আবুল কাসেম হায়দার
অফিস করছিলাম ৭ মে, ২০১২। সকাল থেকে অফিসে নানা কাজের মধ্যে সময় কেটে যাচ্ছিল। এমন সময় মোবাইল বেজে উঠল। দৈনিক জনকণ্ঠ থেকে স্বদেশ রায় জানালেন, গতকাল আপনার একটি লেখা দৈনিক জনকণ্ঠে ছাপা হয়েছিল। অর্থমন্ত্রী তা পড়ে খুবই আনন্দিত হয়েছেন। তাই তিনি আপনাকে আজ বেলা ৩টায় একটু সাক্ষাত্ করার জন্য মন্ত্রণালয়ে তাঁর অফিস কক্ষে আসার অনুরোধ করেছেন। শুনে মনটা বেশ ভরে গেল। দ্রুত প্রস্তুত হয়ে মন্ত্রণালয়ের দিকে রওনা হলাম।
গাড়িতে বসে পত্রিকা পড়ছিলাম। পড়ছিলাম সিপিডি সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্য। সিপিডির দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সংবাদ সম্মেলনে তিন বন্ধু দেশের শীর্ষ ব্যক্তিদের সাম্প্রতিক সফরের সংক্ষিপ্ত মূল্যায়ন তুলে ধরে বলেন, বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে বৈঠকের চারটি বার্তা দিয়েছেন তারা—প্রথমত, বিনিয়োগ বাড়াতে অবকাঠামোগত উন্নয়ন। দ্বিতীয়ত, দুর্নীতি প্রতিরোধ। তৃতীয়ত, মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি। চতুর্থত, সংঘাত পরিহার করে সবার গ্রহণযোগ্য, সবার অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন করা।
১. অবকাঠামোগত উন্নয়ন : অবকাঠামোগত উন্নয়ন বলতে আমরা উন্নয়নের প্রধান প্রধান শর্তকে বুঝি। গ্যাস, বিদ্যুত্ ও সব ধরনের জ্বালানি এই শর্তের অংশ। রাস্তা, ব্রিজ, বন্দর, রেল ও নদীপথ অবকাঠামোগত উন্নয়নের দ্বিতীয় বিষয়। বিগত পাঁচ বছর ধরে দেশে শিল্পকারখানা নতুন করে স্থাপিত হয়নি বললেই চলে। স্থাপিত অনেক শিল্পকারখানা গ্যাস-বিদ্যুতের অভাবে বন্ধ রয়েছে। অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠানের উত্পাদন হ্রাস পেয়েছে গ্যাস ও বিদ্যুতের অভাবে। দেশে বর্তমানে বিদ্যুত্ উত্পাদনের ক্ষমতা রয়েছে ৬ হাজার মেগাওয়াটের মতো। অন্যদিকে বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে ১২ হাজার মেগাওয়াটেরও বেশি। বিদ্যুত্ উত্পাদন হচ্ছে ৫ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট। বর্তমানে ঘাটতি রয়েছে প্রায় ১ হাজার ৫০০ মেগাওয়াটের বেশি।। এই ঘাটতি দিন দিন বাড়বে।
বৃহত্ শিল্পকারখানা স্থাপন করার ক্ষেত্রে এই চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে ২০ শতাংশ হারে। এই চাহিদা পূরণের উদ্দেশ্যে সরকার বেশকিছু ভাড়াভিত্তিক গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপন করেছে। বিগত তিন বছরে বর্তমান সরকার বিদ্যুত্ উত্পাদন করে জাতীয় গ্রিডে যোগ করতে পেয়েছে ২ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। অন্যদিকে পুরনো বিদ্যুেকন্দ্র গুলো অকেজো হয়ে পড়ছে। তাই বিদ্যুত্ ঘাটতি লেগে রয়েছে। গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্রগুলোও ঠিকমত উত্পাদন করতে পারছে না। তাই বিদ্যুত্ উত্পাদনের স্থায়ী ব্যবস্থায় আমাদের যেতে হবে। তা হচ্ছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপন করা। সরকার এরই মধ্যে রাশিয়ার সঙ্গে পারমাণবিক পর্যায়ে বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপনের চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে কাজ শুরু করেছে। তা বাস্তবায়ন করতে সময় লাগবে প্রায় ৫ থেকে ৭ বছর। দ্রুততার সঙ্গে বিদ্যুতের চাহিদা পূরণের জন্য কয়লাভিত্তিক আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতায় বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এই পর্যায়ে দেশে ৭টি বিভাগে ৫ হাজার মেগাওয়াট করে কমপক্ষে ৩৫ হাজার মেগাওয়াটের পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। তা না হলে কখনও বিদ্যুতের ঘাটতি স্থায়ীভাবে সমাধান করা যাবে না।
এরই মধ্যে সরকার খুলনায় ২১০ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এই উদ্যোগ ভালো। তবে উত্পাদন ক্ষমতা কম হয়েছে। কমপক্ষে খুলনায় ৫ হাজার মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্রের পরিকল্পনা নিতে হবে। সরকার পরিবর্তন হলেও এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ যেন চলতে থাকে, সেই মনোভাব রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অবশ্যই থাকতে হবে এবং সুনিশ্চিত গ্যারান্টিও দিতে হবে। সরকার দ্রুত বিদ্যুতের চাহিদা পূরণের জন্য ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপন করেছে প্রায় ২ হাজার মেগাওয়াট। তাতে তেমন কোনো লাভ হয়নি, বরং বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছে। ভর্তুকি প্রদানের জন্য বিদ্যুতের চার্জ বছরে কয়েকবার বাড়াতে হয়েছে। সংখ্যা হিসাব অনুযায়ী বিগত তিন বছরে এসব কেন্দ্রে বিদ্যুত্ উত্পন্ন হয়েছে ২ হাজার ৯০০ মেগাওয়াট। সরকারি বিদ্যুেকন্দ্রগুলোর মধ্যে উত্পাদন বন্ধ রয়েছে বেশ কয়েকটির। তাই মোট উত্পাদন ও সরবরাহের মধ্যে ঘাটতি বাড়ছে। তাই সরকারকে পুরনো বিদ্যুেকন্দ্রগুলোর মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ পরিকল্পিত, নিয়মমাফিক করে যেতে হবে, যাতে মেরামতের অভাবে বিদ্যুত্ উত্পাদন কোনোভাবে বন্ধ না থাকে।
দ্বিতীয় যে বিষয়টি আমরা আলোচনা করব, তা হচ্ছে গ্যাস। দেশে বৃহত্ সব শিল্প কারখানা গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল। গ্যাস নেই—কারখানা বন্ধ, উত্পাদন বন্ধ হয়ে যাবে। বর্তমানে গ্যাসের দৈনিক চাহিদা ২৫০ কোটি ঘনফুট। উত্পাদন হচ্ছে ২০০ থেকে ২১০ কোটি ঘনফুট। দৈনিক গ্যাসের ঘাটতি ৪০ থেকে ৫০ কোটি ঘনফুট। এই অবস্থার পরিবর্তনের জন্য আমাদের গ্যাস উত্তোলন, সরবরাহ ও আবিষ্কারের দিকে মনোনিবেশ করতে হবে। এজন্য আমাদের একমাত্র প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলাকে শক্তিশালী করতে হবে। প্রতি বছর সরকার বাজেটে কিছু অর্থ বরাদ্দ রাখছে, কিন্তু তা খুব অপ্রতুল। এই অর্থের পরিমাণ অনেক অনেক বাড়াতে হবে। বিদেশ থেকে বাংলাদেশী অভিজ্ঞ পেট্রোবাংলার পুরনো কর্মকর্তাদের বিশেষ কর্মসূচি দিয়ে দেশে ফেরত এনে তাদের অভিজ্ঞতার আলোকে পুরো পেট্রোবাংলাকে ঢেলে সাজাতে হবে।
২. দুর্নীতি প্রতিরোধ : আমাদের অগ্রযাত্রার দ্বিতীয় ও সবচেয়ে শক্তিশালী বাধা হচ্ছে দুর্নীতি। দুর্নীতির অভিযোগে সমাজের সব স্তরের মানুষ আবদ্ধ। রাজনৈতিক ব্যক্তি, সুশীল সমাজ, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সব স্তরের মানুষ সরাসরি বা পরোক্ষভাবে দুর্নীতির করাল গ্রাসে আবদ্ধ। দুর্নীতি দমন কমিশন আজ নামমাত্র সংগঠনে পরিণত হয়েছে।
গত ২ মে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) আটটি দেশের রাষ্ট্রদূত ও ইইউ ডেলিগেশন প্রধান ‘ইউরোপ ডে’ উপলক্ষে এক সভায় সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের বর্তমান দুর্নীতি-পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
এদিকে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু দুর্নীতির কারণে আর্থিক সহযোগিতা বন্ধ করে রেখেছে। বিশ্বব্যাংক আবারও অর্থমন্ত্রীর কাছে দুর্নীতির প্রমাণ দিয়ে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শ দিয়েছে। সরকার কিন্তু কখনও কার্যকর তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি, শুধু যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনকে সরিয়ে অন্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিয়েছে। এবার বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির তথ্য দেয়ার পাশাপাশি দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্যও তাগিদ দিয়েছে এবং বলেছে অর্থ পেতে হলে সরকারকে অবশ্যই দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
৩. মানবাধিকার পরিস্থিতি : বাংলাদেশের শিল্পায়ন তথা অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য মানবাধিকার পরিস্থিতিকে অবশ্যই কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে উন্নত করতে হবে। দেশে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে মর্মে তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। কিন্তু পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছে। প্রতিদিন হত্যা, গুম ও নির্যাতনের খবর আসছে। বিগত ১৭ মে এম ইলিয়াস আলী, সাবেক এমপি, বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক গুম হয়েছেন। শ্রমিক নেতা আনোয়ার হোসেন গুম এবং খুন হলেন। কিন্তু কোনো কূল-কিনারা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বাহিনী এখন পর্যন্ত করতে পারেনি। ইদানীং ক্রসফায়ার কিছুটা কমেছে। ক্রসফায়ারের অন্যরূপ গুপ্তহত্যা বেড়েছে।
দেশে আইন রয়েছে, কিন্তু আইনের প্রয়োগ ঠিকমত ন্যায়সঙ্গতভাবে হয় না। সরকারকে দলীয় চেতনার ঊর্ধ্বে উঠতে হবে। সবার জন্য সমানভাবে, ন্যায়ভাবে আইনের বাস্তবায়ন করতে হবে। তবেই মানবাধিকার লঙ্ঘিত হবে না।
৪. সংঘাত পরিহার, গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন : প্রায় কয়েক বছর ধরে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে। রাজনৈতিক দমন, নির্যাতন, গুম, হত্যা যেন আজ আমাদের জীবনে চলার সঙ্গী হয়ে পড়েছে। বিরোধী দলগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আবার প্রবর্তনের জন্য দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছে। সরকার নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রাখতে রাজি না থাকায় হাইকোর্টের নির্দেশ মোতাবেক সংবিধান সংশোধন করেছে বলে বারবার বলছে। এই সমস্যার দ্রুত সমাধান হোক, সুশীল সমাজসহ সবাই তা চান। আন্তর্জাতিক মহল থেকেও বিষয়টির স্থায়ী সমাধান চাওয়া হয়েছে।
দেশের উন্নয়ন, অর্থনৈতিক উন্নতি, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অবশ্যই জরুরি। তার জন্য সবার অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সবার কাম্য। সবার গ্রহণযোগ্য নির্বাচন না হলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসবে না। উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে। আর আমাদের উন্নয়নের প্রধান শর্ত হচ্ছে, রাজনৈতিক সহাবস্থান ও স্থিতিশীলতা, আইনের শাসন কায়েম।
দেশের সবাইকে একযোগে দেশ গড়ার জন্য এগিয়ে যেতে হবে। বিভক্তিকরণের রাজনীতি সবাইকে পরিহার করতে হবে। সবার ধর্মকর্ম ও মূল্যবোধের সম্মান প্রদান করতে হবে। নিজ নিজ ধর্মীয় অনুভূতিতে কেউ যাতে আঘাত না করতে পারে, রাষ্ট্রকে সেজন্য সব সময় সতর্ক থাকতে হবে।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি ও সাবেক সহসভাপতি এফবিসিসিআই, লেখক ও কলামিস্ট
গাড়িতে বসে পত্রিকা পড়ছিলাম। পড়ছিলাম সিপিডি সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্য। সিপিডির দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সংবাদ সম্মেলনে তিন বন্ধু দেশের শীর্ষ ব্যক্তিদের সাম্প্রতিক সফরের সংক্ষিপ্ত মূল্যায়ন তুলে ধরে বলেন, বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে বৈঠকের চারটি বার্তা দিয়েছেন তারা—প্রথমত, বিনিয়োগ বাড়াতে অবকাঠামোগত উন্নয়ন। দ্বিতীয়ত, দুর্নীতি প্রতিরোধ। তৃতীয়ত, মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি। চতুর্থত, সংঘাত পরিহার করে সবার গ্রহণযোগ্য, সবার অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন করা।
১. অবকাঠামোগত উন্নয়ন : অবকাঠামোগত উন্নয়ন বলতে আমরা উন্নয়নের প্রধান প্রধান শর্তকে বুঝি। গ্যাস, বিদ্যুত্ ও সব ধরনের জ্বালানি এই শর্তের অংশ। রাস্তা, ব্রিজ, বন্দর, রেল ও নদীপথ অবকাঠামোগত উন্নয়নের দ্বিতীয় বিষয়। বিগত পাঁচ বছর ধরে দেশে শিল্পকারখানা নতুন করে স্থাপিত হয়নি বললেই চলে। স্থাপিত অনেক শিল্পকারখানা গ্যাস-বিদ্যুতের অভাবে বন্ধ রয়েছে। অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠানের উত্পাদন হ্রাস পেয়েছে গ্যাস ও বিদ্যুতের অভাবে। দেশে বর্তমানে বিদ্যুত্ উত্পাদনের ক্ষমতা রয়েছে ৬ হাজার মেগাওয়াটের মতো। অন্যদিকে বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে ১২ হাজার মেগাওয়াটেরও বেশি। বিদ্যুত্ উত্পাদন হচ্ছে ৫ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট। বর্তমানে ঘাটতি রয়েছে প্রায় ১ হাজার ৫০০ মেগাওয়াটের বেশি।। এই ঘাটতি দিন দিন বাড়বে।
বৃহত্ শিল্পকারখানা স্থাপন করার ক্ষেত্রে এই চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে ২০ শতাংশ হারে। এই চাহিদা পূরণের উদ্দেশ্যে সরকার বেশকিছু ভাড়াভিত্তিক গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপন করেছে। বিগত তিন বছরে বর্তমান সরকার বিদ্যুত্ উত্পাদন করে জাতীয় গ্রিডে যোগ করতে পেয়েছে ২ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। অন্যদিকে পুরনো বিদ্যুেকন্দ্র গুলো অকেজো হয়ে পড়ছে। তাই বিদ্যুত্ ঘাটতি লেগে রয়েছে। গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্রগুলোও ঠিকমত উত্পাদন করতে পারছে না। তাই বিদ্যুত্ উত্পাদনের স্থায়ী ব্যবস্থায় আমাদের যেতে হবে। তা হচ্ছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপন করা। সরকার এরই মধ্যে রাশিয়ার সঙ্গে পারমাণবিক পর্যায়ে বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপনের চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে কাজ শুরু করেছে। তা বাস্তবায়ন করতে সময় লাগবে প্রায় ৫ থেকে ৭ বছর। দ্রুততার সঙ্গে বিদ্যুতের চাহিদা পূরণের জন্য কয়লাভিত্তিক আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতায় বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এই পর্যায়ে দেশে ৭টি বিভাগে ৫ হাজার মেগাওয়াট করে কমপক্ষে ৩৫ হাজার মেগাওয়াটের পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। তা না হলে কখনও বিদ্যুতের ঘাটতি স্থায়ীভাবে সমাধান করা যাবে না।
এরই মধ্যে সরকার খুলনায় ২১০ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এই উদ্যোগ ভালো। তবে উত্পাদন ক্ষমতা কম হয়েছে। কমপক্ষে খুলনায় ৫ হাজার মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্রের পরিকল্পনা নিতে হবে। সরকার পরিবর্তন হলেও এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ যেন চলতে থাকে, সেই মনোভাব রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অবশ্যই থাকতে হবে এবং সুনিশ্চিত গ্যারান্টিও দিতে হবে। সরকার দ্রুত বিদ্যুতের চাহিদা পূরণের জন্য ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপন করেছে প্রায় ২ হাজার মেগাওয়াট। তাতে তেমন কোনো লাভ হয়নি, বরং বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছে। ভর্তুকি প্রদানের জন্য বিদ্যুতের চার্জ বছরে কয়েকবার বাড়াতে হয়েছে। সংখ্যা হিসাব অনুযায়ী বিগত তিন বছরে এসব কেন্দ্রে বিদ্যুত্ উত্পন্ন হয়েছে ২ হাজার ৯০০ মেগাওয়াট। সরকারি বিদ্যুেকন্দ্রগুলোর মধ্যে উত্পাদন বন্ধ রয়েছে বেশ কয়েকটির। তাই মোট উত্পাদন ও সরবরাহের মধ্যে ঘাটতি বাড়ছে। তাই সরকারকে পুরনো বিদ্যুেকন্দ্রগুলোর মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ পরিকল্পিত, নিয়মমাফিক করে যেতে হবে, যাতে মেরামতের অভাবে বিদ্যুত্ উত্পাদন কোনোভাবে বন্ধ না থাকে।
দ্বিতীয় যে বিষয়টি আমরা আলোচনা করব, তা হচ্ছে গ্যাস। দেশে বৃহত্ সব শিল্প কারখানা গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল। গ্যাস নেই—কারখানা বন্ধ, উত্পাদন বন্ধ হয়ে যাবে। বর্তমানে গ্যাসের দৈনিক চাহিদা ২৫০ কোটি ঘনফুট। উত্পাদন হচ্ছে ২০০ থেকে ২১০ কোটি ঘনফুট। দৈনিক গ্যাসের ঘাটতি ৪০ থেকে ৫০ কোটি ঘনফুট। এই অবস্থার পরিবর্তনের জন্য আমাদের গ্যাস উত্তোলন, সরবরাহ ও আবিষ্কারের দিকে মনোনিবেশ করতে হবে। এজন্য আমাদের একমাত্র প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলাকে শক্তিশালী করতে হবে। প্রতি বছর সরকার বাজেটে কিছু অর্থ বরাদ্দ রাখছে, কিন্তু তা খুব অপ্রতুল। এই অর্থের পরিমাণ অনেক অনেক বাড়াতে হবে। বিদেশ থেকে বাংলাদেশী অভিজ্ঞ পেট্রোবাংলার পুরনো কর্মকর্তাদের বিশেষ কর্মসূচি দিয়ে দেশে ফেরত এনে তাদের অভিজ্ঞতার আলোকে পুরো পেট্রোবাংলাকে ঢেলে সাজাতে হবে।
২. দুর্নীতি প্রতিরোধ : আমাদের অগ্রযাত্রার দ্বিতীয় ও সবচেয়ে শক্তিশালী বাধা হচ্ছে দুর্নীতি। দুর্নীতির অভিযোগে সমাজের সব স্তরের মানুষ আবদ্ধ। রাজনৈতিক ব্যক্তি, সুশীল সমাজ, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সব স্তরের মানুষ সরাসরি বা পরোক্ষভাবে দুর্নীতির করাল গ্রাসে আবদ্ধ। দুর্নীতি দমন কমিশন আজ নামমাত্র সংগঠনে পরিণত হয়েছে।
গত ২ মে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) আটটি দেশের রাষ্ট্রদূত ও ইইউ ডেলিগেশন প্রধান ‘ইউরোপ ডে’ উপলক্ষে এক সভায় সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের বর্তমান দুর্নীতি-পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
এদিকে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু দুর্নীতির কারণে আর্থিক সহযোগিতা বন্ধ করে রেখেছে। বিশ্বব্যাংক আবারও অর্থমন্ত্রীর কাছে দুর্নীতির প্রমাণ দিয়ে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শ দিয়েছে। সরকার কিন্তু কখনও কার্যকর তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি, শুধু যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনকে সরিয়ে অন্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিয়েছে। এবার বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির তথ্য দেয়ার পাশাপাশি দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্যও তাগিদ দিয়েছে এবং বলেছে অর্থ পেতে হলে সরকারকে অবশ্যই দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
৩. মানবাধিকার পরিস্থিতি : বাংলাদেশের শিল্পায়ন তথা অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য মানবাধিকার পরিস্থিতিকে অবশ্যই কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে উন্নত করতে হবে। দেশে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে মর্মে তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। কিন্তু পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছে। প্রতিদিন হত্যা, গুম ও নির্যাতনের খবর আসছে। বিগত ১৭ মে এম ইলিয়াস আলী, সাবেক এমপি, বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক গুম হয়েছেন। শ্রমিক নেতা আনোয়ার হোসেন গুম এবং খুন হলেন। কিন্তু কোনো কূল-কিনারা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বাহিনী এখন পর্যন্ত করতে পারেনি। ইদানীং ক্রসফায়ার কিছুটা কমেছে। ক্রসফায়ারের অন্যরূপ গুপ্তহত্যা বেড়েছে।
দেশে আইন রয়েছে, কিন্তু আইনের প্রয়োগ ঠিকমত ন্যায়সঙ্গতভাবে হয় না। সরকারকে দলীয় চেতনার ঊর্ধ্বে উঠতে হবে। সবার জন্য সমানভাবে, ন্যায়ভাবে আইনের বাস্তবায়ন করতে হবে। তবেই মানবাধিকার লঙ্ঘিত হবে না।
৪. সংঘাত পরিহার, গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন : প্রায় কয়েক বছর ধরে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে। রাজনৈতিক দমন, নির্যাতন, গুম, হত্যা যেন আজ আমাদের জীবনে চলার সঙ্গী হয়ে পড়েছে। বিরোধী দলগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আবার প্রবর্তনের জন্য দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছে। সরকার নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রাখতে রাজি না থাকায় হাইকোর্টের নির্দেশ মোতাবেক সংবিধান সংশোধন করেছে বলে বারবার বলছে। এই সমস্যার দ্রুত সমাধান হোক, সুশীল সমাজসহ সবাই তা চান। আন্তর্জাতিক মহল থেকেও বিষয়টির স্থায়ী সমাধান চাওয়া হয়েছে।
দেশের উন্নয়ন, অর্থনৈতিক উন্নতি, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অবশ্যই জরুরি। তার জন্য সবার অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সবার কাম্য। সবার গ্রহণযোগ্য নির্বাচন না হলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসবে না। উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে। আর আমাদের উন্নয়নের প্রধান শর্ত হচ্ছে, রাজনৈতিক সহাবস্থান ও স্থিতিশীলতা, আইনের শাসন কায়েম।
দেশের সবাইকে একযোগে দেশ গড়ার জন্য এগিয়ে যেতে হবে। বিভক্তিকরণের রাজনীতি সবাইকে পরিহার করতে হবে। সবার ধর্মকর্ম ও মূল্যবোধের সম্মান প্রদান করতে হবে। নিজ নিজ ধর্মীয় অনুভূতিতে কেউ যাতে আঘাত না করতে পারে, রাষ্ট্রকে সেজন্য সব সময় সতর্ক থাকতে হবে।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি ও সাবেক সহসভাপতি এফবিসিসিআই, লেখক ও কলামিস্ট
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন