জিবলু রহমান :
১৯৮১ সালের ১০ মে ভারত থেকে শেখ হাসিনা প্রত্যাবর্তন করে যখন বহুধারায় বিভক্ত আওয়ামী লীগের হাল ধরলেন, তারপর থেকে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক তৎপরতা নতুন শক্তি লাভ করে। কিন্তু সবাইকে নিয়ে শেখ হাসিনা এগিয়ে যেতে পারেননি। আওয়ামী লীগের ভেতর নেতৃত্বের দ্বনদ্ব ছিল এবং শীর্ষ পদ নিয়ে প্রতিদ্বনিদ্বতা চলছিল। ফলে শেখ মুজিব হত্যার পর দীর্ঘ ২১ বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতা থেকে দূরে ছিল।
আশির দশকের শেষে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার মতো অবস্থায় ফিরে আসে এবং সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদের পদত্যাগের দাবিতে বিভিন্ন সময়ের আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু সেই সময় আওয়ামী লীগের আদর্শগত প্রেক্ষিত স্ববিরোধিতাও পরিলক্ষিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শীর্ষ রাজনৈতিক দলের পরিচয় নিয়ে সরকার বিরোধী আন্দোলনে অংশ নিলেও আন্দোলনকে বেগবান করার অভিপ্রায়ে বিভিন্ন দলের সঙ্গেও আওয়ামী লীগ অাঁতাত করেছে। এর ফলে আওয়ামী লীগের আদর্শগত অবস্থান যে সুদৃঢ় নয় এবং সেখানে আপনের স্থান আছে, এই ধারণা সৃষ্টি হয়েছে।
১৯৯৬ সালের ২৩ জুন দীর্ঘ ২১ বছর পর সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদের জাতীয় পার্টির সঙ্গে সমঝোতার প্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণ করে। এর জন্য জাতীয় পার্টির মহাসচিব আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে যোগাযোগমন্ত্রী করে ‘জাতীয় ঐকমত্যের' নাম ধারণ করে সরকার গঠন করা হয়েছিল। অবশ্য সেখানে জাসদের আ.স.ম আবদুর রব মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়ে ‘জাতীয় ঐকমত্যের' সরকারের পাল্লা ভারী করেছিলেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের অধিকাংশ মন্ত্রীই ছিলেন আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান এবং জ্যেষ্ঠ নেতা। নতুন মুখ হাসিনার মন্ত্রিসভায় তেমন প্রকাশ পায়নি। আওয়ামী লীগের ভেতর ও বিভিন্ন স্তরে নেতৃত্ব দিয়েছেন বর্ষীয়ান নেতারাই। ফলে আওয়ামী লীগের ভেতর নতুন রক্তসঞ্চালন বেশ সংকুচিত ছিল।
আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর থেকেই মন্ত্রীদের সঙ্গে দলের, মন্ত্রিসভার বাইরে থাকা নেতা-কর্মীদের দূরত্ব ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। এ নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ক্ষোভও চরম আকার ধারণ করেছিল। তাদের অভিযোগ ছিল, ‘আওয়ামী লীগের বড় নেতা-মাঝারি নেতারা মন্ত্রী হয়েছেন এবং যথারীতি ভুলে গেছেন দল এবং দলের কর্মীদের। সরকারের পেটে ঢুকে গেছে ক্ষমতায় আসার মূল ভিত্তি দল বা সংগঠন।'
১৯৯৬ সালের ২৩ জুন উত্তর মন্ত্রিসভায় আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা, সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান ছাড়াও আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলী, কেন্দ্রীয় ও জেলা পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন। পরবর্তী সময়ে মন্ত্রিসভার সম্প্রসারণে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য আমির হোসেন আমু ও আব্দুল জলিলও মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পেয়েছিলেন। আমু-জলিল মন্ত্রী হওয়ার পর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক বিষয়াদি দেখাশোনা করেন মাঝারি সারির কয়েকজন নেতা।
সক্রিয় প্রায় সব নেতাই মন্ত্রী বা সরকারি দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত থাকায় আওয়ামী লীগে নেমে আসে সাংগঠনিক স্থবিরতা। শুধু কেন্দ্র নয়, জেলা পর্যায়ের অনেক নেতা মন্ত্রী হয়ে যাওয়ায় জেলার সঙ্গে তাদের যোগাযোগ হয়ে পড়ে নিছক আনুষ্ঠানিক। বিরোধী দলে থাকার সময় আওয়ামী লীগের বঙ্গবন্ধু এভিনিউর কার্যালয়ে নেতা-কর্মীদের ভিড় লেগে থাকত। কর্মীরা অনায়াসে কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে দেখা করতে পারত, সাংগঠনিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মতবিনিময় করতে পারত। কিন্তু শেখ হাসিনার মন্ত্রীরা, যারা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাও, তারা দলীয় কার্যালয়ে এসেছিলেন পূর্ব নির্ধারিত সময় অনুযায়ী-অত তারিখ, অতটার সময়। দল ও কর্মীদের সঙ্গে মন্ত্রীদের দূরত্ব কমাতে মন্ত্রীদের গণসাক্ষাতের কর্মসূচি চালু করা হয়েছিল একাধিকবার। এ কর্মসূচি অনুযায়ী নির্দিষ্ট তারিখে নির্দিষ্ট মন্ত্রীরা কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আসতেন। কিন্তু মন্ত্রীদের অনাগ্রহের কারণে বন্ধ হয়ে যায় এ কর্মসূচিও। আর যতদিন চালু ছিল ততদিনেও এ কর্মসূচি দলীয় কর্মীদের সঙ্গে মন্ত্রীদের দূরত্ব ঘোচাতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। মন্ত্রীরা কার্যালয়ে আসতেন ঘড়ি ধরে, এসেই ব্যস্ত হয়ে পড়তেন যাওয়ার জন্য। মন্ত্রীদের কাছে কর্মীদের আর্জি পেশ করতে হতো লিখিতভাবে। আর সেই লিখিত আবেদন দেখে কোনো কোনো মন্ত্রী বলে উঠতেন, এটা তো আমার মন্ত্রণালয়ের অধীনে নয়।
সরকার গঠনের পর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক তৎপরতা সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। বিভিন্ন দিবস পালন বা সংবর্ধনায়, আর বড়জোর ঢাকায় মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরীর নেতৃত্বে হরতাল বিরোধী মিছিল-সমাবেশে। আওয়ামী লীগের এসব অনুষ্ঠানে মন্ত্রীরা এসেছিলেন অতিথি হিসেবে। সাধারণ কর্মীদের সঙ্গে নেতাদের এই দূরত্ব এবং সাংগঠনিক স্থবিরতার সুযোগে আওয়ামী লীগে ভিড় করেছিল সুবিধাবাদীরা। সন্ত্রাসীরাও সুবিধা বুঝে ভিড়ে যায় আওয়ামী লীগে। মন্ত্রীদের চারপাশে তখন যাদের দেখা যায়, বিরোধী দলে থাকতে তাদের অনেককেই দেখা যায়নি। আওয়ামী লীগ আমলে পার্বত্য শান্তি চুক্তি হয়েছে সংসদকে পাশ কাটিয়ে, এমনকি চুক্তি হওয়ার আগে মন্ত্রিসভার সদস্যরাও জানতেন না চুক্তিতে কি থাকছে। সাপ্তাহিক ছুটি দু'দিন করার বিষয়টি মন্ত্রীরা জেনেছেন সংবাদপত্র পড়ে।
দেশবাসী বিশেষ করে রাজধানীর পুলিশকে অপরাধ দমনের জন্য যতটুকু সময় দেয়ার কথা তারা ততটুকু দিতে পারেনি। কারণ সরকারের নির্দেশে পুলিশকে ব্যস্ত থাকতে হয় বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের হয়রানি ও ক্ষমতাসীন দলীয় নেতা-কর্মীদের কর্মকান্ডে সহযোগিতা করার কাজে। ফলশ্রুতিতে রাজধানীতে প্রতিদিন অপরাধের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় অথচ বিরোধী দলের কর্মসূচি বানচালেই পুলিশ সারাক্ষণ ব্যস্ত ছিল। পুলিশের পক্ষে সম্ভব হয়নি অপরাধ দমন ও আইন-শৃক্মখলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা। কথায় বলে ‘সন্ত্রাস সন্ত্রাসকেই ডেকে আনে'। হাসিনার প্রথম আমলে এ সত্যটিই সবচেয়ে প্রকট হয়ে উঠেছে। গণতন্ত্রে বিরোধী দলের কর্মসূচি প্রতিহত করার কোন রেওয়াজ কোন দেশে নেই। আওয়ামী লীগাররা এটা করতে গিয়ে দেশে অনাকাঙ্ক্ষিত সংঘাত সৃষ্টি করেছিল। বিরোধীদল গণতান্ত্রিক রাজনীতির আওতায় হরতাল আহবান করেছিল সত্য। কিন্তু আওয়ামীরা হরতালের দিন জোরপূর্বক গাড়ি মিছিল, লাঠি মিছিল ও বোমাবাজি করে ত্রাস সৃষ্টি করে হরতাল সফল করে দেয়।
তৎকালীন সময়ে সরকার সভা-সমাবেশ বিধি-নিষেধ আরোপ না করলেও পুলিশ ও দলীয় সন্ত্রাসীদের দিয়ে তা পন্ড করার অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপ অব্যাহত রেখেছিল। পুলিশ রাজনৈতিক দলের অফিসে গিয়ে মারপিট, গ্রেফতার, ভাঙচুর, জিনিসপত্রাদি সিজ, টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপের মতো বর্বরতা চালায়। শান্তির রক্ষক পুলিশ বাহিনীকে সরকার তাদের ভাড়াটে বাহিনীর মতো ব্যবহার করেছে। রাজপথে বিরোধী দলের মিছিল হলে পুলিশকে দিয়ে তা ছত্রভঙ্গ করানো হয়েছে। পুলিশের অহেতুক বিড়ম্বনায় নিরীহ জনতার রক্ত ঝড়েছে রাজপথে। হরতাল হলেই সরকার পুলিশ, বিডিআর, আনসার ও দলীয় সন্ত্রাসীদের রাজপথে নামিয়ে যত্রতত্র লাঠিচার্জ, টিয়ারগ্যাস, গুলী নিক্ষেপ করে হত্যা করেছে, প্রতিবাদকারীদের গ্রেফতার করেছে। আইন-শৃক্মখলার চরম অবনতি রোধের বদলে সরকার ব্যস্ত ছিল নিজেকে নিয়ে। পুলিশের কাজ ছিল মন্ত্রীদের পাহারা দেয়া এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক আচরণ করা ও সরকারি দলকে সন্ত্রাসে সহযোগিতা করা।
ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ প্রধান বিরোধী দল বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় পার্টি ও সমমনা বেশ কয়েকটি দলের আন্দোলন ও কর্মসূচি সামনে বেশ কঠোরতার পরিচয় দিয়েছে। সরকার মিছিল-সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করার জন্য পুলিশকে সব ধরনের এ্যাকশনে যেতে নির্দেশ দিয়েছে। বিরোধী দলের সঙ্গে সমঝোতায় আসার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়নি এবং এর জন্য আগ্রহও প্রকাশ করা হয়নি। ফলে সংসদে বিরোধীদল বারংবার অনুপস্থিত থেকেছে এবং হরতাল ডেকে সরকারকে ব্যতিব্যস্ত করার কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। উদ্ভূত রাজনৈতিক অস্থিরতায় গণতন্ত্রের চর্চা যেমন অগ্রসর হতে পারেনি, একই সঙ্গে জনজীবনও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে মাঝে মাঝেই।
প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ওপর রাজনৈতিক হয়রানি, নির্যাতন ও নিপীড়ন চালানো হয়েছে। খালেদা জিয়াসহ বিরোধী দলের শত শত নেতাকর্মীর নামে বিভিন্ন মামলা দায়ের, হয়রানি ও গ্রেফতার করা হয়। ৭ নবেম্বর ১৯৯৮ টিয়ার গ্যাস ছুঁড়ে পল্টন ময়দানে বিএনপির জনসভা পন্ড, ৯ জুন পার্বত্য চট্টগ্রাম অভিমুখী লংমার্চে বাধা দান এবং সবচেয়ে ন্যক্কারজনক ঘটনা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়গামী ছাত্রদল নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার করে পুলিশ কন্ট্রোলরুমে জামা-কাপড় খুলে অর্ধ-উলঙ্গ অবস্থায় সূর্যের দিকে মুখ দিয়ে বসিয়ে রাখার ঘটনা।
১০ নবেম্বর ১৯৯৮ সকালে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার ক্যান্টনমেন্টস্থ বাসার সামনে শহীদ মঈনুল রোডে ব্যারিকেড দেয়া হয়। শহরের রেলক্রসিংগুলোতে যেভাবে লোহার পোল দিয়ে ব্যারিকেড দেয়া হয়, সেভাবেই ব্যারিকেড তৈরি করা হয়। খালেদা জিয়াকে বিব্রত করার জন্যই এটা করা হয়। ক্যাপ্টেন মনিরুল আলম এ ব্যারিকেডের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি জানিয়েছিলেন, কর্তৃপক্ষের নির্দেশেই ব্যারিকেড দেয়া হয়েছে। সকালে ক্যাপ্টেন মনিরুল আলম সাদা পোশাকে ৭/৮ জন জওয়ান নিয়ে ব্যারিকেড নির্মাণ শুরু করেন। কেন এই ব্যারিকেড নির্মাণ করা হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি প্রশ্ন এড়িয়ে যান। সন্ধ্যায় দৈনিক দিনকালের নির্বাহী পরিচালক তারেক রহমান ব্যারিকেডের ছবি তুলতে গেলে ক্যাপ্টেন তার ক্যামেরা ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন এবং তাকে হুমকি প্রদর্শন করেন। খালেদা জিয়ার বাসভবনে ব্যারিকেড তৈরির খবর বিবিসি থেকে প্রচারিত হওয়ার পর সাংবাদিকরা সেখানে ছুটে যান। তখন সাংবাদিকদের ক্যান্টনমেন্টের বাসভবনে ব্যারিকেড তৈরির খবর বিবিসি থেকে প্রচারিত হওয়ার পর সাংবাদিকরা সেখানে ছুটে যান। তখন সাংবাদিকদের ক্যান্টনমেন্টের মূল গেটে আটকে রাখার নির্দেশ দেন ক্যাপ্টেন মনিরুল। তিনি তখন তার সহকর্মীদের লোহা-লক্কর আপাতত সরিয়ে নেয়ার নির্দেশ দেন। এ সময় খালেদা জিয়া নিজে গিয়ে ব্যারিকেড নির্মাণের কারণ জানতে চাইলে মনিরুল ব্রিগেডিয়ার শহীদকে খবর দেন। তিনি এসে বলেন, ব্যারিকেড সরিয়ে দিচ্ছি। এরপর তিনি ব্যারিকেডের কিছু সরঞ্জাম সরিয়ে নেন। বিবিসি'র কাছে খালেদা জিয়া অভিযোগ করেন, ‘আমার বাড়ি থেকে মেইন রোডে বেরুনোর যে রাস্তা রয়েছে, আমাকে না জানিয়ে আমার বাসার সামনে সেখানে হঠাৎ করে ব্যারিকেড সৃষ্টি করা হয়েছে। লোহার পাইপ দিয়ে গাড়ি চলাচলের রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কিসের জন্য রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কিসের জন্য রাস্তা বন্ধ করা হয়েছে, কে অর্ডার দিয়েছে, সে সম্পর্কে আমাকে কিছু বলা হয়নি। আমার গাড়ি যাতে যাতায়াত করতে না পারে সে জন্যই এসব কাজ চলছে। আমার ছেলেরা যেন যাতায়াত করতে না পারে সে জন্যই এসব কাজ চলছে। ব্যারিকেড সম্পর্কে আন্তঃবাহিনী গণসংযোগ দফতর থেকে একটি ব্যাখ্যা দেয়া হয় যা পরের দিন ১১ নবেম্বর বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত হয়। তবে আইএসপিআর-এর ব্যাখ্যা কারো কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। কারণ, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ এবং দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য যদি ব্যারিকেড দেয়া হয়, তাহলে আরো আগেই তা দেয়া উচিত ছিল। খালেদা জিয়ার বাড়ির সামনের রাস্তায় এ ব্যারিকেড যে কোন সদুদ্দেশ্যে দেয়া হয়নি সেটা জনগণ ভালো করেই বুঝেছে। বিষয়টা আরো পরিষ্কার হয়ে গেছে, জাতীয় সংসদে মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের দেয়া বক্তব্য থেকে। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে খালেদা জিয়াকে উচ্ছেদ করার পরিকল্পনা সরকার নিয়েছে।' (সূত্র ঃ দৈনিক দিনকাল ১০ নবেম্বর ১৯৯৮)
১৯৯৯ বিরোধী দল আহূত সচিবালয় গেটে শান্তিপূর্ণ অবস্থানে বাধা দিবেন না বলে হাসিনার ঘোষণা থাকা সত্ত্বেও ওইদিন ঢাকা প্রবেশের বিভিন্ন পথে প্রবল বাধা দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার অঙ্গীকার খেলাপের নমুনা পেশ করে। এতে কি সংবিধানে স্বীকৃত অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়নি? মানবতা লঙ্ঘিত হয়নি? হাসিনার প্রথম শাসনামলে মিরপুর এলাকাকে সন্ত্রাসীদের ক্যান্টনমেন্ট বললে অত্যুক্তি হবে না। এখানে ছিল বিভিন্ন মাস্তান বাহিনী। কোনো কোনো বাহিনী এতই শক্তিশালী ছিল যে, পুলিশ ও দস্তুরমত তাদের ভয় পেত।
একটি গরীব দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে শেখ হাসিনা ৫২টি দেশে আত্মীয়-স্বজন নিয়ে সফর করে ৬০,৮৮,৯১,৩৩৩ কোটি টাকা খরচ করেছেন।
শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হয়ে নিকটস্থ লোকদের প্রভাবে পড়ে গিয়েছিলেন এবং প্রশংসা শুনতে আগ্রহী হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি নবীন দল খুব প্রভাবশালী হয়ে ওঠে, যার জন্য জ্যেষ্ঠ নেতারা সব সময় প্রধানমন্ত্রীর কাছে তেমন সময় পাননি। অভিজ্ঞতার চেয়ে অন্ধ আনুগত্যই প্রাধান্য পেয়েছে। শেখ হাসিনা ক্ষমতা গ্রহণের পরই বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর ২৫ বছরের সকল নিয়মনীতি ও শৃক্মখলা ভেঙ্গে অবসর প্রস্তুতিমূলক ছুটিতে চলে যাওয়া ফুফা মেজর জেনারেল মোস্তাফিজুর রহমানকে এলপিআর বাতিল করে জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার মহাপরিচালক পদে নিয়োগ দেন। সেখান থেকে বদলী করে প্রধানমন্ত্রীর দফতরের পিএস এবং পরবর্তীতে সেনাপ্রধান করা হয়।
অন্যদিকে মহিউদ্দিন খান আলমগীর চাকরি থাকতেই চাকরিবিধি লঙ্ঘন করে ‘জনতার মঞ্চে' উঠে বক্তৃতা দেয়া এবং অন্য আমলাদের নেতৃত্ব দেয়ার স্বীকৃতিস্বরূপ প্রতিমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্তি পান। এটি খুব ভালো দৃষ্টান্ত হয়নি। চাকরিতে বহাল থেকে কোন আমলা রাজনীতি চর্চা করতে পারবে না এবং কোন দলের প্রতি আনুগত্য দেখাতে পারবে না, এই নীতি থাকা উচিত ছিল আওয়ামী লীগের। এই নীতির প্রতি গুরুত্ব না দেয়ার জন্যই পরবর্তীকালে ক্ষমতায় এসে প্রশাসনকে সম্পূর্ণভাবে দলীয়করণের উদ্যোগ নেয় এবং সফলও হয়, যার প্রভাব হয়েছে সুশাসনের জন্য ক্ষতিকর। আওয়ামী লীগের শাসনকালে প্রশাসনকে ঢালাওভাবে দলীয়করণ করা হয়। মুষ্টিমেয় আমলা দলীয় আনুগত্যের জন্য ভালো এবং গুরুত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত হন। শেখ হাসিনার শাসনামলে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে শেখ হাসিনার ফুফাতো বোনের স্বামী রাশিদুল আলমকে ভারপ্রাপ্ত সচিব হিসেবে বসিয়ে শেখ মুজিবের স্বপ্ন বাস্তবায়নের কাজ শুরু করা হয়।
রাশিদুল আলম সংস্থাপন সচিব নিযুক্ত হওয়ার পর ১৯৭৩ সালের ব্যাচের অফিসারদের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয়। শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ আত্মীয় সৈয়দ ইউসুফ হোসেনকে অতিরিক্ত সচিব থেকে রাতারাতি ভারপ্রাপ্ত ও পরে পূর্ণ সচিব করা হয়। তারপর টানা চার বছরে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পান সৈয়দ ইউসুফ। শেখ হাসিনার ভগ্নিপতি এম এ ওয়াদুদ বিএডিসি'র চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি একই পদে এক বছরের এক্সটেনশনের পর অবসরে যান। কিন্তু কিছুদিন পরেই অতিরিক্ত সচিব পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়ে জাতীয় সংসদের সচিবালয়ের নিয়োগ পান এম এ ওয়াদুদ।
অষ্টম জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে ২০০০ সালে পরিকল্পিতভাবে প্রশাসনকে দলীয়ভিত্তিতে সাজানো হয়। এ লক্ষ্যে ১৮টি সচিবের ও ১০টি অতিরিক্ত সচিবের পদ খালি রাখা হয়। মামুনুর রশীদ, বদিউর রহমান, ফজলুর রহমান, শহীদুল আলমের মত দায়িত্বশীল ও যোগ্য ব্যক্তিদের গুরুত্বহীন পদে ওএসডি করে রাখা হয়। সৃষ্টি করা হয় কৃত্রিম সঙ্কট। অপরদিকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রদানে শেখ হাসিনার শাসনামলে রেকর্ড সৃষ্টি করা হয়। বিতর্কিত যেসব ব্যক্তিদের দায়িত্বশীল পদে বসানো হয়েছিল সেগুলো হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর দফতরের মুখ্য সচিব ড. সৈয়দ আব্দুস সামাদ, ইআরডি সচিব ড. একেএম মশিয়ূর রহমান, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ড. শাহ এম ফরিদ, সংসদ সচিবালয়ের সচিব কাজী রকিবদ্দীন আহমেদ, স্বরাষ্ট্র সচিব এম এম রেজা, এনএসআই'র ডিজি কাজী গোলাম রহমান, টার্নওভার ট্যাক্সেস কমিশনের চেয়ারম্যান ড. একেএম মুবিন, বৃহত্তর ঢাকা ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান ও কো-অর্ডিনেশন বোর্ডের নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ ওমর হাদী, নির্বাচন কমিশনের সচিব মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন, বিসিআইসি'র চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আনোয়ারুল হক, সংসদ সচিবালয়ের অতিরিক্ত সচিব এম এ ওয়াদুদ ও আব্দুল মুক্তাদির চৌধুরী, দুর্নীতি দমন ব্যুরোর ডিজি মোহাম্মদ বদিউজ্জামান, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব সিএম মহসিন, মৎস্য ও পশুপালন সচিব ড. জহুরুল করিম প্রমুখ। ১৮টি সচিব পদে শূন্য, ১২টিতে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ, অর্থাৎ ৩০টি সচিব পদ খালি করা হয় দলীয় স্বার্থে।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার ঘন ঘন বিদেশ যাত্রা অনেকের কাছে দৃষ্টিকটূ মনে হয়েছে। তোষামোদকারীদের প্রভাবে পড়ে তিনি যে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পদক ও ডিগ্রী গ্রহণে উৎসাহিত হয়ে পড়েন, সেই বিষয়ও সংবাদপত্রের সমালোচনার বিষয় হয়ে যায়। তাকে শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার দেয়ার জন্য প্রশাসনের কেউ কেউ উৎসাহ দেখিয়েছেন এবং রাষ্ট্রের অর্থে ঘন ঘন বিদেশে সফর করেছেন।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে দলীয় নেতা শামসীম ওসমান, আবু তাহের, জয়নাল হাজারী, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ প্রমুখ জনমতে ভয়ভীতির সঞ্চার করে নিজেদের কর্তৃত্ব স্থাপন করেছিল। এদের কেউ কেউ সাংবাদিকদের ওপরও সত্য ভাষণের জন্য পেশীশক্তি ব্যবহার করছিল। এদের কারও কারও সন্ত্রাস ও দুর্নীতি বিষয়ও বেশ প্রচার পেয়েছিল। এদের সংখ্যা মুষ্টিমেয় ছিল, তবে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য যথেষ্ট।
শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামলে ‘একটা লাশের পরিবর্তে দশটি লাশ' চেয়েছেন এবং ক্ষমতা হারানোর পর দলীয় নেতা-কর্মীদের বলেছেন, তারা যেন সরাকারি ক্যাডারদের হাত-পা ভেঙে দেয়।
লেখক পরিচিতি ঃ সদস্য সচিব, শামসুর রহমান ফাউন্ডেশন, সিলেট।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন