বদরুদ্দীন উমর
কৃষিপণ্য বাজারে ফড়িয়াদের উৎপাত ও লুটপাট কোনো নতুন ব্যাপার নয়। খোদ কৃষকরা, বিশেষত ভূমিহীনরা ভূমি মালিক ও মহাজনদের শোষণের শিকার। কিন্তু সর্বস্তরের কৃষকরা খুব বড় আকারে ক্ষতিগ্রস্ত হন মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ী ও ফড়িয়াদের দ্বারা। সব রকম অসুবিধার মধ্য দিয়ে কৃষকরা ফসল উৎপাদন করার পর সেটা বিক্রির সময় পড়েন ফড়িয়া ব্যবসায়ীদের খপ্পরে। এটা যদি না হতো তা হলে কৃষকদের অবস্থা এত শোচনীয় হতো না। এই মুহূর্তে বোরো ধান নিয়ে কৃষকরা এমনই এক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন। সরকার নিজে বোরো ধান ক্রয়ের দর নির্ধারণ করেছে মণপ্রতি ৭২০ টাকা। কিন্তু ফড়িয়াদের পাতা জালে আটকা পড়ে কৃষকরা গ্রামের বাজারে এই ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন ৪২৫ থেকে ৪৪০ টাকা মণ দরে। অর্থাৎ সরকার যা নির্ধারণ করেছে তার প্রায় অর্ধেক দরে! এর ফলে হাড়ভাঙা খাটুনি ও খরচ খরচার পর লাভ তো দূরের কথা কৃষকরা এমন ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন যার ধাক্কা সামলে ওঠা তাদের পক্ষে এক অসহনীয় ব্যাপার। সরকার ইচ্ছা করলেই ধানের বাজারের ওপর ফড়িয়াদের এই নিয়ন্ত্রণ বন্ধ করতে পারে। এর জন্য প্রয়োজন ফসল ক্রয়ের ব্যবস্থা সরকারের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা। এটা দু'ভাবে হতে পারে। প্রথমত, সরকার কর্তৃক নিজে ফসল, এ ক্ষেত্রে ধান কেনা। দ্বিতীয়ত, সারাদেশে বিভিন্ন এলাকায় নির্দিষ্ট ধান ক্রয় কেন্দ্র স্থাপন করে সরকারের তদারকিতে ক্রয়-বিক্রয় ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে ফড়িয়াদের বাজার থেকে তাড়িয়ে দিয়ে কৃষকদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা।
কৃষকরা বোরো ধানের ন্যায্য দাম পাওয়া তো দূরের কথা। অনেকে এখন বাধ্য হয়ে অতি কম দামে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। এই পরিস্থিতিতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ধানের ন্যায্যমূল্যের জন্য আন্দোলন হচ্ছে। শুধু ফড়িয়াদের উৎপাত ও লুটপাটের বিরুদ্ধেই যে তারা আন্দোলন করছেন তাই নয়, সরকারের বেঁধে দেওয়া দামের পরিবর্তে তারা মণপ্রতি ৮৫০ টাকা করার দাবিও করছেন। কিন্তু এসব আন্দোলন এত বিচ্ছিন্নভাবে হচ্ছে এবং এর সাংগঠনিক শক্তি এত দুর্বল যে ফড়িয়ারা তো দূরের কথা, সরকার পর্যন্ত এদিকে দৃষ্টি দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করছে না।
ধানের ক্ষেত্রে এভাবে বাজারে ফড়িয়াদের যে তৎপরতা চলছে এটা অন্য সব অর্থকরী ফসলের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কিন্তু ধান যেহেতু অন্য সব ফসলের থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং দেশের লোকের প্রধান খাদ্য, সে কারণে ধানের বাজার ফড়িয়াদের নিয়ন্ত্রণে থাকা এক বিপজ্জনক ব্যাপার। বাংলাদেশ এখন খাদ্যে অর্থাৎ মূলত ধানের চাহিদা ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। এ নিয়ে সরকারও অনেক ঢেঁড়ি পিটিয়ে থাকে। কিন্তু সরকার যতই ঢেঁড়ি পেটাক, এর কৃতিত্ব হচ্ছে কৃষকের, যারা হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে ফসল উৎপাদন করেন। তাদের এই খাটুনির কথা অনেক সরকারি লোকজন বললেও তাদের এই খাটুনির উপযুক্ত মূল্য দেওয়ার ব্যাপারে তাদের কোনো সুনির্দিষ্ট নীতি ও কর্মসূচি নেই। কাজেই ধান ক্রয় ক্ষেত্রে যেমন থাকে টিলেঢালা অবস্থা, তেমনি ফড়িয়া নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে থাকে তাদের পরিপূর্ণ নিষ্ক্রিয়তা।
বাংলাদেশে এখন দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ীরা সব ক্ষেত্রেই নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। তারা নানা ধরনের সিন্ডিকেট গড়ে তুলে খাদ্যবাজার সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে। এই নিয়ন্ত্রণ এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যাতে প্রতিদিনই সব রকম খাদ্যবস্তুর মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেহেতু এ ক্ষেত্রে কোনো সরকারি হস্তক্ষেপ নেই, সে কারণে বাংলাদেশ এখন পরিণত হয়েছে বিক্রেতাদের বাজারে (ঝবষষবৎং সধৎশবঃ)। এখানে ক্রেতাদের দরদস্তুর করারও কোনো সুযোগ নেই। বিক্রেতাদের হাতে তারা জিম্মি।
বলাই বাহুল্য যে, এসব সিন্ডিকেটওয়ালা হলো সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। শুধু তাই নয়, শীর্ষস্থানীয় সরকারি লোকেরা অনেকে বেনামিতে এই কারবারের সঙ্গে জড়িত। মাছ, গোস্ত, সবজি, ডাল, মসলা সব রকম খাদ্যসামগ্রী এভাবে অসৎ ও দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী এবং ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক ব্যক্তিদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত মূল্যে বিক্রি হচ্ছে। এর ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ স্থাপনের কোনো ব্যাপার নেই। সরকারি মহলে এ রকম কোনো চিন্তাভাবনার কথাও শোনা যায় না। কাজেই সারাদেশে যেখানে যা উৎপাদিত হচ্ছে তার ওপর উৎপাদকের নয়, ফড়িয়া ব্যবসায়ী এবং অসৎ রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ন্ত্রণই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে স্থাপিত হয়েছে।
এখন মাঠে বোরো ধান উঠেছে এবং বিক্রির জন্য কৃষকরা তা বাজারে নিচ্ছেন। কিন্তু তারা ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়ে সর্বনাশের দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন। এর ওপর সংবাদপত্রেও কিছু কিছু রিপোর্ট প্রকাশিত হচ্ছে। কিন্তু একদিকে সরকারের সচেতন উদাসীনতা এবং অন্যদিকে দেশে কোনো শক্তিশালী কৃষক আন্দোলন না থাকায় কৃষকরা নিদারুণ পরিশ্রম সত্ত্বেও কোনো ফসলেরই ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না।
বাংলাদেশের অর্থনীতি কৃষক শ্রমিকরাই সচল রেখেছেন। কিন্তু এই শ্রমজীবীদের স্বার্থই আজ সব থেকে বেশি উপেক্ষিত। কৃষকরা কৃষিক্ষেত্রে বীজ, সার, সেচ, কীটনাশক ইত্যাদি উৎপাদন সামগ্রীর অভাবে অথবা বেশি দাম দিতে বাধ্য হয়ে এবং হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে তাদের ফসলের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। এমনকি জমিতে নিজেরা যে পরিশ্রম করছেন তার বিশেষ কোনো মূল্যও তারা পাচ্ছেন না। কিন্তু তারা যা উৎপাদন করছেন তার থেকে বিরাট আকারে উদ্বৃত্ত অপহরণ করে ভূমি মালিক, মহাজন, ফড়িয়া ব্যবসায়ী, লুটপাটকারী সরকারি লোকজন নিজেদের পকেট ভর্তি করছে।
শিল্প শ্রমিকদের ক্ষেত্রেও শোষণ-লুণ্ঠন একইভাবে চলছে। বাংলাদেশে শ্রমিকের মজুরি বিশ্বের অন্যান্য দেশের শ্রমিক মজুরি থেকে কম। এই সস্তা শ্রমশক্তির কারণে আন্তর্জাতিক পুঁজি বাংলাদেশের প্রতি আকৃষ্ট হয়। এখানে গার্মেন্ট শিল্পের রমরমা অবস্থার এটাই মূল কারণ। কিন্তু শুধু দেশে নিযুক্ত শ্রমিকরাই নন, বিদেশে কর্মরত লাখ লাখ শ্রমিক কাজ করছেন। তারা বাংলাদেশে বছরে ১২ বিলিয়ন বা ১২শ' কোটি ডলার পাঠিয়ে থাকেন। এই বৈদেশিক মুদ্রা যদি বাংলাদেশ না পেত তাহলে এখানকার অর্থনীতি অচল হতো। এ কথা সরকারি মহলে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত হলেও এই গরিব শ্রমিকরা বিদেশে যেভাবে স্থানীয় সরকার ও মালিকদের দ্বারা নিগৃহীত হন সে ব্যাপারে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলো এবং বাংলাদেশ সরকার কোনো দৃষ্টি দেয় না। না দেওয়ারই কথা। কারণ, কৃষক শ্রমিকের ঘাম ও রক্তের কোনো মূল্য বাংলাদেশের শাসকশ্রেণী ও তাদের কোনো সরকারের কাছে নেই।
এই মৌসুমে বোরো ধানের মূল্য না পেয়ে কৃষকরা কী পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে সে কথা বলতে গিয়ে এসব কথা বলার প্রয়োজন হলো। কারণ এসবই প্রাসঙ্গিক কথা। বাংলাদেশে গরিবের শ্রমের যদি কোনো মর্যাদা থাকত তাহলে কৃষকরা যেমন ফসলের ন্যায্যমূল্য পেতেন, তেমনি কারখানা শ্রমিকরা পেতেন মনুষ্যোচিত মজুরি এবং বিদেশে কার্যরত শ্রমিকদের শ্রমের মর্যাদা ও মূল্য তারা লাভ করতেন। কাজেই এসব ক্ষেত্রে যা হচ্ছে তাকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখার উপায় নেই। এই অখণ্ড অর্থনীতিতে কোনো ধরনের শ্রমজীবীদেরই স্বার্থ দেখা ও সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা আজ নেই।
২১.৫.২০১২
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন