সোমবার, ২৮ মে, ২০১২

অপরকিল্পতি নগরে ফুটপাথও দখল!

ড. হারুন রশীদ
ঢাকা দেশের রাজধানী, সবচেয়ে বড় নগরী এবং এক কোটির বেশি মানুষের বাস। এখানে দেশের প্রধান প্রশাসনিক কেন্দ্র সচিবালয় ছাড়াও রয়েছে নানা অফিস-আদালত, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল। অনেক বিদেশীও নানা কর্মসূত্রে আসছেন, অনেকে বাসও করছেন। সব মিলিয়ে মহা কর্মব্যস্ত এক নগরী ঢাকা। দুঃখজনক হলেও সত্যি, ৪শ’ বছরের পুরনো ঐতিহাসিক ঢাকা নগরী বেড়ে উঠেছে সম্পূর্ণ অপরিকল্পিতভাবে। ফলে নাগরিক সুবিধার অনেকটাই এখানে অনুপস্থিত। 
আসলে পরিকল্পিত নগর বলতে বোঝায় একটি পরিকল্পিত জনবসতি। কোথায় স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল হবে, অফিস-আদালত কোথায়, কোথায় বসবাসের জায়গা; সবই হবে পরিকল্পনা মাফিক। পরিকল্পনা মাফিক সব কিছু হলে প্রত্যেক নগরেই মানুষ শৃঙ্খলাপূর্ণ নাগরিক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে। এতে তার নাগরিক জীবন হয় মর্যাদাপূর্ণ, গ্রাম কিংবা মফঃস্বলের তুলনায় উন্নততর, স্বস্তিদায়ক। কিন্তু এই নগরই আবার পরিকল্পনাহীনভাবে বেড়ে উঠলে তাতে নাগরিকদের জীবন অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে। জনজীবনকে তা বিপর্যস্ত করে ফেলে। মানুষের ভোগান্তির কোন শেষ থাকে না। অপরিকল্পিতভাবে বেড়ে ওঠার কারণে রাজধানীর মোট দুই হাজার ২৮৯ দশমিক ৬৯ কিলোমিটার রাস্তার অনেকাংশই আবার নানা শ্রেণী-পেশার মানুষের দখলে। বিশেষ করে ঢাকার ফুটপাথগুলো দখলে থাকায় যারপরনাই ভোগান্তির শিকার সাধারণ মানুষজন। যানজটের নিগড়ে পিষ্ট মানুষের কাছে এ যেন গোদের ওপর বিষফোঁড়া। সাধারণত হকাররাই ফুটপাথগুলো দখল করে রাখে। 
এজন্য ফুটপাথগুলো হকারমুক্ত রাখা প্রয়োজন। কিন্তু ফুটপাথে হকারদের বসা, না বসা নিয়ে নানা রকম মত রয়েছে। কেউ বলছেন, ছিন্নমূল এসব মানুষজনকে যদি ফুটপাথ থেকে উচ্ছেদ করা হয় সেটা হবে তাদের রুটিরুজির ওপর হস্তক্ষেপ। তাই স্থায়ী পুনর্বাসন ছাড়া হকার উচ্ছেদ হবে সম্পূর্ণ অমানবিক। 
বাংলাদেশ ছিন্নমূল হকার সমিতির তথ্যানুসারে বর্তমানে ঢাকা শহরে ১ লাখ ৩০ হাজার হকার রয়েছে। এর মধ্যে ৭০ হাজার স্থায়ী ও ৬০ হাজার অস্থায়ী। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সহায়সম্বলহীন এসব মানুষ ঢাকা শহরে কাজের সন্ধানে এসে হকার পেশায় যুক্ত হয়ে পড়ে। সামান্য পুঁজিতেই ফুটপাথে বসে যে কোন ধরনের ছোটখাটো ব্যবসা করা যায়। আর সরকারী দলের পাতি মস্তান, পুলিশ, অন্যান্য চাঁদাবাজ গোষ্ঠীকে বখরা দিয়ে বাকি যে আয় থাকে তাও নিছক কম নয়। ওই দিয়েই একেকজনের আয়ে ৩/৪ জনের একটি সংসার চলে।
প্রায় দেড় কোটি মানুষের বসবাসের এই নগরী আসলে এক বিশাল বাজার। এই বাজারের অন্তত ২৫% অর্থনীতি পরিচালিত হয় বা নিয়ন্ত্রিত হয় এই হকারদের মাধ্যমেই। হকারদের কাছ থেকে সস্তায় জিনিসপত্র কেনা যায়। কারণ তাদের দোকান ভাড়া, বিদ্যুত বিল পরিশোধ করতে হয় না বলে পণ্যের মূল্যের ওপর তার প্রভাব পড়ে না। ফলে এই উচ্চমূল্যের বাজারে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তের লোকজন কেনাকাটার জন্য হকারদের ওপর নির্ভরশীল। এই কারণে হকারদের উচ্ছেদের ব্যাপারটি আসলে একপাক্ষিক কোন ব্যাপার নয়। তাদের উচ্ছেদ করলে কোথায় গিয়ে তারা দাঁড়াবে, এ বিষয়টিও অবশ্যই ভাবতে হবে।
এছাড়া যানজট সৃষ্টির জন্য হকারদের দায়ী করা হলেও তারা আসলে এজন্য কতটা দায়ী সেটিও ভেবে দেখতে হবে। ঢাকার যানজটের প্রধান কারণ রাস্তার সঙ্কট। ঢাকায় যে পরিমাণ জমি রয়েছে তার জন্য ২৫ ভাগ রাস্তা দরকার। সেখানে অলিগলিসহ আছে মাত্র ৭ ভাগ। মেন রোড আছে ৩ ভাগ। এই ৩ ভাগের ৩০ ভাগ দখল করে আছে দখলদাররা। যার মধ্যে একটি অংশ হচ্ছে হকার।
রাজধানীর ৭০ শতাংশ ফুটপাথ প্রাইভেট গাড়ি দখল করে রেখেছে। ভাবতে অবাক লাগে রাজধানীর অধিকাংশ রাস্তার পাশেই যেসব দোকান ও আবাসিক ভবন রয়েছে তাদের কোন পার্কিং ব্যবস্থা নেই। ফলে রাস্তার অর্ধেকটা তারা দখল করে গাড়ি পার্কিং করে। দিনের পর দিন এ অবস্থা চললেও এগুলো দেখার কেউ নেই। যত দোষ কেবল যেন ওই নন্দ ঘোষ; হকারদের।
আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, যে পুলিশ হকার উচ্ছেদ করে সেই পুলিশই রাজধানীর ফুটপাথ ও রোড ডিভাইডারে দেড় শতাধিক পুলিশবক্স স্থাপন করেছে। যার সবই অবৈধ। সিটি কর্পোরেশন থেকে কোন রকম অনুমতি না নিয়েই তা করা হয়েছে। ফুটপাথ ও রোড ডিভাইডারের ওপর এসব বক্সের কারণে লোকজনের চলাচলে মারাত্মক অসুবিধার সৃষ্টি হলেও কারও কিছু করার নেই। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন পুলিশের চাপের মুখে এসব অবৈধ বক্স উচ্ছেদ করত পারছে না। সরকারের এক শীর্ষস্থানীয় মন্ত্রীও এ ব্যাপারে সংসদে বলেছিলেনÑ‘রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে নির্মিত পুলিশ বক্স পথচারীদের নির্বিঘœ চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সষ্টি করছে। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের অনুমতি ছাড়া রাস্তা, ফুটপাথ ও আইল্যান্ডের ওপর স্থাপিত বিজ্ঞাপন সংবলিত পুলিশবক্স অপসারণের সিদ্ধান্ত পুলিশ কর্তৃপক্ষকে নিয়ে যৌথসভা করে দেয়ার পরও পুলিশ কর্তৃপক্ষ তা অপসারণ করেনি।’ জোর যার মুল্লুক তার নীতি আর কাকে বলে!
রাজধানীর ভাসমান হকারদের পুনর্বাসনে গত ২৫ বছরে অন্তত দুই ডজন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী ১৯৫২ সালে এবং স্বাধীনতা পরবর্তী ১৯৭৯ সালেও বাস্তবায়ন করা হয় দু’টি প্রকল্প। ডিসিসির খাতাপত্রে এসব প্রকল্পের আওতায় সর্বমোট ১৮ হাজার হকারকে পুনর্বাসনের কথা বলা হয়েছে। রাজধানীর হকারদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে তৎকালীন ঢাকা পৌরসভা কর্তৃপক্ষ নগরীর সদরঘাট এলাকায় প্রথম প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে ১৯৫২ সালে।
‘সদরঘাট হকার্স মার্কেট’ নামের ওই প্রকল্পে পুনর্বাসন করা হয় সর্বমোট ৮১২ হকারকে। এরপর ১৯৭৯ সালে সদরঘাট এলাকাতেই হকার পুনর্বাসনের ২য় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। লেডিস পার্ক হকার্স মার্কেট নামের ওই প্রকল্পে ৬৪৫ হকার পুনর্বাসিত হয়। তারপর আশির দশকের শেষার্ধে হকার পুনর্বাসনের ব্যাপকভিত্তিক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এভাবেই গত ২৫ বছর ধরে বিভিন্ন স্থানে প্রায় ১৮ হাজার হকারকে পুনর্বাসন করা হয়। কিন্তু এত প্রকল্প বাস্তবায়নের পরও নগরজুড়ে হকারের সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। 
এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, হকার পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার আদৌ কি কোন শেষ আছে?
আসলে ফুটপাথ দখলমুক্ত করার কথাই বলি আর হকার পুনর্বাসনের কথাই বলি না কেন, এ দু’টি কাজ করতে হলে উভয়পক্ষ থেকেই দায়িত্বশীল কর্মপন্থা অবলম্বন করতে হবে। স্রোতের মতো হকাররা আসতে থাকবে আর তারা ফুটপাথ দখল করে ব্যবসাবাণিজ্য করবে তারপর পুনর্বাসনের দাবি তুলবেÑ এটি কখনও বাস্তবসম্মত নয়। এজন্য সবাইকে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। একটি সুসমন্বিত পন্থায় এগিয়ে যেতে হবে। এ লক্ষ্যে প্রসঙ্গত আমরা কলকাতা শহরের হকারদের পুনর্বাসনের নীতিটি পর্যালোচনা করে দেখতে পারি।
এই নীতিতে হকার পুনর্বাসনের ব্যাপারে কিছু পদক্ষেপ নেয় পুরসভা। ‘হকার নীতি’ নামে পরিচিত ওই নতুন নীতিতে বলা হয়েছেÑ
১. পুরসভা হকারদের চিহ্নিত করে পরিচয়পত্র দেয়ার ব্যবস্থা করবে। ২. নতুন কোন হকার ফুটপাথ দখল করে বসে পড়ছে কি-না তা মাঝে মধ্যেই সমীক্ষা করে দেখা হবে। ৩. পুরসভা হকারদের বিভিন্ন স্বাস্থ্য প্রকল্প, রাষ্ট্রীয় বীমা যোজনা ইত্যাদিতে অন্তর্ভুক্ত করবে। ৪. অপ্রাপ্ত বয়স্ক বা শিশু হকারদের পুনর্বাসন দিয়ে বিভিন্ন কর্মশিক্ষা, শিশু শিক্ষা প্রকল্প, জাতীয় শিশুশ্রম প্রকল্পে যুক্ত করা হবে। ৫. হকার সন্তানরা অবৈতনিক শিক্ষা এবং মিডডে মিল পাবে। ৬. ঋণ দেয়ার পাশাপাশি বিশেষ কারিগরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। ৭. খাবার এবং আতশবাজি বিক্রি করে যারা তাদের প্রয়োজনীয় লাইসেন্স নিতে হবে। ৮. ন্যূনতম ১৫ বর্গফুট এবং সর্বাধিক ৪০ বর্গফুট জায়গা একজন হকারের জন্য নির্দিষ্ট হবে। যেখানে সম্ভব এবং প্রয়োজন সেখানে নির্দিষ্ট অনুপাতে শহরের তফসিলি জাতি, উপজাতি, সংখ্যালঘু এবং প্রতিবন্ধী হকারদের জন্যও বিক্রির জায়গা নির্দিষ্ট করে দিতে হবে। ৯. হকারদের বেঁধেছেদে রেখে যাওয়া দোকানের মালপত্র রাতে যাতে চুরি না যায় সেজন্য জিনিসপত্র সুরক্ষিত রাখার ব্যবস্থা করা হবে।
১০. কোথায় কে বসবেন তা পরিচয়পত্র দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে চিহ্নিত করে কাঠামোভিত্তিক ফি নির্ধারণ করা হবে। ১১. এছাড়া হকার নিয়ন্ত্রিত ফুটপাথে কঠিন বর্জ্য অপসারণ, শৌচাগার নির্মাণ, বিদ্যুত সংযোজন ও পানীয় জল, বিক্রেতাদের জন্য ছাউনি এবং কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে ফুটপাথেই প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে পুরসভা। ১২. হকার হিসেবে অন্তর্ভুক্তির জন্য পুরসভার নির্দিষ্ট ফরমে আবেদন করতে হবে। আবেদনকারীর বয়স অবশ্যই কমপক্ষে ১৮ বছর হতে হবে। পথচারীদের জন্য হকারদের কিছু নির্দেশিকাও মানতে হবে। পথচারী চলাচলের জন্য দুই-তৃতীয়াংশ ফুটপাথ খালি রাখতে হবে। এছাড়া বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনায় পুরসভা কর্তৃপক্ষ যে কোন জায়গায় হকারদের বসা, বিক্রি নিয়ন্ত্রণ ও নিষিদ্ধ রাখতে পারবে।
এই নীতিটি যে একটি চমৎকার এবং বাস্তবানুগ সেটি তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশের বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে এর অনেক নীতিই সামঞ্জস্যপূর্ণ।
হকারদের যদি পরিচয়পত্র দেয়া যায় তাহলে তারা একটি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে চলে আসবে। তাছাড়া যে কোন সিদ্ধান্ত যেমন পুনর্বাসন, বা অন্যান্য সেবা দেয়ার ক্ষেত্রেও হকারদের একটি সঠিক পরিসংখ্যান জানা থাকলে তা সহজ হবে। এছাড়া সার্বিকভাবে একটি শৃঙ্খলাও প্রতিষ্ঠিত হবে। এটি উভয় পক্ষের জন্যই মঙ্গলজনক হবে নিঃসন্দেহে। এজন্য একটি হকার নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা গেলে বিষফোঁড়ার মতো এই সমস্যা থেকে বাঁচা যাবে। এজন্য উদ্যোগটাই জরুরি।

harun_press@yahoo.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন