॥ ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী ॥
এক অদ্ভুত রাষ্ট্রাচরণের ভেতর দিয়ে এখন আমাদের পথ অতিক্রম চলছে। রাষ্ট্রের পুলিশ-প্রশাসন-বিচার সব কিছু যেন এক পুতুলনাচে পরিণত হয়েছে। কোনো এক বাজিকর সব সুতো নিজ হাতে নিয়ে যখন যেভাবে টানছেন তখন সব কিছুই সেভাবে নাচছে। কোনো কোনো বিচারকের ভাষা ও মন্তব্য কখনো কখনো সাধারণ নাগরিকদের স্তম্ভিত করে দিচ্ছে। কী হচ্ছে দেশটার ভেতরে! কোনো কিছুরই কোনো খেই করা যাচ্ছে না। এ দেশে ব্রিটিশ রাজতন্ত্র চালু থাকলেও তারা প্রায় এক শতাব্দী আগে এখানে ধীরে ধীরে জনপ্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম করার চেষ্টা করেছিল এবং সেভাবে এ দেশে ক্রমে ক্রমে একটি গণতান্ত্রিক কাঠামো গড়ে উঠেছিল। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৪৭ সালে
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল একটি গণতান্ত্রিক চেতনার ভেতর দিয়ে। এমনকি পূর্ব পাকিস্তান বা বর্তমান বাংলাদেশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত থাকবে নাকি পাকিস্তানের সাথে যোগ দেবে সেটিও ভোটের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়েছিল। সিলেটবাসী আন্দোলন করে, ভোট দিয়ে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। সব জায়গায়ই জনগণের মতামতকে বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল।
এরপর ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে। কিন্তু ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পর পাকিস্তানে তখনো ব্রিটিশ প্রশাসক ছিল। দেশকে পূর্ণাঙ্গ গণতান্ত্রিক পরিবেশে ফিরিয়ে আনতে তার প্রয়োজনীয়তা ছিল বলেই সে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। ধীরে ধীরে
পাকিস্তানি জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছিল। আমরাও পাকিস্তানের অংশ ছিলাম। বাংলাদেশ ছিল পূর্ব পাকিস্তান। সে আমলে নির্বাচন কমিশন কারচুপির কথা কল্পনাও করতে পারেনি। কেউ কোনো দিন অভিযোগও তোলেনি যে, নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে। অর্থাৎ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষেরা এসব দায়িত্ব পালন করতেন এবং সরকারই তাদের ওপর এই দায়িত্ব অর্পণ করত।
এখন মনে হচ্ছে চতুর্দিকে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন কোনো মানুষ নেই। বিবেকসম্পন্ন কোনো লোক নেই। পুলিশ বলি, প্রশাসন বলি, বিচার বিভাগ বলিÑ সর্বত্রই যেন এক সেবাদাস প্রদর্শনী। সরকার যা চায় পুলিশ সেভাবে রিপোর্ট দেয়। ধারণা করার কারণ সৃষ্টি হয়েছে যে, সরকার যা চায় বিচার বিভাগ সেভাবেই রায় দেন। কিংবা ততধিক কঠোর। এর কোথাও বিবেক-বুদ্ধি কাজ করছে বলে মনে হয় না। কোনো কোনো বিচারক কখনো কখনো যে ভাষায় কথা বলেন, তাতে স্তম্ভিত হয়ে যেতে হয়। যে দলই করেন না কেন, কোনো ব্যক্তি যখন বিচারকের আসনে বসেন, তখন আমরা নিরীহ-সরল বিশ্বাসী মানুষেরা মনে করতে চাই, তিনি বিচারক আসনের মর্যাদা সমুন্নত রাখবেন; কিন্তু এখন সে আশা তিরোহিত হয়ে যাচ্ছে।
দৃশ্য কিংবা অদৃশ্য এক জাদুকর সব কিছুই সুতোর টানে নিয়ন্ত্রণ করছেন। প্রশাসন বলি, পুলিশ বলি, বিচার বলি, সব কিছুই যেন সেই কারিগর জাদুকরের হাতে বন্দী। এসব অনাচার এমন এক সময়ে কার্যকর ছিল যখন মানুষের শিা ছিল না, বোঝার মতা ছিল না, চোখ-কান উন্মোচিত ছিল না। তারা কেবলই অনুগত ক্রীতদাসের মতো প্রভুর নির্দেশ পালন করে গেছে। এখন দিন বদলেছে, শাসকশ্রেণী সেটা উপলব্ধি করতে পারছে না। স্তাবকেরা শীর্ষস্থানে উঠে আসছে। মহাদুর্নীতিবাজদের মহাশাসক ছোট্ট শিশুর মতো কোলে নিয়ে দোল দিচ্ছেন। এই দোলে সব কিছু দুলছে। জনগণ বলে যে একটা ব্যাপার আছে, সেটা ভাববার প্রয়োজন তাদের পড়ছে না। রাজন্য যা চাইছেন তাই হচ্ছে।
অথচ যুগের যে পরিবর্তন হয়েছে, তিনি তা কোনোভাবেই উপলব্ধি করতে পারছেন না। বাংলাদেশে সামন্ত যুগের অবসান হয়েছে বহু আগে। সে ইতিহাসজ্ঞান তার নেই। ইতিহাস নিয়ে তার
চিন্তাভাবনাও নেই। কিছু অশিতি নিম্নশ্রেণীর লোক তার আমত্য। তারা পুতুলের সুতায় নাচছে। রাজা যত বলে পারিষদ দল বলে তার শত গুণ। নাহিদ এক ভদ্রলোক, সিপিবি করতেন। এখন আওয়ামী লীগের শিামন্ত্রী। মন্ত্রণালয়ের পাঁচ-ছয়টা গাড়ি ব্যবহার, ভারতীয় প্রকাশকদের মাধ্যমে টেক্সট বই প্রকাশ করা ছাড়া তার বিরুদ্ধে সুরঞ্জিতের মতো বড় কোনো অভিযোগ নেই। কিন্তু এই নষ্ট ব্যক্তির কারণে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। পাঠ্যবইয়ে বাংলাদেশের ইতিহাস ৭ই মার্চ পল্টনে শেখ মুজিবের ভাষণ থেকে শুরু। ভেবেছিলাম, তিনি তার মূর্খতার পরিমাপ করতে পেরে কোথাও না কোথাও থামবেন। এই সিপিবি নেতা (নব্য লীগার) তার কোনো পরোয়াও করেননি। ক্ষমতাসীনদের প্রচার-প্রচারণা দেখে মনে হয়, শেখ মুজিবুর রহমান থেকেই এ দেশের নেতৃত্ব শুরু। তার আগে কিছু ছিল না। তারা এখন রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় উচ্চকিত। আমার অগ্রজ সাংবাদিক প্রেস কাবের সাবেক সভাপতি মোজাম্মেল হক আমাদের সব যুক্তিতর্ক অগ্রাহ্য করে হাস্যোচ্ছলে বলতেন যে, জুলফিকার আলী ভুট্টো যদি শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নিতেন, তাহলে তো আর মুক্তিযুদ্ধ হতো না। পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ গঠন করার প্রয়োজনও পড়ত না। তিনি ঠাট্টা করে বলতেন, তোমরা জুলফিকার আলী ভুট্টোর জন্ম-মৃত্যুদিবস কেন পালন করো না?
মোজাম্মেল হক এমনই মানুষ ছিলেন। তার প্রতি আমার শ্রদ্ধা অপরিসীম। এর সব কিছুই বলতেন অনর্থক তর্ক বাড়ানোর জন্য। কখনো কখনো আমরা ভাবতাম, সত্যিই তো, যদি জুলফিকার আলী ভুট্টো আপত্তি না করতেন, তাহলে শেখ মুজিবুর রহমানও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতেন। আগেও অনেক পূর্ব পাকিস্তানি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর তার জেনারেলদের সাথে এই বলে শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন যে, ‘ভদ্র মহোদয়গণ, আপনারা পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাাৎ করছেন। তিনি পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী।’ সব জেনারেল শেখ মুজিবুর রহমানকে সম্মানসূচক স্যালুট প্রদান করেছিলেন। কিন্তু জুলফিকার আলী ভুট্টো ও পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র মিলে এ দেশে এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি করল যে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি শাসকদের কাছে বন্দী হলেও মেজর জিয়াউর রহমানের ঘোষণায় স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। এবং পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করে বাংলাদেশের জনগণ বাংলাদেশকে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করল। পাকিস্তানি সরকার শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে বাংলাদেশে আসার ব্যবস্থা করল, তখনো শেখ মুজিবুর রহমান জানতেন না যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। সে জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতও ছিলেন না। লন্ডনে বিবিসির সাংবাদিক শেখ মুজিবুর রহমানের দীর্ঘকালের ঘনিষ্ঠজন সিরাজুর রহমান তার জন্য এক সাংবাদিক সমাবেশের আয়োজন করেন। সেখানে সবাই তাকে ‘ইওর এক্সিলেন্সি’ বলায় তিনি বিস্মিত হয়ে সিরাজুর রহমানের কাছে জানতে চান, এরা তাকে কেন ইওর এক্সিলেন্সি বলছে। সিরাজুর রহমান তখন বলেন, ‘আপনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট। সে কারণে এরা আপনাকে ইওর এক্সিলেন্সি সম্বোধন করছে।’ তিনি বিস্মিত হয়ে বলেছিলেন, ‘আরে সিরাজ, চালাম স্বায়ত্তশাসন, পালাম স্বাধীনতা।’
সিরাজুর রহমান তার কোনো জবাব দেননি। অর্থাৎ তিনি পাকিস্তান থেকে লন্ডন আসার আগ পর্যন্ত জানতেনই না বা তাকে জানতেই দেয়া হয়নি যে, বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলছে এবং হাজার হাজার তরুণ-যুবক প্রশিতি পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে দুর্ধর্ষ লড়াই করে যাচ্ছে।
শেখ মুজিবুর রহমান সারা জীবন গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করলেও বাংলাদেশের রাষ্ট্রমতা হাতে পেয়ে দেশে গণতন্ত্র ধ্বংস করে মতা নিরঙ্কুশ করার জন্য একদলীয় স্বৈরশাসন বাকশাল কায়েম করেছিলেন। এতে বিস্মিত হয়েছিলেন তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীসহ দেশের প্রায় সব শ্রেণীর মানুষ। সে প্রক্রিয়ায় তিনি এমনকি নিজের দল আওয়ামী লীগও নিষিদ্ধ করেছিলেন। জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক দলবিধির আওতায় সে আওয়ামী লীগ আবার পুনরুজ্জীবিত হয়।
কিন্তু এখন দেশে তার চেয়েও ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। আনুষ্ঠানিকভাবে আইন করে অন্য সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা না হলেও বিরোধী রাজনৈতিক দলকে কোনো কার্যক্রমই পরিচালনা করতে দেয়া হচ্ছে না। সভা-সমাবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। মিটিং-মিছিল করতে দেয়া হচ্ছে না। আলোচনায় বসতে দেয়া হচ্ছে না। হাজার হাজার অজ্ঞাত ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে সে মামলায় যে কাউকে গ্রেফতারের অধিকার জারি রাখা হচ্ছে। ফলে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো এখন দারুণভাবে কোণঠাসা। প্রধান বিরোধী দল বিএনপির মহাসচিবসহ ওই দলের শীর্ষস্থানীয় প্রায় সব নেতাকে গাড়ি পোড়ানোর মামলা দিয়ে আটক করে রাখা হয়েছে। তাদের জামিন আবেদন সব আদালতে বারবার নাকচ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু দেশের মানুষ কিছুতেই বিশ্বাস করছে না যে, গাড়ি পোড়ানোর মতো ঘটনায় এসব ব্যক্তি জড়িত থাকতে পারেন। সাধারণ মানুষ বরং বলাবলি করছে, সরকারই গাড়ি পুড়িয়ে বিরোধী দলকে ফাঁসিয়ে দেয়ার আয়োজন করেছে। আর সরকারের প্রধান থেকে শুরু করে চাঁইয়েরা পর্যন্ত ঘোষণা করছেন, ২০২১ সাল পর্যন্ত তারা নির্বিঘেœ মতায় থাকবেন। তার জন্য ইতোমধ্যে সব আয়োজনই প্রায় সম্পন্ন করা হয়েছে। বিএনপি-জামায়াত মাঠে থাকলে অসুবিধা। ফলে এই দুই দলকে হামলা-মামলা দিয়ে দৌড়ের ওপর রাখা হচ্ছে, যাতে তারা রাজনৈতিক কর্মসূচি না নিতে পারে। ভবিষ্যতে কী হবে সে কথা মানুষ বলতে পারে না। ভবিষ্যৎ নির্মাণের পরিকল্পনা করতে পারে মাত্র। বাকি আল্লাহর মর্জি।
মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্টে বাংলাদেশের ভয়াবহ রিপোর্ট তুলে ধরা হয়েছে। প্রভাবশালী ইকোনমিস্ট পত্রিকা বাংলাদেশকে ধ্বংসের হাত থেকে রা করতে শেখ হাসিনাকে থামানোর জন্য ভারতকে অনুরোধ করেছে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি ভালো নয়। এর শেষ কোথায় কেউ জানে না।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com
এক অদ্ভুত রাষ্ট্রাচরণের ভেতর দিয়ে এখন আমাদের পথ অতিক্রম চলছে। রাষ্ট্রের পুলিশ-প্রশাসন-বিচার সব কিছু যেন এক পুতুলনাচে পরিণত হয়েছে। কোনো এক বাজিকর সব সুতো নিজ হাতে নিয়ে যখন যেভাবে টানছেন তখন সব কিছুই সেভাবে নাচছে। কোনো কোনো বিচারকের ভাষা ও মন্তব্য কখনো কখনো সাধারণ নাগরিকদের স্তম্ভিত করে দিচ্ছে। কী হচ্ছে দেশটার ভেতরে! কোনো কিছুরই কোনো খেই করা যাচ্ছে না। এ দেশে ব্রিটিশ রাজতন্ত্র চালু থাকলেও তারা প্রায় এক শতাব্দী আগে এখানে ধীরে ধীরে জনপ্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম করার চেষ্টা করেছিল এবং সেভাবে এ দেশে ক্রমে ক্রমে একটি গণতান্ত্রিক কাঠামো গড়ে উঠেছিল। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৪৭ সালে
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল একটি গণতান্ত্রিক চেতনার ভেতর দিয়ে। এমনকি পূর্ব পাকিস্তান বা বর্তমান বাংলাদেশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত থাকবে নাকি পাকিস্তানের সাথে যোগ দেবে সেটিও ভোটের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়েছিল। সিলেটবাসী আন্দোলন করে, ভোট দিয়ে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। সব জায়গায়ই জনগণের মতামতকে বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল।
এরপর ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে। কিন্তু ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পর পাকিস্তানে তখনো ব্রিটিশ প্রশাসক ছিল। দেশকে পূর্ণাঙ্গ গণতান্ত্রিক পরিবেশে ফিরিয়ে আনতে তার প্রয়োজনীয়তা ছিল বলেই সে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। ধীরে ধীরে
পাকিস্তানি জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছিল। আমরাও পাকিস্তানের অংশ ছিলাম। বাংলাদেশ ছিল পূর্ব পাকিস্তান। সে আমলে নির্বাচন কমিশন কারচুপির কথা কল্পনাও করতে পারেনি। কেউ কোনো দিন অভিযোগও তোলেনি যে, নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে। অর্থাৎ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষেরা এসব দায়িত্ব পালন করতেন এবং সরকারই তাদের ওপর এই দায়িত্ব অর্পণ করত।
এখন মনে হচ্ছে চতুর্দিকে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন কোনো মানুষ নেই। বিবেকসম্পন্ন কোনো লোক নেই। পুলিশ বলি, প্রশাসন বলি, বিচার বিভাগ বলিÑ সর্বত্রই যেন এক সেবাদাস প্রদর্শনী। সরকার যা চায় পুলিশ সেভাবে রিপোর্ট দেয়। ধারণা করার কারণ সৃষ্টি হয়েছে যে, সরকার যা চায় বিচার বিভাগ সেভাবেই রায় দেন। কিংবা ততধিক কঠোর। এর কোথাও বিবেক-বুদ্ধি কাজ করছে বলে মনে হয় না। কোনো কোনো বিচারক কখনো কখনো যে ভাষায় কথা বলেন, তাতে স্তম্ভিত হয়ে যেতে হয়। যে দলই করেন না কেন, কোনো ব্যক্তি যখন বিচারকের আসনে বসেন, তখন আমরা নিরীহ-সরল বিশ্বাসী মানুষেরা মনে করতে চাই, তিনি বিচারক আসনের মর্যাদা সমুন্নত রাখবেন; কিন্তু এখন সে আশা তিরোহিত হয়ে যাচ্ছে।
দৃশ্য কিংবা অদৃশ্য এক জাদুকর সব কিছুই সুতোর টানে নিয়ন্ত্রণ করছেন। প্রশাসন বলি, পুলিশ বলি, বিচার বলি, সব কিছুই যেন সেই কারিগর জাদুকরের হাতে বন্দী। এসব অনাচার এমন এক সময়ে কার্যকর ছিল যখন মানুষের শিা ছিল না, বোঝার মতা ছিল না, চোখ-কান উন্মোচিত ছিল না। তারা কেবলই অনুগত ক্রীতদাসের মতো প্রভুর নির্দেশ পালন করে গেছে। এখন দিন বদলেছে, শাসকশ্রেণী সেটা উপলব্ধি করতে পারছে না। স্তাবকেরা শীর্ষস্থানে উঠে আসছে। মহাদুর্নীতিবাজদের মহাশাসক ছোট্ট শিশুর মতো কোলে নিয়ে দোল দিচ্ছেন। এই দোলে সব কিছু দুলছে। জনগণ বলে যে একটা ব্যাপার আছে, সেটা ভাববার প্রয়োজন তাদের পড়ছে না। রাজন্য যা চাইছেন তাই হচ্ছে।
অথচ যুগের যে পরিবর্তন হয়েছে, তিনি তা কোনোভাবেই উপলব্ধি করতে পারছেন না। বাংলাদেশে সামন্ত যুগের অবসান হয়েছে বহু আগে। সে ইতিহাসজ্ঞান তার নেই। ইতিহাস নিয়ে তার
চিন্তাভাবনাও নেই। কিছু অশিতি নিম্নশ্রেণীর লোক তার আমত্য। তারা পুতুলের সুতায় নাচছে। রাজা যত বলে পারিষদ দল বলে তার শত গুণ। নাহিদ এক ভদ্রলোক, সিপিবি করতেন। এখন আওয়ামী লীগের শিামন্ত্রী। মন্ত্রণালয়ের পাঁচ-ছয়টা গাড়ি ব্যবহার, ভারতীয় প্রকাশকদের মাধ্যমে টেক্সট বই প্রকাশ করা ছাড়া তার বিরুদ্ধে সুরঞ্জিতের মতো বড় কোনো অভিযোগ নেই। কিন্তু এই নষ্ট ব্যক্তির কারণে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। পাঠ্যবইয়ে বাংলাদেশের ইতিহাস ৭ই মার্চ পল্টনে শেখ মুজিবের ভাষণ থেকে শুরু। ভেবেছিলাম, তিনি তার মূর্খতার পরিমাপ করতে পেরে কোথাও না কোথাও থামবেন। এই সিপিবি নেতা (নব্য লীগার) তার কোনো পরোয়াও করেননি। ক্ষমতাসীনদের প্রচার-প্রচারণা দেখে মনে হয়, শেখ মুজিবুর রহমান থেকেই এ দেশের নেতৃত্ব শুরু। তার আগে কিছু ছিল না। তারা এখন রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় উচ্চকিত। আমার অগ্রজ সাংবাদিক প্রেস কাবের সাবেক সভাপতি মোজাম্মেল হক আমাদের সব যুক্তিতর্ক অগ্রাহ্য করে হাস্যোচ্ছলে বলতেন যে, জুলফিকার আলী ভুট্টো যদি শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নিতেন, তাহলে তো আর মুক্তিযুদ্ধ হতো না। পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ গঠন করার প্রয়োজনও পড়ত না। তিনি ঠাট্টা করে বলতেন, তোমরা জুলফিকার আলী ভুট্টোর জন্ম-মৃত্যুদিবস কেন পালন করো না?
মোজাম্মেল হক এমনই মানুষ ছিলেন। তার প্রতি আমার শ্রদ্ধা অপরিসীম। এর সব কিছুই বলতেন অনর্থক তর্ক বাড়ানোর জন্য। কখনো কখনো আমরা ভাবতাম, সত্যিই তো, যদি জুলফিকার আলী ভুট্টো আপত্তি না করতেন, তাহলে শেখ মুজিবুর রহমানও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতেন। আগেও অনেক পূর্ব পাকিস্তানি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর তার জেনারেলদের সাথে এই বলে শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন যে, ‘ভদ্র মহোদয়গণ, আপনারা পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাাৎ করছেন। তিনি পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী।’ সব জেনারেল শেখ মুজিবুর রহমানকে সম্মানসূচক স্যালুট প্রদান করেছিলেন। কিন্তু জুলফিকার আলী ভুট্টো ও পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র মিলে এ দেশে এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি করল যে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি শাসকদের কাছে বন্দী হলেও মেজর জিয়াউর রহমানের ঘোষণায় স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। এবং পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করে বাংলাদেশের জনগণ বাংলাদেশকে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করল। পাকিস্তানি সরকার শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে বাংলাদেশে আসার ব্যবস্থা করল, তখনো শেখ মুজিবুর রহমান জানতেন না যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। সে জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতও ছিলেন না। লন্ডনে বিবিসির সাংবাদিক শেখ মুজিবুর রহমানের দীর্ঘকালের ঘনিষ্ঠজন সিরাজুর রহমান তার জন্য এক সাংবাদিক সমাবেশের আয়োজন করেন। সেখানে সবাই তাকে ‘ইওর এক্সিলেন্সি’ বলায় তিনি বিস্মিত হয়ে সিরাজুর রহমানের কাছে জানতে চান, এরা তাকে কেন ইওর এক্সিলেন্সি বলছে। সিরাজুর রহমান তখন বলেন, ‘আপনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট। সে কারণে এরা আপনাকে ইওর এক্সিলেন্সি সম্বোধন করছে।’ তিনি বিস্মিত হয়ে বলেছিলেন, ‘আরে সিরাজ, চালাম স্বায়ত্তশাসন, পালাম স্বাধীনতা।’
সিরাজুর রহমান তার কোনো জবাব দেননি। অর্থাৎ তিনি পাকিস্তান থেকে লন্ডন আসার আগ পর্যন্ত জানতেনই না বা তাকে জানতেই দেয়া হয়নি যে, বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলছে এবং হাজার হাজার তরুণ-যুবক প্রশিতি পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে দুর্ধর্ষ লড়াই করে যাচ্ছে।
শেখ মুজিবুর রহমান সারা জীবন গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করলেও বাংলাদেশের রাষ্ট্রমতা হাতে পেয়ে দেশে গণতন্ত্র ধ্বংস করে মতা নিরঙ্কুশ করার জন্য একদলীয় স্বৈরশাসন বাকশাল কায়েম করেছিলেন। এতে বিস্মিত হয়েছিলেন তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীসহ দেশের প্রায় সব শ্রেণীর মানুষ। সে প্রক্রিয়ায় তিনি এমনকি নিজের দল আওয়ামী লীগও নিষিদ্ধ করেছিলেন। জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক দলবিধির আওতায় সে আওয়ামী লীগ আবার পুনরুজ্জীবিত হয়।
কিন্তু এখন দেশে তার চেয়েও ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। আনুষ্ঠানিকভাবে আইন করে অন্য সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা না হলেও বিরোধী রাজনৈতিক দলকে কোনো কার্যক্রমই পরিচালনা করতে দেয়া হচ্ছে না। সভা-সমাবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। মিটিং-মিছিল করতে দেয়া হচ্ছে না। আলোচনায় বসতে দেয়া হচ্ছে না। হাজার হাজার অজ্ঞাত ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে সে মামলায় যে কাউকে গ্রেফতারের অধিকার জারি রাখা হচ্ছে। ফলে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো এখন দারুণভাবে কোণঠাসা। প্রধান বিরোধী দল বিএনপির মহাসচিবসহ ওই দলের শীর্ষস্থানীয় প্রায় সব নেতাকে গাড়ি পোড়ানোর মামলা দিয়ে আটক করে রাখা হয়েছে। তাদের জামিন আবেদন সব আদালতে বারবার নাকচ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু দেশের মানুষ কিছুতেই বিশ্বাস করছে না যে, গাড়ি পোড়ানোর মতো ঘটনায় এসব ব্যক্তি জড়িত থাকতে পারেন। সাধারণ মানুষ বরং বলাবলি করছে, সরকারই গাড়ি পুড়িয়ে বিরোধী দলকে ফাঁসিয়ে দেয়ার আয়োজন করেছে। আর সরকারের প্রধান থেকে শুরু করে চাঁইয়েরা পর্যন্ত ঘোষণা করছেন, ২০২১ সাল পর্যন্ত তারা নির্বিঘেœ মতায় থাকবেন। তার জন্য ইতোমধ্যে সব আয়োজনই প্রায় সম্পন্ন করা হয়েছে। বিএনপি-জামায়াত মাঠে থাকলে অসুবিধা। ফলে এই দুই দলকে হামলা-মামলা দিয়ে দৌড়ের ওপর রাখা হচ্ছে, যাতে তারা রাজনৈতিক কর্মসূচি না নিতে পারে। ভবিষ্যতে কী হবে সে কথা মানুষ বলতে পারে না। ভবিষ্যৎ নির্মাণের পরিকল্পনা করতে পারে মাত্র। বাকি আল্লাহর মর্জি।
মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্টে বাংলাদেশের ভয়াবহ রিপোর্ট তুলে ধরা হয়েছে। প্রভাবশালী ইকোনমিস্ট পত্রিকা বাংলাদেশকে ধ্বংসের হাত থেকে রা করতে শেখ হাসিনাকে থামানোর জন্য ভারতকে অনুরোধ করেছে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি ভালো নয়। এর শেষ কোথায় কেউ জানে না।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন