শনিবার, ২৬ মে, ২০১২

আওয়ামী লীগের আকাশে কালো মেঘ




ব দ রু দ্দী ন উ ম র
২২৯ জন সংসদ সদস্য নিয়ে আওয়ামী লীগ এখন শনির দশাপ্রাপ্ত হয়েছে। কোন দিকেই এখন তার আশা-ভরসার ক‚লকিনারা নেই। ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ ইত্যাদির মতো তাদের তথাকথিত মহাজোটের শরিকদের পা-চাটা কথাবার্তা যে তাদের কোন কাজেই আসছে না ও আসবে না, এটা কাউকে বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন নেই। বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে প্রকৃতপক্ষে উৎখাত হয়ে যাওয়া এই দলগুলোর একমাত্র ভরসা এখন আওয়ামী লীগ, যার নিজেরই এখন শুর“ হয়েছে অš—র্জলি যাত্রা। যার নিদান হাঁকা শুর“ হয়েছে দেশে-বিদেশে সর্বত্র, এমনকি তার প্রধান শরিক সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের দ্বারা।
ভারতই এখন বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের সব থেকে ঘনিষ্ঠ সাম্রাজ্যবাদী পৃষ্ঠপোষক এবং পেয়ারের রাষ্ট্র। কিন্তু যে দেশের প্রভাবশালী অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় অল্প সময়ের জন্য ঢাকা সফরে এসে বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে শুধু তাকে দিলি­তে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে যাননি, তিনি বলেছেন, অনেকের ধারণা, ভারত বাংলাদেশে একটি বিশেষ দলের প্রতি বেশি পক্ষপাতিত্ব করে। কিন্তু সেটা ঠিক নয়। ভারত বাংলাদেশ ও তার জনগণের বন্ধু এবং বাংলাদেশের জনগণ যাকেই নির্বাচিত করবে তার সঙ্গেই ভারতের সুসম্পর্ক থাকবে। কোন বিশেষ দলের প্রতি ভারতের কোন পক্ষপাতিত্ব নেই!
এ কথা বলা যত সহজ, বলে পার পাওয়া তত সহজ নয়। কারণ ভারত যে আওয়ামী লীগের মুর“ব্বি এবং তাদের প্রতিই যে তাদের পক্ষপাতিত্ব এটা কোন গোপন ব্যাপার নয়। কিন্তু তা সত্তে¡ও কেন এখন ভারতের অর্থমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে এসে নিজেদের পক্ষপাতহীনতার কথা বললেন, সেটাই ভেবে দেখার বিষয়! বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাতাসে তারা নিশ্চয়ই পরিবর্তনের এমন গন্ধ পেয়েছেন, যা তাকে এ কথা বলতে প্ররোচিত করেছে। এটা শুধু প্রণব মুখার্জির ব্যক্তিগত মত মনে করার কারণ নেই। ভারত সরকারের মুখপাত্র হিসেবেই তিনি এ কথা বলেছেন। আওয়ামী লীগ এবং তাদের মহাজোটের পা-চাটাদের জন্য এটা যে সুখের বার্তাবহ নয়, তা বলাই বাহুল্য।
কিন্তু বিপদ শুধু এখানেই নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন একই সময়ে ঢাকা সফরে এসে যা বলেছেন এবং তাদের পররাষ্ট্র দফতর থেকে বাংলাদেশের ওপর যে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে, তাতে এখানকার দুর্নীতিবাজ ও সন্ত্রাসী সরকার কর্তৃক যে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তার কঠোর সমালোচনা আছে। হিলারি ঢাকা এসে তাদের পরম প্রিয়পাত্র ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশের জনগণের কাছে তার লুপ্তপ্রায় ভাবমূর্তি চাঙ্গা করার চেষ্টা করেছেন। ইউনূসকে নিয়ে তাদের বড়ই দুঃখ। বেচারাকে তারা বাংলাদেশে গুর“ত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ভ‚মিকা পালন করার জন্য তৈরি করেছিলেন। কিন্তু ইউনূস নিজেই ২০০৭ সালে নিজের যোগ্যতার তুলনায় বেশি উৎসাহিত হয়ে তড়িঘড়ি করে দল গঠন করে ক্ষমতার সিংহাসনে আরোহণের জন্য যে তৎপরতা দেখিয়েছিলেন সেটা মাঠে মারা যাওয়ায় তারা ইউনূসকে নিয়ে বেশ বিপাকেই পড়েন। এখন আওয়ামী লীগের বিপর্য¯— অবস্থায় তারা আবার ইউনূসের ভাবমূর্তি চাঙ্গা করার জন্য ব্য¯— হয়েছেন। আওয়ামী লীগ নিজেদের নোংরা ¯^ার্থে ইউনূসের বির“দ্ধে যাই করার চেষ্টা কর“ক, তার বিশেষ কোন গুর“ত্ব নেই। কারণ দেশের গরিবদের কাছে, গ্রামাঞ্চলের ব্যাপক জনগণের কাছে, বাংলাদেশের সচেতন মধ্যবিত্তের কাছে ইউনূসের উজ্জ্বল ভাবমূর্তি বলে কিছু নেই। কাজেই যা নেই, সেটা দিয়ে কোন রাজনৈতিক দাবা খেলার কোন সুফল সাম্রাজ্যবাদীদের ক্ষেত্রে হওয়ার কথা নয়।
ইউনূসের প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে এখানে যা বলা দরকার তা হল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামাজিক প্রয়োজনে হাসিল এখন আর ব্যবহারযোগ্য নেই। কেউ ব্যবহারযোগ্য না হলে সাম্রাজ্যবাদীরা বিশেষত আমেরিকানরা যে তাকে ছুড়ে ফেলে দিতে এতটুকুও দ্বিধাবোধ ও বিলম্ব করে না, এটা সাধারণ ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার ব্যাপার। কাজেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন হাসিনাকে কোনভাবে সংশোধন করতে ব্যর্থ হয়ে ও তার সরকার দুর্নীতি, সন্ত্রাস ইত্যাদির মাধ্যমে যে অরাজকতা তৈরি করেছে, সে পরিস্থিতিতে এই সরকারকে আগের মতো সমর্থন দিতে আর প্রস্তুত নয়।
গুম, খুন ইত্যাদি থেকে বিরত থাকা, মিটিং-মিছিলের ওপর হামলা বন্ধ করা এবং পুলিশ, র‌্যাব, বর্ডার গার্ড ইত্যাদি সশস্ত্র বাহিনীকে বিরোধী রাজনৈতিক দমনে, বিশেষত বিএনপির ওপর হামলা চালানো বন্ধ করার কোন সম্ভাবনা না দেখে, সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির দ্র“ত ও ভয়াবহ অবনতি দেখেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন বাংলাদেশে তার সাম্রাজ্যবাদী লাইন নতুনভাবে গোছানোর জন্য তৈরি হয়েছে। ঢাকায় নতুন মার্কিন রাষ্ট্রদূত যেভাবে এখন কথা বলছেন, এভাবে তাদের জন্য কোন রাষ্ট্রদূতকে প্রকাশ্যে কোন বিদ্যমান সরকারের এত সমালোচনা করতে আগে দেখা যায়নি। এই পরিস্থিতিতে হিলারি ক্লিনটন ঢাকা সফর করে ফিরে যাওয়ার পর মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর বাংলাদেশের পরিস্থিতির ওপর তাদের যে রিপোর্ট দিয়েছে তা খুবই অর্থপূর্ণ।
এখানে মিটিং-মিছিল করতে দেয়া হচ্ছে না, সরকার বাক ¯^াধীনতা দমন করছে, এসব সমালোচনা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ব্যাপার। কারণ এরা তো এ দেশে জনগণের প্রকৃত বন্ধু হিসেবে এটা করছে না। কিন্তু তবু কেন তারা এখন এটা করছে, এটাই এক গুর“ত্বপূর্ণ জিজ্ঞাসা। এই জিজ্ঞাসার জবাব মিলতে পারে যদি আমরা বর্তমান পরিস্থিতির দিকে তাকিয়ে এটা বুঝি যে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয়লাভের যে শুধু কোন সম্ভাবনা নেই তা নয়, এবার মনে হয় আওয়ামী লীগ দলটিও প্রায় উচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। এদের শাসনে শুধু দেশের মানুষই অতিষ্ঠ হয়ে আছে তাই নয়, ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান ইত্যাদি সাম্রাজ্যবাদীরাও এই দলটির শাসন সহ্য করার মতো অবস্থায় আর নেই।
এ প্রসঙ্গে আজ ২৬ মে লন্ডনের সাপ্তাহিক ইকোনমিস্টের দুটি প্রবন্ধ খুব উলে­খযোগ্য। এর একটির নাম ‘বাংলাদেশের বিষাক্ত রাজনীতি : হ্যালো বাংলাদেশ’। দ্বিতীয়টির নাম ‘বাংলাদেশের রাজনীতি : উচ্চকণ্ঠ, চিৎকার’। প্রথম প্রবন্ধটির সাব-হেডিং আবার হল, ‘হাসিনা কর্তৃক বাংলাদেশকে ধ্বংস করা থেকে বিরত রাখার দায়িত্ব এখন ভারতের’। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনীতি এবং দ্ব›দ্ব-সংঘর্ষ বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের জীবনকে আরও বড় সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, এ কথা বলে দুটি প্রবন্ধেই বাংলাদেশে সরকারি পর্যায়ে অপহরণ, গুম, খুন, দুর্নীতি, লুটতরাজ ইত্যাদি বিষয়ে বলা হয়েছে। এই সঙ্গে বলা হয়েছে যে, ২০০১-২০০৬ পর্যš— বিএনপির শাসন ছিল বর্বরোচিত। দুর্নীতি, ঠগবাজি, সন্ত্রাস ইত্যাদি ¶েত্রে তাদেরও কীর্তিকলাপ আছে। কিন্তু বিএনপি সম্পর্কে এসব কথা বললেও ইকনোমিস্টের এ প্রবন্ধ দুটি আওয়ামী লীগের কার্যকলাপের সমালোচনাতেই মুখর। জিনিসপত্রের মূল্য বৃদ্ধি, রাজনৈতিক নির্যাতন, দুর্নীতি, সন্ত্রাস ইত্যাদি সম্পর্কে বলতে গিয়ে সভা-সমিতি, মিছিলের ওপর নিষেধাজ্ঞা ও হামলা, বিরোধীদলীয় রাজনীতিকদের বির“দ্ধে মামলা ও তাদের জেলে পাঠানো, ইলিয়াস আলী অপহরণ ও সম্ভাব্য হত্যা, শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের অপহরণ ও হত্যা, সাংবাদিক দম্পতিকে হত্যা এবং তার সঙ্গে সর্বোপরি উচ্চ মহলের দুর্নীতির সম্পর্ক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিতের দুর্নীতি এবং সে দুর্নীতির প্রহসনমূলক বিভাগীয় তদš— ইত্যাদি বিষয় এ প্রবন্ধ দুটিতে বেশ ফলাও করে বলা হয়েছে।
প্রথম প্রবন্ধটিতে ভারতকে হাসিনার অভিভাবক বা মালিক হিসেবে ধরে নিয়ে যেভাবে ভারতকে চেষ্টা করতে বলা হয়েছে হাসিনাকে সংযত করতে, এটা থেকে বোঝা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের থেকে ভারতের সঙ্গেই হাসিনার সম্পর্ক অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ বলে মনে করে। এটা হতেই পারে। কারণ ১৯৭৫ সালের পর হাসিনা বেশ কয়েক বছর ভারত কর্তৃক প্রতিপালিত হয়েছিলেন এবং সেখানকার বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে তার যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। কিন্তু ভারতও যে মার্কিন সরকার কথিত ভ‚মিকা হাসিনাকে নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে পালন করতে পারছে না, এটা প্রণব মুখার্জির ঢাকা সফরকালীন কথাবার্তা থেকে স্পষ্ট। কাজেই কার্যত দেখা যাচ্ছে, একদিকে নিজের দলীয় লোকজন ও তাদের ঘরানার কিছু বুদ্ধিজীবী এবং মহাজোটের কিছু চাটুকার নেতা পরিবৃত শেখ হাসিনা বাংলাদেশের জনগণের থেকে এখন প্রায় সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন। ভোটের বাজারে তার ভয়ানক দরপতন ইতিমধ্যেই হয়েছে। ভবিষ্যতে এ অবস্থা আরও খারাপ হয়ে এমন দাঁড়াবে যে, আগামী নির্বাচনে ১৫-২০টির বেশি আসন লাভ করাও কষ্টকর হবে। অন্যদিকে নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী মুরব্বি ও পৃষ্ঠপোষকরাও এখন তাদের থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন। এই পরিস্থিতিতে হাসিনার ব্যর্থ নেতৃত্বের অধীন আওয়ামী লীগ দল ও আওয়ামী লীগ সরকার এখন উচ্ছন্নে যাওয়ার পথে। ইতিমধ্যেই আওয়ামী লীগের আকাশকে যে ঘোর কালো মেঘ আচ্ছন্ন করেছে, সে মেঘ অদূর ভবিষ্যতেই এক প্রলয়ংকর তুফান তুলে বাংলাদেশের মাটি থেকে তাদের উড়িয়ে দেবে।
২৬-০৫-২০১২

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন