রাহাত খান
বাংলাদেশ সম্পর্কে বিখ্যাত ইংরেজী পাক্ষিক দ্য ইকোনোমিস্টের বর্তমান সংখ্যায় একটি বেশ বড় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। শিরোনাম : বাংলাদেশের দূষিত রাজনীতি : হ্যালো দিল্লী!
দ্য ইকোনোমিস্ট খুব বড় মাপের প্রভাবশালী পত্রিকা। দুনিয়াজুড়ে এর ব্যাপ্তি। গ্রহণযোগ্যতাও ব্যাপক। আমি নিজে এই অসাধারণ পত্রিকার একজন ভক্ত পাঠক। দৈনিক ইত্তেফাকে চাকরি করার সময় অফিসের খরচায় পত্রিকাটি পেতাম। এখন হদ্দ বেকার। এখন পত্রিকাটি পয়সা দিয়ে কেনার সামর্থ্য নেই। অধুনা সপ্তাহে অন্তত তিন দিন ঢাকা ক্লাবে যাই (এক) সারাদিন প্রায় ঘরে আটকে থাকার নিঃসঙ্গতা ঘোচাতে, (দুই) ক্লাবের লাইব্রেরীতে গিয়ে দ্য ইকোনোমিস্টসহ আরো কিছু দেশী বিদেশী পত্রিকা ও ম্যাগাজিন পড়তে, (তিন) ক্লাবের কিচেনে নানারকম মসলা দিয়ে তৈরি ভিন্ন স্বাদ ও গন্ধের এক পেয়ালা চা পান করতে।
দ্য ইকোনোমিস্টের প্রতিবেদনগুলোর অধিকাংশই নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। এর একটি কারণ পত্রিকাটি যা কিছু লেখে বা মন্তব্য করে তা সাধারণত তথ্য-সমৃদ্ধ থাকে। সম্ভবত একমাত্র দ্য ইকোনোমিস্ট পত্রিকারই প্রায় গোটা বিশ্বে একটি গোয়েন্দা ইউনিট কাজ করছে যে নেটওয়ার্কের মূল কাজ বিভিন্ন দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অবলোকন করা এবং সেই অনুযায়ী পত্রিকার মূল অফিসে নিজেদের বিশ্লেষণ ও মন্তব্য সংবলিত প্রতিবেদন পেশ করা। পত্রিকার সেটা অ-প্রকাশ্য বা গোপনীয় ব্যাপার, তবে বিশ্বের উল্লেখযোগ্য দেশে প্রকাশ্যে পত্রিকার নিয়মিত বা অনিয়মিত রিপোর্টার থাকেন। প্রতিবেদনটি সাধারণত তাদের নামে কিংবা বেনামে পত্রিকার বিশেষ প্রতিবেদন হিসাবে ছাপা হয়ে থাকে।
পত্রিকাটি বেশির ভাগ সময় প্রকৃত তথ্য তুলে ধরে সঠিক প্রতিবেদনই ছাপায়। অন্তত তিন দশক থেকে এই রকমটাই দেখে আসছি। তবে যত বড় প্রচার-মাধ্যম হোক এর গ্রহণযোগ্যতা যেমনই থাকুক বড় ও গ্রহণযোগ্য পত্রিকাও সব সময় সত্যি কথাটা বলে না। সত্যিকার বাস্তবতাকে পত্রিকার পৃষ্ঠায় তুলে ধরে না। নিজেদের দেশের দু’একটি বড় ও গ্রহণযোগ্যতার অধিকারী পত্রিকার কথা এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়। নিজেদের অবস্থান মনে হয় তারা নিয়েই ফেলেছে। বর্তমান মহাজোট সরকার গত সাড়ে তিন বছরে যে কোন বিচারে কিছু কিছু ব্যর্থতা ও অসাফল্য থাকা সত্ত্বেও একটি অত্যন্ত সফল সরকার হিসাবে পরিগণিত হতে পারে। সেটা যে পত্রিকাগুলোর অজানা তা নয়। তবে যারা ইতোমধ্যে, কারণ যা-ই হোক, ঠিক করে ফেলেছে, বর্তমান জঙ্গী-বিরোধী, যুদ্ধাপরাধী-বিরোধী সরকারকে ফেলে দিয়ে আগামী নির্বাচনে দূষিত, দুর্নীতি-পরায়ণ এবং জঙ্গীবাদী দল বা জোটকে ক্ষমতায় দেখবে, সেটা নানা কায়দায় গোপন রাখতে চাইলেও গোপন রাখা যাচ্ছে না। এর পেছনে দুটি কারণ থাকতে পারে। (এক) পাশ্চাত্যের কোনো একটি মহলের ষড়যন্ত্র, যার চাবিকাঠি ঘোরাচ্ছেন নেপথ্য থেকে এক বা একাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। (দুই) আওয়ামী লীগ সরকারকে কোনোদিন অতীতে প্রচার-বান্ধব হতে দেখা যায়নি। গত সাড়ে তিন বছরে তাদের অর্জিত সাফল্য যে কোনো বিচারে যা বিশাল, সেই সাফল্যকেও পাদ-প্রদীপের আলোয় তুলে ধরার তাদের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার অভাব রয়েছে। এ নিয়ে ক্ষমতাসীন দল বা জোটের কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। অথচ কে না জানে এটা প্রচারের যুগ। প্রচার মাধ্যমের সাহায্য ছাড়া হাজার ভালো কাজ করেও অনেক সময়ই নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া যায় না।
পাক্ষিক ইংরেজী পত্রিকা দ্য ইকোনোমিস্টের কথাই ধরা যাক। পত্রিকাটি সাধারণত বস্তু-নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকে। তবে সব সময়ই ইকোনোমিস্ট যে তাদের বস্তু-নিরপেক্ষতাকে ধরে রাখতে সক্ষম, সেটা বলতে পারলে খুশি হতাম। শুধু দ্য ইকোনোমিস্টের ক্ষেত্রে নয়, বিশ্বের বেশিরভাগ পত্রিকা বা প্রচার-মাধ্যমের ক্ষেত্রেই সংবাদ ও মন্তব্য পরিবেশনের ক্ষেত্রে কতগুলো ফ্যাক্টর জোরালোভাবে কাজ করে। যেমন পাশ্চাত্যের সমরাস্ত্র বিক্রির যে বিশাল-বিপুল সাম্রাজ্য, সেই সাম্রাজ্যের প্রভাব। দুনিয়ার দুই-চারটি দেশে যদি যুদ্ধ বা যুদ্ধাবস্থা বিরাজ না করে তাহলে সেই সাম্রাজ্যের অবস্থাটা কি দাঁড়াবে! বিশ্বে টেরোরিজম বা সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদ যদি বিশ্বের এখানে-ওখানে বিরাজ না করে, তাহলে গোপনে থাকা সমরাস্ত্র নির্মাতা ও বিক্রেতা সাম্রাজ্যের চলবে কি করে? পৃথিবী যদি সত্যি উত্তাপ উত্তেজনাহীন শান্ত পৃথিবী হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে সমরাস্ত্র বিক্রি হবে কাদের কাছে? দেখা যায়, প্রভাবশালী এবং গ্রহণযোগ্যতার অধিকারী বিশ্বের দু’চারটি প্রচার মাধ্যমের পেছনে সমরাস্ত্র নির্মাতা ও বিক্রয়ের এই গোপন সাম্রাজ্যের প্রত্যক্ষ-অপ্রত্যক্ষ একটা প্রভাব থাকে। ‘মহান’ পত্রিকা ইকোনোমিস্ট জর্জ বুশ-ওবামার প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে কিন্তু সুনিপুণ কৌশলে যুদ্ধবাজ, ইসলামবিরোধী জর্জ বুশের পক্ষাবলম্বন করেছিল। যাদের ‘সত্য-নিষ্ঠ’ জরিপ ও সমীক্ষায় বলা হয়েছে ওবামা ‘ক্যারিশম্যাটিক লিডার’ কোনো সন্দেহ নেই। তবে দেশের ও গোটা বিশ্বের নিরাপত্তা রক্ষার প্রশ্নে গরিষ্ঠসংখ্যক মার্কিনীদের ভোট পাবেন জর্জ বুশই।
অনেক বিজ্ঞ এবং বিশেষজ্ঞ পর্যবেক্ষক মহলের মতে আল-কায়েদার জনকের নাম জর্জ বুশ (জুনিয়র) বৈ আর কেউ নয়। আল-কায়েদার ৯/১১-এর নৃশংস এবং জঘন্য ঘটনার ছুতো ধরে জর্জ বুশের বাহিনী ইরাক আক্রমণ করে। একটা গড়ে ওঠা মোটামুটি সমৃদ্ধ দেশকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে, লুণ্ঠন করে ইরাকের অপরিমেয় তেল-সম্পদ। জর্জ বুশের কল্যাণে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে আফগানিস্তান এবং আফ্রিকার ইথিওপিয়া, সোমালিয়া এবং সুদানেও। আর পাকিস্তান তো বিশ্ব সন্ত্রাসের রাজধানী ছিলই। জঙ্গী-সন্ত্রাসবাদী রাজনীতি বিস্তারে পাকিস্তানী প্রশাসনের নিকট নীরব প্রশ্রয় থাকা সত্ত্বেও মার্কিন প্রশাসন অনেক সময় জেনে শোনেও বিলিয়ন-কে বিলিয়ন ডলার সাহায্য দিয়েছে পাকিস্তানকে। এই রহস্যের কোনো কূলকিনারা পাওয়া যায় না।
সন্দেহ হয় অস্ত্র-সাম্রাজ্যের কা-ারীরা বাংলাদেশকে পরবর্তী পর্যায়ে ‘দ্বিতীয় পাকিস্তান’ করতে চাইছে কিনা। ফর্মুলা তো ঠিকই আছে, একদিকে জঙ্গীবাদ সন্ত্রাস কায়েম হতে থাকবে অন্যদিকে জঙ্গীবাদ দমনে মার্কিন ও পাশ্চাত্য সাহায্য আসতে শুরু করবে। এ রকম দু’মুখো নীতির নামতা মুখস্থ করিয়েছে পাকিস্তানকে দিয়ে, আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট সরকারের পরবর্তী বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধ অস্বীকারকারী সম্ভাব্য জোট সরকারকে দিয়ে একই নামতা মুখস্থ করাতে কতক্ষণ! তারা তো বুকে হেলালী চাঁদের নিশান ধারণ করে সেই সুসময়ের অপেক্ষায়ই আছে।
এসবই আমার সন্দেহ। এই সন্দেহ অমূলক হতে পারে। মার্কিন কূটনীতির কেন্দ্রবিন্দু এখন দক্ষিণ এশিয়া। বিশেষত ভারত। ভবিষ্যতে চীন যাতে অর্থনীতি কূটনীতি ও সমরশক্তিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যেতে না পারে, সেজন্য ভারত, সেই সাথে দক্ষিণ এশিয়ার শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, আফগানিস্তান, নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ এমনকি পাকিস্তানের মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ্য বাড়ানো, শিল্প ও বাণিজ্য ভল্যুম বৃদ্ধির যৌথ প্রয়াস, অস্ত্রের ঝনঝনানির অবসান ঘটানো এবং চীনসহ গোটা দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে কানেকটিভিটি প্রসারণের লক্ষ্যে কাজ করতে চাইছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বিশেষত উল্লেখিত দেশগুলোর মধ্যে জঙ্গী-সন্ত্রাস দমন, অর্থনৈতিক উন্নয়নে অগ্রগতি সাধন এবং কানেকটিভিটি প্রসারণে উদ্যম ও সাফল্য আশা করে মার্কিন কূটনীতি। এটাই বিশ্বের এই সময়ের প্রধান পরাশক্তি দেশটির বিঘোষিত নীতি ও লক্ষ্য।
বিশ্বের ভূ-তাত্ত্বিক-রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে জঙ্গীবাদী ও বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী শক্তির অদূর কিংবা দূরভবিষ্যতে ক্ষমতায় আসার কোনো সম্ভাবনা দ্যাখেন না বিশ্বের বেশিরভাগ পর্যবেক্ষক মহল। বাংলাদেশকে দ্বিতীয় পাকিস্তানে পরিণত করার কোনো আশঙ্কাও করেন না শান্তিবাদী ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় ইচ্ছুক দেশ বা দেশের অধিবাসীরা। তবু যে বাংলাদেশকে জঙ্গীবাদী তথা দ্বিতীয় পাকিস্তান তৈরির আশঙ্কা করেছি, সেটা আর কোনো কারণে নয় পাক্ষিক ইংরেজী দ্য ইকোনোমিস্ট পত্রিকার সাম্প্রতিক প্রতিবেদন : ‘বাংলাদেশের দূষিত রাজনীতি : হ্যালো দিল্লী’ প্রতিবেদনটি পাঠ করে। লেখাটা জঙ্গীবাদী ও সস্ত্রাসী দল-জোটের পক্ষে এবং বাংলাদেশে সন্ত্রাস দমনে, জঙ্গীবাদ নির্মূলে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে সাফল্যের অধিকারী দল-জোটের বিপক্ষে এমন নগ্নভাবে লেখা যে মনে হয় লেখাটা যেন দ্য ইকোনোমিস্ট পত্রিকার কোনো নিজস্ব প্রতিবেদক লেখেননি, লিখেছে বিএনপি-জামায়াতের কোনো লোক। অথবা লিখেছে নেপথ্যে দেওয়া একটা মোটা অঙ্কের অর্থ। তা নইলে বিএনপি এবং বিএনপি-জামায়াতের দুই আমলের সাথে আওয়ামী লীগ তথা মহাজোটের বর্তমান সরকারের কোনো তুলনামূলক বিচার না করে ইকোনোমিস্ট কিভাবে লিখতে পারল : বর্তমান সরকার এ যাবত বাংলাদেশের ক্ষমতায় আসা সরকারসমূহের মধ্যে ‘ওয়ারস্ট’ বা সবচেয়ে ব্যর্থ ও খারাপ সরকার!
সফল সরকারের মাপকাঠি বুঝি যথেচ্ছ রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুট করা এবং তা বিদেশে পাচার করা? সফল সরকারের নমুনা বুঝি জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদ প্রসারে যে সরকার বিশেষ পারঙ্গমতা দেখিয়েছে সেই গোষ্ঠী? হ্যালো ইকোনোমিস্ট, সফল সরকার বলতে বুুঝি ক্ষমতায় থাকতে যারা হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করেও জ্বালানি খাতে দুই টার্মের দশ বছরে এক কিলোওয়াট বিদ্যুতও উৎপাদন করে না, সেই সরকার?
হত্যা, গুম, দুর্নীতি, গ্রেনেডবাজি, বোমাবাজি, সৈন্য ও পুলিশ লেলিয়ে মানুষ হত্যার নাম বুঝি মানবাধিকার পালন? ইকোনোমিস্টের বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পর্কিত বিশ্লেষণ তো অনেকটা এই রকমই বোঝায়। হ্যাঁ, বর্তমানের বাংলাদেশে গুম, হত্যা ও আইন বহির্গত কিছু হত্যকা- ঘটেছে। তবে হত্যা, গুম ও গ্রেনেডবাজি বোমাবাজি ইত্যাকার কাজে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দল যে বিএনপি-জামায়াতÑএ কথা বাংলাদেশের কে না জানে! অথচ আঙ্গুল তাদের বিপক্ষে উঠল না, ইকোনোমিস্টের আঙ্গুল উঠল হত্যা, গুম ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে বর্তমান মহাজোট সরকারের প্রতি, এটা ভারি এক আশ্চর্য কথা। দূষিত রাজনীতির জন্য সংসদে না যাওয়া, রাজপথে আন্দোলনের নামে আগুন লাগিয়ে মানুষ হত্যা করা, সংসদে মাত্র ৩০টি আসন পাওয়া দলটির সামান্য কিছু হলেই সরকার পতনের ডাক দেয়া, এসব কিছু আমলে নিতে বুঝি বাধল ইকোনোমিস্ট পত্রিকার! প্রশ্ন উঠতে এবং সন্দেহ জাগতেই পারে আলোচ্য পত্রিকার বাংলাদেশ সম্পর্কিত প্রতিবেদনটির লেখকের নাম কি অর্থ!
রাজনীতি দূষিত করছে কারা? যারা ক্ষমতা থাকাকালীন সময়ে পাকিস্তান, ভারত ও মধ্যপ্রাচ্যের সন্ত্রাসী জঙ্গীবাদী দল জেএমবি, হুজি, জয়শে মুহম্মদ, লস্কর-ই তৈয়বা, আল কায়েদাকে বাংলাদেশে শিকড় গাড়তে সুযোগ দেয়, পৃষ্ঠপোষকতা করে, বাংলা ভাইদের প্রকাশ্য হিংস্র উত্থানকে নীরবতার নামে প্রশ্রয় ও সমর্থন দেয়, তারা? নাকি যে দল-জোট ক্ষমতায় থাকাকালীন জঙ্গীবাদের শিকড় উপড়ে ফেলতে সর্বাত্মক ব্যবস্থা নেয়, সাফল্য অর্জন করে, তারা? প্রশ্ন জাগে, রাজনীতি দূষিত করে কারা? যারা দেশটা উন্নয়নশীল হওয়া সত্ত্বেও দুই টার্মে এক কিলোওয়াটও বিদ্যুতও উৎপাদন করে না, অথচ হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নেপথ্যে থাকা বিএনপি গণতান্ত্রিক প্রধানমন্ত্রীর ছেলের ফার্ম থেকে খাম্বা কেনে তারা বুঝি খুব উন্নত শ্রেণীর গণতান্ত্রিক রাজনীতি করে? ইংল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার কিংবা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী যদি কালো টাকা সাদা করতেন তাহলে তাদের নেতৃত্ব চলে যেতে ক’ সেকেন্ড বা ক’ মিনিট লাগত? অথচ বাংলাদেশে আর্মি সমর্থনপুষ্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে খালেদা জিয়া ও তার প্রয়াত অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান তেমনটাই করেছিলেন, কালো টাকা সাদা করেছিলেন এবং এজন্যে বিএনপি থেকে কোনো প্রতিবাদ বা শোরগোল ওঠা দূরে থাক, টু শব্দটিও হয়নি। হ্যালো ইকোনোমিস্ট, দূষিত রাজনীতি কাকে বলে?
বর্তমান মহাজোট সরকারের সাফল্যের তালিকাটি দীর্ঘই বলতে হয়। (এক) দেশকে বর্তমান সরকার কৃষকের কাছে সুলভে এবং সময়মতো বীজ সার সেচের জন্য বিদ্যুত সরবরাহের মাধ্যমে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছে। নিকটভবিষ্যতে চাল রফতানির সম্ভাবনাও রয়েছে ষোলো আনা। (দুই) দুরূহ, প্রায় অসাধ্য বিদ্যুত সমস্যার আংশিক সুরাহা করতে পেরেছে সরকার। ‘গত’ সাড়ে তিন বছরে তারা যে শুধু ৩ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত জাতীয় গ্রিডে সংযোজন করতে পেরেছে তাই নয়, শুধু যে ২১ লাখ নতুন বিদ্যুত গ্রাহকের কাছে বিদ্যুত পৌঁছে দিতে পেরেছে তা নয়, পরন্তু দেশে নতুন নতুন গ্যাস ও তেল ক্ষেত্র আবিষ্কৃত হওয়ার প্রেক্ষাপটে বর্তমান সরকার ২০১৪ সালের মধ্যে দেশে বিদ্যুতের ৭০ ভাগ চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হবে বলে অনেক বিশেষজ্ঞেরই স্থির বিশ্বাস, (তিন) দেশে শিক্ষার একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হতে শুরু করেছে। সেই শিক্ষা ব্যবস্থার লক্ষ্য শুধু শিক্ষার্থীর ডিগ্রী অর্জন করা নয়, দেশের জনবলকে দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করা বস্তুত এটাই শিক্ষার লক্ষ্য হওয়া উচিত। জিয়াউর রহমান খালেদা জিয়া শিক্ষা ও শিক্ষার্থী দুটোকেই সর্বনাশের শেষপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিলেন। বর্তমান সরকারের আমলে কোচিং সিস্টেম বন্ধ এবং যুগোপযোগী সৃষ্টিশীল সিলেবাস ও প্রশ্ন পদ্ধতি বহাল করে শিক্ষার বেহাল দশা যেমন বন্ধ করার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, তেমনি প্রযুক্তি ও বিজ্ঞাননির্ভর শিক্ষার সঠিক প্রবর্তনের চেষ্টা চলছে। আমি বলব, বর্তমান সরকারের এটা এক বিশাল সাফল্য। (চার) বর্তমান সরকারের আমলে প্রযুক্তির ব্যবহার দেশের অধিকাংশ গ্রাম ইউনিয়ন পর্যন্ত বিস্তার করা হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যে গোটা দেশ এর সুফল পেতে শুরু করবে। এটা দেশের তথ্য আহরণ ও কৃষি-শিল্পের উন্নয়নের জন্য দেশব্যাপী এক ব্যাপক ইতিবাচক ফলাফল বয়ে আনবে। (পাঁচ) ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা প্রভৃতি মহানগরীতে উড়াল সেতু, টানেল নির্মাণ এবং মেট্রোরেল প্রকল্প নির্মাণের ৯০ ভাগ ২০১৩ সালের মধ্যে শেষ হবে বলে সরকার ঘোষণা দিয়েছে। বর্তমান সরকারের সাফল্যের তালিকা আরও দীর্ঘ। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যর্থতা, বিচ্যুতি ইত্যাদিও আছে অতি অবশ্যই। তবে দূষিত রাজনীতির জন্য বর্তমান মহাজোট সরকারকে দায়ী করা যায় না। যারা ক্ষমতায় গিয়ে সব প্রতিষ্ঠান দলীয়করণ করে, দুর্নীতি ও জঙ্গীবাদকে প্রাতিষ্ঠানিক করে তোলে এবং বিরোধী দলে থাকাকালীন সময়ও কোনো ক্ষেত্রেই কোনো দায়িত্ববোধের পরিচয় দেয় না, বরং দেশে নৈরাজ্য ও অচলাবস্থা সৃষ্টির তালে থাকে সর্বক্ষণ, দূষিত রাজনীতির হোতা তো বলা উচিত তাদেরকেই। ইংরেজী পাক্ষিক ইকোনোমিস্ট তাদের কেন আড়াল করে রাখতে চায়, সেটা তারাই ভালো জানে। ইকোনোমিস্ট যা-ই ভাবুক যা-ই লিখুক, বাংলাদেশের গরিষ্ঠ সংখ্যক মানুষ জানে দূষিত রাজনীতির দানব ও অপহোতা কারা।
লেখক : সাংবাদিক, কথাসাহিত্যিক
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন