ড. আর এম দে ব না থ
যেখানে যাই সেখানেই প্রশ্ন, টাকা কোথায় গেল? জমি কেনার লোক নেই, ফ্ল্যাট কেনার ক্রেতা কম, ব্যাংকে আমানত রাখার লোকের অভাব, সঞ্চয়পত্র কেনার জন্য সরকারের আবেদন সত্ত্বেও তা কেনার লোক কম, শেয়ারবাজারে টাকা খাটানোর বিনিয়োগকারী নেই, ধার চাইলে ধার পাওয়া যায় না, ধার দিলে তা শোধ হয় না, বাকিতে মাল বিক্রি কম। এ ধরনের শত প্রশ্নে জর্জরিত টাকার বাজার। কী রমরমা ছিল টাকার বাজার! কথায় কথায় বকশিশ মিলত। এখন মিলে কম। এসব প্রশ্নের শেষে মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন, টাকা গেল কোথায়? আমি নিজেও বিচলিত এই প্রশ্নে। নানাজন নানা কথা বলে। কার কথা যে ঠিক, কার কথা যে বেঠিক তা বুঝি কম। আমি চাই তথ্য। কেউ দেয়, কেউ দিতে পারে না। যে তথ্য পাই, তা দিয়ে আমার পুরো সš‘ষ্টি আসে না। বিশেষ করে প্রচার গুণের কারণে ও মিডিয়ার কল্যাণে অর্থনীতিবিদ বনে যাওয়া লোকদের এবং তিন মাসের বনের রাজা উপদেষ্টাদের কথায় বিশ্বাস ও আ¯’া রাখা বড়ই কঠিন। তারা পৃথিবীর সব বিষয়ের ওপর জ্ঞান ও বুদ্ধি রাখেন। এসব কারণে তাদের কাছ থেকে আমি আমার প্রশ্নের উত্তর অর্ধেক পাই, অর্ধেক পাই না, কনফিউজ্ড হই। টাকা গেল কোথায়?
টাকা কি কেউ কেউ সিন্দুকে ভরে রেখে দিয়েছে? টাকা কি ১০০০ টাকার নোট করে মানুষ বালিশের তলায় রেখে দিয়েছে? টাকা কি বস্তাভর্তি করে ব্যবসায়ীরা বিদেশ নিয়ে গেছে? হতে পারে এসব। কিš‘ তা হলে ক্যাশ আউটসাইড ব্যাংক (সিওবি) বেশ বাড়ার কথা। এর হিসাব বাংলাদেশ ব্যাংক রাখে। ওইসব তথ্যে দেখা যায়, ২০১১ সালের জুলাইয়ের তুলনায় ২০১২ সালের ফেব্র“য়ারি পর্যন্ত সিওবি তত বেশি বাড়েনি। যেটুকু বেড়েছে, স্বাভাবিক মূল্যস্ফীতির কারণে জিনিসের যে মূল্য বেড়েছে তা মেটানোর জন্যই লাগার কথা। এই সময়ে দুই-সোয়া দুই হাজার কোটি টাকার সিওবি বেড়েছে। অর্থাৎ ৮ মাসে এই বৃদ্ধি। গেল বছরের একই সময়ে তা বেড়েছিল প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা। সেই হিসাবে সিওবি বাড়েনি বলা যায়। তাহলে যে বলা হ”েছ টাকা সিন্দুকে আবদ্ধ, ঘরে তালাবদ্ধ, বালিশের তলায়, মধ্যপ্রাচ্যে বা ভারতীয় মাড়োয়ারির হাতেÑ এসবের ভিত্তি কী? কেউ কেউ বলেন, কুরিয়ার সার্ভিস ওয়ালারা ‘প্যারালাল ব্যাংকিং’ করছে। অর্থাৎ তারা টাকা ধরে রাখছে। তারা তাদের টাকা ব্যাংকে রাখছে না। এটা হলেও তো ‘সিওবি’ বাড়ার কথা। কিš‘ গেল বছরের তুলনায় ‘সিওবি’ এবার তো নিয়ন্ত্রণাধীন। এর কারণও আছে। চেকের ব্যবহার বাড়ছে। অনলাইন ব্যাংকিং চালু হওয়ায় টাকা ব্যাংক থেকে বেরো”েছ না। এক ব্যাংক থেকে আরেক ব্যাংকে, এক ব্রাঞ্চ থেকে আরেক ব্রাঞ্চে যা”েছ মাত্র। এজন্য গভর্নরকে ধন্যবাদ। আরেকটা মজার তথ্য হ”েছ, ব্যাংকের ‘ভোল্টেও’ টাকা হ্রাস পেয়েছে। এই টাকা থাকে কাস্টমারদের টাকা উত্তোলনের চাহিদা মেটানোর জন্য। দেখা যা”েছ, ভোল্টের টাকার পরিমাণ জুলাই-ফেব্র“য়ারি মাসে ৩৭৩ কোটি টাকা হ্রাস পেয়েছে। এতে কি কাস্টমারদের টাকা উত্তোলনে কোন সমস্যা হ”েছ? না, এমন কথা শুনিনি। এমন কোন রিপোর্ট পাওয়া যায়নি যে, ব্যাংক টাকা তুলতে গেলে টাকা দিতে পারছে না। এটাও চেক ব্যবহারের একটা ফল হতে পারে।
তাহলে টাকা গেল কোথায়? বিদেশে ডলার হয়ে পাচার হয়ে গেছে? ডলার রূপান্তরিত করে টাকা পাঠাতে হলে তো টাকার সরবরাহে কোন সমস্যা হবে না। একজন দুই নম্বরে মার্কেটে ডলার বিক্রি করবে, আরেকজন কিনবে। যে কিনবে সে টাকা দেবে আর যে বিক্রি করবে সে পাবে। এতে তো দুই নম্বর বাজারের ডলার দুই নম্বর দিয়েই বিদেশ যাবে। টাকার সরবরাহ ঠিকই থাকবে। অধিকš‘ বাংলাদেশের টাকার বিদেশে কোন বাজার নেই। কিছু বাংলাদেশী টাকা কলকাতা-মুম্বাই ইত্যাদি শহর এবং মধ্যপ্রাচ্যের কিছু শহরে বাংলাদেশীদের লাগে। কিš‘ সেই টাকা মাড়োয়ারিরাই সংগ্রহ করে আবার তারা তা বাংলাদেশেই ফেরত পাঠায়, কারণ এই টাকা এখানেই চলে, অন্যত্র নয়। এই টাকা যদি বেশি পরিমাণের হতো তাহলেও ‘সিওবি’ বাড়ত। দেখা যা”েছ ঘটনা তা নয়।
এ অব¯’ায় প্রশ্নের জবাব এখন পর্যন্ত পাওয়া যা”েছ না। আমরা যে টাকার কথা বলছি তার কয়েকটা রূপ আছে। এক নম্বর, মানুষের হাতে টাকা যাকে বলা হয় ‘ক্যাশ আউটসাইড ব্যাংকস’ (সিওবি)। দুই নম্বর, ব্যাংকের ভোল্টের টাকা যা দিয়ে ব্যাংক দৈনন্দিন চাহিদা মেটায়। একে বলা হয় ‘ক্যাশ ইন টিলস’। তিন নম্বর, তলবি আমানত (ডিমান্ড ডিপোজিট), চার নম্বর, মেয়াদি আমানত (টাইম ডিপোজিট)। আর কিছু টাকা থাকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং বিভাগে বিভিন্ন ব্যাংকের জমা দেয়া টাকা হিসেবে। টাকা বলতে এসবকেই বোঝায়। টাকার টানাটানি মানেই এসব উপাদানের টানাটানি। টাকার টানাটানি মানেই প্রধানত আমানতের টানাটানি। আমানত বাড়লে টাকা বাড়ে। টাকা বাড়লে আমানত বাড়ে। এখন আমানত বাড়ে না। এর অনেক কারণ থাকতে পারে। এগুলোর বিচার বিশ্লেষণ হতে পারে। অবশ্যই একটা কারণ, মানুষের সঞ্চয় হ্রাস পেয়েছে। আয়ের তুলনায় মানুষের ব্যয় বেড়েছে। আমি সামিট গ্র“প, এস আলম, এসআর পরিবহন, হলমার্ক গ্র“প, ট্রান্সকমের কথা বলছি না। তারা বিধাতার বিশেষ সৃষ্টি। তাদের বিধাতা উপর থেকে পুষ্পবৃষ্টির মাধ্যমে টাকা দেন। কিš‘ সাধারণ মানুষের ব্যয় বেশি, আয় কম। অতএব, মানুষের সঞ্চয় কম। ব¯‘ত সঞ্চয় ¯’বির হয়ে আছে। ২০১০-এর জুলাইয়ের তুলনায় ২০১১ সালের ফেব্র“য়ারিতে ব্যাংক আমানত (সরকারি ও আন্তঃব্যাংক বাদে) বেড়েছিল ১১ দশমিক ৮৫ শতাংশ। সেই তুলনায় চলতি অর্থবছরের একই সময়ে আমানত বেড়েছে মাত্র ৯ দশমিক ২৯ শতাংশ। অসুবিধা হ”েছ আমানত কম বাড়লে কী হবে, ঋণ বাড়ছে মারাÍকভাবে। প্রসঙ্গত বলে নিই, সাধারণ মানুষের সঞ্চয় যে কমছে তার আরেকটা প্রমাণ হ”েছ ডাকঘর আমানত কমে যাওয়া। অর্থবছরের প্রথম আট মাসে ডাকঘর আমানত কমেছে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। ওই যে বলছিলাম ঋণের কথা, দেখা যা”েছ আমানতের তুলনায় ঋণ বাড়ছে বেশি, অনেক বেশি হারে। মুশকিল হ”েছ, ‘প্রাইমারি ডিপোজিট’ (ক্যাশ ডিপোজিট) না বাড়লে ব্যাংক আমানত বা টাকা বাড়াতে পারে না। তারল্য হার যদি ২০ শতাংশ হয় তাহলে ব্যাংক এক টাকার প্রাইমারি ডিপোজিট পেলে ৫ টাকার সেকেন্ডারি ডিপোজিট বাড়াতে পারে। যেহেতু কম সঞ্চয়ের কারণে কম প্রাইমারি ডিপোজিট (ক্যাশ ডিপোজিট) হ”েছ, অতএব সেকেন্ডারি ডিপোজিটও কম হ”েছ। অর্থাৎ আমানতের প্রবৃদ্ধি, টাকার প্রবৃদ্ধি কমছে। ব্যাংক আগের মতো ঋণ দিতে পারছে না।
এবার আসি আরেকটি কথায়। ডিপোজিটের প্রবৃদ্ধির টাকার প্রবৃদ্ধি বা হার কমার আরেকটা কারণ আছে। আর সেটা হ”েছ টাকা পাচার। সাদামাটাভাবে চিন্তা করলে বলা যায়, টাকা পাচার করলে কিছু হয় না। কারণ টাকা যে দেশে যাবে সে দেশে তা চলবে না। আবার স্বদেশে টাকাকে ফেরত আসতে হবে। এটা কোন বাংলাদেশী শ্রমিককে দিয়ে চতুর ব্যবসায়ী/হুন্ডিওয়ালা শ্রমিকের কাছ থেকে ডলারটা নিয়ে নেবে। ওই শ্রমিক টাকা দেশে পাঠাবে। এভাবেও রেমিটেন্স হয়। আমি এই পদ্ধতিতে টাকা পাচারের কথা বলছি না। আমি বলছি ‘আন্ডার ইনভয়েসিং’-এর মাধ্যমে টাকা পাচারের কথা। ধরা যাক, রফতানি পণ্যের দাম ১০০ ডলার। এলসি খোলা হল ৫০ ডলার হিসাবে। বিদেশে ৫০ ডলার পাচার হয়ে গেল। দেশে এলো ৫০ ডলার। এটা টাকায় কনভার্ট করে রফতানিকারকের অ্যাকাউন্টে জমা দেয়া হবে। ধরা যাক, এতে পাওয়া গেল ৫০ পূরণ ৮০ সমান ৪০০০ টাকা। যদি ১০০ ডলার হতো তাহলে হতো ৮০০০ টাকা। অর্থাৎ রফতানিকারকের আমানত বাড়ল অর্থাৎ ব্যাংকের আমানত বাড়ল ৪০০০ টাকা। যদি তার ঋণ থেকে থাকে, তাহলে অবশ্য তা এডজাস্ট হবে। সেই টাকা আবার অন্যকে দেয়া হবে। একে বলে ‘ক্রেডিট ক্রিয়েশন’ মেকানিজম যার মাধ্যমে ব্যাংক আমানত সৃষ্টি করে। যদি আন্ডার ইনভয়েসিং না হতো, তাহলে ৪০০০-এর ¯’লে টাকার হিসাব হতো ৮০০০। অতএব বলা হ”েছ, আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে টাকা পাচারের ফলে ব্যাংকের আমানতের প্রবৃদ্ধির হারও কমছে।
অতএব করণীয়? করণীয় হ”েছ মানুষের সঞ্চয় বাড়ানো। এর জন্য দরকার কর্মসং¯’ান বৃদ্ধি করা। দরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা। করণীয় বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা। মানুষের যাতে চাকরি না যায় তার ব্যব¯’া করা। মানুষ যাতে সারা বছর কাজ পায় তার ব্যব¯’া করা। এসব হবে কি?
ড. আর এম দেবনাথ : সাবেক অধ্যাপক, বিআইবিএম
ৎসফবনহধঃয@ুধযড়ড়.পড়স
যেখানে যাই সেখানেই প্রশ্ন, টাকা কোথায় গেল? জমি কেনার লোক নেই, ফ্ল্যাট কেনার ক্রেতা কম, ব্যাংকে আমানত রাখার লোকের অভাব, সঞ্চয়পত্র কেনার জন্য সরকারের আবেদন সত্ত্বেও তা কেনার লোক কম, শেয়ারবাজারে টাকা খাটানোর বিনিয়োগকারী নেই, ধার চাইলে ধার পাওয়া যায় না, ধার দিলে তা শোধ হয় না, বাকিতে মাল বিক্রি কম। এ ধরনের শত প্রশ্নে জর্জরিত টাকার বাজার। কী রমরমা ছিল টাকার বাজার! কথায় কথায় বকশিশ মিলত। এখন মিলে কম। এসব প্রশ্নের শেষে মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন, টাকা গেল কোথায়? আমি নিজেও বিচলিত এই প্রশ্নে। নানাজন নানা কথা বলে। কার কথা যে ঠিক, কার কথা যে বেঠিক তা বুঝি কম। আমি চাই তথ্য। কেউ দেয়, কেউ দিতে পারে না। যে তথ্য পাই, তা দিয়ে আমার পুরো সš‘ষ্টি আসে না। বিশেষ করে প্রচার গুণের কারণে ও মিডিয়ার কল্যাণে অর্থনীতিবিদ বনে যাওয়া লোকদের এবং তিন মাসের বনের রাজা উপদেষ্টাদের কথায় বিশ্বাস ও আ¯’া রাখা বড়ই কঠিন। তারা পৃথিবীর সব বিষয়ের ওপর জ্ঞান ও বুদ্ধি রাখেন। এসব কারণে তাদের কাছ থেকে আমি আমার প্রশ্নের উত্তর অর্ধেক পাই, অর্ধেক পাই না, কনফিউজ্ড হই। টাকা গেল কোথায়?
টাকা কি কেউ কেউ সিন্দুকে ভরে রেখে দিয়েছে? টাকা কি ১০০০ টাকার নোট করে মানুষ বালিশের তলায় রেখে দিয়েছে? টাকা কি বস্তাভর্তি করে ব্যবসায়ীরা বিদেশ নিয়ে গেছে? হতে পারে এসব। কিš‘ তা হলে ক্যাশ আউটসাইড ব্যাংক (সিওবি) বেশ বাড়ার কথা। এর হিসাব বাংলাদেশ ব্যাংক রাখে। ওইসব তথ্যে দেখা যায়, ২০১১ সালের জুলাইয়ের তুলনায় ২০১২ সালের ফেব্র“য়ারি পর্যন্ত সিওবি তত বেশি বাড়েনি। যেটুকু বেড়েছে, স্বাভাবিক মূল্যস্ফীতির কারণে জিনিসের যে মূল্য বেড়েছে তা মেটানোর জন্যই লাগার কথা। এই সময়ে দুই-সোয়া দুই হাজার কোটি টাকার সিওবি বেড়েছে। অর্থাৎ ৮ মাসে এই বৃদ্ধি। গেল বছরের একই সময়ে তা বেড়েছিল প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা। সেই হিসাবে সিওবি বাড়েনি বলা যায়। তাহলে যে বলা হ”েছ টাকা সিন্দুকে আবদ্ধ, ঘরে তালাবদ্ধ, বালিশের তলায়, মধ্যপ্রাচ্যে বা ভারতীয় মাড়োয়ারির হাতেÑ এসবের ভিত্তি কী? কেউ কেউ বলেন, কুরিয়ার সার্ভিস ওয়ালারা ‘প্যারালাল ব্যাংকিং’ করছে। অর্থাৎ তারা টাকা ধরে রাখছে। তারা তাদের টাকা ব্যাংকে রাখছে না। এটা হলেও তো ‘সিওবি’ বাড়ার কথা। কিš‘ গেল বছরের তুলনায় ‘সিওবি’ এবার তো নিয়ন্ত্রণাধীন। এর কারণও আছে। চেকের ব্যবহার বাড়ছে। অনলাইন ব্যাংকিং চালু হওয়ায় টাকা ব্যাংক থেকে বেরো”েছ না। এক ব্যাংক থেকে আরেক ব্যাংকে, এক ব্রাঞ্চ থেকে আরেক ব্রাঞ্চে যা”েছ মাত্র। এজন্য গভর্নরকে ধন্যবাদ। আরেকটা মজার তথ্য হ”েছ, ব্যাংকের ‘ভোল্টেও’ টাকা হ্রাস পেয়েছে। এই টাকা থাকে কাস্টমারদের টাকা উত্তোলনের চাহিদা মেটানোর জন্য। দেখা যা”েছ, ভোল্টের টাকার পরিমাণ জুলাই-ফেব্র“য়ারি মাসে ৩৭৩ কোটি টাকা হ্রাস পেয়েছে। এতে কি কাস্টমারদের টাকা উত্তোলনে কোন সমস্যা হ”েছ? না, এমন কথা শুনিনি। এমন কোন রিপোর্ট পাওয়া যায়নি যে, ব্যাংক টাকা তুলতে গেলে টাকা দিতে পারছে না। এটাও চেক ব্যবহারের একটা ফল হতে পারে।
তাহলে টাকা গেল কোথায়? বিদেশে ডলার হয়ে পাচার হয়ে গেছে? ডলার রূপান্তরিত করে টাকা পাঠাতে হলে তো টাকার সরবরাহে কোন সমস্যা হবে না। একজন দুই নম্বরে মার্কেটে ডলার বিক্রি করবে, আরেকজন কিনবে। যে কিনবে সে টাকা দেবে আর যে বিক্রি করবে সে পাবে। এতে তো দুই নম্বর বাজারের ডলার দুই নম্বর দিয়েই বিদেশ যাবে। টাকার সরবরাহ ঠিকই থাকবে। অধিকš‘ বাংলাদেশের টাকার বিদেশে কোন বাজার নেই। কিছু বাংলাদেশী টাকা কলকাতা-মুম্বাই ইত্যাদি শহর এবং মধ্যপ্রাচ্যের কিছু শহরে বাংলাদেশীদের লাগে। কিš‘ সেই টাকা মাড়োয়ারিরাই সংগ্রহ করে আবার তারা তা বাংলাদেশেই ফেরত পাঠায়, কারণ এই টাকা এখানেই চলে, অন্যত্র নয়। এই টাকা যদি বেশি পরিমাণের হতো তাহলেও ‘সিওবি’ বাড়ত। দেখা যা”েছ ঘটনা তা নয়।
এ অব¯’ায় প্রশ্নের জবাব এখন পর্যন্ত পাওয়া যা”েছ না। আমরা যে টাকার কথা বলছি তার কয়েকটা রূপ আছে। এক নম্বর, মানুষের হাতে টাকা যাকে বলা হয় ‘ক্যাশ আউটসাইড ব্যাংকস’ (সিওবি)। দুই নম্বর, ব্যাংকের ভোল্টের টাকা যা দিয়ে ব্যাংক দৈনন্দিন চাহিদা মেটায়। একে বলা হয় ‘ক্যাশ ইন টিলস’। তিন নম্বর, তলবি আমানত (ডিমান্ড ডিপোজিট), চার নম্বর, মেয়াদি আমানত (টাইম ডিপোজিট)। আর কিছু টাকা থাকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং বিভাগে বিভিন্ন ব্যাংকের জমা দেয়া টাকা হিসেবে। টাকা বলতে এসবকেই বোঝায়। টাকার টানাটানি মানেই এসব উপাদানের টানাটানি। টাকার টানাটানি মানেই প্রধানত আমানতের টানাটানি। আমানত বাড়লে টাকা বাড়ে। টাকা বাড়লে আমানত বাড়ে। এখন আমানত বাড়ে না। এর অনেক কারণ থাকতে পারে। এগুলোর বিচার বিশ্লেষণ হতে পারে। অবশ্যই একটা কারণ, মানুষের সঞ্চয় হ্রাস পেয়েছে। আয়ের তুলনায় মানুষের ব্যয় বেড়েছে। আমি সামিট গ্র“প, এস আলম, এসআর পরিবহন, হলমার্ক গ্র“প, ট্রান্সকমের কথা বলছি না। তারা বিধাতার বিশেষ সৃষ্টি। তাদের বিধাতা উপর থেকে পুষ্পবৃষ্টির মাধ্যমে টাকা দেন। কিš‘ সাধারণ মানুষের ব্যয় বেশি, আয় কম। অতএব, মানুষের সঞ্চয় কম। ব¯‘ত সঞ্চয় ¯’বির হয়ে আছে। ২০১০-এর জুলাইয়ের তুলনায় ২০১১ সালের ফেব্র“য়ারিতে ব্যাংক আমানত (সরকারি ও আন্তঃব্যাংক বাদে) বেড়েছিল ১১ দশমিক ৮৫ শতাংশ। সেই তুলনায় চলতি অর্থবছরের একই সময়ে আমানত বেড়েছে মাত্র ৯ দশমিক ২৯ শতাংশ। অসুবিধা হ”েছ আমানত কম বাড়লে কী হবে, ঋণ বাড়ছে মারাÍকভাবে। প্রসঙ্গত বলে নিই, সাধারণ মানুষের সঞ্চয় যে কমছে তার আরেকটা প্রমাণ হ”েছ ডাকঘর আমানত কমে যাওয়া। অর্থবছরের প্রথম আট মাসে ডাকঘর আমানত কমেছে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। ওই যে বলছিলাম ঋণের কথা, দেখা যা”েছ আমানতের তুলনায় ঋণ বাড়ছে বেশি, অনেক বেশি হারে। মুশকিল হ”েছ, ‘প্রাইমারি ডিপোজিট’ (ক্যাশ ডিপোজিট) না বাড়লে ব্যাংক আমানত বা টাকা বাড়াতে পারে না। তারল্য হার যদি ২০ শতাংশ হয় তাহলে ব্যাংক এক টাকার প্রাইমারি ডিপোজিট পেলে ৫ টাকার সেকেন্ডারি ডিপোজিট বাড়াতে পারে। যেহেতু কম সঞ্চয়ের কারণে কম প্রাইমারি ডিপোজিট (ক্যাশ ডিপোজিট) হ”েছ, অতএব সেকেন্ডারি ডিপোজিটও কম হ”েছ। অর্থাৎ আমানতের প্রবৃদ্ধি, টাকার প্রবৃদ্ধি কমছে। ব্যাংক আগের মতো ঋণ দিতে পারছে না।
এবার আসি আরেকটি কথায়। ডিপোজিটের প্রবৃদ্ধির টাকার প্রবৃদ্ধি বা হার কমার আরেকটা কারণ আছে। আর সেটা হ”েছ টাকা পাচার। সাদামাটাভাবে চিন্তা করলে বলা যায়, টাকা পাচার করলে কিছু হয় না। কারণ টাকা যে দেশে যাবে সে দেশে তা চলবে না। আবার স্বদেশে টাকাকে ফেরত আসতে হবে। এটা কোন বাংলাদেশী শ্রমিককে দিয়ে চতুর ব্যবসায়ী/হুন্ডিওয়ালা শ্রমিকের কাছ থেকে ডলারটা নিয়ে নেবে। ওই শ্রমিক টাকা দেশে পাঠাবে। এভাবেও রেমিটেন্স হয়। আমি এই পদ্ধতিতে টাকা পাচারের কথা বলছি না। আমি বলছি ‘আন্ডার ইনভয়েসিং’-এর মাধ্যমে টাকা পাচারের কথা। ধরা যাক, রফতানি পণ্যের দাম ১০০ ডলার। এলসি খোলা হল ৫০ ডলার হিসাবে। বিদেশে ৫০ ডলার পাচার হয়ে গেল। দেশে এলো ৫০ ডলার। এটা টাকায় কনভার্ট করে রফতানিকারকের অ্যাকাউন্টে জমা দেয়া হবে। ধরা যাক, এতে পাওয়া গেল ৫০ পূরণ ৮০ সমান ৪০০০ টাকা। যদি ১০০ ডলার হতো তাহলে হতো ৮০০০ টাকা। অর্থাৎ রফতানিকারকের আমানত বাড়ল অর্থাৎ ব্যাংকের আমানত বাড়ল ৪০০০ টাকা। যদি তার ঋণ থেকে থাকে, তাহলে অবশ্য তা এডজাস্ট হবে। সেই টাকা আবার অন্যকে দেয়া হবে। একে বলে ‘ক্রেডিট ক্রিয়েশন’ মেকানিজম যার মাধ্যমে ব্যাংক আমানত সৃষ্টি করে। যদি আন্ডার ইনভয়েসিং না হতো, তাহলে ৪০০০-এর ¯’লে টাকার হিসাব হতো ৮০০০। অতএব বলা হ”েছ, আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে টাকা পাচারের ফলে ব্যাংকের আমানতের প্রবৃদ্ধির হারও কমছে।
অতএব করণীয়? করণীয় হ”েছ মানুষের সঞ্চয় বাড়ানো। এর জন্য দরকার কর্মসং¯’ান বৃদ্ধি করা। দরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা। করণীয় বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা। মানুষের যাতে চাকরি না যায় তার ব্যব¯’া করা। মানুষ যাতে সারা বছর কাজ পায় তার ব্যব¯’া করা। এসব হবে কি?
ড. আর এম দেবনাথ : সাবেক অধ্যাপক, বিআইবিএম
ৎসফবনহধঃয@ুধযড়ড়.পড়স
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন