বৃহস্পতিবার, ২৪ মে, ২০১২

ঝড়ের মওসুমে যাত্রীবাহী লঞ্চের সতর্কতা



অলিউর রহমান ফিরোজ :
 বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে দেশের মধ্যে সাধারণ একটু ঝড়ো বাতাস বইলে তা ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। কিন্তু আমাদের নৌপথে চলাচলরত নৌযানগুলোর সে মতে প্রস্তুতি খুবই সামান্য। একটু সচেতনতা এবং ধৈর্যধারণ করা গেলে শত শত মানুষের জীবন বাঁচে। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয় দক্ষিণাঞ্চলের যাত্রীবাহী লঞ্চগুলোকে। লঞ্চের ধারণক্ষমতার অধিক মানুষ বহন করার পাশাপাশি লঞ্চের ডেকে যাত্রীদের পাশাপাশি মালের বস্তা বহন করাতে লঞ্চের ঝুঁকি বেড়ে যায় কয়েকগুণ। এ বিষয়টি দেখার মতো কেউ যেন নেই। ধরা যাক একটি যাত্রীবাহী লঞ্চের ধারণক্ষমতা রয়েছে পাঁচশ' মানুষ বহন করার- সেখানে ছয় থেকে সাতশ' পর্যন্ত মানুষ লঞ্চে আরোহন করে থাকে। কিন্তু ভয়ের বিষয়টি হলো সেখানে আরো যদি দু'মণ ওজনের ছয়শ' বস্তা মাল বহন করে তখন স্বাভাবিকভাবেই তা বিপজ্জনক অবস্থার তৈরি হয়। অনেক ক্ষেত্রে লঞ্চের খোন্দল থাকলে সেখানে মাল বোঝাই শেষে ডেকে পর্যন্ত অতিরিক্ত মালের বস্তা বহন করে থাকে এ সমস্ত লঞ্চগুলো। রাতের অাঁধারে চলতে যেয়ে যদি কোন কালবৈশাখীর ঝড়ে পড়ে লঞ্চ সামান্য কাত হয়ে পড়ে তখন বস্তাগুলো সেদিকেই ঝুঁকে পড়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে লঞ্চডুবির ঘটনা ঘটে থাকে। আর এ বিষয়গুলো যাদের নজরদারির কথা তাদের ব্যর্থতার কারণেই সমস্যা আরো প্রকট আকার ধারণ করে থাকে। লঞ্চ দুর্ঘটনার জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে কখনোই সরকার কঠোর হতে পারেনি। কয়েকদিন আগে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় এমভি শরীয়তপুর লঞ্চডুবির ঘটনায় উদ্ধারকারী জাহাজ রুস্তম প্রাথমিক চেষ্টা চালিয়ে লঞ্চটি উদ্ধার করতে ব্যর্থ হয়। আমরা এ দৃশ্যপট মোটামুটি সবক'টি দুর্ঘটনার বেলায়ই প্রত্যক্ষ করে থাকি। যেখানে দুর্ঘটনা কবলিত হয় সেখানে এমনিতেই স্বজন হারানোদের দুর্ভোগের শেষ বলতে কিছু থাকে না। সেখানে উদ্ধারকারী জাহাজ আসার অপেক্ষায় স্বজন হারানো মানুষের ভোগান্তি যে আরো কষ্টের এ মর্মবাণী দেশের রাজনীতিবিদ এবং আমলাদের না বোঝার কথা নয়। কেন প্রথম থেকেই দু'টি উদ্ধারকারী জাহাজ একসাথে ডাকা হয় না। একটি বড় ধরনের লঞ্চ উদ্ধার করা রুস্তমের পক্ষে যে সম্ভব নয়, তাতো উদ্ধারকারীদের না জানার কথা নয়। দেশের বিরাট এক জনগোষ্ঠীকে নদীপথ পাড়ি জমাতে হয় বিপদসংকুল অবস্থার মুখে দাঁড়িয়ে। সেখানে সরকার শক্তিশালী উদ্ধারকারী জাহাজ সংগ্রহ করতে কেন ব্যর্থ? মান্ধাতা আমলের উদ্ধারকারী জাহাজ দিয়েই চালানো হয় হতভাগ্য মৃত লঞ্চ যাত্রীদের উদ্ধারের তৎপরতা। বিভিন্ন সরকারের যেখানে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতির কথা শোনা যায় সেখানে শত শত লঞ্চযাত্রী মরণের পরেও তাদের স্বজনদের কাছে লাশের প্রাপ্যতা সরকার কোন ত্বরিত গতিতে নিশ্চিত করতে পারে না। এটা বড়ই পরিতাপের এবং বড়ই লজ্জার। নদীপথের যাত্রীদের নিরাপত্তা দিতে সরকার কখনোই মনোযোগী হননি। রাতের অাঁধার অথবা দিনের বেলা কখনোই যাত্রীরা তাদের যাত্রাপথে নিরাপদ ভাবতে পারেনি। তারা জীবন্ত লাশ হবার জন্যই যেন এদেশে জন্ম নিয়েছে। এ দেশের লঞ্চ মালিকরা এতোটাই ক্ষমতাধর যে, তারা কোন নিয়মনীতির তোয়াক্কা করেন না। আর সরকার মূলত লঞ্চ মালিকদের প্রতি কখনো কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করলেও তাদের দলীয় লঞ্চ মালিক সমিতির নেতাদের গা বাঁচাতে নদীপথের শান্তি রক্ষার্থে কোন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করাই সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি। দুর্ঘটনায় কবলিত হলেই দেশের প্রশাসন এবং রাজনীতিবিদরা নদী পাড়ে ছুটে এসে হতভাগ্যদের লাশের প্রতি কিছু টাকার সাহায্য-সহযোগিতা ঘোষণা করা পর্যন্তই যেন তাদের দায়। তারপর আবার লঞ্চ দুর্ঘটনা আবার সেই একই বুলি ছাড়া দেশের মানুষ সত্যিকার অর্থে ফলপ্রসূ কোন পদক্ষেপ তারা দেখতে পায় না। নদীপথে লঞ্চ চলাচলের জন্য রয়েছে হাজারো সমস্যা। একটি দুর্ঘটনার জন্য যেমন দায়ী লঞ্চ চালক সে রকম মালিকও কখনো কখনো সে অপরাধের কিছুটা ভাগীদার হন। দেশের অনেক লঞ্চ এখনো চলছে যেগুলো চলাচলের যোগ্যতা অনেক আগেই হারিয়ে ফেলেছে। তারপরও কর্তৃপক্ষকে মাসোহারা দিয়ে তাদের ফিটনেস সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে বহাল তবিয়তে অচল লঞ্চ নির্বিঘ্নে চলাচল করে দুর্ঘটনায় পতিত হচ্ছে। দেশের নৌপথ মূলত দক্ষিণাঞ্চলের যাত্রীদেরই একমাত্র বড় ধরনের অবলম্বন। সড়কপথ থাকলেও দক্ষিণাঞ্চল এলাকা নদীবেষ্টিত হওয়ায় এ এলাকার মানুষের জন্য লঞ্চের বিকল্প কোন পথ এখনো গড়ে ওঠেনি। আর সে কারণে কালবৈশাখীর ছোবল আর ভরা বর্ষার প্রমত্তা নদী পাড়ি দিতে গিয়ে এভাবেই তাদের জীবন্ত লাশে পরিণত হতে হয়। সরকারের কাছে নদীপথের কোন নিয়ন্ত্রণ না থাকায় লঞ্চ মালিকরা তাদের খেয়াল-খুশি মতো লঞ্চ চলাচলের পারমিট পাওয়া বৈধ আর অবৈধ বলতে এখানে কোন শব্দ নেই। তাদের ইচ্ছাই এখানে বড় কথা। অতীতেও বড় বড় লঞ্চ দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে হাজার হাজার মানুষের জীবন প্রদীপ নিভে গেলেও আজো তার কোন সুরাহা হয়নি। আলোর মুখ দেখেনি কি কারণে দুর্ঘটনার শিকার হলো তা খতিয়ে দেখার সেই তদন্ত প্রতিবেদন। কেন তাহলে লঞ্চ দুর্ঘটনায় পতিত হলে সরকারের মন্ত্রীরা সেখানে ছুটে যেয়ে মিথ্যা আশ্বাসে জাতিকে প্রলুব্ধ করেন? এ প্রশ্ন এখন হতভাগ্যদের পরিবারের। তারা অতীতের লঞ্চ দুর্ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন দেখতে চান এবং সেই তদন্ত প্রতিবেদনের আলোকে দায়ীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন কি না সেটিও তারা এখন দেখতে চান। সরকার কিছুদিন আগে রোটেশন প্রথা বাতিল করলেও তা কি কার্যকর করতে পেরেছেন। যে নদীপথে লঞ্চের প্রয়োজন ৫টি সেখানে হয়তো দু'টোর বেশি লঞ্চ চলাচল করে না। সে কারণে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অতিরিক্ত যাত্রী হয়ে তাদের পাড়ি জমাতে হয়। আর সে কারণেই লঞ্চ দুর্ঘটনায় এতো বেশি লাশের সংখ্যা জাতি দেখতে পায়। কিছুদিন আগে নারায়ণগঞ্জ এলাকায় একটি লঞ্চ একই কায়দায় পেছন থেকে অন্য একটি তেলের জাহাজ ধাক্কা দিলে মুহূর্তের মধ্যে লঞ্চটি তলিয়ে যেয়ে অনেক লোক তাতে প্রাণ হারান। তার আগে ঢাকা কাঠপট্টি নৌপথে চলাচলরত একটি লঞ্চকে বালুবাহী কার্গো ধাক্কা দিলে অনেক লোকের প্রাণ যায়। কিন্তু কোন ঘটনার জন্যই দায়ীদের শাস্তির মুখে পড়তে হয়নি। যে কারণে লঞ্চ বেশি দুর্ঘটনার মুখে পড়ে তা হলো দক্ষ চালক দিয়ে লঞ্চ চালানো হয় না। সবচেয়ে অবাক হতে হয় যখন দক্ষিণাঞ্চলের বড় বড় কোন লঞ্চেই প্রথম শ্রেণীর কোন চালক খুঁজে পাওয়া যাবে না। অনেক লঞ্চ আবার তৃতীয় শ্রেণীর চালক দিয়ে লঞ্চ পরিচালনা করা হয়। ভরা বর্ষা মওসুমে নদী থাকে উত্তাল। তখন যদি কোন ঘূর্ণিঝড় অথবা কালবৈশাখী আঘাত হানে তখন চালক যদি বাতাসের গতিবিধি পরখ করতে ব্যর্থ হন তাহলে কিছুতেই লঞ্চ দুর্ঘটনার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার কোন সুযোগ থাকে না। একজন প্রশিক্ষিত চালক তার উপস্থিত  বুদ্ধিমত্তা দিয়ে বড় বড় সমস্যা মোকাবিলা করতে পারেন অনায়াসেই। কিন্তু আমাদের বেশির ভাগ লঞ্চের চালকই তাদের লঞ্চ চালানোর মতো কোন দক্ষতা নেই। হাতুরে ডাক্তারের মতো তারা দেখতে দেখতে একসময় লঞ্চের চালক বনে যান। আর একশ্রেণীর মালিক স্বল্প বেতনে তাদের রাখতে যেয়ে যেমন তিনি ক্ষতিগ্রস্ত হন আর যাত্রীদেরও মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেন। লঞ্চ মালিকরা একদিকে যেমন ধারণক্ষমতার বিপরীতে যাত্রীর সংখ্যা দ্বিগুণ লঞ্চে তোলেন অপরদিকে মালামাল পরিবহন করার কোন নিয়ম না থাকলেও লঞ্চের খোন্দলে অনেক মাল নিয়ে ঝুঁকি নিয়ে লঞ্চ নদীতে ছাড়েন। আর এগুলো দেখভাল করার জন্য যারা রয়েছে তারা যেন অন্ধ বা বধিরের মতো নিশ্চুপ থাকেন। তাদের চোখে কিছুই ধরা পড়ে না। আর সে কারণেই একের পর এক এভাবেই দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মানুষ নির্বিচারে প্রাণ হারাচ্ছে।
-লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন