বৃহস্পতিবার, ২৪ মে, ২০১২

অবাক পৃথিবী অবাক করলে তুমি


কা মা ল লো হা নী 
রক্তোৎপল বাংলাদেশ। এর একটি অংশে রয়েছে প্রতিবেশী হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ। ভারতের একটি রাজ্য হিসেবে। আমাদের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি সবই এক। কিন্তু দেশ বিভাগের প্রয়োজনে ইংরেজরা বঙ্গভঙ্গের যে পরিকল্পনা নিয়ে সেদিন প্রবল বাধার সম্মুখীন হয়েছিল, সেটাই কার্যকর করল চার দশক পরে, ১৯৪৭ সালে তথাকথিত ¯^াধীনতার টোপ রাজনীতির প্রধান দুই দল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং নিখিল ভারত মুসলিম লীগের মতৈক্যে। আমাদের মাতৃভ‚মি পূর্ববঙ্গের মানুষ ‘পাকি¯—ান’ সৃষ্টির জন্য ‘লড়কে লেঙ্গে পাকি¯—ান’ ¯ে­াগানে আপ­ুত হয়ে প্রচুর পরিমাণে ভোট দিয়েছিলেন। জিন্নাহ সাহেব ছিলেন মুসলিম লীগের প্রধান। তার বক্তব্য ছিল, পাকি¯—ান হবে সব ধর্মের মানুষের বাসস্থান। অথচ এ খুব বেশিদিন গেল না, আমরা পূর্ব বাংলার মানুষ সংখ্যায় অনেক বেশি ছিলাম, পাঞ্জাব, সিন্ধু, উত্তর-পশ্চিম সীমাš— প্রদেশ এবং বেলুচি¯—ানের সর্বমোট তিন কোটির জায়গায় আমরা ছিলাম সাড়ে চার কোটি। প্রথমেই বাধা এলো ভাষার ওপর। মুসলিম লীগ শাসকচক্র তৎকালীন কোন অঞ্চলের ভাষা না হওয়া সত্তে¡ও ‘উর্দু’কে চাপিয়ে দেয়ার সিদ্ধাš— নিল। কিন্তু বাংলার দুরš— দামাল তর“ণ ছাত্রসমাজ প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠল। চক্রাš— আর বিশ্বাসঘাতকতার পরিণামে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্র“য়ারি ছাত্ররা রক্তাক্ত ইতিহাস রচনা করলেন। সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, সালাউদ্দিন, সফিউর প্রাণ দিয়ে মাতৃভাষার মান বাঁচালেন।
আমাদের যৌক্তিক দাবি ছিল : অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। সব আঞ্চলিক ভাষার সমান মর্যাদা চাই এবং সব রাজবন্দির মুক্তি চাই। 
১৯৫২ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যš— ভাষা সংগ্রাম অব্যাহতভাবে চলতে থাকে। ১৯৫৬ সালে পাকি¯—ানের সংবিধান গৃহীত হলে তাতে বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু কার্যকরী কোন পদ¶েপই নেয়া হয়নি তখন। ফলে ১৯৫৮ সালে সামরিক অভ্যুত্থানে হলে সংবিধান, পার্লামেন্ট সব বাতিল করে দেয় জেনারেল আইয়ুব খান। এই সামরিক জেনারেল দেশের (পাকি¯—ানের) সর্বময় ¶মতার অধিকারী হয়ে বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যের ওপর আঘাত করতে শুর“ করল। প্রথমেই একুশে ফেব্র“য়ারি যেন পালিত হতে না পারে তার জন্য চেষ্টা করতে থাকল, কিন্তু বাংলার সচেতন জনগোষ্ঠী এবং প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিষেধাজ্ঞা উপে¶া করে মহান ‘শহীদ দিবস’ পালন করে। এ হ¯—¶েপ কার্যকর করতে না পেরে ১৯৬১ সালে কবিগুর“ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জš§শতবর্ষ যাতে পালিত হতে না পারে তার জন্য বেতারে রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হল। শুধু কি তাই, কোন শিল্পীই কপালে টিপ পরে গান গাইতে পারবে না। এছাড়া নানা ধরনের নিবর্তনমূলক আচরণ ও নিষেধাজ্ঞা জারি করতে থাকল। কিন্তু যে দেশে সাধ্য না থাকলেও রবীন্দ্রনাথ, নজর“ল ও সুকাšে—র একসঙ্গে জšে§াৎসব করে এসেছে জনসচেতন বাঙালিরা, যে দেশের মুক্তি সংগ্রামে যাদের কবিতা, গান, নাটক, নৃত্যনাট্য ‘সাংস্কৃতিক লড়াই’-এর শাণিত হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহƒত হয়েছে, সেই দেশে সুকাš— আজ একেবারে নির্বাসিত। মজার ব্যাপার, সেইখানে প্রকৃত আর øিগ্ধতার কবি জীবনানন্দ দাশ স্থান পেয়েছেন অনায়াসে। 
অথচ পাকি¯—ানি দুঃশাসনকে প্রতিহত করা কিংবা বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও ঐতিহ্যবাহী লোকজ সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার ঔপনিবেশিক চক্রাš—কে প্রতিরোধ করে নিজ¯^ কৃষ্টিকে সমুন্নত রাখার প্রয়োজনে আমরা বাংলাদেশের সব মানুষই তো একাট্টা হয়েছিলাম। লড়াই করেছি সেই সাম্প্রদায়িক অপসংস্কৃতির ভাগাড়Ñ মুসলিম লীগের ষড়যন্ত্রমূলক ‘পাকি¯—ানি কালচার’-এর বির“দ্ধে। এ লড়াই ছিল লীগশাহী এবং সামরিক অপশাসন কালেও। সংস্কৃতি তখন মূল রাজনীতিকে সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী করেছে প্রবলভাবে। সে সময়ের প্রতিবাদী সংস্কৃতি আয়োজনে এই তিন কবি ছিলেন প্রধান। তাদের রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছিল সুস্পষ্ট। ¯^দেশ প্রেম ছাড়া ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চক্রাš—কে র“খে দাঁড়ানোর হাতিয়ার হিসেবে এই তিন কবিÑ রবীন্দ্রনাথ, নজর“ল ও সুকাš—কে আমরা পথপ্রদর্শক হিসেবেই পেয়েছিলাম। কবিগুর“ পর্যš— জালিয়ানওয়ালাবাগের ফ্যাসিস্ট হত্যাকাÊের পর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দেয়া উপাধি বর্জন করেছিলেন। ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর ১৯০৫ সালে বাংলাকে বিভক্ত করার নৃশংস অপচেষ্টাকে র“খে দিয়ে বাংলার রক্তিম প্রাš—রে নতুন যে লড়াইয়ের নিশান উড়েছিল, তাকে আরও বেগবান করতে কবিগুর“ই রচনা করেছিলেন অমিত দেশপ্রেমে উজ্জীবনের গানÑ ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’Ñ যা অবশেষে ব্রিটিশ চক্রাšে— খÊিত বাংলার পূর্বাংশের পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের ‘জাতীয় সঙ্গীত’ হিসেবে গৃহীত হয়েছে। যদিও তৎকালীন পাকি¯—ানি নিপীড়ন-নির্যাতনের বির“দ্ধে পূর্ববঙ্গের ¯^ায়ত্তশাসন থেকে মুক্তির সংগ্রামে রাজনৈতিক লড়াইয়ের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অবশ্যগীত গান হয়ে দাঁড়িয়েছিল এই ‘সোনার বাংলা’। তখনকার যে কোন সভা-সমাবেশ কিংবা প্রতিবাদী অনুষ্ঠানের অবশ্যগীত গান ছিল এটি। মুক্তিযুদ্ধকালেও ‘¯^াধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ থেকে এ গানটি অগণিতবার পরিবেশন করা হয়েছে। এছাড়াও ‘মর“বিজয়ের কেতন উড়াও’, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে’, ‘হিংসায় উš§ত্ত পৃথ্বী’, ‘সঙ্কোচের বিহŸলতায় নিজেরে অপমান’ এমন বহু গান।
আমাদের রাজনৈতিক লড়াই-সংগ্রামে বিদ্রোহী কবি কাজী নজর“ল ইসলামেরও গান, কবিতা নানাভাবে সমৃদ্ধ, শাণিত করেছে আমাদের আন্দোলনকে। আমরা তো ‘বিদ্রোহী’ কবিতা আবৃত্তি করতে করতে একদিন সুরারোপই করে ফেললাম। সুর সংযোজন করলেন দেশের প্রখ্যাত নজর“ল সঙ্গীত গায়ক গণশিল্পী শেখ লুৎফর রহমান। পাকি¯—ানবিরোধী আন্দোলনে নজর“লের যে গানগুলো গাওয়া হতো, তার মধ্যে ‘শিকল পরা ছল’, ‘কারার ঐ লৌহকপাট’, ‘দুর্গম গিরি’, ‘চল চল চল’Ñ এ ধরনের অসাম্প্রদায়িক, দেশপ্রেমমূলক ও উদ্দীপনা-প্রেরণাউদ্দীপক গানই ছিল প্রধান। ‘কামাল পাশা’ কবিতাটি আবৃত্তির সঙ্গে সঙ্গে সুর সংযোজন করেছিলেন শেখ লুৎফর রহমান এবং তিনিই গাইতেন এই জাগরণমূলক সাহসের গানটি। তার লেখা আমাদের কেবল উজ্জীবিতই করেনি, লড়তে শিখিয়েছে। র“টির দোকানে অনির্দিষ্টকাল শ্রম বিক্রি করে যে অভিজ্ঞতা ‘দুখু মিয়া’ সঞ্চয় করেছিল, তারই সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল সৈনিক জীবনে অর্জিত যুদ্ধবিরোধী, মানুষ হত্যার বির“দ্ধে প্রবল ঘৃণা, আর তাকেই উস্কে দিয়েছিলেন কমরেড মোজাফফর আহমদ। যার বিস্ফোরণ ঘটেছিল ‘নবযুগ’ পত্রিকায় তার সম্পাদকীয় ¯—ম্ভে। তাই তো তার রচনাবলীতে উঠেছে ‘অবাধ্যতার’ ঢেউ। তাই তো দেখি, মেহনতি মানুষের প্রতি কবির দৃঢ় অঙ্গীকার, তিনি রচনা করেছিলেন কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল গানের বঙ্গানুবাদ। এটাই তার রাজনৈতিক কমিটমেন্ট। আমাদের ধারণা, নজর“ল কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের অনুসরণে যে গানটি রচনা করেছেন, সম্ভবত এটিই বাংলায় রচিত প্রথম গণসঙ্গীত। 
পাকি¯—ানি দুঃশাসন, শোষণ-পীড়নের বির“দ্ধে আমাদের সর্বাÍক সংগ্রামে এবং সর্বশেষ বাংলার মানুষের মুক্তিযুদ্ধেও বিদ্রোহী কবির রচনাবলী আমাদের প্রেরণা জাগাতে এবং লড়তে সাহস জুগিয়েছে নিরš—র। তাই তো কবিকে যেমন ‘জাতীয় কবি’ হিসেবে সম্মানিত করা হয়েছে, তেমনি তার কবিতা ‘চল চল চল ঊর্ধ্বগগনে বাজে মাদল’ গানটিকে রণসঙ্গীত হিসেবে নির্বাচিত করা হয়েছে। 
কিন্তু ব্যত্যয় ঘটেছে কবি-কিশোর সুকাš— ভট্টাচার্যের ¶েত্রে। মুক্তিযুদ্ধোত্তর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে তার অবদানকে, কেন জানি না, একেবারে নির্বাসনে দিলাম। কোন ¶েত্রেই তার যে কোন অবদান বা ভ‚মিকা আছে, তা বেমালুম ভুলে গেলাম। সচেতনভাবেই যেন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান, রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ এমনকি সাংস্কৃতিক আয়োজনের ¶েত্রেও এই সাহসী-তার“ণ্যদীপ্ত কবির বলিষ্ঠ উদ্ভাবন ও রচনাবলী আমাদের জীবন থেকেই অপসারণ করে ফেললাম। প্রগতিশীল সচেতন জনগোষ্ঠী যারা সত্যিকার মুক্তির লড়াইয়ে সংগ্রামী চৈতন্যকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন, সুকাš— কেবল তাদের গÊিতেই আবদ্ধ হয়ে গেলেন। যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করতে ব্যর্থ হলাম। আমার তো অনেকের মতোই ধারণা হল, বিপ­বে বিশ্বাসী কবিকে যেন প্রশ্রয় দেয়া না হয়, সেজন্যই সচেতনভাবে তাকে বিসর্জন। 
পাকি¯—ানের মুসলিম লীগশাহীর নিপীড়ন শুর“ হওয়ার সময় থেকেই কবি-কিশোর সুকাšে—র অনন্য কাব্যসম্ভার আমাদের চেতনায় সংগ্রামের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। তার গান আমাদের নবনবীন জীবন গড়ার পথে ত‚র্য নিনাদের মতো ধ্বনিত হয়েছে। মানুষের আদত মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাসী তর“ণ এ কবির এই উপলব্ধি ছিল শোষণ-বঞ্চণার বির“দ্ধে। তাই শাšি—র পৃথিবী গড়তে নিরস্ত্র মানুষকে পর্যš— সংগঠন শক্তির ঐক্যে লড়ার তাগিদ দিয়ে গেছেন। শ্রেণী শোষণহীন সাম্যের সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তিনি তার ¶ুরধার লেখনীকে প্রকাশ করেছেন সংঘবদ্ধ মানুষের প্রবল শক্তি হিসেবে। এই দ্ব›দ্ববি¶ুব্ধ, শোষিত পৃথিবীকে তিনি ‘শিশুর বাসযোগ্য’ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিলেন। 
আমরা তাই কবিগুর“ ও বিদ্রোহী কবির পাশাপাশি কবি-কিশোর সুকাš— ভট্টাচার্যের গণমুখী লেখা এবং চৈতন্য-জাগরণী কাব্যগাথা ও রচনাবলীকে নিরš—র অপরিহার্য হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছি পাকি¯—ানি শোষণ-যন্ত্রণার প্রক্রিয়াকে দূর করে সুখী-সমৃদ্ধ দেশ গড়ার ল¶্য।ে তিনি তার কাব্যের জগতে সব ভাবালুতাকে পরিহার করে বা¯—ব জীবনে মানুষকে শোষণের সব অপশক্তির বির“দ্ধে রচনা করেছেন জ্বলে ওঠার সাহসী ও বলিষ্ঠ কাব্য। সেই সঙ্গে কবি শোষণ-বঞ্চনার প্রতীকী কাহিনী কবিতায় তুলে ধরে মানুষকে সচেতন করেছেন এবং সংগঠিত শক্তিতে গড়ে ওঠার ডাক দিয়েছেন। তাই তো তার রচিত কবিতাকে মানুষের লড়াই-সংগ্রামের প্রয়োজনে গণসঙ্গীতে রূপ দিয়েছেন সুরকার। ‘অবাক পৃথিবী অবাক করলে তুমি, জšে§ই দেখি ¶ুব্ধ ¯^দেশভ‚মি’ কিংবা ‘বিদ্রোহ আজ বিপ­ব চারিদিকে’-এর মতো সাহসী উচ্চারণ-আহŸান শুনেছি তার রচনায়। কিংবা ‘অভিযান’-এ এই দেশের মানুষের পোষণ-নিপীড়নকে অগ্রাহ্য করে জনতার বিজয় সূচনার অভিযান হিসেবে শোষিত মানুষের সম্মুখে চক্রাš—-দুর্ভি¶ের বির“দ্ধে ঐক্যের আহŸান নিয়ে হাজির হয়েছেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী চক্রাšে—র কালে ভারতবাসীকে নিঃগৃহীত করতে যে প্রক্রিয়া চালানো হয়েছিল, তারই এক কাহিনী ‘রানার’ কবিতা, যাকে গানে পরিণত করে মানুষের জীবনের চরম দুঃখের বির“দ্ধে বিদ্রোহ করার আহŸান জানিয়েছেন। এখানে উলি­খিত গানগুলোয় সুর সংযোজনা করেছিলেন শিল্পী সংগ্রামী সলিল চৌধুরী এবং সব ক’টিতেই কণ্ঠ দিয়েছেন অমর কণ্ঠশিল্পী হেমš— মুখোপাধ্যায়। আন্দোলনের প্রয়োজনে আমরা কবির ‘বোধন’ কবিতার একটা অংশকে সুরারোপ করে গেয়েছি। সুরকার ছিলেন পাবনার এক সাধারণ গণশিল্পী শম্ভু জোয়ারদার, সেই পঞ্চাশের দশকের প্রথম দিকেই। আরও পরে দেশময় যখন পাকি¯—ানবিরোধী সর্বাÍক যুদ্ধের পূর্বাভাস ধ্বনিত হয়েছে, তখন আমাদের শ্রদ্ধেয় গণসঙ্গীত সুরকার শেখ লুৎফর রহমান সুর করলেন, ‘হিমালয় থেকে সুন্দরবন হঠাৎ বাংলাদেশ, জেগে জেগে উঠে পদ্মার উচ্ছ¡াসে, আমি পাই তার উদ্দেশ’। পাকি¯—ানবিরোধী গণআন্দোলনে সুকাšে—র এই গণসঙ্গীতগুলো মানুষের মনকে প্রবলভাবে দোলা দিয়েছে। সেই পঞ্চাশের দশক থেকে শুর“ করে যে কবির গান, কবিতা, গীতিনাট্য ও নৃত্যনাট্য গণআন্দোলনকে শোষণ-দুঃশাসনের বির“দ্ধে র“খে দাঁড়ানোর সাহস জুগিয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধকালে ¯^াধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রবল প্রাণের অমূল্য সম্পদ ছিল মুক্তিফৌজের কাছে, জীবনকে বাজি রাখার লড়াইয়ে কিংবা অবর“দ্ধ বাংলায় পাকি¯—ানি দস্যু পিশাচদের আক্রমণ ও হত্যার আতংকে দিনরাত অতিবাহিত করা অগণিত মানুষের জন্য ছিল বাঁচার সাহস, প্রতিরোধের উজ্জ্ব¡ল শিখার মতো; যে কবির এ অবদান পাকি¯—ান শোষণ-শাসনের বির“দ্ধে নিরš—র ও সংকল্পবদ্ধ গণশক্তির অন্যতম মন্ত্র, সেই কবিকেই তো মুক্তিযুদ্ধে রণাঙ্গনে আমরা নিত্যই পেয়েছিলাম সহযোদ্ধা হিসেবে। তাকে কেন আমরা সচেতনভাবে প্রত্যাখ্যান করলাম, ঈপ্সিত মুক্তি পাওয়ার পর থেকেই। তারই জায়গায় বসিয়ে দিলাম জীবনানন্দ দাশের নাম। তার ‘বনলতা সেন’ কেন বলি, বহু কবিতাই বাংলার প্রকৃতি, প্রেম ও জীবনকে উপলব্ধির সুযোগ করে দিয়েছে কাব্যগুণে। কিন্তু পাকি¯—ানবিরোধী লড়াইয়ে কি আমরা তেমন সক্রিয়ভাবে তাকে পেয়েছিলাম? সুকাšে—র সঙ্গে তাকে তুলনা করতে চাই না। কিন্তু অঙ্গীকার, রাজনৈতিক চেতনা ও মুক্তির উদ্দেশ্যে নিবেদিত কতটা হতে পেরেছিলেন জীবনানন্দ দাশ?
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকালে গণসঙ্গীত শিল্পী-সুরকার অজিত রায় ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি’ কবিতাটিকে গানে রূপাš—রিত করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পর সম্ভবত ‘বনলতা সেন’ কবিতাটিও গান হয়েছিল। কিন্তু সেই গানগুলোকে বড়জোর দেশগান বলা যেতে পারে, ¯^দেশী কিংবা মুক্তিযুদ্ধের গান বা আন্দোলন-সংগ্রামের গান বলা যাবে না। তবে কেন সুকাš— হারিয়ে গেলেন, জীবনানন্দ দাশের কাছে। সুদীর্ঘ সংগ্রামী ভ‚মিকার কবিকে কেন বিসর্জন দেয়া হল প্রকৃতি ও প্রেমের কেবল কাব্যময়তার কাছে এবং কারা দিলেন? 
এ কি তবে রাজনীতির ভেতর রাজনীতিরই অন্য ধরনের চক্রাš— নাকি সিদ্ধাš—? যে কবি পাকি¯—ানকালে সংগ্রামের উপাদান তৈরি করে আমাদের বলিষ্ঠ ভ‚মিকা নিতে সাহস দিলেন, এমনই একজনকে প্রত্যাখ্যান করলাম কেন? এ কি মুক্তিযুদ্ধের চার ¯—ম্ভের কেবল বাঙালি জাতীয়তাবাদকেই প্রাধান্য দেয়ার জন্য? তবে কি একে তুলনা করতে পারি মুক্তিযুদ্ধ পরিকল্পনা ও পরিচালনাকারী তাজউদ্দীন আহমদকে অপসারণ করে খোন্দকার মোশতাক আহমেদকে পুষে রাখার জন্য। কারণ মোশতাক তো মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী মুক্তিযুদ্ধবিরোধী চক্রাšে—র শিরোমণি ছিলেন আওয়ামী লীগ রাজনীতির মধ্যেই। এর পেছনে যে মার্কিন তোষণনীতিই প্রকট হয়ে উঠেছিল, আমেরিকা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করা সত্তে¡ও। এ কেবল জাতীয়তাবাদী চরিত্র ধারণের কারণে? সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী তর“ণ কবির বৈপ­বিক চিš—া-চেতনা যেন মুক্তিযুদ্ধের পর আর প্রসারিত হতে না পারে, তারই জন্য? 
আমাদের দেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের চালিকাশক্তি ছিলেন সাধারণ মানুষÑ জনগণ। জনগণ সংগঠিত না হলে গেরিলা যুদ্ধ করা সম্ভব নয়। তেমনি মুক্তিসংগ্রামও শক্তিশালী হয় জনতার প্রতিরোধে। সে কথা ভুলে গেলে যে বিপন্ন অবস্থায় পড়তে হয়, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ বর্তমান বাংলাদেশ। আমরা মুক্তিযুদ্ধের ¯ে­াগান, ধর্মনিরপে¶তা, সমাজতন্ত্র, এমনকি গণতন্ত্র পর্যš— বিসর্জন দিয়েছি। না হলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুর“ করতে কেন এত বছর লাগল? কেন এবং কার নির্দেশে ওই বিচারে আমরা এগোয়নি? এতদিন প্রক্রিয়া শুর“ হলেও আমাদের মনে কেন সন্দেহ দেখা দিচ্ছে আদৌ সম্পন্ন হবে কিনা এ বিচার, নাকি দোরগোড়ায় পৌঁছে হাল ছেড়ে দিতে হবে? সেও বোধহয় একই কারণে। যে কারণে সুকাš—কে বিসর্জন দিতে কার্পণ্য করিনি, যে কারণে ধর্মনিরপে¶তাকে বাহাত্তরের সংবিধান থেকে বিসর্জন দিতে হাত সামান্যতম কাঁপেনি দেশের রাজনৈতিক নেতাদের। 
তাহলে এ প্রবণতা রাজনৈতিক ¶েত্রে যেমন দেশ ও দেশবাসীকে জিম্মি করে ফেলেছে, তেমনি যুদ্ধোš§াদ মার্কিন প্রভুকে সন্তুষ্ট করতে একের পর এক ছোট-বড় নেতার পরামর্শ শ্রবণ করেই চলেছি। এই পরামর্শে যেমন অনেক কিছুই বিসর্জন দিতে হচ্ছে, জনগণের ভোগাšি— বাড়ছে, তেমনি দেশের পরনির্ভরশীলতা ক্রমে বেড়েই চলেছে। হিলারির আগমনে কী পরমানন্দেই না গণমাধ্যমে নানা কাহিনীÑ সফলতার কেচ্ছা তুলে ধরা হচ্ছে। এই কেচ্ছাই যে কেলেংকারি লেপটে দেবে জনগণের কপালে, তা তো দেশের সাধারণ মানুষ বুঝতে পারছেন, নেতারা পারছেন না? কেউ কোমর বাঁধছেন ‘নালিশের তালিকা’ তৈরি করে ¶মতাসীনদের ধমকে দেয়ার আশায়। আবার সরকার তো নিরাপত্তার তিন-চার ¯—র নয়, নিñিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছে। তবু আমেরিকার ‘জ্যামার’ দল হিলারি ও প্রণবের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব নিয়ে ঢাকায় এসেছে। এই যে অবিশ্বাস ও প্রভুত্ব ফলানোর চেষ্টা, তা আজ নয়, মুক্তিযুদ্ধোত্তর সময় থেকেই চালিয়ে আসছে। আজ আমরা ওদের হাতেই বন্দি। ওরা যা বলবে, তাই শুনতে হবে। সুতরাং, বিপ­বে বিশ্বাসীদের মার্কিনিরা প্রশ্রয় তো দেবেই না, বর্তমান সরকারও তাদের লাই দেবে না।
কামাল লোহানী : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন