ফরিদা আখতার | তারিখ: ২৯-০৫-২০১২
সেদিন একটি খবর পড়ে খুব অবাক হলাম। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেছেন, সিগারেটের ওপর থেকে শুল্ক কমিয়ে বিড়িতে শুল্ক বাড়িয়ে সরকার বৈষম্যমূলক আচরণ করছে, যা মানবাধিকার লঙ্ঘন ও সংবিধান পরিপন্থী। বিড়িশ্রমিকদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করে শুল্ক বাড়িয়ে বিড়িশিল্পকে ধ্বংস করা সরকারের উচিত নয়। তিনি বলেছেন, সরকারের বৈষম্যমূলক শুল্কনীতির কারণে কয়েক শ বিড়ি ফ্যাক্টরি ইতিমধ্যে বন্ধ হওয়ায় ১৮ লাখ নারী শ্রমিক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় আছেন। বিড়ি ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে গেলে পুষ্টি ও খাদ্যনিরাপত্তার ওপর হুমকি আসবে এবং নারীর ক্ষমতায়নের পথ রুদ্ধ হবে। (প্রথম আলো ও নয়াদিগন্ত ২১ মে, ২০১২)। খবরটি পড়ার আগেই ফোন পেতে শুরু করি। কারণ, মিজানুর রহমান শুধু মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নন, তিনি দীর্ঘদিন ধরে মানবাধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে কাজ করেছেন; সেই সুবাদে বাংলাদেশের মানবাধিকার কর্মীদের সহকর্মীও বটে। শ্রমিকদের প্রতি তাঁর সংবেদনশীলতা স্বাভাবিক এবং তাঁদের জন্য তাঁর উদ্বেগ ন্যায্য। কিন্তু ক্ষতিকর পণ্য উৎপাদনে শ্রমিকদের নিয়োগ করাটাই যে মানবাধিকারবিরোধী কাজ, এই দিকটি তিনি লক্ষ করলেন না। শ্রমিকদের স্বার্থের পাশাপাশি এ কথাও আমরা তাঁর কাছ থেকে শুনতে চেয়েছি।
বিড়ি ভোক্তাদের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, যাদের প্রায় সবাই গরিব। এমনকি তামাক চাষ করতে গিয়ে প্রাণ ও পরিবেশের যেমন সর্বনাশ ঘটে, তেমনি কৃষকেরও ক্ষতি। তা ছাড়া যেখানে আমাদের খাদ্যের অভাব, সেখানে খাদ্য উৎপাদন না করে জমিতে তামাক চাষ করতে দেওয়া ও গ্রামাঞ্চলে খাদ্যের অভাব ঘটানো গুরুতর মানবাধিকারবিরোধী কাজ। দুঃখজনক হচ্ছে, শ্রমিকদের পক্ষে দাঁড়াতে গিয়ে তিনি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর একটি পণ্য ও সেই পণ্য উৎপাদনের পক্ষেও দাঁড়িয়েছেন। বিড়িশ্রমিকদের প্রতি তাঁর সংবেদনশীলতার পূর্ণ সুযোগ নেবে তামাক কোম্পানি। এরা শুধু শ্রম শোষণ করে না; কৃষি, পরিবেশ ও স্বাস্থ্যেরও ক্ষতি করে। এর আগে মে দিবসে টেলিভিশনে দেখেছি, আমাদের অত্যন্ত প্রিয় বাম রাজনৈতিক দলের নেতা মঞ্জুরুল আহসান খানও বিড়িশ্রমিকদের নিয়ে একটি টক শোতে বক্তব্য দিয়েছেন। আমি তাঁকে ফোন করে আমার প্রতিক্রিয়া জানিয়েছি। আজ যখন লিখছি, তখন এটা কেবল এই দুজন বিশিষ্ট ব্যক্তির কথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে নয়, বরং তামাক কোম্পানিগুলোর কৌশলের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যই লিখছি।
তামাকজাত দ্রব্যের মধ্যে সিগারেট, বিড়ি, জর্দা, খইনি, সাদাপাতা সবই পড়ে। এর উৎপাদন এবং ব্যবহার দুটোই মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর—এ বিষয়ে কেউ দ্বিমত করবেন না। কারণ, ব্যক্তিগত জীবন হোক বা গবেষণার তথ্য হোক, কোথাও সিগারেট-বিড়ি খেয়ে কেউ সুস্থ জীবনযাপন করেছে, তার প্রমাণ পাওয়া যাবে না। অন্য কোনো পণ্যের ব্যবহারে এত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ক্ষতির আশঙ্কা আছে কি না, আমার জানা নেই। কিন্তু এতে কোম্পানির মুনাফা অনেক বেশি। এই পণ্য উৎপাদনে নিয়োজিত শ্রমিকেরা নানা অসুস্থতায় ভোগেন। এমন একটি ক্ষতিকর পণ্য উৎপাদনের পক্ষে জনমত তৈরি করার জন্যই কোম্পানিগুলো শ্রমিকদের জন্য মায়াকান্না কাঁদে এবং শ্রমিকদের স্বার্থের প্রতি সংবেদনশীলদের প্রভাবিত করতে চেষ্টা করে।
জুন মাসে জাতীয় সংসদে বাজেট অধিবেশনে ২০১২-১৩ অর্থবছরের বাজেট পেশ হবে। তামাকজাত দ্রব্যের উৎপাদন ও ব্যবহারে ক্ষতির দিকগুলো জেনে এর ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের জন্য যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের পক্ষ থেকে দাবি উঠেছে, তামাকজাত পণ্যের ওপর করের হার বাড়ানো। জনস্বাস্থ্য রক্ষার ক্ষেত্রে এই পদক্ষেপ ভালো ভূমিকা রাখবে। কর বাড়লে এর দাম বাড়বে। আশা করা যায়, অন্তত দামের কারণে হলেও ব্যবহার কিছুটা কমবে। এটা শুধু কথার কথা নয়, হিসাব কষেই দেখানো হয়েছে, সিগারেট ও বিড়ির ওপর ৭০ শতাংশ সম্পূরক শুল্কের হার ধার্য করলে এক হাজার ৩৬০ কোটি শলাকা সিগারেট ও বিড়ি কম সেবন করা হবে এবং একই সঙ্গে বাড়তি রাজস্ব আয় হবে এক হাজার ৫৮৮ কোটি টাকা। জর্দা ও গুলের ওপরও ৭০ শতাংশ সম্পূরক শুল্কের হার ধার্য করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। কোম্পানি বাজেটের সময় সরকারকে কত রাজস্ব দিচ্ছে, তার বিশাল এক হিসাব দিয়ে কাবু করে ফেলে। অথচ সরকার নিজেই তামাকজাত দ্রব্যের ওপর উচ্চহারে কর আরোপ করে রাজস্বও বাড়াতে পারে।
এখন কথা উঠেছে, সিগারেট ও বিড়ির মধ্যে বৈষম্য নিয়ে। এই বিতর্ক সৃষ্টি একটি কোম্পানি কৌশল। সিগারেট মধ্যবিত্ত ও ধনীরা সেবন করে, আর গরিব মানুষ খায় বিড়ি। কাজেই একই সমান শুল্ক ধার্য করার কারণে দাম বাড়লে বিড়ি যারা খায়, তাদের ওপর আনুপাতিক চাপ একটু বেশি পড়বে। আমাদের দেশে সিগারেট, বিড়ি দুটোই পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় খুব সস্তা, আর বাংলাদেশের বিড়ি তামাকজাত পণ্যের মধ্যে পৃথিবীতে সবচেয়ে সস্তা। যাঁরা বিড়ির দাম বাড়লে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন যে গরিব মানুষের ওপর বোঝা হবে, তাঁদের যুক্তি আমি বুঝতে অক্ষম। একে তো গরিব মানুষ ঠিকমতো পেট ভরে খেতে পায় না, তার ওপর যদি বিড়ির মতো ক্ষতিকর দ্রব্য তার শরীরে যায়, কিংবা তার ধোঁয়াও, তাহলে যে অসুখ হবে, তা কি আমরা মেনে নেব?
তামাক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের আইন আছে ঠিকই, কিন্তু তার মধ্যে ফাঁক আছে অনেক বড় বড়। ধূমপানবিরোধী আন্দোলন বিশ্বব্যাপী গড়ে উঠেছে। এই আন্দোলনে আইনের পাশাপাশি কর আরোপ করা একটি উপায় হিসেবে দেখা হয়েছে মাত্র। আমার জানামতে, সিগারেট ও বিড়ির একই হারে সম্পূরক শুল্কের হার ধার্য করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, সিগারেটের ওপর কর কম করার কথা কোথাও হয়নি। আমার মনে হয়, মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানকে ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করা হয়েছে।
বিড়িশ্রমিকদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করে শুল্ক বাড়িয়ে বিড়িশিল্পকে ধ্বংস করা ও কয়েক শ বিড়ি ফ্যাক্টরি ইতিমধ্যে বন্ধ হওয়ায় ১৮ লাখ নারী শ্রমিক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় আছেন বলে যে কথা এসেছে, তা দেখে আমরা উদ্বিগ্ন হচ্ছি। এত শ্রমিকের সংখ্যা কোথা থেকে এল? কারখানার মালিকেরা নিজেদের প্রয়োজনে ইচ্ছামতো শ্রমিকসংখ্যা বাড়ালে তো হবে না। যেসব অনুসন্ধানমূলক তথ্য আমাদের হাতে এসেছে, তাতে দেখা গেছে, দেশে ১১৭টি বিড়ি কারখানায় ৬৫ হাজার শ্রমিক আছেন, তার সঙ্গে খণ্ডকালীন সহায়তাকারী শ্রমিক (যার মধ্যে নারী ও শিশু শ্রমিক রয়েছে) দুই লাখ ২০ হাজার রয়েছেন। দুটো যোগ দিলেও তিন লাখ শ্রমিক হয় না, তাহলে ১৮ লাখ শ্রমিকের এই সংখ্যা কোথা থেকে আসে? বিড়ি কারখানায় কাজ করা খুব সুখের নয়। খুব নিম্ন মজুরি (দিনে ১০০ টাকারও কম); অমানবিক ও অস্বাস্থ্যকর কাজের পরিবেশে শ্রমিকদের কাজ করতে হয় এবং শ্বাসকষ্ট, কাশি, যক্ষ্মা, বুকের ব্যথা ও নানা রোগে আক্রান্ত হতে হয়। অভাবে পড়ে অন্য কাজের সংস্থান নেই বলে কেউ যদি বাধ্য হয়ে এই কাজ করে, তাহলে সে কাজ টিকিয়ে রেখে শোষণ টিকিয়ে রাখার কী অর্থ থাকতে পারে? বিড়িশ্রমিকদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে, সেটা ভিন্ন বিতর্ক। কিন্তু তার দায় একা সরকার নেবে কেন? অবিলম্বে এ ধরনের অমানবিক কাজ বন্ধ করাই প্রথম কাজ।
মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানকে ধন্যবাদ জানাই, তিনি তামাক চাষের প্রসঙ্গ এনেছেন। তিনি বলেছেন, সরকার বহুজাতিক সিগারেট কোম্পানিকে সুবিধা দিতে পার্বত্য অঞ্চলে তামাক চাষকে উৎসাহিত করছে, যা খুবই দুঃখজনক। আমি তাঁর সঙ্গে একমত যে বহুজাতিক সিগারেট কোম্পানিগুলো কোনো এক অজানা কারণে সরকারের সুদৃষ্টিতে (!) আছে, রাজস্ব বেশি দেয় দাবি করে। কিন্তু তাদের দ্বারা যে ক্ষতি হচ্ছে, তা দেখাই হচ্ছে না।
শেষে শুধু এটুকু বলব, তর্ক বিড়ি বনাম সিগারেট কিংবা গরিব বনাম ধনী নয়। বিড়ি কারখানার পক্ষে কথা বলার জন্য সিগারেট কোম্পানির বিরোধিতা করার মধ্য দিয়ে মনে হয় আমরা বুঝি শ্রমিকের বা দেশের স্বার্থে কথা বলছি। আসলে মোটেও নয়। তামাক—সেটা বিড়ি হোক কিংবা সিগারেট কিংবা হোক জর্দা, খইনি বা অন্য কিছু—সবই স্বাস্থ্যের জন্য খারাপ। আমাদের কৃষি, বন, প্রাণ, পরিবেশ ধ্বংস করছে তামাক কোম্পানি। দেশি ও বিদেশি জনস্বাস্থ্য রক্ষা করা যদি আমাদের সাংবিধানিক কর্তব্য হয়, তাহলে সিগারেট ও বিড়ি কেউই আমাদের আপন নয়, তারা ‘মাসতুতো’ ভাই। এ ধরনের বিতর্ক সৃষ্টি করাও তাদের একটি কৌশল।
ফরিদা আখতার: নারীনেত্রী, উন্নয়নকর্মী।
সেদিন একটি খবর পড়ে খুব অবাক হলাম। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেছেন, সিগারেটের ওপর থেকে শুল্ক কমিয়ে বিড়িতে শুল্ক বাড়িয়ে সরকার বৈষম্যমূলক আচরণ করছে, যা মানবাধিকার লঙ্ঘন ও সংবিধান পরিপন্থী। বিড়িশ্রমিকদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করে শুল্ক বাড়িয়ে বিড়িশিল্পকে ধ্বংস করা সরকারের উচিত নয়। তিনি বলেছেন, সরকারের বৈষম্যমূলক শুল্কনীতির কারণে কয়েক শ বিড়ি ফ্যাক্টরি ইতিমধ্যে বন্ধ হওয়ায় ১৮ লাখ নারী শ্রমিক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় আছেন। বিড়ি ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে গেলে পুষ্টি ও খাদ্যনিরাপত্তার ওপর হুমকি আসবে এবং নারীর ক্ষমতায়নের পথ রুদ্ধ হবে। (প্রথম আলো ও নয়াদিগন্ত ২১ মে, ২০১২)। খবরটি পড়ার আগেই ফোন পেতে শুরু করি। কারণ, মিজানুর রহমান শুধু মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নন, তিনি দীর্ঘদিন ধরে মানবাধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে কাজ করেছেন; সেই সুবাদে বাংলাদেশের মানবাধিকার কর্মীদের সহকর্মীও বটে। শ্রমিকদের প্রতি তাঁর সংবেদনশীলতা স্বাভাবিক এবং তাঁদের জন্য তাঁর উদ্বেগ ন্যায্য। কিন্তু ক্ষতিকর পণ্য উৎপাদনে শ্রমিকদের নিয়োগ করাটাই যে মানবাধিকারবিরোধী কাজ, এই দিকটি তিনি লক্ষ করলেন না। শ্রমিকদের স্বার্থের পাশাপাশি এ কথাও আমরা তাঁর কাছ থেকে শুনতে চেয়েছি।
বিড়ি ভোক্তাদের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, যাদের প্রায় সবাই গরিব। এমনকি তামাক চাষ করতে গিয়ে প্রাণ ও পরিবেশের যেমন সর্বনাশ ঘটে, তেমনি কৃষকেরও ক্ষতি। তা ছাড়া যেখানে আমাদের খাদ্যের অভাব, সেখানে খাদ্য উৎপাদন না করে জমিতে তামাক চাষ করতে দেওয়া ও গ্রামাঞ্চলে খাদ্যের অভাব ঘটানো গুরুতর মানবাধিকারবিরোধী কাজ। দুঃখজনক হচ্ছে, শ্রমিকদের পক্ষে দাঁড়াতে গিয়ে তিনি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর একটি পণ্য ও সেই পণ্য উৎপাদনের পক্ষেও দাঁড়িয়েছেন। বিড়িশ্রমিকদের প্রতি তাঁর সংবেদনশীলতার পূর্ণ সুযোগ নেবে তামাক কোম্পানি। এরা শুধু শ্রম শোষণ করে না; কৃষি, পরিবেশ ও স্বাস্থ্যেরও ক্ষতি করে। এর আগে মে দিবসে টেলিভিশনে দেখেছি, আমাদের অত্যন্ত প্রিয় বাম রাজনৈতিক দলের নেতা মঞ্জুরুল আহসান খানও বিড়িশ্রমিকদের নিয়ে একটি টক শোতে বক্তব্য দিয়েছেন। আমি তাঁকে ফোন করে আমার প্রতিক্রিয়া জানিয়েছি। আজ যখন লিখছি, তখন এটা কেবল এই দুজন বিশিষ্ট ব্যক্তির কথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে নয়, বরং তামাক কোম্পানিগুলোর কৌশলের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যই লিখছি।
তামাকজাত দ্রব্যের মধ্যে সিগারেট, বিড়ি, জর্দা, খইনি, সাদাপাতা সবই পড়ে। এর উৎপাদন এবং ব্যবহার দুটোই মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর—এ বিষয়ে কেউ দ্বিমত করবেন না। কারণ, ব্যক্তিগত জীবন হোক বা গবেষণার তথ্য হোক, কোথাও সিগারেট-বিড়ি খেয়ে কেউ সুস্থ জীবনযাপন করেছে, তার প্রমাণ পাওয়া যাবে না। অন্য কোনো পণ্যের ব্যবহারে এত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ক্ষতির আশঙ্কা আছে কি না, আমার জানা নেই। কিন্তু এতে কোম্পানির মুনাফা অনেক বেশি। এই পণ্য উৎপাদনে নিয়োজিত শ্রমিকেরা নানা অসুস্থতায় ভোগেন। এমন একটি ক্ষতিকর পণ্য উৎপাদনের পক্ষে জনমত তৈরি করার জন্যই কোম্পানিগুলো শ্রমিকদের জন্য মায়াকান্না কাঁদে এবং শ্রমিকদের স্বার্থের প্রতি সংবেদনশীলদের প্রভাবিত করতে চেষ্টা করে।
জুন মাসে জাতীয় সংসদে বাজেট অধিবেশনে ২০১২-১৩ অর্থবছরের বাজেট পেশ হবে। তামাকজাত দ্রব্যের উৎপাদন ও ব্যবহারে ক্ষতির দিকগুলো জেনে এর ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের জন্য যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের পক্ষ থেকে দাবি উঠেছে, তামাকজাত পণ্যের ওপর করের হার বাড়ানো। জনস্বাস্থ্য রক্ষার ক্ষেত্রে এই পদক্ষেপ ভালো ভূমিকা রাখবে। কর বাড়লে এর দাম বাড়বে। আশা করা যায়, অন্তত দামের কারণে হলেও ব্যবহার কিছুটা কমবে। এটা শুধু কথার কথা নয়, হিসাব কষেই দেখানো হয়েছে, সিগারেট ও বিড়ির ওপর ৭০ শতাংশ সম্পূরক শুল্কের হার ধার্য করলে এক হাজার ৩৬০ কোটি শলাকা সিগারেট ও বিড়ি কম সেবন করা হবে এবং একই সঙ্গে বাড়তি রাজস্ব আয় হবে এক হাজার ৫৮৮ কোটি টাকা। জর্দা ও গুলের ওপরও ৭০ শতাংশ সম্পূরক শুল্কের হার ধার্য করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। কোম্পানি বাজেটের সময় সরকারকে কত রাজস্ব দিচ্ছে, তার বিশাল এক হিসাব দিয়ে কাবু করে ফেলে। অথচ সরকার নিজেই তামাকজাত দ্রব্যের ওপর উচ্চহারে কর আরোপ করে রাজস্বও বাড়াতে পারে।
এখন কথা উঠেছে, সিগারেট ও বিড়ির মধ্যে বৈষম্য নিয়ে। এই বিতর্ক সৃষ্টি একটি কোম্পানি কৌশল। সিগারেট মধ্যবিত্ত ও ধনীরা সেবন করে, আর গরিব মানুষ খায় বিড়ি। কাজেই একই সমান শুল্ক ধার্য করার কারণে দাম বাড়লে বিড়ি যারা খায়, তাদের ওপর আনুপাতিক চাপ একটু বেশি পড়বে। আমাদের দেশে সিগারেট, বিড়ি দুটোই পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় খুব সস্তা, আর বাংলাদেশের বিড়ি তামাকজাত পণ্যের মধ্যে পৃথিবীতে সবচেয়ে সস্তা। যাঁরা বিড়ির দাম বাড়লে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন যে গরিব মানুষের ওপর বোঝা হবে, তাঁদের যুক্তি আমি বুঝতে অক্ষম। একে তো গরিব মানুষ ঠিকমতো পেট ভরে খেতে পায় না, তার ওপর যদি বিড়ির মতো ক্ষতিকর দ্রব্য তার শরীরে যায়, কিংবা তার ধোঁয়াও, তাহলে যে অসুখ হবে, তা কি আমরা মেনে নেব?
তামাক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের আইন আছে ঠিকই, কিন্তু তার মধ্যে ফাঁক আছে অনেক বড় বড়। ধূমপানবিরোধী আন্দোলন বিশ্বব্যাপী গড়ে উঠেছে। এই আন্দোলনে আইনের পাশাপাশি কর আরোপ করা একটি উপায় হিসেবে দেখা হয়েছে মাত্র। আমার জানামতে, সিগারেট ও বিড়ির একই হারে সম্পূরক শুল্কের হার ধার্য করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, সিগারেটের ওপর কর কম করার কথা কোথাও হয়নি। আমার মনে হয়, মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানকে ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করা হয়েছে।
বিড়িশ্রমিকদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করে শুল্ক বাড়িয়ে বিড়িশিল্পকে ধ্বংস করা ও কয়েক শ বিড়ি ফ্যাক্টরি ইতিমধ্যে বন্ধ হওয়ায় ১৮ লাখ নারী শ্রমিক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় আছেন বলে যে কথা এসেছে, তা দেখে আমরা উদ্বিগ্ন হচ্ছি। এত শ্রমিকের সংখ্যা কোথা থেকে এল? কারখানার মালিকেরা নিজেদের প্রয়োজনে ইচ্ছামতো শ্রমিকসংখ্যা বাড়ালে তো হবে না। যেসব অনুসন্ধানমূলক তথ্য আমাদের হাতে এসেছে, তাতে দেখা গেছে, দেশে ১১৭টি বিড়ি কারখানায় ৬৫ হাজার শ্রমিক আছেন, তার সঙ্গে খণ্ডকালীন সহায়তাকারী শ্রমিক (যার মধ্যে নারী ও শিশু শ্রমিক রয়েছে) দুই লাখ ২০ হাজার রয়েছেন। দুটো যোগ দিলেও তিন লাখ শ্রমিক হয় না, তাহলে ১৮ লাখ শ্রমিকের এই সংখ্যা কোথা থেকে আসে? বিড়ি কারখানায় কাজ করা খুব সুখের নয়। খুব নিম্ন মজুরি (দিনে ১০০ টাকারও কম); অমানবিক ও অস্বাস্থ্যকর কাজের পরিবেশে শ্রমিকদের কাজ করতে হয় এবং শ্বাসকষ্ট, কাশি, যক্ষ্মা, বুকের ব্যথা ও নানা রোগে আক্রান্ত হতে হয়। অভাবে পড়ে অন্য কাজের সংস্থান নেই বলে কেউ যদি বাধ্য হয়ে এই কাজ করে, তাহলে সে কাজ টিকিয়ে রেখে শোষণ টিকিয়ে রাখার কী অর্থ থাকতে পারে? বিড়িশ্রমিকদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে, সেটা ভিন্ন বিতর্ক। কিন্তু তার দায় একা সরকার নেবে কেন? অবিলম্বে এ ধরনের অমানবিক কাজ বন্ধ করাই প্রথম কাজ।
মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানকে ধন্যবাদ জানাই, তিনি তামাক চাষের প্রসঙ্গ এনেছেন। তিনি বলেছেন, সরকার বহুজাতিক সিগারেট কোম্পানিকে সুবিধা দিতে পার্বত্য অঞ্চলে তামাক চাষকে উৎসাহিত করছে, যা খুবই দুঃখজনক। আমি তাঁর সঙ্গে একমত যে বহুজাতিক সিগারেট কোম্পানিগুলো কোনো এক অজানা কারণে সরকারের সুদৃষ্টিতে (!) আছে, রাজস্ব বেশি দেয় দাবি করে। কিন্তু তাদের দ্বারা যে ক্ষতি হচ্ছে, তা দেখাই হচ্ছে না।
শেষে শুধু এটুকু বলব, তর্ক বিড়ি বনাম সিগারেট কিংবা গরিব বনাম ধনী নয়। বিড়ি কারখানার পক্ষে কথা বলার জন্য সিগারেট কোম্পানির বিরোধিতা করার মধ্য দিয়ে মনে হয় আমরা বুঝি শ্রমিকের বা দেশের স্বার্থে কথা বলছি। আসলে মোটেও নয়। তামাক—সেটা বিড়ি হোক কিংবা সিগারেট কিংবা হোক জর্দা, খইনি বা অন্য কিছু—সবই স্বাস্থ্যের জন্য খারাপ। আমাদের কৃষি, বন, প্রাণ, পরিবেশ ধ্বংস করছে তামাক কোম্পানি। দেশি ও বিদেশি জনস্বাস্থ্য রক্ষা করা যদি আমাদের সাংবিধানিক কর্তব্য হয়, তাহলে সিগারেট ও বিড়ি কেউই আমাদের আপন নয়, তারা ‘মাসতুতো’ ভাই। এ ধরনের বিতর্ক সৃষ্টি করাও তাদের একটি কৌশল।
ফরিদা আখতার: নারীনেত্রী, উন্নয়নকর্মী।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন