আহমদ আশিকুল হামিদ :
২৪ মে'র একই দিনের সংবাদপত্রে দুটি খবর বেরিয়েছে। একটি বলা হয়েছে, ভারতকে দেয়া ট্রানজিট-করিডোরের সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য সরকার বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সমন্বয়ে একটি ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করেছে। দ্বিতীয় খবরটি হলো, ভারতের বাণিজ্যিক কোম্পানি সাহারাকে সরকার ঢাকার চারদিকে স্যাটেলাইট উপশহর নির্মাণ করার সুযোগ দিয়েছে। এ বিষয়ে রাজউকের সঙ্গে চুক্তি করার জন্য সাহারার চেয়ারম্যান ঢাকায় এসেছেন। দুটি খবরই বাংলাদেশকে ভারতের ইচ্ছাধীন করার দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। একই নিবন্ধে দুটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা সম্ভব নয় বলে আজ শুধু ট্রানজিট-করিডোরের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা হবে। কিন্তু তারও আগে দিনকয়েক আগের একটি খবর জানিয়ে রাখি।
ভারতের রাজ্য পশ্চিম বঙ্গের একটি টিভি চ্যানেলে সম্প্রতি ‘মিরাক্কেল' নামের একটি প্রতিযোগিতার অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়েছে। বাংলাদেশেরও কয়েকজন অংশ নিয়েছিল বলে এটা নাকি বাংলাদেশেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। ‘মিরাক্কেল'-এর শেষ অনুষ্ঠানে ভারতীয় উপস্থাপক আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে ব্যঙ্গ-তামাশা করেছে। শেখ হাসিনাকে বলেছে ‘হাসি- না'! শুধু তা-ই নয়, ওই উপস্থাপক একাধিকবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের ‘মুখ্যমন্ত্রী' বলে উল্লেখ করেছে। বাংলাদেশী যারা অংশ নিয়েছে তারা কিন্তু প্রতিবাদ জানায়নি। তারা সম্ভবত অতীতের একটি ঘটনা স্মরণ করে থাকবে। পাঠকদেরও মনে পড়তে পারে, এর আগেরবার প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে পশ্চিম বঙ্গে সফরে গেলে শেখ হাসিনাকে কপালে সিঁদুর ও চন্দন তিলক লাগানো হয়েছিল। সেবারও তাকে ‘মুখ্যমন্ত্রী' বলেই সম্বোধন করা হয়েছিল। কিন্তু শেখ হাসিনা বা তার সঙ্গের লোকজন প্রতিবাদ জানাননি। সে কারণেই সম্ভবত ‘মিরাক্কেল'-এ অংশগ্রহণকারী বাংলাদেশী প্রতিযোগীরাও চুপচাপই থেকেছে। যার মাথা তিনি নিজে যদি ব্যথায় কাতর না হন তাহলে অন্যরা কেন তার জন্য অযথা ঝামেলা করতে যাবে!
কপালে সিঁদুর ও চন্দন তিলক লাগানো থেকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে ‘মুখ্যমন্ত্রী' বলে সম্বোধন করা পর্যন্ত বিষয়গুলোকে অবশ্যই হাল্কাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। এসবের মধ্য দিয়ে প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতীয়দের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনারই ঘটনাক্রমিক প্রকাশ ঘটে চলেছে। বলা বাহুল্য, সবকিছুর পেছনে রয়েছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের সমর্থন ও সহযোগিতা। বিষয়টি পরিষ্কার হবে যদি ট্রানজিট-করিডোর সংক্রান্ত ওয়ার্কিং কমিটি গঠনের খবরটি লক্ষ্য করা যায়। খবরে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের রেল, সড়ক ও নৌপথ দিয়ে ভারতীয় যানবাহনের চলাচল ও পণ্যের আনা-নেয়া যাতে নির্বিঘ্নে হতে পারে এবং কর, শুল্ক বা ফি আদায়ের নামে যাতে কোনো জটিলতার সৃষ্টি না হয় সেসব মনিটর করাই হবে কমিটির কাজ। অর্থাৎ ভারতকে ট্রানজিট-করিডোর দেয়া হবে কি হবে না সেটা এখন আর আদৌ বিবেচ্য বিষয় নয়। দেশপ্রেমিকদের প্রতিবাদ ও বিরোধিতাকে পাত্তা পর্যন্ত না দিয়ে সরকার ভারতকে ট্রানজিট-করিডোর দিয়ে ফেলেছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে সফরে এসে বিষয়টি চূড়ান্ত করে গেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। সে সময় সম্পাদিত ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাগ্রিমেন্টের মাধ্যমেই ভারতকে ট্রানজিট-করিডোর দিয়েছে সরকার। এখন চলছে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের আনুষ্ঠানিকতা। সে দিকে যাওয়ার আগে একটি বিশেষ তথ্য উল্লেখ করা দরকার।
তথ্যটি হলো, নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও সরকার কোনো চুক্তির ব্যাপারেই কিন্তু জাতীয় সংসদে যাচ্ছে না। অনুমোদন নেয়া দূরে থাকুক জাতীয় সংসদকে আগে থেকে অবহিত পর্যন্ত করছে না। এসব চুক্তি সম্পাদনের সমগ্র প্রক্রিয়ায় মাতববরি করছেন প্রধানমন্ত্রীর অরাজনৈতিক উপদেষ্টারা। তাদের হুকুমই তামিল করতে হচ্ছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে। ট্রানজিট-করিডোর সংক্রান্ত ওয়ার্কিং কমিটি গঠনের ক্ষেত্রেও প্রধানমন্ত্রীর অর্থবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমানকেই কর্তৃত্ব করতে দেখা গেছে। প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, আইন মন্ত্রণালয় ভারতকে ট্রানজিট-করিডোরের সুবিধা দেয়ার বিরুদ্ধে কঠিন অবস্থান নিয়েছিল। কিন্তু অতীতের অন্য কিছু উপলক্ষের মতো এবারও উপদেষ্টা মশিউর রহমান চাপ সৃষ্টি করেছেন, ভয়-ভীতি দেখিয়েছেন। এর ফলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও আইন মন্ত্রণালয়কে আলোচ্য কমিটি গঠন এবং ভারতীয় যানবাহনের চলাচল ও পণ্য আনা-নেয়ার ব্যাপারে ‘সম্মতি' জানাতে হয়েছে। কর, শুল্ক বা ফি আদায়ের ব্যাপারেও উপদেষ্টা ধমকই দিয়েছেন। বলেছেন, ট্রানজিট-করিডোরের কোনো ‘সভ্য' রাষ্ট্র তার প্রতিবেশীদের কাছ থেকে কোনো রকমের মাশুল বা অর্থ আদায় করে না। অর্থাৎ যানবাহনই শুধু নয়, ভারতীয় পণ্যের জন্যও বাংলাদেশ কোনোরকমের কর, শুল্ক বা ফি আদায় করতে পারবে না। আপত্তি উঠেছে এজন্য যে, ভারতকে ট্রানজিট-করিডোর দেয়ার প্রশ্নে প্রথম থেকে প্রধানমন্ত্রীসহ ক্ষমতাসীনরা হাজার হাজার কোটি টাকা আয়ের গালগল্প শুনিয়ে এসেছেন। বলেছেন, ট্রানজিট-করিডোর দেয়া হলে এত বেশি টাকা আয় হবে যে, দেশে কর্মসংস্থানের একেবারে বন্যা বইতে শুরু করবে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত তো দেশকে ‘ভাড়া' পর্যন্ত খাটাবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। অন্যদিকে এখন দেখা যাচ্ছে, আয় দূরে থাকুক, বাংলাদেশকে উল্টো ভারতীয় যানবাহন ও পণ্যের চলাচল নিশ্চিত করার জন্য দু'দিন পরপরই নিজের টাকায় রাস্তাঘাট মেরামত করতে হবে। একই কথা রেলপথ ও নৌবন্দরের ক্ষেত্রেও সত্য। এজন্যই সাড়ে তিন বছরের মাথায় এসে সরকার ভারতীয় যানবাহন ও পণ্যেও চলাচল নিশ্চিত করার জন্য আন্তঃমন্ত্রণায়লয় ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করেছে।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে এমন কিছুই যে ঘটবে সে কথা কিন্তু দেশপ্রেমিকরা প্রথম থেকেই বলে এসেছেন। হঠাৎ শুনতে খারাপ লাগতে পারে, কিন্তু সত্য হলো, এই সরকার বাংলাদেশকে ভারতের অধীনস্থ একটি রাজ্য বানানোর লক্ষ্য নিয়ে এরই মধ্যে বহুদূর এগিয়ে গেছে। উদাহরণ দেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-এর সফরকালে সম্পাদিত ‘ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাগ্রিমেন্ট' বা কাঠামোগত চুক্তির উল্লেখ করা যায়। চুক্তিটির পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এর মাধ্যমে বাংলাদেশকে সর্বাত্মকভাবেই ভারতের ইচ্ছাধীন করা হয়েছে। এই চুক্তি ১৯৭২ সালের ২৫ বছর মেয়াদী চুক্তির চাইতেও ভয়াবহ। আগের চুক্তিতে তবু ২৫ বছরের মেয়াদ ছিল, যার পর চুক্তি বহাল রাখা বা না রাখার অধিকার পেয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু ‘ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাগ্রিমেন্টে' কোনো মেয়াদের উল্লেখ নেই। অর্থাৎ বাংলাদেশ কখনো এই চুক্তি বাতিল বা অকার্যকর করার সুযোগ পাবে না। সে অধিকারই চুক্তিতে দেয়া হয়নি। চুক্তিটিতে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও সামরিক সকল দিক থেকেই বাংলাদেশকে গোলামির জিঞ্জিরে বেঁধে ফেলেছে ভারত। এই চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ভারতের অভ্যত্মরীণ সকল বিষয়ে বাংলাদেশকে ভারতের পক্ষে ভুমিকা পালন করতে হবে। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে চলমান স্বাধীনতা সংগ্রামকে ধ্বংস করে দেয়ার প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশকে এমনকি সামরিকভাবেও জড়িয়ে পড়তে হবে। যার ফলে বিশেষ করে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর যুদ্ধ চলে আসবে বাংলাদেশের ভেতরে।
‘ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাগ্রিমেন্টে' অনুযায়ী বাংলাদেশের স্বাধীন কোনো পররাষ্ট্রনীতি থাকতে পারবে না। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ভারতকে অনুসরণ করতে হবে। এমন কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পর্ক রাখতে ও বাণিজ্যসহ দ্বিপাক্ষিক ভিত্তিতে লেনদেন করতে পারবে না যার সঙ্গে ভারতের শত্রুতা রয়েছে। বিষয়টি গুরুত্ব অর্জন করেছে বিশেষ করে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক এবং বাংলাদেশের প্রতিরক্ষার দৃষ্টিকোণ থেকে। কারণ, গণচীনের আন্তরিক সমর্থন ও সহযোগিতা নিয়েই গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী। গাজীপুরস্থ সমরাস্ত্র কারখানায় অস্ত্র তৈরির মাধ্যমে তো বটেই, রফতানির পথেও গণচীনই বাংলাদেশকে অস্ত্রশস্ত্রের যোগান দিয়ে চলেছে। ট্যাংক থেকে যুদ্ধ বিমান পর্যন্ত বাংলাদেশের ৯০ শতাংশেরও বেশি সমরাস্ত্র এসেছে গণচীন থেকে। অর্থাৎ গণচীনের সহযোগিতা ছাড়া বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর পক্ষে যুদ্ধ করার কথা কল্পনা করাও সম্ভব নয়। এমন বিশ্লেষণের ভিত্তিতে বলা যায়, ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাগ্রিমেন্টের ফলে চীনের সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত সুসম্পর্ক বাধাগ্রস্ত হবে। কারণ, সরকারের এই ভারতপ্রীতিকে চীন সহজভাবে নাও নিতে পারে। চীন ও ভারতের দ্বনদ্বমূলক দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে তো বটেই, নিজের সমরাস্ত্রের গোপনীয়তা রক্ষার ব্যাপারে চীনের সতর্কতাও একটি বড় কারণ হয়ে উঠবে। এর ফলে বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্কে অবনতি ঘটতে পারে, চীন এমনকি সামরিক সহযোগিতা বন্ধও করতে পারে। তেমন অবস্থায় বাংলাদেশকে সম্পূর্ণরূপেই ভারতের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে হবে- যার অর্থ, বাংলাদেশ আসলে ভারতের অধীনস্থ হয়ে পড়বে।
ভারতকে দেয়ার ব্যাপারে বাকি ছিল শুধু ট্রানজিট-করিডোরের আনুষ্ঠানিকতা। ওয়ার্কিং কমিটি গঠনের মাধ্যমে সেটাই এবার চূড়ান্ত করা হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এর মধ্য দিয়ে সরকারের ভারতের স্বার্থে ভূমিকা পালনের গোপন উদ্দেশ্যেরই প্রকাশ ঘটেছে। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা এবং রেল, সড়ক ও নৌপথের দুরবস্থার মতো বাস্তব অনেক কারণের পাশাপাশি উল্লেখ করা দরকার, নানা চুক্তির আড়ালে ভারতকে উজাড় করে দিলেও সরকার দেশের স্বার্থে কিন্তু কোনো কিছুই আদায় বা অর্জন করতে পারেনি, পারছেও না। সর্বশেষ উদাহরণ হিসেবে তিস্তা চুক্তির কথা উল্লেখ করলেই সরকারের ব্যর্থতা ও অযোগ্যতার বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তির একটি মাত্র অজুহাত দেখিয়েই ভারত তিস্তা চুক্তিকে হিমাগারে পাঠিয়ে দিয়েছে। কিন্তু পাল্টা ব্যবস্থা নেয়ার ধারেকাছে যাওয়ার পরিবর্তে সরকার একই ভারতের জন্য ট্রানজিট-করিডোরের পরিপূর্ণ সুবিধা নিশ্চিত করতে উঠেপড়ে লেগেছে। এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত অনেক আগেই নেয়া হলেও কর, শুল্ক বা ফি আদায় করা না করার বিষয়টি বাকি ছিল। সেটাও এবার পাকাপাকি করেছেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থবিষয়ক উপদেষ্টা। অর্থাৎ যানবাহনই শুধু নয়, ভারতীয় পণ্যের জন্যও বাংলাদেশ কোনো রকমের কর, শুল্ক বা ফি আদায় করতে পারবে না।
প্রসঙ্গক্রমে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে উপদেষ্টাদের দাপটের কথা উল্লেখ করা দরকার। যেমন মনমোহন সিং-এর সফরকেন্দ্রিক ঘটনাপ্রবাহে দেখা গেছে, প্রধানমন্ত্রী সর্বতোভাবে দু'জন মাত্র উপদেষ্টার হাতে সবকিছু ছেড়ে দিয়েছিলেন। একজন হলেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান এবং দ্বিতীয়জন পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী। ভারতকে ট্রানজিট দেয়া থেকে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য, ছিটমহলসহ সীমান্ত সমস্যা এবং তিস্তাসহ বিভিন্ন নদ-নদীর পানিবণ্টন চুক্তি পর্যন্ত কোনো একটি বিষয়ে আয়োজনের সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের কারো ভূমিকা ‘দৃশ্যমান' ছিল না। মনেই হয়নি, দেশে পররাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, যোগাযোগমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, নৌপরিবহণমন্ত্রী এবং পানিসম্পদমন্ত্রী রয়েছেন। কারণ, এত বেশি বিষয়ে চুক্তি ও সমঝোতাপত্রে স্বাক্ষর করার সব আয়োজনের জন্য দু'জন মাত্র উপদেষ্টাকেই দৌড়ঝাঁপ করতে দেখা গেছে। অথচ ‘সুপার উপদেষ্টা' হিসেবে পরিচিতি পাওয়া দু'জনের কেউই কিন্তু ‘নির্বাচিত' জনপ্রতিনিধি নন। সাধারণ মানুষও তাদের সম্পর্কে খু্ব একটা জানে না। তা সত্ত্বেও তাদের মর্জিমাফিকই প্রতিটি বিষয়ে চুক্তি ও সমঝোতা স্বাক্ষরের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীরা পাত্তাই পাননি। দীপু মনিকে তো বটেই, সাহারা খাতুন থেকে বৃদ্ধ আবুল মাল আবদুল মুহিত পর্যন্ত প্রত্যেক মন্ত্রীকে সোজা দর্শকের গ্যালারিতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন দুই ‘সুপার উপদেষ্টা'। ফলে ট্রানজিট নিয়ে যার কথা বলার কথা সে যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন সড়ক মেরামত করে বেড়িয়েছেন। ছিটমহল বিনিময়ের ব্যাপারে কিছুই জানতে পারেননি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন। দুর্দান্ত দাপটের বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খানেরও কোনো খবর ছিল না। তিস্তাচুক্তি ও পানিবণ্টন নিয়ে এই যে এত হইচই হয়েছে এসব সম্পর্কে কিছুই জানানো হয়নি পানিসম্পদমন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেনকে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর সচিব ও কর্মকর্তাদেরও ছিল একই অবস্থা। সবাইকে অন্ধকারে রেখে কাজ গুছিয়েছিলেন দুই ‘সুপার উপদেষ্টা'। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠেছিল, বাংলাদেশে ‘নির্বাচিত' ও ‘গণতান্ত্রিক' সরকারের আড়ালে অন্য কোনো সরকারের রাজত্ব চলেছে কি না।
বর্তমান পর্যায়েও ব্যতিক্রম হয়নি। ওয়ার্কিং কমিটি গঠনের ব্যাপারে সবকিছুই করেছেন মশিউর রহমান। এমনকি আইন মন্ত্রণালয়কেও তার হুকুমই তামিল করতে হয়েছে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, ভারতের স্বার্থ উদ্ধার করে দেয়ার কর্মকান্ডে পারঙ্গমতা দেখালেও একই উপদেষ্টারা কিন্তু দেশের স্বার্থে কোনো ‘গড়ই' ওল্টাতে পারেননি। তিস্তা চুক্তির কথাই ধরা যাক। ১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি অনুযায়ী বেরুবাড়ি হস্তান্তরের প্রশ্নে ভারত ‘বাঙ্গালকে' তাদের ‘হাই কোর্ট' দেখিয়েছিল, এবার তিস্তা চুক্তির বিষয়ে সামনে এনেছে পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। কিন্তু এত যে পারঙ্গম উপদেষ্টারা তারা কিন্তু এখনো পর্যন্ত ভারতকে দিয়ে তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষর করাতে পারেননি। সে তারাই আবার ভারতের যানবাহন ও পণ্যের চলাচল নিশ্চিত করার জন্য ধেই ধেই করে নেচে বেড়াচ্ছেন! সামান্য লজ্জাও দেখা যাচ্ছে না তাদের মধ্যে। কথা অবশ্যই এমনি এমনি ওঠেনি। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা এবং সড়ক, রেলপথ ও নৌবন্দরের বেহাল দশার পাশাপাশি আপত্তির অন্য একটি কারণ হলো, বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা এতদিন রফতানির বিরাট অংশই করেছেন ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে। এবার ট্রানজিট-করিডোরের সুযোগে খোদ ভারতের ব্যবসায়ীরা ওই অঞ্চলে ঝাঁপিয়ে পড়বে। ফলে ভারতে বাংলাদেশের রফতানি অনেক কমে যাবে। এমনিতেই বাংলাদেশ ২১ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য ঘাটতির মধ্যে রয়েছে, এরপর ঘাটতি কেবল বাড়তেই থাকবে। ওদিকে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে চলছে স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম। চুক্তির আড়াল নিয়ে ভারত বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে সেনাবাহিনী পাঠানো শুরু করলে বাংলাদেশকে ভারতের অভ্যন্তরীণ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হবে। অর্থাৎ ট্রানজিট-করিডোরের বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য সব দিক থেকেই বিপজ্জনক হয়ে উঠবে। কিন্তু সব জেনে-বুঝেও সরকার ভারতকে শুধু চলাচল ও পণ্য আনানেয়ার সুযোগই দিচ্ছে না, দেশকেও ভারতের কাছে এমনভাবেই কষে বেঁধে রেখে যাচ্ছে, যাতে ভবিষ্যতে যতো দেশপ্রেমিক দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন কারো পক্ষেই এসব চুক্তি বাতিল করা বা জাতীয় স্বার্থে কোনো ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব না হয়। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, রাজনৈতিক দলগুলোকেও এত বড় একটি বিষয়ে শক্তিশালী কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে দেখা যাচ্ছে না।
২৪ মে'র একই দিনের সংবাদপত্রে দুটি খবর বেরিয়েছে। একটি বলা হয়েছে, ভারতকে দেয়া ট্রানজিট-করিডোরের সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য সরকার বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সমন্বয়ে একটি ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করেছে। দ্বিতীয় খবরটি হলো, ভারতের বাণিজ্যিক কোম্পানি সাহারাকে সরকার ঢাকার চারদিকে স্যাটেলাইট উপশহর নির্মাণ করার সুযোগ দিয়েছে। এ বিষয়ে রাজউকের সঙ্গে চুক্তি করার জন্য সাহারার চেয়ারম্যান ঢাকায় এসেছেন। দুটি খবরই বাংলাদেশকে ভারতের ইচ্ছাধীন করার দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। একই নিবন্ধে দুটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা সম্ভব নয় বলে আজ শুধু ট্রানজিট-করিডোরের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা হবে। কিন্তু তারও আগে দিনকয়েক আগের একটি খবর জানিয়ে রাখি।
ভারতের রাজ্য পশ্চিম বঙ্গের একটি টিভি চ্যানেলে সম্প্রতি ‘মিরাক্কেল' নামের একটি প্রতিযোগিতার অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়েছে। বাংলাদেশেরও কয়েকজন অংশ নিয়েছিল বলে এটা নাকি বাংলাদেশেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। ‘মিরাক্কেল'-এর শেষ অনুষ্ঠানে ভারতীয় উপস্থাপক আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে ব্যঙ্গ-তামাশা করেছে। শেখ হাসিনাকে বলেছে ‘হাসি- না'! শুধু তা-ই নয়, ওই উপস্থাপক একাধিকবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের ‘মুখ্যমন্ত্রী' বলে উল্লেখ করেছে। বাংলাদেশী যারা অংশ নিয়েছে তারা কিন্তু প্রতিবাদ জানায়নি। তারা সম্ভবত অতীতের একটি ঘটনা স্মরণ করে থাকবে। পাঠকদেরও মনে পড়তে পারে, এর আগেরবার প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে পশ্চিম বঙ্গে সফরে গেলে শেখ হাসিনাকে কপালে সিঁদুর ও চন্দন তিলক লাগানো হয়েছিল। সেবারও তাকে ‘মুখ্যমন্ত্রী' বলেই সম্বোধন করা হয়েছিল। কিন্তু শেখ হাসিনা বা তার সঙ্গের লোকজন প্রতিবাদ জানাননি। সে কারণেই সম্ভবত ‘মিরাক্কেল'-এ অংশগ্রহণকারী বাংলাদেশী প্রতিযোগীরাও চুপচাপই থেকেছে। যার মাথা তিনি নিজে যদি ব্যথায় কাতর না হন তাহলে অন্যরা কেন তার জন্য অযথা ঝামেলা করতে যাবে!
কপালে সিঁদুর ও চন্দন তিলক লাগানো থেকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে ‘মুখ্যমন্ত্রী' বলে সম্বোধন করা পর্যন্ত বিষয়গুলোকে অবশ্যই হাল্কাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। এসবের মধ্য দিয়ে প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতীয়দের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনারই ঘটনাক্রমিক প্রকাশ ঘটে চলেছে। বলা বাহুল্য, সবকিছুর পেছনে রয়েছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের সমর্থন ও সহযোগিতা। বিষয়টি পরিষ্কার হবে যদি ট্রানজিট-করিডোর সংক্রান্ত ওয়ার্কিং কমিটি গঠনের খবরটি লক্ষ্য করা যায়। খবরে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের রেল, সড়ক ও নৌপথ দিয়ে ভারতীয় যানবাহনের চলাচল ও পণ্যের আনা-নেয়া যাতে নির্বিঘ্নে হতে পারে এবং কর, শুল্ক বা ফি আদায়ের নামে যাতে কোনো জটিলতার সৃষ্টি না হয় সেসব মনিটর করাই হবে কমিটির কাজ। অর্থাৎ ভারতকে ট্রানজিট-করিডোর দেয়া হবে কি হবে না সেটা এখন আর আদৌ বিবেচ্য বিষয় নয়। দেশপ্রেমিকদের প্রতিবাদ ও বিরোধিতাকে পাত্তা পর্যন্ত না দিয়ে সরকার ভারতকে ট্রানজিট-করিডোর দিয়ে ফেলেছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে সফরে এসে বিষয়টি চূড়ান্ত করে গেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। সে সময় সম্পাদিত ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাগ্রিমেন্টের মাধ্যমেই ভারতকে ট্রানজিট-করিডোর দিয়েছে সরকার। এখন চলছে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের আনুষ্ঠানিকতা। সে দিকে যাওয়ার আগে একটি বিশেষ তথ্য উল্লেখ করা দরকার।
তথ্যটি হলো, নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও সরকার কোনো চুক্তির ব্যাপারেই কিন্তু জাতীয় সংসদে যাচ্ছে না। অনুমোদন নেয়া দূরে থাকুক জাতীয় সংসদকে আগে থেকে অবহিত পর্যন্ত করছে না। এসব চুক্তি সম্পাদনের সমগ্র প্রক্রিয়ায় মাতববরি করছেন প্রধানমন্ত্রীর অরাজনৈতিক উপদেষ্টারা। তাদের হুকুমই তামিল করতে হচ্ছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে। ট্রানজিট-করিডোর সংক্রান্ত ওয়ার্কিং কমিটি গঠনের ক্ষেত্রেও প্রধানমন্ত্রীর অর্থবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমানকেই কর্তৃত্ব করতে দেখা গেছে। প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, আইন মন্ত্রণালয় ভারতকে ট্রানজিট-করিডোরের সুবিধা দেয়ার বিরুদ্ধে কঠিন অবস্থান নিয়েছিল। কিন্তু অতীতের অন্য কিছু উপলক্ষের মতো এবারও উপদেষ্টা মশিউর রহমান চাপ সৃষ্টি করেছেন, ভয়-ভীতি দেখিয়েছেন। এর ফলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও আইন মন্ত্রণালয়কে আলোচ্য কমিটি গঠন এবং ভারতীয় যানবাহনের চলাচল ও পণ্য আনা-নেয়ার ব্যাপারে ‘সম্মতি' জানাতে হয়েছে। কর, শুল্ক বা ফি আদায়ের ব্যাপারেও উপদেষ্টা ধমকই দিয়েছেন। বলেছেন, ট্রানজিট-করিডোরের কোনো ‘সভ্য' রাষ্ট্র তার প্রতিবেশীদের কাছ থেকে কোনো রকমের মাশুল বা অর্থ আদায় করে না। অর্থাৎ যানবাহনই শুধু নয়, ভারতীয় পণ্যের জন্যও বাংলাদেশ কোনোরকমের কর, শুল্ক বা ফি আদায় করতে পারবে না। আপত্তি উঠেছে এজন্য যে, ভারতকে ট্রানজিট-করিডোর দেয়ার প্রশ্নে প্রথম থেকে প্রধানমন্ত্রীসহ ক্ষমতাসীনরা হাজার হাজার কোটি টাকা আয়ের গালগল্প শুনিয়ে এসেছেন। বলেছেন, ট্রানজিট-করিডোর দেয়া হলে এত বেশি টাকা আয় হবে যে, দেশে কর্মসংস্থানের একেবারে বন্যা বইতে শুরু করবে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত তো দেশকে ‘ভাড়া' পর্যন্ত খাটাবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। অন্যদিকে এখন দেখা যাচ্ছে, আয় দূরে থাকুক, বাংলাদেশকে উল্টো ভারতীয় যানবাহন ও পণ্যের চলাচল নিশ্চিত করার জন্য দু'দিন পরপরই নিজের টাকায় রাস্তাঘাট মেরামত করতে হবে। একই কথা রেলপথ ও নৌবন্দরের ক্ষেত্রেও সত্য। এজন্যই সাড়ে তিন বছরের মাথায় এসে সরকার ভারতীয় যানবাহন ও পণ্যেও চলাচল নিশ্চিত করার জন্য আন্তঃমন্ত্রণায়লয় ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করেছে।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে এমন কিছুই যে ঘটবে সে কথা কিন্তু দেশপ্রেমিকরা প্রথম থেকেই বলে এসেছেন। হঠাৎ শুনতে খারাপ লাগতে পারে, কিন্তু সত্য হলো, এই সরকার বাংলাদেশকে ভারতের অধীনস্থ একটি রাজ্য বানানোর লক্ষ্য নিয়ে এরই মধ্যে বহুদূর এগিয়ে গেছে। উদাহরণ দেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-এর সফরকালে সম্পাদিত ‘ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাগ্রিমেন্ট' বা কাঠামোগত চুক্তির উল্লেখ করা যায়। চুক্তিটির পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এর মাধ্যমে বাংলাদেশকে সর্বাত্মকভাবেই ভারতের ইচ্ছাধীন করা হয়েছে। এই চুক্তি ১৯৭২ সালের ২৫ বছর মেয়াদী চুক্তির চাইতেও ভয়াবহ। আগের চুক্তিতে তবু ২৫ বছরের মেয়াদ ছিল, যার পর চুক্তি বহাল রাখা বা না রাখার অধিকার পেয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু ‘ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাগ্রিমেন্টে' কোনো মেয়াদের উল্লেখ নেই। অর্থাৎ বাংলাদেশ কখনো এই চুক্তি বাতিল বা অকার্যকর করার সুযোগ পাবে না। সে অধিকারই চুক্তিতে দেয়া হয়নি। চুক্তিটিতে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও সামরিক সকল দিক থেকেই বাংলাদেশকে গোলামির জিঞ্জিরে বেঁধে ফেলেছে ভারত। এই চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ভারতের অভ্যত্মরীণ সকল বিষয়ে বাংলাদেশকে ভারতের পক্ষে ভুমিকা পালন করতে হবে। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে চলমান স্বাধীনতা সংগ্রামকে ধ্বংস করে দেয়ার প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশকে এমনকি সামরিকভাবেও জড়িয়ে পড়তে হবে। যার ফলে বিশেষ করে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর যুদ্ধ চলে আসবে বাংলাদেশের ভেতরে।
‘ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাগ্রিমেন্টে' অনুযায়ী বাংলাদেশের স্বাধীন কোনো পররাষ্ট্রনীতি থাকতে পারবে না। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ভারতকে অনুসরণ করতে হবে। এমন কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পর্ক রাখতে ও বাণিজ্যসহ দ্বিপাক্ষিক ভিত্তিতে লেনদেন করতে পারবে না যার সঙ্গে ভারতের শত্রুতা রয়েছে। বিষয়টি গুরুত্ব অর্জন করেছে বিশেষ করে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক এবং বাংলাদেশের প্রতিরক্ষার দৃষ্টিকোণ থেকে। কারণ, গণচীনের আন্তরিক সমর্থন ও সহযোগিতা নিয়েই গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী। গাজীপুরস্থ সমরাস্ত্র কারখানায় অস্ত্র তৈরির মাধ্যমে তো বটেই, রফতানির পথেও গণচীনই বাংলাদেশকে অস্ত্রশস্ত্রের যোগান দিয়ে চলেছে। ট্যাংক থেকে যুদ্ধ বিমান পর্যন্ত বাংলাদেশের ৯০ শতাংশেরও বেশি সমরাস্ত্র এসেছে গণচীন থেকে। অর্থাৎ গণচীনের সহযোগিতা ছাড়া বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর পক্ষে যুদ্ধ করার কথা কল্পনা করাও সম্ভব নয়। এমন বিশ্লেষণের ভিত্তিতে বলা যায়, ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাগ্রিমেন্টের ফলে চীনের সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত সুসম্পর্ক বাধাগ্রস্ত হবে। কারণ, সরকারের এই ভারতপ্রীতিকে চীন সহজভাবে নাও নিতে পারে। চীন ও ভারতের দ্বনদ্বমূলক দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে তো বটেই, নিজের সমরাস্ত্রের গোপনীয়তা রক্ষার ব্যাপারে চীনের সতর্কতাও একটি বড় কারণ হয়ে উঠবে। এর ফলে বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্কে অবনতি ঘটতে পারে, চীন এমনকি সামরিক সহযোগিতা বন্ধও করতে পারে। তেমন অবস্থায় বাংলাদেশকে সম্পূর্ণরূপেই ভারতের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে হবে- যার অর্থ, বাংলাদেশ আসলে ভারতের অধীনস্থ হয়ে পড়বে।
ভারতকে দেয়ার ব্যাপারে বাকি ছিল শুধু ট্রানজিট-করিডোরের আনুষ্ঠানিকতা। ওয়ার্কিং কমিটি গঠনের মাধ্যমে সেটাই এবার চূড়ান্ত করা হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এর মধ্য দিয়ে সরকারের ভারতের স্বার্থে ভূমিকা পালনের গোপন উদ্দেশ্যেরই প্রকাশ ঘটেছে। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা এবং রেল, সড়ক ও নৌপথের দুরবস্থার মতো বাস্তব অনেক কারণের পাশাপাশি উল্লেখ করা দরকার, নানা চুক্তির আড়ালে ভারতকে উজাড় করে দিলেও সরকার দেশের স্বার্থে কিন্তু কোনো কিছুই আদায় বা অর্জন করতে পারেনি, পারছেও না। সর্বশেষ উদাহরণ হিসেবে তিস্তা চুক্তির কথা উল্লেখ করলেই সরকারের ব্যর্থতা ও অযোগ্যতার বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তির একটি মাত্র অজুহাত দেখিয়েই ভারত তিস্তা চুক্তিকে হিমাগারে পাঠিয়ে দিয়েছে। কিন্তু পাল্টা ব্যবস্থা নেয়ার ধারেকাছে যাওয়ার পরিবর্তে সরকার একই ভারতের জন্য ট্রানজিট-করিডোরের পরিপূর্ণ সুবিধা নিশ্চিত করতে উঠেপড়ে লেগেছে। এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত অনেক আগেই নেয়া হলেও কর, শুল্ক বা ফি আদায় করা না করার বিষয়টি বাকি ছিল। সেটাও এবার পাকাপাকি করেছেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থবিষয়ক উপদেষ্টা। অর্থাৎ যানবাহনই শুধু নয়, ভারতীয় পণ্যের জন্যও বাংলাদেশ কোনো রকমের কর, শুল্ক বা ফি আদায় করতে পারবে না।
প্রসঙ্গক্রমে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে উপদেষ্টাদের দাপটের কথা উল্লেখ করা দরকার। যেমন মনমোহন সিং-এর সফরকেন্দ্রিক ঘটনাপ্রবাহে দেখা গেছে, প্রধানমন্ত্রী সর্বতোভাবে দু'জন মাত্র উপদেষ্টার হাতে সবকিছু ছেড়ে দিয়েছিলেন। একজন হলেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান এবং দ্বিতীয়জন পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী। ভারতকে ট্রানজিট দেয়া থেকে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য, ছিটমহলসহ সীমান্ত সমস্যা এবং তিস্তাসহ বিভিন্ন নদ-নদীর পানিবণ্টন চুক্তি পর্যন্ত কোনো একটি বিষয়ে আয়োজনের সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের কারো ভূমিকা ‘দৃশ্যমান' ছিল না। মনেই হয়নি, দেশে পররাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, যোগাযোগমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, নৌপরিবহণমন্ত্রী এবং পানিসম্পদমন্ত্রী রয়েছেন। কারণ, এত বেশি বিষয়ে চুক্তি ও সমঝোতাপত্রে স্বাক্ষর করার সব আয়োজনের জন্য দু'জন মাত্র উপদেষ্টাকেই দৌড়ঝাঁপ করতে দেখা গেছে। অথচ ‘সুপার উপদেষ্টা' হিসেবে পরিচিতি পাওয়া দু'জনের কেউই কিন্তু ‘নির্বাচিত' জনপ্রতিনিধি নন। সাধারণ মানুষও তাদের সম্পর্কে খু্ব একটা জানে না। তা সত্ত্বেও তাদের মর্জিমাফিকই প্রতিটি বিষয়ে চুক্তি ও সমঝোতা স্বাক্ষরের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীরা পাত্তাই পাননি। দীপু মনিকে তো বটেই, সাহারা খাতুন থেকে বৃদ্ধ আবুল মাল আবদুল মুহিত পর্যন্ত প্রত্যেক মন্ত্রীকে সোজা দর্শকের গ্যালারিতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন দুই ‘সুপার উপদেষ্টা'। ফলে ট্রানজিট নিয়ে যার কথা বলার কথা সে যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন সড়ক মেরামত করে বেড়িয়েছেন। ছিটমহল বিনিময়ের ব্যাপারে কিছুই জানতে পারেননি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন। দুর্দান্ত দাপটের বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খানেরও কোনো খবর ছিল না। তিস্তাচুক্তি ও পানিবণ্টন নিয়ে এই যে এত হইচই হয়েছে এসব সম্পর্কে কিছুই জানানো হয়নি পানিসম্পদমন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেনকে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর সচিব ও কর্মকর্তাদেরও ছিল একই অবস্থা। সবাইকে অন্ধকারে রেখে কাজ গুছিয়েছিলেন দুই ‘সুপার উপদেষ্টা'। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠেছিল, বাংলাদেশে ‘নির্বাচিত' ও ‘গণতান্ত্রিক' সরকারের আড়ালে অন্য কোনো সরকারের রাজত্ব চলেছে কি না।
বর্তমান পর্যায়েও ব্যতিক্রম হয়নি। ওয়ার্কিং কমিটি গঠনের ব্যাপারে সবকিছুই করেছেন মশিউর রহমান। এমনকি আইন মন্ত্রণালয়কেও তার হুকুমই তামিল করতে হয়েছে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, ভারতের স্বার্থ উদ্ধার করে দেয়ার কর্মকান্ডে পারঙ্গমতা দেখালেও একই উপদেষ্টারা কিন্তু দেশের স্বার্থে কোনো ‘গড়ই' ওল্টাতে পারেননি। তিস্তা চুক্তির কথাই ধরা যাক। ১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি অনুযায়ী বেরুবাড়ি হস্তান্তরের প্রশ্নে ভারত ‘বাঙ্গালকে' তাদের ‘হাই কোর্ট' দেখিয়েছিল, এবার তিস্তা চুক্তির বিষয়ে সামনে এনেছে পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। কিন্তু এত যে পারঙ্গম উপদেষ্টারা তারা কিন্তু এখনো পর্যন্ত ভারতকে দিয়ে তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষর করাতে পারেননি। সে তারাই আবার ভারতের যানবাহন ও পণ্যের চলাচল নিশ্চিত করার জন্য ধেই ধেই করে নেচে বেড়াচ্ছেন! সামান্য লজ্জাও দেখা যাচ্ছে না তাদের মধ্যে। কথা অবশ্যই এমনি এমনি ওঠেনি। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা এবং সড়ক, রেলপথ ও নৌবন্দরের বেহাল দশার পাশাপাশি আপত্তির অন্য একটি কারণ হলো, বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা এতদিন রফতানির বিরাট অংশই করেছেন ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে। এবার ট্রানজিট-করিডোরের সুযোগে খোদ ভারতের ব্যবসায়ীরা ওই অঞ্চলে ঝাঁপিয়ে পড়বে। ফলে ভারতে বাংলাদেশের রফতানি অনেক কমে যাবে। এমনিতেই বাংলাদেশ ২১ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য ঘাটতির মধ্যে রয়েছে, এরপর ঘাটতি কেবল বাড়তেই থাকবে। ওদিকে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে চলছে স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম। চুক্তির আড়াল নিয়ে ভারত বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে সেনাবাহিনী পাঠানো শুরু করলে বাংলাদেশকে ভারতের অভ্যন্তরীণ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হবে। অর্থাৎ ট্রানজিট-করিডোরের বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য সব দিক থেকেই বিপজ্জনক হয়ে উঠবে। কিন্তু সব জেনে-বুঝেও সরকার ভারতকে শুধু চলাচল ও পণ্য আনানেয়ার সুযোগই দিচ্ছে না, দেশকেও ভারতের কাছে এমনভাবেই কষে বেঁধে রেখে যাচ্ছে, যাতে ভবিষ্যতে যতো দেশপ্রেমিক দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন কারো পক্ষেই এসব চুক্তি বাতিল করা বা জাতীয় স্বার্থে কোনো ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব না হয়। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, রাজনৈতিক দলগুলোকেও এত বড় একটি বিষয়ে শক্তিশালী কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে দেখা যাচ্ছে না।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন