বৃহস্পতিবার, ৩১ মে, ২০১২

বাংলাদেশে সংবাদ মাধ্যমের ওপর সরকারি হামলা


ব দ রু দ্দী ন উ ম র
আজ থেকে ঠিক দু’বছর আগে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন তথাকথিত মহাজোট সরকারের পুলিশ দৈনিক আমার দেশ পত্রিকা অফিসে হামলা চালিয়ে পত্রিকাটির সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করেছিল এবং পত্রিকার প্রেসে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছিল। আওয়ামী লীগ স্বাধীন বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে দেখিয়ে দিয়েছে জনগণের ওপর নির্যাতন, অপহরণ, গুম খুন, সংবাদপত্রের ওপর হামলায় তারা কতখানি পারদর্শী। কাজেই এসব ক্ষেত্রে তাদের অভিজ্ঞতা এবং কৌশলগত দক্ষতা অন্য যে কোনো দলের থেকেই বেশি। যদিও শাসক শ্রেণীর অন্য দলও ক্ষমতায় থাকার সময় একই ধরনের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে চেষ্টার ত্রুটি রাখে না।
১৯৭৪ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিব বাংলাদেশে জরুরি অবস্থা জারি করে জনগণের ওপর নির্যাতনের যে স্টিমরোলার চালিয়েছিলেন, সেটা তার শাসনকে কলঙ্কিত করেছিল এবং সেটাই তার উত্খাতের প্রধান কারণ ছিল। শেখ মুজিব সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ যেভাবে করেছিলেন তার তুলনা একমাত্র প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ১৯৭১ সালের নয় মাসের শাসন ছাড়া পাকিস্তান আমলে এবং আজ পর্যন্ত যত সরকার এসেছে তার কোনোটির আমলেই পাওয়া যাবে না। স্বাধীনতার লড়াইয়ের পর জনগণকে এভাবে যে ‘স্বাধীনতা’ শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ দান করেছিল, ঐতিহাসিক রেকর্ড থেকে সেটা মুছে ফেলা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। দুষ্ট প্রকৃতির মতলববাজ লোক ছাড়া এ চিন্তা করাও কারও পক্ষে সম্ভব নয়।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ইয়াহিয়ার সামরিক বাহিনী আমাদের জনগণের ওপর ব্যাপক ও নিষ্ঠুর আক্রমণ পরিচালনা শুরু করার সময় শেখ মুজিব নিজে বাড়িতে বসে থেকে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়ার কোনো ক্ষমতা তখন তার ছিল না। রাজনৈতিক দল হিসেবে সেই আক্রমণ প্রতিরোধের কোনো লাইনই আওয়ামী লীগের ছিল না। তারা শেখ মুজিবকে ধরে নিয়ে পাকিস্তানে চালান দিয়েছিল। দেশের লাখ লাখ মানুষ জীবন দান থেকে নিয়ে হাজার রকম নির্যাতনের শিকার হতে থাকার সময় তার নিরাপদ জীবনের দায়িত্ব নিয়েছিল পাকিস্তান সরকার। শুধু তাই নয়, ঢাকায় তার স্ত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রীসহ পুত্র-কন্যাদের ভরণপোষণ ও নিরাপত্তার দায়িত্বও নিয়েছিল ইয়াহিয়ার সামরিক সরকার। অন্যদিকে ২৫ মার্চের পর স্বাধীনতার আওয়াজ তুলে আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতানেত্রীরা দেশের জনগণকে পাকিস্তানিদের বর্বরোচিত আক্রমণের মুখে ফেলে দেশ ছেড়ে প্রাণভয়ে যথাসাধ্য দ্রুততার সঙ্গে ভারতে পলায়ন করেছিলেন। ওই কাপুরুষতা ও দেশের জনগণের প্রতি কলঙ্কজনক আচরণের জন্য তাদের যে ব্যাখ্যা থাকা দরকার ছিল, সে ব্যাখ্যা তারা আজ পর্যন্ত কোনোদিন দেয়নি। দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে লড়াই না করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব নিজেরা ভারতে নিরাপদ অবস্থানে থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন করার দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন ভারতীয় সরকারের কাছে! ভারত সরকার দক্ষতার সঙ্গে সে দায়িত্ব পালন করেছিল!! এই যাদের অবস্থা ছিল, তারা ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে দেশ স্বাধীন করতে চেয়েছিল, তার পরিকল্পনা করেছিল ও তার জন্য ডাক দিয়েছিল—এর থেকে হাস্যকর কথা আর কী হতে পারে? কিন্তু যা হাস্যকর তারই পতাকা আজ বাংলাদেশে উড়ছে। অন্যদিকে দেশের হাজার হাজার তরুণ ও যুবক দেশ স্বাধীন করার জন্য এগিয়ে এসেছিল। তারা আওয়ামী লীগের বা তার কোনো অঙ্গ সংগঠনের সদস্য ছিল না। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়েই তারা বাংলাদেশের ভেতরে এবং ভারত থেকে বাংলাদেশের মধ্যে এসে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়াই করেছিল। অগণিত সংখ্যক এই যোদ্ধা অকাতরে নিজেদের জীবন দিয়েছিলেন। কিন্তু যারা এভাবে জীবন দিয়েছিলেন তারা কোনো স্বীকৃতি পাননি, তাদের পরিবার এবং যারা এই যুদ্ধে নানাভাবে শরিক ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন তারা ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বরের পর কিছুই পাননি। যারা কলকাতায় বসে ছিল এবং যারা দেরাদুনে ভারতীয় জেনারেল ওভান্দের তদারকিতে ভারতীয় এজেন্ট হিসেবে ট্রেনিং লাভ করেছিল তারাই দেশে ফিরে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিজেদের ঢেঁড়ি পিটিয়ে মাখন-রুটির ব্যবস্থা করেছিল। লুটপাট করে দেশকে ছারখার করেছিল। শেখ মুজিব পাকিস্তানিদের হেফাজত থেকে ঢাকায় এসে স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়েছিলেন। কিন্তু এমনভাবে তারা স্বাধীন বাংলাদেশে নিজেদের শাসন পরিচালনা করেছিলেন যাতে মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় প্রায় সমস্ত পরিবারসহ শেখ মুজিব নিজে নিষ্ঠুরভাবে নিহত হয়েছিলেন এবং আওয়ামী লীগ সরকারই শুধু নয়, সংগঠনও এমনভাবে বিলুপ্ত হয়েছিল যাতে মুজিব হত্যা ও নিজেদের সরকার উত্খাতের বিরুদ্ধে সামান্যতম কোনো প্রতিবাদ ও প্রতিরোধই তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। চরম প্রতিক্রিয়াশীল একটি সামরিক চক্র মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র সহযোগিতায় শেখ মুজিব এবং আওয়ামী লীগকে এভাবে হত্যা ও নিশ্চিহ্ন করলেও এর মূল দায়িত্ব সেই সামরিক চক্রের ঘাড়ে চড়িয়ে দেয়া একেবারেই সঠিক হচ্ছে না। সেটা কোনো যোগ্য ঐতিহাসিকেরই কাজ নয়। এজন্য আওয়ামী লীগকে নিজের দায় অবশ্যই স্বীকার করতে হবে।
কিন্তু সে দায় স্বীকার করার মতো নৈতিক ও রাজনৈতিক সততা তাদের না থাকায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসকে তারা ১৯৭২ সাল থেকেই বিকৃত করতে থাকে। ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে তাদের এই ভূমিকার জন্য বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃতকরণের যত রকম চেষ্টা হয়েছে, তার পথিকৃতের গৌরব আওয়ামী লীগেরই প্রাপ্য।
বাংলাদেশে আজ সমগ্র জনগণ ও সেই সঙ্গে সংবাদপত্র ও বৈদ্যুতিক সংবাদ মাধ্যমের ওপর যেভাবে সরকারি আক্রমণ চলছে, একে এর ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে উপস্থিত করার উদ্দেশ্যে ওপরের এত সব কথা বলার প্রয়োজন হলো। শুধু আওয়ামী লীগই এসব করছে, তার জন্যই এর প্রয়োজন নয়। আওয়ামী লীগ ছাড়া ১৯৭৫ সালের পর প্রত্যেকটি সরকারই পরিস্থিতি অনুযায়ী একই কাজ করেছে। এ বিষয়টি ভুলে গিয়ে শুধু আওয়ামী লীগের সমালোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলে তার কোনো গণতান্ত্রিক তাত্পর্য থাকবে না। কিন্তু এ সত্ত্বেও যা বলা দরকার তা হলো, ১৯৭২-৭৫ সালের আওয়ামী বাকশালী শাসন আমলে জনগণের ওপর নির্যাতনের যে ঐতিহ্য শুরু হয়েছিল, সেই ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা রক্ষা করেই অন্যান্য সরকার অভিন্ন শাসক শ্রেণীর পক্ষে একইভাবে একই কাজ করেছে। কাজেই সংবাদপত্র এবং বৈদ্যুতিক সংবাদ মাধ্যমের ওপর আক্রমণ শুধু আওয়ামী লীগেরই কাজ নয়। বিএনপি, জাতীয় পার্টি কেউই এদিক দিয়ে নিজেদের সরকারের আমলে হাত গুটিয়ে বসে ছিল না।
দুই বছর আগে দৈনিক আমার দেশ-এর ওপর বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আক্রমণ প্রসঙ্গে ফিরে এসে বলা দরকার যে, এই পত্রিকাটি সরকারবিরোধী রিপোর্ট ও নানা তথ্য প্রকাশ করার জন্য যেভাবে পুলিশ তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, এখন সে আক্রমণ আরও ব্যাপক আকারে দেশজুড়ে চলছে। এমনকি যে রিপোর্ট ও তথ্য প্রকাশিত হয়নি কিন্তু প্রকাশের মুখে ছিল, তা বন্ধ করার জন্য সাংবাদিক হত্যাও এখন শুরু হয়েছে! সেই হত্যাকাণ্ডের কোনো প্রকৃত তদন্ত যে আজ পর্যন্ত হচ্ছে না, এর কারণ বোঝার অসুবিধা কোনো সত্ লোকের আছে?
বাংলাদেশে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণ এখন প্রায় প্রতিদিন এমনভাবে হচ্ছে যাতে একে এক নিয়মিত ব্যাপার হিসেবে গণ্য করা চলে। মারপিট, অপহরণ, গুম-খুন সবকিছুই যেমন সাধারণ রাজনৈতিক বিরোধীদের ক্ষেত্রে হচ্ছে, তেমনি তা হচ্ছে সাংবাদিকদের ক্ষেত্রেও। অবস্থা এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে, এই আক্রমণ শুধু সরকারবিরোধী সাংবাদিকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। নানা ধরনের বিক্ষোভ সমাবেশের সংবাদ সংগ্রহের জন্য সরকার সমর্থক পত্রিকার সাংবাদিকরাও পুলিশের আক্রমণের শিকার হচ্ছেন।
দৈনিক আমার দেশ সরকারের আক্রমণের বিশেষ লক্ষ্যস্থল এ কারণে যে, এই পত্রিকাটি যথেষ্ট তথ্য সহকারে সরকারের নানা দুষ্কৃতির সংবাদ জনগণকে সরবরাহ করে থাকে। এই পত্রিকাটির বিক্রি এবং প্রচারও যথেষ্ট। কাজেই এর বিরুদ্ধে শুধু পুলিশি আক্রমণ নয়, পরোক্ষভাবে বিজ্ঞাপন বন্ধ করে একে আর্থিকভাবে পঙ্গু করার ব্যবস্থাও সরকার করেছে। এই পরিস্থিতিতে শুধু সরকারি বিজ্ঞাপনই নয়, বেসরকারি বিজ্ঞাপন থেকেও এরা বঞ্চিত হচ্ছেন। কারণ সরকারের এই বিজ্ঞাপননীতি লঙ্ঘন করে বিজ্ঞাপন দিলে বিজ্ঞাপনদাতারা সরকারি রোষ এবং হয়রানির শিকার হওয়ার ভয় করেন। ভয় করারই কথা। সবশেষে এখানে বলা দরকার যে শুধু আমার দেশ পত্রিকাটিই নয়, দেশজুড়ে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এখন যে সরকারি আক্রমণ প্রায় প্রতিদিন নিয়মিতভাবে চলছে, তার বিরুদ্ধে জোরদার সংগ্রাম সাংবাদিকরা করছেন না। তারা যেভাবে সংগ্রাম করছেন সেটা দাঁড়াচ্ছে সংগ্রাম সংগ্রাম খেলার মতো। এজন্য তারা মানববন্ধন, অনশন, ঘরোয়া সভা, দলবাজি ইত্যাদি করলেও এখনও পর্যন্ত তাদের ঢাকা এবং অন্যত্র কোনো বড় সমাবেশ ও মিছিল করতে দেখা যায়নি। মিছিল ছাড়া কোনো আন্দোলন শক্তিশালী হওয়ার নয়। মিছিল হলো রাস্তার লড়াইয়ের এক অপরিহার্য অনুষঙ্গ। অন্যদের কর্মসূচির তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে তারা মার খাচ্ছেন। কিন্তু নিজেদের কর্মসূচি নিয়ে রাস্তায় নেমে যখন তারা পুলিশের মার খাবেন, তখনই বোঝা যাবে যে সংবাদপত্র কর্মীরা নিজেদের বিরুদ্ধে আক্রমণ প্রতিরোধ ও নিজেদের পেশাগত স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রাম সঠিক পথে ও যথাযথভাবে শুরু করেছেন।
৩০-০৫-২০১২

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন