বৃহস্পতিবার, ২৪ মে, ২০১২

প্রিয় শহর ঢাকায় নজরুল



সৈয়দ আবদাল আহমদ
ঢাকার বুকে ঘুমিয়ে আছেন নজরুল। কবি নজরুল গেয়েছিলেন, ‘মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই।’ তাঁর কবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশেই। কবরের সামনের বেদিতে উত্কীর্ণ রয়েছে নজরুলের সেই বিখ্যাত ‘বিদ্রোহী’ কবিতার লাইন—
‘মহা-বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত,
যবে উত্পীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না—
বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত—
আমি সেই দিন হব শান্ত...।’
আজ ১১ জ্যৈষ্ঠ। বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১১৩তম জন্মবার্ষিকী। কবির এই জয়ন্তী আজ এমন একসময় হচ্ছে, যখন তাঁর বিদ্রোহী কবিতারও ৯০ বছর পূর্তি হচ্ছে। ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে বিদ্রোহী রচনা করেছিলেন নজরুল। ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি সাপ্তাহিক ‘বিজলী’ পত্রিকায় প্রথম বিদ্রোহী প্রকাশিত হয়। ১৩২৮ বঙ্গাব্দের কার্তিক সংখ্যা মোসলেম ভারতেও একইসঙ্গে বিদ্রোহী ছাপা হয়।
বাংলাদেশের জাতীয় কবি নজরুল বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ‘বিদ্রোহী কবি’ এবং আধুনিক বাংলা সঙ্গীতের ‘বুলবুল’ নামেই শুধু খ্যাত নন; তিনি মানবতার কবি, যৌবনের কবি, স্বাধীনতার কবি, শক্তিমত্তার কবি এবং প্রেমের কবি। নজরুলগবেষক অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের ভাষায় বিশ শতকের বিশ ও তিরিশের দশকে উপমহাদেশে অবিভক্ত বাংলার সাংস্কৃতিক জগতের সবচেয়ে বর্ণাঢ্য ব্যক্তিত্ব নজরুল। তিনি রবীন্দ্রোত্তর আধুনিকতারও পথিকৃত্। নজরুল তাঁর কবিতা, গান, উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ, নাটক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে পরাধীন ভারতে, বিশেষ করে বিভক্ত বাংলার পরাধীনতা, সাম্প্রদায়িকতা, সামন্তবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ এবং দেশি-বিদেশি শোষণের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বলিষ্ঠ ও সোচ্চার ছিলেন। সে কারণে ইংরেজ সরকার একের পর এক তার গ্রন্থ ও রচনা নিষিদ্ধই শুধু করেনি; শেষ পর্যন্ত তাঁকে গ্রেফতার ও কারাদণ্ডে দণ্ডিতও করেছিল। রাজবন্দি নজরুল প্রায় চল্লিশ দিন একটানা অনশন করে ইংরেজ সরকারের জেল-জুলুমের প্রতিবাদ করেছিলেন।
নজরুলগবেষক ও প্রেমিক, কবি আবদুল হাই শিকদারের ভাষায়, ‘আমাদের জাতীয় সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সঙ্গীতেরও সবচেয়ে বড় রূপকার নজরুল। তাঁর জীবন ও সৃষ্টির পরতে পরতে আছে সব যুগের সব মানুষের ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার সমান আতিথ্য। নজরুল একমাত্র কবি, যিনি কাউকে বড় করতে গিয়ে অন্যকে ছোট করেননি। ‘মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান,’ ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম ওই জিজ্ঞাসে কোন জন’—এমন কথা তাঁর আগে এ ভাষায় কেউ বলেননি। বিংশ শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্য উচ্চারণ ‘গাহি সাম্যের গান, মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান’—এটাই নজরুলের দর্শন। তাই বাংলাদেশের জাতীয় কবি হয়েও তিনি বিশ্বকবি, বিশ্বনাগরিক। বাংলা সাহিত্যে তাঁর আবির্ভাব অনেকটা ধূমকেতুর মতো। তিনি কেবল কবিই নন; একাধারে তিনি গল্পকার, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীত রচয়িতা, সুরকার, অভিনেতা, গায়ক, সাংবাদিক ও রাজনীতিক।
কবি নজরুল এক অনন্যপ্রতিভা। তাঁর সাহিত্য-সাংস্কৃতিক জীবন মাত্র একুশ বছরের। কিন্তু এ সময়ের মধ্যে তিনি যা সৃষ্টি করেছেন, তার কোনো তুলনা নেই। নজরুলের গানের সংখ্যা তিন হাজার তিনশ’রও বেশি। তাঁর গান এত বিষয়-বৈচিত্র্যের, তাঁর গানে রাগ-রাগিণীর এত খেলা, তা বিশ্বসঙ্গীতেও দেখা যায় না। মাত্র দশ বছরের সঙ্গীত সাধনায় ২৪টি রাগ তিনি সৃজন করেছেন। তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে সফল সঙ্গীতজ্ঞ। বিশ্বসঙ্গীতের সঙ্গে তুলনা করলে শ্রেষ্ঠ দশ জন সঙ্গীতজ্ঞের একজন হবেন নজরুল। চলচ্চিত্রের সবক’টি শাখায় তিনি কাজ করেছেন। অপেরাধর্মী নাটকের প্রতিষ্ঠাতা তিনি। নজরুল গণমুখী সাংবাদিকতার জনক। নবযুগ, ধূমকেতু ও লাঙল এক্ষেত্রে পথিকৃত্।
তিনি ১৯২২ সালে ধূমকেতু পত্রিকায় ভারতবর্ষের স্বাধীনতার কথা উচ্চারণ করেছেন। এক কথায় নজরুল যেখানে হাত দিয়েছেন, তাতেই সোনা ফলেছে।
প্রথম মহাযুদ্ধ শেষে ১৯২০ সালের মার্চ মাসে নজরুল কলকাতায় এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন এবং এ সময় থেকেই তিনি পুরোপুরি সাহিত্য সাধনায় মনোনিবেশ করেন। তাঁর সাংবাদিকতা জীবনও তখনই শুরু হয়। ভারতে এ সময় ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন চলছিল। নজরুল এ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। এ সময়েই তাঁর বিখ্যাত বিদ্রোহী কবিতা প্রকাশিত হয়,
‘বল বীর—বল উন্নত মম শির
শির নেহারি আমার, নত-শির ওই শিখর হিমাদ্রির।’
বিদ্রোহী কবিতা প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নজরুলের খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। বিদ্রোহী কবিতাকে বলা হয় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিতা। এ কবিতায় এত বিপুল বৈচিত্র্যের সমাবেশ ঘটেছে—যাকে সাহিত্যবিশ্লেষকরা এক কথায় বলেন অনন্য। কবিতাটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই অভূতপূর্ব আলোড়ন তুলেছিল। কবিতাটিতে সব ধরনের অন্যায়, অত্যাচার আর অবিচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ প্রকাশিত হয়েছে বলেই নজরুল বিদ্রোহী কবি নামে তখন থেকেই পরিচিতি লাভ করেন। সেই কবিতাটির বয়সই এখন ৯০ বছর।
ঢাকাও নজরুলের প্রিয় শহর : যে ঢাকায় নজরুল আছেন চিরনিদ্রায়, সেই ঢাকায় ছড়িয়ে আছে নজরুলের অসংখ্য স্মৃতি। কলকাতায় সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সাংবাদিক জীবন কাটালেও ঢাকা ছিল নজরুলের এক অতিপ্রিয় শহর। সুযোগ পেলেই তিনি চলে আসতেন ঢাকায়। ঢাকায় তার বন্ধুবান্ধবও কম ছিলেন না। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, কবি আবদুল কাদির, ড. কাজী মোতাহার হোসেন, ফজিলাতুন্নেসা, প্রফেসর সত্যেন বোস, হাবিবুল্লাহ বাহার তাদের উল্লেখযোগ্য। ঢাকার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নজরুল গান গেয়েছেন, কবিতা আবৃত্তি করেছেন এবং বক্তৃতা দিয়েছেন। অনেক জনপ্রিয় কবিতা তিনি ঢাকায় বসে লিখেছেন। ঢাকার রমনা লেক ছিল নজরুলের একটি প্রিয় জায়গা। লেকের ধারে সাপের আস্তানা জেনেও শান্ত, নিরিবিলি ও মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্যের এ স্থানে একান্তে প্রশান্তির সান্নিধ্যে যেতেন নজরুল। নজরুল গেছেন আহসান মঞ্জিল ও পুরান ঢাকার রূপলাল হাউসের আসরে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, ঢাকা কলেজ এবং জগন্নাথ কলেজের অনুষ্ঠানে। বুড়িগঙ্গা তীরের করনেশন পার্কে ঘুরে বেরিয়েছেন নজরুল। এ নগরীতে সঙ্গীতের টিউশনিও করেছেন তিনি। আবার বনগাঁ লেনে উচ্ছৃঙ্খল যুবকদের আক্রমণের শিকার হলে তাদের পাল্টা আক্রমণও করেছেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম স্নাতকোত্তর শিক্ষিত নারী বেগম ফজিলাতুন্নেসার হাতের রেখাও গণনা করে দিয়েছেন নজরুল। বর্ধমান হাউসে (বর্তমান বাংলা একাডেমী) তিনি থেকেছেন দিনের পর দিন। ঢাকায় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা নজরুলকে পীড়িত করেছে। দাঙ্গা নিয়ে অসাধারণ একটি কবিতাও লিখেছেন তিনি। দাঙ্গা কতিবাটির সঠিক রচনাকাল জানা না থাকলেও এটি যে বিশের দশকের হবে, সেটা বলা যায়। দাঙ্গা কবিতার কয়েকটি লাইন—
‘এল কুিসত ঢাকার দাঙ্গা আবার নাঙ্গা হয়ে।
এল হিংসার চিল ও শকুন নখর চঞ্চু লয়ে।
সারা পৃথিবীর শ্মশানের ভূত-প্রেতেরা সর্বনেশে
ঢাকার বক্ষে আখা জ্বালাইতে জুটেছে কি আজ এসে?
এরা কি মানুষ? এরা আল্লার সৃষ্টি কি? হুঁঁশ নাই;
ডান হাত দিয়ে বাম হাত কাটে, ভাইকে মারিছে ভাই।’
অসুস্থ হওয়ার আগে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত নজরুল অন্তত বারো বার ঢাকা সফর করেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে নজরুল চলে আসেন চিরদিনের জন্য ঢাকায়। তার শেষ জীবন ঢাকাতেই কাটে। ঢাকাই এখন নজরুলের চিরকালের ঠিকানা, শেষ ঠিকানা।
নজরুল প্রথম কখন ঢাকায় এসেছিলেন? নজরুল ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক কবি আবদুল হাই শিকদারের লেখা থেকে জানা যায়, কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র ও বুদ্ধদেব বসুর তথ্য অনুযায়ী ঢাকায় কবির প্রথম আগমন ঘটে ১৯২৫ সালের ৪ জুলাই, শনিবার অথবা এর পরদিন। ইউরোপীয় শ্বেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে ফুটবলে দেশীয় দলের বিজয়ে আনন্দে উদ্বেল কবি বন্ধুবান্ধব নিয়ে বেরিয়ে পড়েন ঢাকার পথে। এর চেয়ে বেশি বিবরণ আর পাওয়া যায়নি। দ্বিতীয়বার কবি ঢাকায় আসেন ১৯২৬ সালের মার্চ মাসে। ওই সময় তিনি আতিথ্য নিয়েছিলেন পুরান ঢাকার কাচারি সংলগ্ন মোহিনী মোহন দাশের বাড়িতে। কবিকে সে সময় সারাক্ষণ সঙ্গ দিয়েছেন কবি আবদুল কাদির, আবুল কাশেম ও আবদুল মজিদ সাহিত্যরত্ন। কবি তখন এক বা দু’দিন ঢাকায় ছিলেন।
কবি নজরুলের বন্ধু কাজী মোতাহার হোসেন তার স্মৃতিকথায় ১৯২৭ সালে কবির ঢাকা আগমনের বিবরণ লেখেন। সেবার ২৮ ফ্রেবুয়ারি নজরুল ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের ক্ষেত্রে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজে’র প্রথম বার্ষিক সম্মেলনে যোগদান করেন। এ সম্পর্কে কাজী মোতাহার হোসেন লিখেন—বিশিষ্ট সম্মানীয় অতিথি হিসেবে নজরুল ওই অনুষ্ঠানে আসেন। তিনি উদ্বোধনী সঙ্গীত ও কবিতা আবৃত্তি করেন এবং মুসলিম সাহিত্য সমাজের তরুণ সদস্যদের উদ্দেশে উত্সাহমূলক বক্তব্য দেন। গোয়ালন্দ থেকে লঞ্চে নারায়ণগঞ্জ আসার পথে ‘খোশ আমদেদ’ (স্বাগতম) নামে উদ্বোধনী সঙ্গীতটি তিনি রচনা করেন। করতালির মধ্যে নতুন লেখা এ গানটি তিনি এভাবে শুরু করেন—
‘আসিলে কে গো অতিথি উড়ায়ে নিশান সোনালী!
ও চরণ ছুঁই কেমনে দুই হাতে মোর মাখা যে কালি!!’
ঢাকায় এসে তিনি ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র সঙ্গে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের একটি কক্ষের নিচের তলায় পূর্বদিকের অর্ধাংশে আস্তানা গাড়েন। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ তখন সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের হাউস টিউটর হিসেবে ওই গৃহের বাসিন্দা ছিলেন। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের বড় ডাইনিং হলে সাহিত্য সমাজের প্রথম অধিবেশন বসে। সে যাত্রায় ঢাকায় তিনি তিনদিন ছিলেন। ওই সময় উপমহাদেশের প্রখ্যাত ঐতিহাসিক জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট ডক্টর রমেশচন্দ্র মজুমদার কবিকে জগন্নাথ হলে আমন্ত্রণ জানান। কবি সেখানে তার বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় গান পরিবেশন করেন। এর একটি হলো—‘কে বিদেশী বন উদাসী বাঁশের বাঁশী বাজাও বনে?’
ড. মোতাহার হোসেন আরও লেখেন—১৯২৮ সালেও মুসলিম সাহিত্য সমাজের দ্বিতীয় বার্ষিক সম্মিলনীতে কবিকে আবারও ঢাকায় আমন্ত্রণ জানানো হয়। ওই সম্মেলনে তিনি তার উদ্দীপনামূলক সঙ্গীত ও বক্তৃতা দিয়ে আমাদের অনুপ্রাণিত করেন। এ সময় তিনি তার বিখ্যাত মার্চ সঙ্গীতটি গেয়েছিলেন। কবি আবদুল কাদির লেখেন—এ সময় কবি নজরুল সাহিত্য সমাজের সৈয়দ আবুল হোসেনের বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসায় আতিথ্য গ্রহণ করেন এবং ‘চল চল চল ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল...’ শীর্ষক মার্চ সঙ্গীত রচনা করেন। ওইবারই অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন, কবি বুদ্ধদেব বসু, কবি অজিত দত্ত এবং গণিত বিভাগের ছাত্রী ফজিলাতুন্নেসার সঙ্গে নজরুলের পরিচয় ও বন্ধুত্ব হয়। একই বছরের জুন মাসে পুনরায় নজরুল ঢাকায় এলে রানু সোম ও উমা মৈত্রের (লোটন) সঙ্গে তার পরিচয় ও সঙ্গীতের সম্পর্ক স্থাপিত হয়।
কাজী মোতাহার হোসেন লেখেন— সাহিত্য সমাজের দ্বিতীয় সম্মেলনে যোগদানের পর কবি বুড়িগঙ্গাতীরের জমিদার রূপলাল বাবুর বিশাল অট্টালিকা রূপলাল হাউসে যান এবং সেখানে গান গাইলেন—‘বসিয়া নদীকূলে এলোচুলে কে উদাসিনী’। একইভাবে তিনি গাইলেন—‘জাগো অনশন বন্দী ওঠরে যত’। ঢাকায় এসে তিনি বর্ধমান হাউসের (বর্তমান বাংলা একাডেমী) নিচের তলায় আমার সঙ্গে থাকতেন। এ সময় বেশ কয়েকটি নিমন্ত্রণে কবির সঙ্গে আমি ছিলাম। নজরুল ঢাকায় যতদিন বর্ধমান হাউসে ছিলেন তিনি নিয়মিত প্রতিদিন দু’ঘণ্টা করে মনোরম সঙ্গীত চর্চায় নিমগ্ন থাকতেন। এ সময় তিনি বেশ কয়েকটি বাড়িতে গিয়ে গান শেখাতেন। এ প্রসঙ্গে মোতাহার হোসেন লেখেন— একদিন বর্ধমান হাউসে আমাদের অতিথি কবি নজরুলের জন্য আমরা রাত ১১টা পর্যন্ত অপেক্ষা করছি। এর আধ ঘণ্টা পর নজরুল এলেন। তার হাতে একটি লাঠি, গায়ের কুর্তায় রক্তের দাগ এবং শরীরে লাঠির আঘাতের চিহ্ন। তিনি জানালেন, ৭-৮ জনের যুবকের দল ছড়ি ও লাঠি দিয়ে নবাবপুর স্ট্রীটের কাছে বনগ্রাম লেনে তার ওপর আক্রমণ চালালে তিনিও লাঠি কেড়ে নিয়ে পাল্টা আক্রমণ করেন। অবস্থা বেগতিক দেখে যুবকরা পালায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন একমাত্র মুসলিম উচ্চশিক্ষিত নারী গণিতের বেগম ফজিলাতুন্নেসা। ‘কবি নজরুল হাত দেখতে জানেন’—এ কথা মোতাহার হোসেনের কাছ থেকে জানতে পেয়ে তিনি নজরুলের কাছে হাত দেখাতে আগ্রহী হন। মোতাহার হোসেন যথারীতি একদিন কবিকে নিয়ে হাসিনা মঞ্জিলের কাছে দেওয়ান বাজার রাস্তার উল্টোদিকে ফজিলাতুন্নেসার বাসায় যান। প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে নজরুল ফজিলাতুন্নেসার হাতের মস্তিষ্ক রেখা, জীবনরেখা, হৃদয় রেখাসহ শুক্র, শনি, রবি, বুধ মঙ্গল ও চন্দ্রের অবস্থান নিরীক্ষা করলেন। ঘণ্টাখানেক পর মোতাহার হোসেন কবিকে নিয়ে ফিরে এলেন বর্ধমান হাউসে। ঘুমিয়ে পড়লেন। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখেন কবি নজরুল নেই। সকালে নাস্তার সময় ফিরে এলেন। এরপর তিনি ফজিলাতুন্নেসার প্রেমে পড়ার গল্প বললেন। রমনার লেক তিনি ভালবাসতেন এবং প্রায়ই সেখানে যেতেন সাপের ভয় সত্ত্বেও। নজরুল প্রেমে পড়লেও ফজিলাতুন্নেসা এদিকে আগাননি। কুমারী ফজিলাতুন্নেসা বিলাত যাওয়ার সময় তাই নজরুল কবিতা লিখেছিলেন ‘বর্ষা বিদায়’—
‘ওগো বাদলের পরী! যাবে কোন দূরে ঘাটে বাঁধা
তব কেতকী পাতার তরী!’
১৯২৬ সালের জুন মাসে নজরুল ঢাকায় এলে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে মুসলিম সাহিত্য সমাজের চতুর্থ বৈঠকে যোগ দেন। সেবার তিনি ছাত্রদলের গান, কৃষাণের গান ও কাণ্ডারী হুঁশিয়ার ছাত্রদের গেয়ে শোনান। এ সময় নারায়ণগঞ্জের মোহাম্মদ কাশেম পত্রিকা বের করতে চাইলে কবি তাকে আশীর্বাণী লিখে দেন। পত্রিকার নাম ঠিক করে দেন অভিযান। লিখে দেন আশীর্বাণী অভিযান নামের কবিতা—
‘নতুন পথের যাত্রা-পথিক
চালাও অভিযান।’
কবি নজরুল ঢাকা বিভাগের মুসলমান কেন্দ্র থেকে ভারতীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য পদপ্রার্থী হন। এ নির্বাচনের জন্য তিনি মনোনয়নপত্র দাখিল ও অন্যান্য কাজের জন্য ঢাকায় আসেন ১৯২৬ সালের অক্টোবরে। তিনি সেবার উঠেছিলেন আবুল হাসানাত্ ওরফে শাহজাদা মিয়ার বাড়িতে। নির্বাচন পরিচালনার কাজে ৩১ অক্টোবরও তিনি ঢাকায় আসেন পঞ্চমবারের মতো। সেবারও শাহজাদা মিয়ার বাড়িতেই ওঠেন। এক সন্ধ্যায় তিনি যান জয়দেবপুরে। সঙ্গে ছিলেন কবি আবদুল কাদির। জোছনায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর। অভিভূত কবি ট্রেনে বসেই লেখেন অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা ‘চাদনী রাতে’— ‘কোদাল মেঘের মউজ উঠেছে গগনের নীল গাঙে
হাবুডুবু খায় তারা-বুদ্বুদ, জোছনা সোনার রঙে,’
এখানে অবস্থানকালেই সুফি সাধক ইউসুফ আল কাদরী কাশ্মীরী শাহের মাজার সংলগ্ন বাগানে বসেই কবি লেখেন বাংলা গানের বাঁক পরিবর্তনকারী গজল— ‘বাগিচায় বুলবুলি তুই।’
দশমবারের মতো ঢাকায় কবির আগমন ঘটে ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৩৩ সালে। কবির সফরসঙ্গী ছিলেন ধীরেন দাশ, নলিনীকান্ত সরকার এবং আব্বাস উদ্দীন আহমদের মতো বরেণ্য শিল্পী। একাদশ সফরে কবি ঢাকায় পা রাখেন ১৯৩৯ সালের জুলাই মাসে। বনগ্রাম লেনের সুনীল রায়ের বাড়ি ছিল সেবারের আস্তানা। কবি তার দ্বাদশতম ঢাকা সফরে আসেন ১৯৪০ সালের ডিসেম্বর। সুস্থ অবস্থায় এটাই কবির শেষ ঢাকা সফর। ঢাকা বেতারের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ‘পূর্বাণী’ নামে গীতিবহুল অনুষ্ঠান পরিচালনার জন্যই সেবার তার ঢাকায় আসা।
ঢাকা বেতার কেন্দ্র তখন ছিল আজকের শেখ বোরহানউদ্দীন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজে। সেদিনের সেসব স্থাপনা আজ আর নেই। থাকলে জানা যেত কবি কোথায় কোন কক্ষে বসে লিখেছিলেন : ‘আমি পূরব দেশের পুরনারী’।
এই সফরেও কবি সলিমুল্লাহ ও ফজলুল হক হলে ছাত্রদের দেয়া সংবর্ধনায় অংশ নেন।
এদেশের জাতীয় ইতিহাসের অনেক ঘটনার সাক্ষী ঐতিহাসিক আহসান মঞ্জিল। এই আহসান মঞ্জিলে ঢাকার নবাব পরিবারের পক্ষ থেকে একবার কবিকে দেয়া হয়েছিল বর্ণাঢ্য সংবর্ধনা। আর এই আহসান মঞ্জিলের মেয়ে এদেশের প্রথম মহিলা চিত্রশিল্পী মেহের বানুর আঁকা ছবি দেখে কবি লেখেন তার অসাধারণ কবিতা, ‘খেয়া পারের তরণী’:
যাত্রীরা রাত্তিরে হ’তে এল খেয়া পার,
বজ্রেরি তূর্যে এ গর্জেছে কে আবার?
চিরদিনের মতো অর্থাত্ ত্রয়োদশ সফরে কবিকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয় ১৯৭২ সালে। মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারের উদ্যোগে, বাক ও লেখনী শক্তিহারা কবিকে তার ৭৩তম জন্মদিনের আগের দিন ২৪ মে, বুধবার সকাল ১১টা ৪০ মিনিটে একটি ফকার ফ্রেন্ডশিপ বিমানে নিয়ে আসা হয় তেজগাঁ বিমানবন্দরে। বিমানবন্দর থেকে একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে কবিকে ধানমন্ডি আবাসিক এলাকায় ২৮ নম্বর সড়কে, ৩৩০ বি’র খোলামেলা সবুজ লনে ঘেরা একটি দোতলা বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। পরদিন জন্মদিনে কবিকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য হাজার হাজার মানুষ আসেন সে বাড়িতে। আসেন তত্কালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান। এ বাড়িতে কবির ৩ বছর ১ মাস ২৮ দিন কাটে। পরবর্তীকালে এ কবি ভবনেই প্রতিষ্ঠিত হয় জাতীয় প্রতিষ্ঠান ‘নজরুল ইন্সটিটিউট’। ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কবিকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে।
১৯৭৫ সালের ২২ জুলাই কবিকে চিকিত্সার জন্য ভর্তি করা হয় পিজি হাসপাতালের ১১৭ নম্বর কেবিনে।
১৯৭৬ সালের জানুয়ারি মাসে কবিকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দিয়ে সম্মান জানান শহীদ জিয়াউর রহমানের সরকার। ওই বছরই কবিকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। ২৫ মে কবিকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ‘আর্মি ক্রেস্ট’ উপহার দেয়া হয়।
পিজি হাসপাতালের ১১৭ নম্বর কেবিনেই কাটে কবি জীবনের শেষ দিনগুলো—এক বছর এক মাস এক সপ্তাহ। এখানেই ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট রোববার সকাল ১০টা ১০ মিনিটে পুরো জাতিকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন আমাদের জাতীয় কবি।
সর্বসাধারণের শেষ শ্রদ্ধা জানানোর জন্য কবির কফিনবদ্ধ লাশ রাখা হয়েছিল টিএসসির সামনে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত হয় কবির নামাজে জানাজা। লাখ লাখ শোকার্ত মানুষের সঙ্গে সেদিন জানাজায় অংশ নিয়েছিলেন তত্কালীন প্রেসিডেন্ট সায়েম ও শহীদ জিয়াউর রহমান।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে কবর পর্যন্ত কফিন বহন করে নিয়ে যান শহীদ জিয়াউর রহমান, সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর প্রধানরা। একুশ বার তোপধ্বনির মধ্য দিয়ে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় কবিকে যখন দাফন করা হয়, ঘড়িতে তখন বিকাল ৫টা। বিউগলে বাজছে করুণ কান্না।
নজরুলকে উপেক্ষা করা যায় না : কাজী নজরুল ইসলামকে আমরা জাতীয় কবি উপাধি দিয়েছি। কিন্তু তাকে যেভাবে মূল্যায়ন করা উচিত ছিল, সে মূল্যায়ন করিনি। যাকে অবলম্বন করলে আমাদের সাহিত্য সমৃদ্ধ হতো, আমাদের স্বাধীনতা অর্থবহ হতো, সে কাজটুকু আমরা করিনি। নজরুল ধীরে ধীরে উপেক্ষিতই হচ্ছেন। আমাদের দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নজরুলের ওপর ১০০ নম্বরের পূর্ণ সিলেবাস আজ অবধি করা যায়নি। নজরুল ছোট-বড় ৮০টির মতো নাটক লিখেছেন। কিন্তু এই মৌলিক নাটকগুলো শিল্পকলা একাডেমীসহ মহিলা সমিতিতে কখনো অভিনীত হয় না। অপেরা নাটকে নজরুল পথিকৃত্। কিন্তু এদেশের মানুষকে তা জানতে দেয়া হয় না। রেডিও-টিভি চ্যানেলে নজরুলের গানের কদর কমিয়ে দেয়া হয়েছে। প্রথম চলচ্চিত্রকার নজরুল, অথচ চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তাকে স্থান দেয়া হয়নি। নজরুল ইনস্টিটিউটকে শান্তিনিকেতনের মতো প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা উচিত ছিল কিন্তু সেটি একটি গরিব প্রতিষ্ঠান।
কলকাতার এঁদো গলি থেকে কবিকে উদ্ধার করে ঢাকায় এনেছিলেন জাতীয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। কবিকে নাগরিকত্ব দিয়ে, একুশে পদক দিয়ে সম্মানিত করেছিলেন শহীদ জিয়াউর রহমান। তিনি কবির স্বপ্নের মতো, কবিকে নিজ কাঁধে করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে পরম মমতায় শুইয়ে দিয়েছিলেন। খালেদা জিয়া, শেখ হাসিনা ও এরশাদ সরকারের আমলেও উন্নয়নমূলক কিছু কাজ হয়। কিন্তু সেই কাজে এখন ভাটা। জার্মানরা পৃথিবীময় গ্যেটেকে তুলে ধরেছে, ইংরেজরা শেক্সপিয়রকে তুলে ধরেছে, ইরান তুলে ধরেছে হাফিজ ও ফেরদৌসিকে; কিন্তু আমরা সেভাবে নজরুলকে তুলে ধরতে পারিনি। সেটা আমাদের ব্যর্থতা।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
abdal62@gmail.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন