আনিসুল হক | তারিখ: ২৯-০৫-২০১২
আমাদের তিন সহকর্মী রাজধানীর ট্রমা সেন্টারের বিছানায় শুয়ে আছেন। আমাদের একজন নিয়মিত প্রদায়ক কিলঘুষি খেয়ে প্রথম আলো অফিসে বসে ছিলেন, তাঁর শরীরজোড়া মারের দাগ, চোখ-মুখ ফোলা। পুরো ঘটনায় আমার কতগুলো অনুভূতি হচ্ছে। এক. নিজেকে দায়ী মনে হচ্ছে। দুই. খুব অপমানিত বোধ করছি। তিন. নিরাপত্তাহীনতার বোধ তৈরি হয়েছে। চার. আমাদের দেশটা নিয়ে, রাষ্ট্র নিয়ে উদ্বেগ সীমাহীনভাবে বেড়ে গেছে। সবটা মিলিয়ে যা তৈরি হয় তা ক্রোধ, ক্ষোভ, হতাশা।
প্রথম আলোর ফটোসাংবাদিক খালেদ সরকার আর প্রদায়ক হাসান ইমামের ওই সময় (শনিবার, ২৬ মে, ২০১২, সকালবেলা) আগারগাঁওয়ের দিকে যাওয়ার কথা নয়। আমার বন্ধু নদী-বিশেষজ্ঞ ড. মনসুর রহমান ফোন করে আমাকে জানালেন, আগারগাঁওয়ে এক মিলনায়তনে তাঁরা একটা আন্তর্জাতিক সেমিনার করছেন। দেশ-বিদেশের বিশেষজ্ঞরা একটা জনবহুল বদ্বীপের মানুষ কীভাবে বেঁচে থাকবে, কীভাবে দারিদ্র্যমুক্ত থাকতে পারবে, তাই নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা তুলে ধরবেন। আমি সেই খবর ও ছবি সংগ্রহ করার জন্য অনুরোধ করেছিলাম সংশ্লিষ্টদের। সেই খবর সংগ্রহ করতেই আলোকচিত্রী খালেদ সরকার আর প্রদায়ক হাসান ইমাম আগারগাঁওয়ে গিয়েছিলেন। খবর ও ছবি সংগ্রহ করে তাঁরা ফিরছিলেন।
ওই সময় তাঁরা দেখেন, রাস্তায় পলিটেকনিকের ছাত্রীরা বিক্ষোভ করছেন।
খালেদ সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা থেকে মাস্টার্স পাস করে প্রথম আলোয় আলোকচিত্র সাংবাদিকতা করেন। অত্যন্ত বিনয়ী, সদাহাসিমুখ, কর্তব্যপরায়ণ। রাস্তায় একটা ঘটনা ঘটছে, খালেদ ছবি তুলতে আরম্ভ করেন। অন্যদিকে এই ঘটনার ছবি তুলতেই আসেন প্রথম আলোর সাংবাদিক জাহিদুল করিম ও সাজিদ হোসেন।
তখন বিক্ষোভ প্রায় প্রশমিত হয়ে পড়েছে। কিন্তু ছাত্রীরা তখনো রাস্তায় রয়ে গেছে। হঠাৎ কোনো ঘটনা ঘটলে ‘এক্সক্লুসিভ’ ছবি পাবেন, এই আশায় এক ফটোসাংবাদিক ফাঁকা রাস্তায় একটা পুলিশের গাড়ির পেছনে মোটরসাইকেল চালিয়ে যেতে থাকেন।
এই সময়েই পুলিশের সঙ্গে তাঁর কথা-কাটাকাটি হয়। পুলিশ বলে, আপনারা এই রাস্তায় মোটরসাইকেল নিয়ে আসছেন কেন? সাংবাদিক বলেন, ছবি তুলতে। একপর্যায়ে বলেন, যদি কোনো অপরাধ হয়ে থাকে, আপনি মামলা করেন। গালিগালাজ করছেন কেন?
যাঁদের হাতে লাঠি আছে, অস্ত্র আছে, তাঁরা গালিগালাজ করবেন, তাঁদের কি জিজ্ঞেস করতে আছে, গালি দিচ্ছেন কেন?
পুলিশের কর্তা নির্দেশ দেন পেটাও। সাংবাদিক পেটালে কিছু হয় না।
তারপর শুরু হয় বৃষ্টির মতো মার। কলার ধরে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে মার। রাস্তায় ফেলে মার। লাঠি দিয়ে বেধড়ক মার। কান বরাবর ঘুষি। রাইফেলের বাঁট দিয়ে মার। একজনকে মারতে দেখে আরেকজন সাংবাদিক ছুটে আসেন। তিনজন ফটোসাংবাদিকই প্রচণ্ড প্রহার-বৃষ্টির মধ্যে পড়েন।
গত পরশু ট্রমা সেন্টারে গিয়ে মারের চোটে থেঁতলানো দেহ নিয়ে পড়ে থাকা তিন সাংবাদিককে দেখতে যাই। একজন বলেন, কোত্থেকে সাদা পোশাকের পুলিশ এসে যে চড়াও হয় এবং প্রচণ্ড মার মারতে থাকে, আল্লাহই জানেন।
মারের চোটে একজনের ঠোঁট কেটে গেছে, দড়দড়িয়ে রক্ত পড়ছে। শরীর জোড়া তাঁদের মারের দাগ। ভেতরে মাংস থেঁতলে গেছে। সাজিদের কানের পেছনে এমন ঘুষি মেরেছে, ফুলে কালো হয়ে আছে জায়গাটা। আমাদের নিরীহ প্রদায়ক মোবাইল ফোনে এই মারধরের ছবি তুলছিলেন, এবার পুলিশ চড়াও হয় তাঁর ওপর। তাঁকে বেধড়ক কিলঘুষি মেরে তাঁর মোবাইল কেড়ে নেয়।
ওই পুলিশ সদস্যদের বড় আক্রোশ ছিল ক্যামেরার ওপর। তারা ক্যামেরা ছিনিয়ে নিতে চায়। ক্যামেরা নিয়ে টানাটানি হয়। শেষ পর্যন্ত ক্যামেরা তারা কেড়ে নিয়েই ছাড়ে। এই সাংবাদিকদের থানায় নিয়ে যাওয়ার পথে সারা পথে কিলঘুষি-চড় মারা হয়।
এসি শহীদুলের উক্তিটা তাৎপর্যপূর্ণ। ‘এই রকম কত সাংবাদিক দেখছি, কত মারছি। এগুলান রে মারলে কিছু হয় না।’
এখানেই আসে আমার দ্বিতীয় অনুভূতিটার কথা। অপমানবোধ। পুলিশ কিন্তু সাংবাদিকদের মার শুরু করেছে কিলঘুষি-চড় দিয়ে, কলার ধরে টানাটানি দিয়ে। একজন সাংবাদিক হিসেবে এই চড় আমার নিজের গালে এসে লাগছে। আর ওই কথাটা? সাংবাদিক পেটালে কিছু হয় না। সত্যি তো, কিছু হয় না। আমার ছোট ভাই সাগর সরওয়ার, আমার ছোট বোন মেহেরুন রুনি নিজ বাড়িতে নৃশংসভাবে খুন হলো, তাদের দেবদূতের মতো ছেলেটা, মেঘ, বাবা-হত্যার বিচার দাবিতে রাস্তায় পর্যন্ত নামল, কী হয়েছে? কিছু হয় না তো আসলে।
ট্রমা সেন্টারে যখন আমি আহত ক্ষত-বিক্ষত সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলি, ওঁরা বলেন, কোথাও কোনো বড় গণ্ডগোল হলে সাংবাদিকেরা মারের মধ্যে পড়ে যান, আহত হন, আমরা তো সেটা আমাদের কাজের অংশই ধরে নিয়েছি। কিন্তু কোনো কারণ ছাড়া, কোনো উত্তেজনা ছাড়া শুধু সাংবাদিক পেটানোর জন্যই একযোগে নিরস্ত্র কর্তব্যরত সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হওয়া আর নির্মমভাবে মারা, যেন একটা স্যাডিজমের লক্ষণ; অন্যকে পীড়িত-অত্যাচারিত হতে দেখে আনন্দিত হওয়া।
এ থেকে একটা সার্বিক নিরাপত্তাহীনতার বোধ তৈরি হয়। সাগর-রুনি মারা যাচ্ছেন নিজের বাড়িতে, বিদেশি কূটনীতিক মারা যাচ্ছেন রাস্তায়, রাজনৈতিক নেতা বা গার্মেন্টস শ্রমিক নেতা হারিয়ে যাচ্ছেন রাজপথ থেকে, পুলিশ রাজনৈতিক নেতাদের পেটাচ্ছে, শিক্ষকদের পেটাচ্ছে, সাংবাদিকদের পেটাচ্ছে, সংসদ সদস্যকে পেটাচ্ছে। এর আগে পুলিশ কমনওয়েলথে স্বর্ণপদক পাওয়া আসিফকে পিটিয়েছিল।
সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডে কূলকিনারা না হওয়া থেকে শুরু করে গাড়িতে তিন কর্তব্যরত সাংবাদিককে তুলে সারাটা পথ পেটাতে পেটাতে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা একত্র করলে একটা তীব্র হতাশার বোধ তৈরি হয় না কি? তার মানে এটা একটা নৈরাজ্যের লক্ষণ।
পুলিশের হাতে লাঠি আছে। পুলিশের হাতে অস্ত্র আছে। সেই কারণেই তাদের শৃঙ্খলার পরিচয় দিতে হবে, সেই কারণেই তাদের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। আপনি গাড়িতে তুলে সাংবাদিককে মারলেন কোন আইনের বলে?
যদি কেউ রং সাইডে মোটরসাইকেল চালিয়ে থাকে, তাহলে তাকে আপনি মারবেন কেন? তার ক্যামেরা কেড়ে নেবেন কেন? কোন আইনের ধারায় আপনি মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিচ্ছেন। মেমরি কার্ড খুলে নিলেন কোন আইনে?
২.
অথচ পুলিশের কাছে আমরা যাই ভরসার সন্ধানে। একটা ঘটনা বলি। ১৯৯০ সালের এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় আমি একজন তরুণ সাংবাদিক, সাপ্তাহিক পূর্বাভাস নামের একটা কাগজ আমরা বের করি। যেদিন পত্রিকা ছাপা হবে, কাজ শেষ করতে করতে রাত হয়ে যায়। স্টেডিয়ামের পত্রিকা অফিস থেকে বের হয়ে প্রেসক্লাবের সামনে দিয়ে হাঁটছি, এরই মধ্যে কারফিউ শুরু হয়ে গেছে। কোনো যানবাহন নেই রাস্তায়। আমাকে যেতে হবে বকশীবাজার। একটা পুলিশের গাড়ি এসে আমার পাশে থামে। আমাকে বলে, কারফিউ শুরু হয়ে যাচ্ছে, আপনি কই যান? আমি বলি, আমি সাংবাদিক, কাজ শেষ করে ঘরে ফিরছি। ওরা বলেন, রাস্তায় মিলিটারি নেমেছে, আমরা না হয় আপনাকে ছেড়ে দিলাম, মিলিটারির সামনে পড়লে যদি আপনার কিছু হয়। আমি বলি, আমি তো কোনো যানবাহন পাচ্ছি না। একটা কাজ করেন, আমাকে আপনাদের গাড়িতে তুলে একটু বকশীবাজারে নামিয়ে দেন।
ওরা আমাকে গাড়ি করে বকশীবাজারের মোড়ে নামিয়ে দিয়েছিলেন। আমি জানি, পুলিশ সম্পর্কে মানুষের ধারণা, যাকে বলে, পারসেপশন, সেটা নেতিবাচক। কারা দুর্নীতি বেশি করে, অর্থমন্ত্রী সেই দিনও যে তালিকা দিয়েছেন, তাতে পুলিশের নাম আছে।
কিন্তু আমি সাধারণভাবে, অতিসরলীকৃতভাবে কথা বলতে চাই না। ভালো মানুষ সব পেশাতেই আছেন। খারাপ মানুষও সব পেশাতেই আছেন। সাংবাদিকদের মধ্যেও ভালো-খারাপ আছে।
পুলিশের বর্তমান আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকারকে অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি মৃদভাষী অমায়িক একজন মানুষ বলে আমার মনে হয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার বেনজির আহমেদের একটা বক্তৃতা শুনে আমি কী যে মুগ্ধ হয়েছি। নিখোঁজ মানুষদের সন্ধানে একটা আশ্রয়কেন্দ্র হবে, সেই উপলক্ষে একটা অনুষ্ঠানে তিনি বক্তৃতা করলেন। তিনি এই উপমহাদেশে কত কারণে মানুষ হারিয়ে যায়, তার সামাজিক কারণ, ঐতিহাসিক কারণ, আমাদের প্রাচীন সাহিত্যে কোথায় কবে হারিয়ে যাওয়ার কী প্রসঙ্গ আছে, এমন সুন্দর করে বললেন যে আমি একেবারে থ বনে গেলাম। আমার লেখা ছাপা হলে যাঁরা সেটার ভালোমন্দ আলোচনা করতে ফোন করেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই পুলিশ অফিসার। সেদিনও পুলিশের একজন ডিআইজির সঙ্গে দেখা হলো, তিনি গোয়েন্দা শাখায় আছেন, প্রথম কথাই হলো, আনিস ভাই, আমরা কিন্তু আপনার ‘মা’ বইয়ের ভক্ত। আমি এটা জানি, মা বইটা পুলিশের অনেক কর্তা নিজেরা পড়েন, আর অন্যদের কিনে কিনে উপহার দেন। এই নিয়ে তাঁদের সঙ্গে আমার অনেকবার কথা হয়েছে। কমিউনিটি পুলিশ নামে একটা আন্দোলন পুলিশ করার চেষ্টা করছে, আমি তাদের অনুষ্ঠানে মিরপুরে ও উত্তরায় বক্তৃতা দিতে গেছি।
আর আমি ভুলতে পারি না যে একাত্তর সালের ২৫ মার্চ রাতে রাজারবাগ পুলিশ ব্যারাকে কী নৃশংস হামলাই না করেছিল পাকিস্তানি সেনারা। পুলিশও সেদিন বীরত্বের সঙ্গে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল, প্রতিরোধ করতে গিয়ে শহীদ হয়েছিলেন অনেকেই। সেই সব শহীদের নাম রাজারবাগের স্মৃতিফলকে উৎকীর্ণ আছে।
আমি যখন কোনো মোড়ে যানজটে আটকা পড়ি, আমি পুলিশ কনস্টেবলদের দেখি, কী রোদে কী বৃষ্টিতে এই বিশৃঙ্খল যানগুলোকে ‘লাইনে’ আনতে কী প্রাণান্তকর পরিশ্রমই তাঁরা করছেন। দূষণকারী ধোঁয়ার মধ্যে নিজেকে ক্ষয়ে দিতে দিতে যানবাহনের গতিটাকে সচল রাখতে কী মরিয়া চেষ্টাই না করে চলেছেন বেচারা।
কাজেই পুলিশকে যখন ঢালাওভাবে গালিগালাজ করা হয়, আমি সেটাকে সমর্থন করতে পারি না।
কিন্তু এর সঙ্গে যখন সহকারী কমিশনার শহীদুল ইসলামের উক্তি মেলাই, সাংবাদিক মারলে কিছু হয় না, তখন সত্যি ভীষণ অপমানিত বোধ করি।
এই মানসিকতা, এই মনোভাবের উৎস কী?
আইনের বাইরে গিয়ে, এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে পুলিশি পদক্ষেপকে যখন রাষ্ট্র উৎসাহিত করছে, এর একটা প্রভাব এই ধরনের মানসিকতার একটা কারণ হতে পারে।
রাজনৈতিক স্বার্থে পুলিশের অপব্যবহার বন্ধ করতে হবে।
আর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায় আছে, অবশেষে পুলিশও গাইল রবীন্দ্রসংগীত।
সত্যি সত্যি পুলিশকে সুসংস্কৃত, সুশিক্ষিত হতে হবে। আমি আমার চেয়ে অনেক গুণ বেশি লেখাপড়া করা, সংস্কৃতিচর্চা করা পুলিশের দেখা পেয়েছি। তাঁদের এই সংস্কৃতিবোধটা পুরো পুলিশ বাহিনীতেই ছড়িয়ে দিতে হবে। সে জন্য যেমন তাঁদের প্রশিক্ষণের মধ্যে মূল্যবোধ জাগ্রত করে তুলতে হবে যে প্রতিটা মানুষ সমান, প্রতিটা মানুষের জীবন মূল্যবান, প্রতিটা মানুষের সম্মানই সম্মান, পুলিশের কাজ মানুষকে রক্ষা করা, তাকে আহত করা, অসম্মান করা নয়; তেমনি এর অন্যথা হলে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিমূলক ব্যবস্থাই নিতে হবে। যাতে কতিপয়ের জন্য সমগ্রের সম্মানহানি না ঘটে।
এই একটা ক্ষেত্রে কী ব্যবস্থা পুলিশ প্রশাসন গ্রহণ করে, তা শেষ পর্যন্ত মনিটর করার জন্য আমি সাংবাদিকদের অনুরোধ করব।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
প্রথম আলোর ফটোসাংবাদিক খালেদ সরকার আর প্রদায়ক হাসান ইমামের ওই সময় (শনিবার, ২৬ মে, ২০১২, সকালবেলা) আগারগাঁওয়ের দিকে যাওয়ার কথা নয়। আমার বন্ধু নদী-বিশেষজ্ঞ ড. মনসুর রহমান ফোন করে আমাকে জানালেন, আগারগাঁওয়ে এক মিলনায়তনে তাঁরা একটা আন্তর্জাতিক সেমিনার করছেন। দেশ-বিদেশের বিশেষজ্ঞরা একটা জনবহুল বদ্বীপের মানুষ কীভাবে বেঁচে থাকবে, কীভাবে দারিদ্র্যমুক্ত থাকতে পারবে, তাই নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা তুলে ধরবেন। আমি সেই খবর ও ছবি সংগ্রহ করার জন্য অনুরোধ করেছিলাম সংশ্লিষ্টদের। সেই খবর সংগ্রহ করতেই আলোকচিত্রী খালেদ সরকার আর প্রদায়ক হাসান ইমাম আগারগাঁওয়ে গিয়েছিলেন। খবর ও ছবি সংগ্রহ করে তাঁরা ফিরছিলেন।
ওই সময় তাঁরা দেখেন, রাস্তায় পলিটেকনিকের ছাত্রীরা বিক্ষোভ করছেন।
খালেদ সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা থেকে মাস্টার্স পাস করে প্রথম আলোয় আলোকচিত্র সাংবাদিকতা করেন। অত্যন্ত বিনয়ী, সদাহাসিমুখ, কর্তব্যপরায়ণ। রাস্তায় একটা ঘটনা ঘটছে, খালেদ ছবি তুলতে আরম্ভ করেন। অন্যদিকে এই ঘটনার ছবি তুলতেই আসেন প্রথম আলোর সাংবাদিক জাহিদুল করিম ও সাজিদ হোসেন।
তখন বিক্ষোভ প্রায় প্রশমিত হয়ে পড়েছে। কিন্তু ছাত্রীরা তখনো রাস্তায় রয়ে গেছে। হঠাৎ কোনো ঘটনা ঘটলে ‘এক্সক্লুসিভ’ ছবি পাবেন, এই আশায় এক ফটোসাংবাদিক ফাঁকা রাস্তায় একটা পুলিশের গাড়ির পেছনে মোটরসাইকেল চালিয়ে যেতে থাকেন।
এই সময়েই পুলিশের সঙ্গে তাঁর কথা-কাটাকাটি হয়। পুলিশ বলে, আপনারা এই রাস্তায় মোটরসাইকেল নিয়ে আসছেন কেন? সাংবাদিক বলেন, ছবি তুলতে। একপর্যায়ে বলেন, যদি কোনো অপরাধ হয়ে থাকে, আপনি মামলা করেন। গালিগালাজ করছেন কেন?
যাঁদের হাতে লাঠি আছে, অস্ত্র আছে, তাঁরা গালিগালাজ করবেন, তাঁদের কি জিজ্ঞেস করতে আছে, গালি দিচ্ছেন কেন?
পুলিশের কর্তা নির্দেশ দেন পেটাও। সাংবাদিক পেটালে কিছু হয় না।
তারপর শুরু হয় বৃষ্টির মতো মার। কলার ধরে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে মার। রাস্তায় ফেলে মার। লাঠি দিয়ে বেধড়ক মার। কান বরাবর ঘুষি। রাইফেলের বাঁট দিয়ে মার। একজনকে মারতে দেখে আরেকজন সাংবাদিক ছুটে আসেন। তিনজন ফটোসাংবাদিকই প্রচণ্ড প্রহার-বৃষ্টির মধ্যে পড়েন।
গত পরশু ট্রমা সেন্টারে গিয়ে মারের চোটে থেঁতলানো দেহ নিয়ে পড়ে থাকা তিন সাংবাদিককে দেখতে যাই। একজন বলেন, কোত্থেকে সাদা পোশাকের পুলিশ এসে যে চড়াও হয় এবং প্রচণ্ড মার মারতে থাকে, আল্লাহই জানেন।
মারের চোটে একজনের ঠোঁট কেটে গেছে, দড়দড়িয়ে রক্ত পড়ছে। শরীর জোড়া তাঁদের মারের দাগ। ভেতরে মাংস থেঁতলে গেছে। সাজিদের কানের পেছনে এমন ঘুষি মেরেছে, ফুলে কালো হয়ে আছে জায়গাটা। আমাদের নিরীহ প্রদায়ক মোবাইল ফোনে এই মারধরের ছবি তুলছিলেন, এবার পুলিশ চড়াও হয় তাঁর ওপর। তাঁকে বেধড়ক কিলঘুষি মেরে তাঁর মোবাইল কেড়ে নেয়।
ওই পুলিশ সদস্যদের বড় আক্রোশ ছিল ক্যামেরার ওপর। তারা ক্যামেরা ছিনিয়ে নিতে চায়। ক্যামেরা নিয়ে টানাটানি হয়। শেষ পর্যন্ত ক্যামেরা তারা কেড়ে নিয়েই ছাড়ে। এই সাংবাদিকদের থানায় নিয়ে যাওয়ার পথে সারা পথে কিলঘুষি-চড় মারা হয়।
এসি শহীদুলের উক্তিটা তাৎপর্যপূর্ণ। ‘এই রকম কত সাংবাদিক দেখছি, কত মারছি। এগুলান রে মারলে কিছু হয় না।’
এখানেই আসে আমার দ্বিতীয় অনুভূতিটার কথা। অপমানবোধ। পুলিশ কিন্তু সাংবাদিকদের মার শুরু করেছে কিলঘুষি-চড় দিয়ে, কলার ধরে টানাটানি দিয়ে। একজন সাংবাদিক হিসেবে এই চড় আমার নিজের গালে এসে লাগছে। আর ওই কথাটা? সাংবাদিক পেটালে কিছু হয় না। সত্যি তো, কিছু হয় না। আমার ছোট ভাই সাগর সরওয়ার, আমার ছোট বোন মেহেরুন রুনি নিজ বাড়িতে নৃশংসভাবে খুন হলো, তাদের দেবদূতের মতো ছেলেটা, মেঘ, বাবা-হত্যার বিচার দাবিতে রাস্তায় পর্যন্ত নামল, কী হয়েছে? কিছু হয় না তো আসলে।
ট্রমা সেন্টারে যখন আমি আহত ক্ষত-বিক্ষত সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলি, ওঁরা বলেন, কোথাও কোনো বড় গণ্ডগোল হলে সাংবাদিকেরা মারের মধ্যে পড়ে যান, আহত হন, আমরা তো সেটা আমাদের কাজের অংশই ধরে নিয়েছি। কিন্তু কোনো কারণ ছাড়া, কোনো উত্তেজনা ছাড়া শুধু সাংবাদিক পেটানোর জন্যই একযোগে নিরস্ত্র কর্তব্যরত সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হওয়া আর নির্মমভাবে মারা, যেন একটা স্যাডিজমের লক্ষণ; অন্যকে পীড়িত-অত্যাচারিত হতে দেখে আনন্দিত হওয়া।
এ থেকে একটা সার্বিক নিরাপত্তাহীনতার বোধ তৈরি হয়। সাগর-রুনি মারা যাচ্ছেন নিজের বাড়িতে, বিদেশি কূটনীতিক মারা যাচ্ছেন রাস্তায়, রাজনৈতিক নেতা বা গার্মেন্টস শ্রমিক নেতা হারিয়ে যাচ্ছেন রাজপথ থেকে, পুলিশ রাজনৈতিক নেতাদের পেটাচ্ছে, শিক্ষকদের পেটাচ্ছে, সাংবাদিকদের পেটাচ্ছে, সংসদ সদস্যকে পেটাচ্ছে। এর আগে পুলিশ কমনওয়েলথে স্বর্ণপদক পাওয়া আসিফকে পিটিয়েছিল।
সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডে কূলকিনারা না হওয়া থেকে শুরু করে গাড়িতে তিন কর্তব্যরত সাংবাদিককে তুলে সারাটা পথ পেটাতে পেটাতে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা একত্র করলে একটা তীব্র হতাশার বোধ তৈরি হয় না কি? তার মানে এটা একটা নৈরাজ্যের লক্ষণ।
পুলিশের হাতে লাঠি আছে। পুলিশের হাতে অস্ত্র আছে। সেই কারণেই তাদের শৃঙ্খলার পরিচয় দিতে হবে, সেই কারণেই তাদের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। আপনি গাড়িতে তুলে সাংবাদিককে মারলেন কোন আইনের বলে?
যদি কেউ রং সাইডে মোটরসাইকেল চালিয়ে থাকে, তাহলে তাকে আপনি মারবেন কেন? তার ক্যামেরা কেড়ে নেবেন কেন? কোন আইনের ধারায় আপনি মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিচ্ছেন। মেমরি কার্ড খুলে নিলেন কোন আইনে?
২.
অথচ পুলিশের কাছে আমরা যাই ভরসার সন্ধানে। একটা ঘটনা বলি। ১৯৯০ সালের এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় আমি একজন তরুণ সাংবাদিক, সাপ্তাহিক পূর্বাভাস নামের একটা কাগজ আমরা বের করি। যেদিন পত্রিকা ছাপা হবে, কাজ শেষ করতে করতে রাত হয়ে যায়। স্টেডিয়ামের পত্রিকা অফিস থেকে বের হয়ে প্রেসক্লাবের সামনে দিয়ে হাঁটছি, এরই মধ্যে কারফিউ শুরু হয়ে গেছে। কোনো যানবাহন নেই রাস্তায়। আমাকে যেতে হবে বকশীবাজার। একটা পুলিশের গাড়ি এসে আমার পাশে থামে। আমাকে বলে, কারফিউ শুরু হয়ে যাচ্ছে, আপনি কই যান? আমি বলি, আমি সাংবাদিক, কাজ শেষ করে ঘরে ফিরছি। ওরা বলেন, রাস্তায় মিলিটারি নেমেছে, আমরা না হয় আপনাকে ছেড়ে দিলাম, মিলিটারির সামনে পড়লে যদি আপনার কিছু হয়। আমি বলি, আমি তো কোনো যানবাহন পাচ্ছি না। একটা কাজ করেন, আমাকে আপনাদের গাড়িতে তুলে একটু বকশীবাজারে নামিয়ে দেন।
ওরা আমাকে গাড়ি করে বকশীবাজারের মোড়ে নামিয়ে দিয়েছিলেন। আমি জানি, পুলিশ সম্পর্কে মানুষের ধারণা, যাকে বলে, পারসেপশন, সেটা নেতিবাচক। কারা দুর্নীতি বেশি করে, অর্থমন্ত্রী সেই দিনও যে তালিকা দিয়েছেন, তাতে পুলিশের নাম আছে।
কিন্তু আমি সাধারণভাবে, অতিসরলীকৃতভাবে কথা বলতে চাই না। ভালো মানুষ সব পেশাতেই আছেন। খারাপ মানুষও সব পেশাতেই আছেন। সাংবাদিকদের মধ্যেও ভালো-খারাপ আছে।
পুলিশের বর্তমান আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকারকে অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি মৃদভাষী অমায়িক একজন মানুষ বলে আমার মনে হয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার বেনজির আহমেদের একটা বক্তৃতা শুনে আমি কী যে মুগ্ধ হয়েছি। নিখোঁজ মানুষদের সন্ধানে একটা আশ্রয়কেন্দ্র হবে, সেই উপলক্ষে একটা অনুষ্ঠানে তিনি বক্তৃতা করলেন। তিনি এই উপমহাদেশে কত কারণে মানুষ হারিয়ে যায়, তার সামাজিক কারণ, ঐতিহাসিক কারণ, আমাদের প্রাচীন সাহিত্যে কোথায় কবে হারিয়ে যাওয়ার কী প্রসঙ্গ আছে, এমন সুন্দর করে বললেন যে আমি একেবারে থ বনে গেলাম। আমার লেখা ছাপা হলে যাঁরা সেটার ভালোমন্দ আলোচনা করতে ফোন করেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই পুলিশ অফিসার। সেদিনও পুলিশের একজন ডিআইজির সঙ্গে দেখা হলো, তিনি গোয়েন্দা শাখায় আছেন, প্রথম কথাই হলো, আনিস ভাই, আমরা কিন্তু আপনার ‘মা’ বইয়ের ভক্ত। আমি এটা জানি, মা বইটা পুলিশের অনেক কর্তা নিজেরা পড়েন, আর অন্যদের কিনে কিনে উপহার দেন। এই নিয়ে তাঁদের সঙ্গে আমার অনেকবার কথা হয়েছে। কমিউনিটি পুলিশ নামে একটা আন্দোলন পুলিশ করার চেষ্টা করছে, আমি তাদের অনুষ্ঠানে মিরপুরে ও উত্তরায় বক্তৃতা দিতে গেছি।
আর আমি ভুলতে পারি না যে একাত্তর সালের ২৫ মার্চ রাতে রাজারবাগ পুলিশ ব্যারাকে কী নৃশংস হামলাই না করেছিল পাকিস্তানি সেনারা। পুলিশও সেদিন বীরত্বের সঙ্গে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল, প্রতিরোধ করতে গিয়ে শহীদ হয়েছিলেন অনেকেই। সেই সব শহীদের নাম রাজারবাগের স্মৃতিফলকে উৎকীর্ণ আছে।
আমি যখন কোনো মোড়ে যানজটে আটকা পড়ি, আমি পুলিশ কনস্টেবলদের দেখি, কী রোদে কী বৃষ্টিতে এই বিশৃঙ্খল যানগুলোকে ‘লাইনে’ আনতে কী প্রাণান্তকর পরিশ্রমই তাঁরা করছেন। দূষণকারী ধোঁয়ার মধ্যে নিজেকে ক্ষয়ে দিতে দিতে যানবাহনের গতিটাকে সচল রাখতে কী মরিয়া চেষ্টাই না করে চলেছেন বেচারা।
কাজেই পুলিশকে যখন ঢালাওভাবে গালিগালাজ করা হয়, আমি সেটাকে সমর্থন করতে পারি না।
কিন্তু এর সঙ্গে যখন সহকারী কমিশনার শহীদুল ইসলামের উক্তি মেলাই, সাংবাদিক মারলে কিছু হয় না, তখন সত্যি ভীষণ অপমানিত বোধ করি।
এই মানসিকতা, এই মনোভাবের উৎস কী?
আইনের বাইরে গিয়ে, এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে পুলিশি পদক্ষেপকে যখন রাষ্ট্র উৎসাহিত করছে, এর একটা প্রভাব এই ধরনের মানসিকতার একটা কারণ হতে পারে।
রাজনৈতিক স্বার্থে পুলিশের অপব্যবহার বন্ধ করতে হবে।
আর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায় আছে, অবশেষে পুলিশও গাইল রবীন্দ্রসংগীত।
সত্যি সত্যি পুলিশকে সুসংস্কৃত, সুশিক্ষিত হতে হবে। আমি আমার চেয়ে অনেক গুণ বেশি লেখাপড়া করা, সংস্কৃতিচর্চা করা পুলিশের দেখা পেয়েছি। তাঁদের এই সংস্কৃতিবোধটা পুরো পুলিশ বাহিনীতেই ছড়িয়ে দিতে হবে। সে জন্য যেমন তাঁদের প্রশিক্ষণের মধ্যে মূল্যবোধ জাগ্রত করে তুলতে হবে যে প্রতিটা মানুষ সমান, প্রতিটা মানুষের জীবন মূল্যবান, প্রতিটা মানুষের সম্মানই সম্মান, পুলিশের কাজ মানুষকে রক্ষা করা, তাকে আহত করা, অসম্মান করা নয়; তেমনি এর অন্যথা হলে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিমূলক ব্যবস্থাই নিতে হবে। যাতে কতিপয়ের জন্য সমগ্রের সম্মানহানি না ঘটে।
এই একটা ক্ষেত্রে কী ব্যবস্থা পুলিশ প্রশাসন গ্রহণ করে, তা শেষ পর্যন্ত মনিটর করার জন্য আমি সাংবাদিকদের অনুরোধ করব।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন