানুষও বাটি চালানোর সনাতন প্রথা ফিরিয়ে আনতে বদ্ধপরিকর। ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরায় যে অপরাধীকে ধরা সম্ভব নয়, তাকে পাকড়াও করার অব্যর্থ অস্ত্র বাটি চালান।
বাটি চালান কোনো রূপকথা নয়। একসময় তা ছিল গ্রামবাংলার বাস্তবতা। ১৯৫০-৫২ সালের দিকে আমি দুটি বাটি চালানের ঘটনা দেখেছি। আমাদের এক আত্মীয়ার একটি সোনার চেন চুরি গিয়েছিল। গেঁয়ো বাটপার ধরনের একদল লোক বাটি চালান দেওয়ার ব্যবস্থা করে। বাটি ঠেলার জন্য খুঁজে বের করা হয় কথিত তুলা রাশির এক লোককে, যে আবার আরেক বাটপার। যার চেন খোয়া গিয়েছিল, তার পায়ের কাছ থেকে বাটি ছুটল। ছুটল মানে তুলা রাশিওয়ালা ঠেলতে লাগল। সে বাটি সারা গ্রাম এদিক-ওদিক ঘুরল। আমরাও বাটিওয়ালার পিছে পিছে ছুটলাম। একপর্যায়ে সে বাটি গ্রামের প্রান্তে খেতের মধ্যে কাজ করছিল এমন এক লোকের পায়ের কাছে গিয়ে থেমে গেল। কাউকে আর বলে দিতে হলো না, চেনের চোরটি কে। লোকটি ছিল নিরীহ গোছের। প্রতিবাদ করল না, তবে চেনও ফেরত দিল না। দুদিন পরে তার লাশ ঝুলতে দেখা গেল তার বাড়ির আমগাছে। তার দুদিন পর চেনটি পাওয়া গেল আসল চোরের কাছে।
সামন্ত যুগে চিহ্নিত চোর ধরতে ব্যবহূত হতো বাটি। আজ গণতন্ত্রের যুগ। আজ প্রতিপক্ষকে পাকড়াও করতে চালান দেওয়া হবে বাটি। বাটি চালান একটি বাঙালি জাতীয়তাবাদী পদ্ধতি। ডিজিটাল বাংলাদেশও থাকবে, বাটি চালানের বাংলাদেশও থাকবে পাশাপাশি। বাংলাদেশ-মার্কা গণতন্ত্রকে আমরা বলতে পারি ‘বাটি চালান গণতন্ত্র’।
বিরোধী দল ক্ষমতায় না যাওয়ার দুঃখে এবং ক্ষমতায় যাওয়ার দুরাশায় হইচই করে। যেসব নেতা হইচই করেন, পুলিশ তাঁদের পাকড়াও করে লোহার খাঁচায় পুরেছে। তাঁদের ছাড়াতে যাঁরা হইচই করবেন, তাঁদের সম্পর্কেও নাশকতার প্রমাণ পাওয়া যাবে। লোকালয়ে থাকলে তাঁদের খুঁজে বের করবে পুলিশ। ভয়ে তাঁরা বন-বাদাড়ে গিয়ে আত্মগোপন করতে পারেন। সে অবস্থায় প্রধান প্রতিমন্ত্রী ঠিকই বলেছেন, ‘আন্দোলনের জন্য ১৮ দলীয় সব নেতাকে বাটি চালান দিয়েও পাওয়া যাবে না।’
বাটি চালানপদ্ধতি চালু হলে রাষ্ট্রের ব্যয় অনেক কমে যাবে। পুলিশ বাহিনীকে আধুনিকায়ন না করলেও চলবে। গোয়েন্দাদের খাটনি কমে যাবে পনেরো আনা, যা করার বাটিই করে দেবে। বাটিই বলে দেবে, এক বাস পোড়াতে আর এক ককটেল ফাটাতে একবাক্যে হুকুম দিয়েছিলেন ৪৪ নেতা। যদিও হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে বোমা মারার হুকুমদাতা দুজনের বেশি নন।
আইয়ুব খানের জামানায় বাটি চালান দিয়ে নেতাদের ধরতে দেখেছি মোনায়েম খানকে। এবং একপর্যায়ে জেলগুলো ভরে যাওয়ার পর বাটি চালান দিয়েও আমেনা বেগম ও মিজান চৌধুরী ছাড়া আর কাউকে খুঁজে পাওয়া গেল না। কিন্তু দুই বছর না যেতেই বাটি চালান দিয়েও খানসাহেবদের লীগের একজনকেও খুঁজে পাওয়া গেল না সত্তরের নির্বাচনের দিন রাত বারোটায়। সারা দেশের লোক দেখতে লাগল অন্য লীগের লোকদের।
বঙ্গীয় বাটি দুই প্রকার: একটি দৃশ্যমান, আরেকটি অদৃশ্য। বাংলাদেশে অদৃশ্য বাটি চালান চলছে বহুদিন থেকে। জোট সরকারের প্রধান প্রতিমন্ত্রী ছিলেন বাবর সাহেব। ১০ ট্রাক অস্ত্রের মামলাই হোক বা একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনাই হোক, গোয়েন্দাদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে না দিয়ে নিজেই বাটি চালান দিলেন। বাটি গিয়ে খপ্ করে অপরাধীদের ধরে ফেলল। পরিণাম হলো এই যে এখন তিনি নিজে এবং শীর্ষ গোয়েন্দা কর্মকর্তারা রাজ অতিথি।
বাংলাদেশে বাটির বহুমুখী ব্যবহার আরও বাড়াতে হবে। বাংলাদেশের জনগণের উচিত যখন বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিরা আসবেন, তাঁদের একটি বাটি উপহার দিয়ে বলা: চোর চোর বলছেন, এইটা চালান দেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যানের প্রয়োজন এখন একটি বাটি। তদন্ত করে কাঁঠালের বস্তায় যখন কোনো দুর্নীতির প্রমাণ মিলবে না, তখন চালান দেবেন বাটি। সব দেখা হয়ে গেছে। বাটিই এখন একমাত্র ভরসা। জয় বাংলা। জয় বাংলার বাটি।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন