আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
আমার আজকের লেখার শিরোনামটি সম্পর্কে সহৃদয় পাঠকদের আগেই জানিয়ে রাখি, শিরোনামটি আমার নয়। আমি ইংরেজি থেকে বাংলা তরজমায় একটু স্বাধীনতা গ্রহণ করেছি মাত্র। গত বৃহস্পতিবারের (২৪ মে) গার্ডিয়ান কাগজে পাকিস্তানে মার্কিন সিআইএর স্পাই হিসেবে ধৃত ও দণ্ডিত পাকিস্তানি ডাক্তার ডা. শাকিল আফ্রিদি সম্পর্কে ইসলামাবাদ থেকে যে রিপোর্টটি পাঠানো হয়েছে তার শিরোনাম দেওয়া হয়েছে হিরো অর ভিলেন? আমার লেখায় সেই শিরোনামটিকেই আমি বাংলা করেছি_ফেরেশতা না শয়তান?
পাকিস্তানের অধিকাংশ মানুষ ভাবছে, ডা. আফ্রিদি একজন রাষ্ট্রদ্রোহী শয়তান। আর আমেরিকা চাচ্ছে তাকে একজন ফেরেশতা প্রমাণ করতে। তাদের চোখে আফ্রিদি একজন হিরো। কারণ, তিনি সিআইএর স্পাই হিসেবে ওসামা বিন লাদেনকে খুঁজে বের করা এবং তাকে হত্যার ব্যাপারে আমেরিকাকে সাহায্য জুগিয়েছেন। লাদেনকে তার এবোটাবাদের গোপন আস্তানায় ইউএসএ নেভি সিলস হানা দিয়ে হত্যা করে। এ ব্যাপারে পাকিস্তানকে কিছু জানানো হয়নি এবং পাকিস্তানের অভ্যন্তরে এই সামরিক হামলায় পাকিস্তানের অনুমতিও গ্রহণ করা হয়নি। ফলে পাক-মার্কিন সম্পর্কে বিরাট ফাটল ধরে, যে ফাটল এখনও মেরামত করা সম্ভব হয়নি। বরং দিন দিন বাড়ছে।
পাকিস্তানের সামরিক ও বেসামরিক কর্তৃপক্ষ প্রথমে বুঝতেই পারেননি, তাদের অগোচরে আমেরিকা এত বড় সামরিক হামলা কী করে চালাল? পরে পাকিস্তানে ইনটেলিজেন্স রহস্যটি উদ্ঘাটন করে। ডা. শাকিল আফ্রিদি ছিলেন পাকিস্তানে একজন সরকারি হেলথ অফিসার। আফগান সীমান্ত সংলগ্ন পাকিস্তানের গ্রামগুলোতে শিশুদের পোলিও টিকা দেওয়ার অভিযানের দায়িত্বে ছিলেন।
লাদেনকে খুঁজে বের করার কাজে মার্কিন সিআইএ আফ্রিদিকে পায়। সিআইএর আনুকূল্যে আফ্রিদি একটি ভুয়া (ইড়মঁং) হেপাটাইটিস-বি ভ্যাকসিনেশন অভিযান শুরু করে, যার আসল উদ্দেশ্য ছিল লাদেন পরিবার বা লাদেনের সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তিদের ডিএনএ টেস্টের জন্য রক্ত সংগ্রহ করা এবং লাদেনকে খুঁজে বের করার কাজে তা ব্যবহার করা। আফ্রিদি তাতে সফল হন। আফ্রিদি তার এই কাজে ১৭ জন নার্স ও হেলথ ওয়ার্কার নিযুক্ত করেছিলেন।
এই হেলথ ওয়ার্কাররা টিকাদানের নামে রক্ত সংগ্রহের জন্য লাদেনের ব্যক্তিগত কম্পাউন্ডে ঢুকতে না পারলেও কম্পাউন্ডের ভেতরের একজনের মোবাইল ফোন নম্বর সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়। এই মোবাইল ফোনই লাদেনকে খোঁজার ব্যাপারে সহায়তা জোগায়। লাদেন হত্যার পর পাকিস্তানের গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষ ডা. আফ্রিদি এবং তার ভুয়া টিকাদান অভিযান কেন্দ্রের সন্ধান পায় এবং তাকে পলায়নের আগেই গ্রেফতার করা হয়। ৪৮ বছর বয়সী এই স্বাস্থ্যকর্মীকে ব্রিটিশ আমলের এক পুরনো আইনে রাষ্ট্রদ্রোহিতা, দেশের বিরুদ্ধে চক্রান্ত এবং বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার হয়ে গুপ্তচরগিরি করার দায়ে তেত্রিশ বছরের জন্য কারাদণ্ড এবং ২ হাজার ২২১ পাউন্ড জরিমানা করা হয়েছে। তার ১৭ জন হেলথ ওয়ার্কার ও নার্সকে বরখাস্ত করা হয়েছে।
এই দণ্ড ঘোষিত হওয়ার পর পাকিস্তানে ও আমেরিকায় তুমুল আলোড়ন শুরু হয়েছে। আমেরিকান নেতারা বলছেন, ডা. আফ্রিদি একজন হিরো। তিনি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নয়, আল কায়দার বিরুদ্ধে কাজ করেছেন। তাকে পুরস্কৃত করা উচিত। আমেরিকার প্রভাবশালী কংগ্রেস সদস্য ডানা রোহয়া বেচার কংগ্রেসে প্রস্তাব এনেছেন, আফ্রিদিকে মার্কিন নাগরিকত্ব দান করা হোক।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার, সাধারণত কোনো দেশের কোনো গোয়েন্দা সংস্থার গুপ্তচর দেশের বাইরে ধরা পড়লে গোয়েন্দা সংস্থাটি তাকে নিজেদের লোক বলে স্বীকার করে না। কিন্তু আফ্রিদির বেলায় আমেরিকা সেই নিয়ম লঙ্ঘন করে তাকে নিজেদের লোক বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। পাকিস্তান যাতে আফ্রিদিকে শাস্তি না দেয়, সে জন্য শীর্ষস্থানীয় মার্কিন নেতারা প্রকাশ্যে দেনদরবার করেছেন। এমনকি মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিয়ন পেনেট্টা ঘোষণা করেন, 'লাদেন হত্যা অভিযানে আফ্রিদির দেওয়া গোপন তথ্য বিরাটভাবে সাহায্য জুগিয়েছে। আফ্রিদি এমন কোনো কাজ করেননি, যা পাকিস্তানের স্বার্থহানি করেছে।' পেনেট্টার এই বক্তব্য আফ্রিদির বিচারে তার পক্ষে যায়নি, বিপক্ষে গিয়েছে।
আমেরিকা যেখানে তাদের একজন পাকিস্তানি গুপ্তচরকে হিরো সাজাবার চেষ্টা করছে, পাকিস্তান সেখানে তাকে ভিলেন হিসেবে কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দিয়ে দীর্ঘ ৩৩ বছরের জন্য জেলে পাঠিয়েছে। আমেরিকার যুক্তির জবাবে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেছেন, বড় বড় নীতিকথা বলা আমেরিকার মুখে সাজে না। জোনাথন পোলার্ড নামে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার এক ব্যক্তিকে কি ইসরায়েলের পক্ষে গুপ্তচরগিরির জন্য কারাদণ্ড দেওয়া হয়নি? ইসরায়েল তো আমেরিকার মিত্র রাষ্ট্র। তাহলে মিত্র রাষ্ট্রের হয়ে গুপ্তচরগিরির জন্য পোলার্ডকে কেন জেলে যেতে হয়েছিল?
এই প্রশ্নের জবাব আমেরিকার কাছে নেই। তারা দেখাতে চাইছেন, পাকিস্তান আর আল কায়দা এক ব্যাপার নয়। ডা. আফ্রিদি আল কায়দার বিরুদ্ধে কাজ করেছেন, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নয়। গত বৃহস্পতিবার (২৪ মে) পেন্টাগনের প্রেস সেক্রেটারি জর্জ লিটলও কথাটা বলেছেন। জর্জ লিটলকে কেউ জিজ্ঞাসা করেনি, আল কায়দার বিরুদ্ধে তো প্রকাশ্য ভূমিকা রয়েছে পাকিস্তানেরও। পাকিস্তানও লাদেনকে খোঁজার কাজে তৎপরতা দেখাচ্ছিল। তাহলে ডা. আফ্রিদি কেন তার দেশের গোয়েন্দা সংস্থার হয়ে কাজটি করলেন না? অথবা তিনি যখন লাদেনের খোঁজ পেলেনই, তখন আগে তা নিজের দেশের কর্তৃপক্ষকে জানালেন না? না জানিয়ে নিজ দেশে তিনি কেন একটি পরাশক্তির গোপন এবং ভয়াবহ হামলার ব্যবস্থা করে দিলেন? এই হামলায় লাদেন নিহত হয়েছেন বটে, কিন্তু পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব কি চূড়ান্তভাবে লঙ্ঘিত হয়নি? আর যে কোনো কারণেই হোক, যে ব্যক্তি নিজের দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের কাজে একটি বাইরের শক্তিকে সাহায্য জুগিয়েছে সে কি ভয়ঙ্কর দেশদ্রোহী নয়? পাকিস্তান তাকে সাজা দিয়ে কি অন্যায় করেছে?
সবচেয়ে বড় কথা, আমেরিকা তার একজনমাত্র শত্রুকে (আমেরিকারই সৃষ্ট রাজনৈতিক শত্রু) খুঁজতে গিয়ে যেভাবে আন্তর্জাতিক সকল নিয়ম-রীতি, সেবা, চিকিৎসা থেকে শুরু করে সকল মানবতাবাদী সংস্থা, সংস্থার কার্যক্রমকে তাদের প্রতিটি আগ্রাসনের কভার হিসেবে ব্যবহার করছে, তাতে বিশ্বময় এই সংস্থাগুলোর প্রতিবাদ ধ্বনি উত্থিত হয়েছে। তারা বলছেন, মার্কিন অবৈধ ও আগ্রাসী কার্যকলাপকে কভার দেওয়ার জন্য যদি এভাবে আন্তর্জাতিক সেবা ও মানবতাবাদী সংস্থাগুলোর কাজকর্মকে ব্যবহার করা হতে থাকে, তাহলে এই সংস্থা ও তাদের কার্যক্রম ক্রেডিবিলিটি হারাবে এবং বিশ্বে দুস্থ, পীড়িত, আর্তমানুষের সেবা কার্যক্রম সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাবে।
পাকিস্তানে শিশুদের মধ্যে পোলিও রোগের সংক্রমণ ব্যাপক। তার বিরুদ্ধে টিকাদান অভিযান একটি আন্তর্জাতিক উদ্যোগ। ডা. আফ্রিদির মাধ্যমে এই টিকাদান অভিযানকে কভার করে সিআইএর লাদেন হত্যা তৎপরতা চালিত হওয়ায় এই টিকাদান অভিযান শুধু ব্যাহত হওয়া নয়, অভিযানটি ক্রেডিবিলিটি হারিয়েছে। গত দু'বছরে পাকিস্তানে দু'লাখ শিশুকে পোলিওর টিকাদান সম্ভব হয়নি। গত মার্চ মাসে বিশ্বের দু'শ সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান সিআইএর ডিরেক্টর ডেভিড পেট্রুজের কাছে যুক্তভাবে চিঠি লিখে তাদের এই অবৈধ, মানবতাবিরোধী কৌশলের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
কূটনৈতিক বা অন্যবিধ চাপ প্রয়োগে ডা. আফ্রিদির দণ্ড মওকুফ করা যাবে তা কেউ আশা করেন না। তাকে আপিল করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে; কিন্তু রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শন ছাড়া আফ্রিদির মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। প্রেসিডেন্ট জারদারির ওপর চাপ প্রয়োগ করে ওয়াশিংটন কি তার কাছ থেকে আফ্রিদির জন্য প্রাণভিক্ষা আদায় করতে পারবে? অনেকে সন্দেহ করেন। জারদারি তার দেশের শক্তিশালী সামরিক কমান্ড ও তাদের গোয়েন্দা সংস্থার চাপের বাইরে যেতে সহজে সাহসী হবেন না। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা জারদারির ওপর ভয়ানক গোসা। সম্প্রতি শিকাগোতে অনুষ্ঠিত ন্যাটোর কনফারেন্সের সময় জারদারি চেয়েছিলেন ওবামার সঙ্গে একটি আনুষ্ঠানিক বৈঠক। ওবামা সাফ না বলে দিয়েছেন।
অন্যদিকে পাকিস্তান সীমান্ত দিয়ে আফগানিস্তানে ন্যাটোর সাপ্লাই ট্রাক চলাচলের ব্যাপারে জারদারি সরকার যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল, তা এখনও প্রত্যাহারে রাজি হয়নি। ওয়াশিংটন রাজি নয়, গত সেপ্টেম্বর মাসে আফগান-সীমান্তে যে ২৪ জন পাকিস্তানি সৈন্য তারা হত্যা করেছে, সে জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাইতে। এসব কারণে কেবল কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ করে সিআইএর এজেন্ট হিসেবে প্রমাণিত ডা. শাকিল আফ্রিদিকে আমেরিকা সহজেই মুক্ত করতে পারবে তা মনে হয় না। পাকিস্তানিদের চোখে তিনি একজন দেশদ্রোহী হিসেবেই বিবেচিত হবেন।
আমেরিকার পক্ষে একজন শত্রুকে বিনাশ করতে গিয়ে শত শত্রুর জন্ম দেওয়া এবং একটি মিত্র ও তাঁবেদার দেশকে একেবারে শত্রু দেশে পরিণত হওয়ার দিকে ঠেলে দেওয়া এশিয়ায় ওবামার নতুন ডকট্রিন সফল হওয়ার কাজে কতটা সাহায্য জোগাবে তা এই মুহূর্তে বলা মুশকিল। তবে লাদেন হত্যা দ্বারা যেমন আল কায়দাকে পরাজিত করা বা আফগান যুদ্ধজয় সম্ভব হয়নি, তেমনি ড্রোন হামলা, সামরিক অভিযান অব্যাহত রেখেও এশিয়ায় ওবামা ডকট্রিন সফল করা যাবে না। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে আমেরিকা যে মানবতাবিরোধী ভূমিকা অনুসরণ করছে, সেটাই তার সাফল্য লাভের আসল অন্তরায়।
লন্ডন, ২৫ মে শুক্রবার, ২০১২
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন