বৃহস্পতিবার, ২৪ মে, ২০১২

পথে আনছেন শেখ হাসিনা


ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী :
 প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি তার এক ভাষণে জানিয়েছেন যে, বিরোধীদলকে কিভাবে সঠিক পথে আনতে হয় সেটি তার জানা আছে। কয়েকদিন আগে আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মাহমুদুর রহমান মান্না পত্রিকায় লিখে প্রধানমন্ত্রীর কাছে জানতে চেয়েছেন যে, তার সেই পথটি কি, তিনি যেন আমাদের জানান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সে পথের খবর জানাননি। কিন্তু তার ক্রিয়াকর্মে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, সে পথটি কি হতে পারে। দেশবাসী তার নমুনা দেখতে পাচ্ছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে, বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলী গুমের ইস্যুতে বিরোধীদল যখন রাজপথে সোচ্চার তখনই বোঝা গেল প্রধানমন্ত্রীর মনোবাঞ্ছার সেই পথটা কি।
দেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৯৫ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত রাজপথে ধ্বংসাত্মক আন্দোলন করেছিল জামায়াতে ইসলামীকে সাথে নিয়ে। তখন শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল বিএনপি। জামায়াতে ইসলামীর প্রস্তাবিত এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণাটি তখন একেবারেই নতুন ছিল। দেশের রাজনীতিকজ্ঞ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, বুদ্ধিজীবী মহলে খানিকটা চোখ ঠারাঠারি হয়েছিল- এ আবার কেমন ব্যবস্থা। হুট করে কিছু অনির্বাচিত লোক এসে নির্বাচন করে দিয়ে চলে যাবে, এটা কেমন করে হয়?
কেমন করে যে হয় তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল ১৯৯১ সালে দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করার জন্য সকল রাজনৈতিক দল মিলে বিচারপতি শাহাবুদ্দীন আহমদকে ক্ষমতায় আসীন করেছিল দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করে দেওয়া জন্য। বিচারপতি শাহাবুদ্দীন অল্প সময়ের জন্য সে সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও সর্বজনগৃহীত নির্বাচন সম্পন্ন করে দিয়ে ফের দেশের প্রধান বিচারপতি পদে ফিরে যান।
ঐ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হলেও জাতীয় সংসদে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আসন লাভ করে। তাতে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। আর কোনো কথা না পেয়ে তিনি কিছু না কিছু বলতে হয় হিসেবে বলেছিলেন যে, ফলাফল মেনে নিয়েছেন। তবে নির্বাচনে সূক্ষ্ম কারচুবির মাধ্যমে তার দলকে হারিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু দেশে বিদেশে কোনো মহলের কাছেই তার এই সূক্ষ্ম কারচুপি তত্ত্ব কোনো ফল দেয়নি। কেউ তার এই তত্ত্ব গ্রহণ করেনি।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ জামায়াত জোটের যৌথ আন্দোলনের মুখে শেষ পর্যন্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকার সংবিধান সংশোধন করে দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন করে। তারপর ভালোই চলে আসছিল। ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সে নির্বাচন সারা পৃথিবীতে প্রশংসিত হয়েছিল। শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছিল। আবার ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে বিএনপি সরকার গঠন করে।
সাংবিধানিকভাবে ২০০৬ সালে নির্বাচন প্রাক্কালে আওয়ামী লীগ সম্ভবত অাঁচ করতে থাকে যে, সাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হলে নির্বাচনে তাদের জয়লাভের সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ। আর সে কারণেই পূর্বের ধারা অনুযায়ী ও সংবিধান মেনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের ক্ষেত্রে তারা নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির পাঁয়তারা শুরু করে। পূর্ববর্তী যে তিনটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তার প্রতিটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানই ছিলেন দেশের সর্বশেষ অবসর গ্রহণকারী প্রধান বিচারপতিগণ। কিন্তু ২০০৭ সালে নির্বাচনের প্রাক্কালে আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা সংবিধান মোতাবেক সদ্য অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে গঠিতব্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার মেনে নিতে বা তাদের অধীনে নির্বাচন করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বসলেন। ফলে সারা দেশে এক চরম অরাজকতার সৃষ্টি হয়।
আওয়ামী লীগ কর্তৃক কোনো বিচারপতির নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার না মানায় উপায়ন্তর না দেখে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ সংবিধানের সর্বশেষ অপশন অনুযায়ী নিজেই তত্ত্বাবধায়ক প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণে বাধ্য হন। তিনি এই দায়িত্ব নেয়ার পর শেখ হাসিনা শুরুতে তাকে প্রত্যাখ্যান করেননি। বরং বলেছিলেন যে, দেখা যাক উনি কতটা নিরপেক্ষভাবে কাজ করেন।
কিন্তু দিন না যেতেই ভোল পাল্টে গেলো আওয়ামী লীগের। বিএনপির ২০০১ সালের শাসন আমলে সকলক্ষেত্রে বাংলাদেশের উন্নয়ন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, বিশ্বখ্যাত অর্থনীতি গবেষক প্রতিষ্ঠান বলতে বাধ্য হলো যে, বাংলাদেশে বর্তমান ধারা চলতে থাকলে আগামী কয়েকবছরের মধ্যেই বাংলাদেশ পৃথিবীর ১২টি নতুন অর্থনৈতিক পরাশক্তির (নিউ ইকোনমিক জায়ান্ট) একটিতে পরিণত হবে। এ খবরে এদেশের অনেক রাজনীতি বিশ্লেষকই ভ্রু কুঁচকেছিলেন। আমি নিজেও শঙ্কাবোধ করে পত্রিকায় নিবন্ধ লিখেছি। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বোধ করি ষড়যন্ত্রের কাল শুরু হলো। সরকার ও জনগণকে সর্তক থাকতে হবে যাতে কেউ আমাদের এই উত্থান যাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করতে না পারে।
কিন্তু বিএনপি আমলের শেষ দিকে ২০০৬ সাল থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠলো যে, ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ভারত ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে শুরু করে খোদ জাতিসংঘ পর্যন্ত এই ষড়যন্ত্রে অংশীদার হয়ে পড়লো। ষড়যন্ত্র অপ্রকাশিতও থাকলো না। ষড়যন্ত্রকারীরা এর জন্য কোনো রাখঢাক করেনি। মার্কিন রাষ্ট্রদূত, ভারতীয় হাইকমিশনার ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত, ইউএনডিপি প্রতিনিধি, জাতিসংঘের প্রতিনিধি সবাই একযোগে প্রকাশ্যে বাংলাদেশে যাতে সাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন না হতে পারে সে ষড়যন্ত্র করতে শুরু করলো। তাতে যোগ দিলো আওয়ামী লীগ। ভারতীয় হাইকমিশনার যেন শেখ হাসিনার বাসভবনকে তার দ্বিতীয় কার্যালয়ই করে ফেললেন। তাদের সেকি দৌড়ঝাঁপ! ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিন-তারিখ ঠিক হয়ে গেলো। আওয়ামী লীগ তার মনোনয়ন পত্রও চূড়ান্ত করলো। কিন্তু এর মধ্যেই একটি মামলায় আদালতের রায়ে দোষী সাব্যস্ত হলেন সাবেক স্বৈরশাসক ও আওয়ামী লীগের অতি আদরের ধারাবাহিক মিত্র হু. মু. এরশাদ। এই অজুহাতকে সামনে নিয়ে আওয়ামী লীগ ২২ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিলো। এবং দেশে এক ধ্বংসাত্মক সন্ত্রাসের রাজনীতির সূচনা করলো।
তারই পরিণতিতে সে নির্বাচন বাতিল হয়ে গেল। সেনাবাহিনী প্রধান লে. জে. মইন উদ্দিন আহমদ অস্ত্রের জোরে ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধানের পদ থেকে সরিয়ে সম্পূর্ণরূপে সংবিধান লঙ্ঘন করে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ফখরুদ্দীন আহমদকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান পদে বসালো। তার আগে ২৮ সেপ্টেম্বর (২০০৬) বিএনপি মেয়াদ শেষ করার দিনই আওয়ামী লীগ লগি-বৈঠার আন্দোলন করে প্রকাশ্য রাজপথে ডজন খানেক নিরপরাধ মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করলো। তারপর শুরু হলো রাজপথ, রেলপথ, নৌপথ অবরোধ। পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য রাষ্ট্রপতি সেনা মোতায়েন শুরু করেছিলেন। কিন্তু তাতে রা রা হায় হায় করে উঠল দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীরা। আওয়ামী সন্ত্রাসী ও গুন্ডাদের হাতে সারা দেশে শত শত মানুষ খুন হলো। অ্যাম্বুলেন্স চলাচলেও বাধা দেয়ায় বহু মানুষ বিনা চিকিৎসায় অ্যাম্বুলেন্সেই মারা গেল। রেলপথ তুলে দেয়া হলো। সড়ক পথে অবরোধ। নৌ চলাচল বন্ধ।
এখন শেখ হাসিনা কথায় কথায় আদালতের দোহাই দিচ্ছেন। কিন্তু আদালতের রায়ে এরশাদ নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষিত হয়েছিলেন। সেদিন তো তিনি আদালত মানেননি। এখন তার সাজানো আদালত তার কথা মতোই সবকিছু করে যাচ্ছে বলে মনে হয়। ফলে এখন আদালত বড় প্রিয় হয়ে উঠেছে। ইতোমধ্যে আদালত অযাচিতভাবে অনেক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। তাতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। শেখ হাসিনা সেসব সিদ্ধান্ত ব্যবহার করে কিংবা সেসব সিদ্ধান্তের অপব্যবহার করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার চেষ্টা করছেন। বাতিল করে দিয়েছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা। যদিও আদালতের রায়ে বলা হয়েছিল পরবর্তী দু'টি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে। রায়ের শেষ অংশ মেনে নেননি শেখ হাসিনা। তিনি এখনই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দিয়েছে।
বিএনপি'র সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলী গুম হয়েছেন গত ১৬ই এপ্রিল। প্রথমদিকে সরকারের তরফ থেকেই বলা হয়েছিল যে, তারা সর্বশক্তি দিয়ে ইলিয়াস আলীকে উদ্ধারের চেষ্টা করবেন। কিন্তু দিন যত যেতে থাকলো, সুর ততই পরিবর্তন হতে থাকলো। একটি পরিবারে স্বামী, পুত্র কিংবা পিতা যদি গুম হয়ে যায়, তাহলে সেই পরিবারে যে শোকের ছায়া নেমে আসে, যে কোনো মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষ সেটা উপলব্ধি করতে পারেন। কিন্তু এই সরকারের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে মন্ত্রিসভার সদস্য ও নেতারা ইলিয়াস আলীর গুম নিয়ে যেসব কথা বলছেন, তাকে পাশবিক বললেও হয়তো দোষের কিছু হয় না।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও ইলিয়াস আলী গুমের বিরুদ্ধে স্বাভাবিকভাবই বিরোধী দল রাজনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ করবে। হরতাল আহবান সে কর্মসূচিরই অংশ। এই হরতালকে কেন্দ্র করে সরকার বিএনপি'র ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ ৪৫ জনের বিরুদ্ধে বোমাবাজি ও গাড়ি পোড়ানোর মামলা দায়ের করে। এবং এদের সকলকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠায়। আর কী আশ্চর্য, পুলিশ মাত্র ২২ দিনের মধ্যেই এদের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণ হাজির করে চার্জশীট দাখিল করেছে। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনীর নিজগৃহে হত্যাকান্ডের সাড়ে তিন মাসেও যে পুলিশ কিনারা করতে পারেনি, ইলিয়াস আলী গুমের পাঁচ সপ্তাহ পরেও যে পুলিশ সামান্যতম ক্লুও বের করতে পারেনি, তারা একেবারে ২২ দিনে বের করে ফেলেছে যে, মির্জা ফখরুল প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের সামনে গাড়িতে বোমা মেরেছেন। এবং তিনি ও তার সহযোগীরা আগুন দিয়ে গাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছেন।
এর সবই সরকারের বিরোধী দল দমন বা নির্মূলের ফ্যাসিবাদী কৌশল। আওয়ামী চামচা কলামিস্ট আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী পর্যন্ত সরকারের এ আচরণে শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। তিনি লিখেছেন, একটি সরকার যখন রাজনৈতিক ও গণভিত্তি হারিয়ে ফেলে তখনই এ ধরনের পেশী শক্তি ব্যবহার শুরু করে। আওয়ামী লীগের জনভিত্তি সমর্থন এখন শূন্যের কোঠায় পৌঁছেছে। এরকম ফ্যাসিবাদীর পতন এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন