সৈ য় দ আ বু ল ম ক সু দ
শিল্প-সাহিত্য ও শি¶া-সংস্কৃতি ¶েত্রে আমাদের কেউ মারা গেলে, তার মৃত্যুতে ‘জাতির অপূরণীয় ¶তি হল’ অথবা তার চলে যাওয়ায় ‘যে শূন্যতার সৃষ্টি হল তা সহজে পূরণ হওয়ার নয়’Ñ বলা যেন আমাদের একটি অর্থহীন অভ্যাস বা প্রথায় পরিণত হয়েছে। শীর্ষ সরকারি নেতারাও এ ভাষাতেই শোকবাণী দেন। অথচ যিনি মারা যান, তার কোন গুর“ত্বপূর্ণ কাজ দেখতে পায়নি দেশের মানুষ ৩০ বছরেও। দেশের মানুষের জন্য তার ত্যাগ নেই এক ছটাক। পুঁজি শুধু কোন এক সময়ে কিছু কাজ করার খ্যাতিটুকু। আমাদের আবেগতাড়িত, যুক্তিবিবর্জিত ও কর্মবিমুখ সমাজে এখনও এমন মানুষ কেউ কেউ আছেন, যাদের মৃত্যুতে আ¶রিক অর্থেই অপূরণীয় শূন্যতার সৃষ্টি হয়। তারা অপ্রতিকল্পনীয়। যাদের পরিবর্তে আর একজন খুঁজে পাওয়া যায় না। তাদেরই একজন ছিলেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ।
কর্মজীবনে অর্থাৎ চাকরি-বাকরিতে মোজাফফর আহমদ কী কী প্রাতিষ্ঠানিক বা প্রশাসনিক পদে দায়িত্ব পালন করেন, তা কোন বিবেচ্য বিষয় নয়। ওসব পদে বহু মানুষই দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স পরী¶া দিয়েই হরগঙ্গা কলেজে শি¶কতা শুর“ করেন। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে যোগ দেন। শি¶কতা ছেড়ে দিয়ে ষাটের দশকে একটি বেসরকারি ব্যাংক এবং পূর্ব পাকি¯—ান শিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশনে কাজ করেন। শি¶ায়তনিক ও তাত্তি¡ক জ্ঞানের সঙ্গে ওই দুই প্রতিষ্ঠানে কাজ করার ফলে তিনি ব্যাংকিং ও শিল্প প্রতিষ্ঠান পরিচালনার অভিজ্ঞতা অর্জন করেন।
¯^াধীনতার পর ১৯৭২ সালে গঠিত বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনে তিনি যোগ দেন। ১৯৭৪ সালে পরিকল্পনা কমিশন থেকে পদত্যাগ করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা প্রশাসন ইন্সটিটিউটে (আইবিএ) অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। তিনি ও তার কয়েকজন সুযোগ্য সহকর্মীর প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের একটি শীর্ষ শি¶া প্রতিষ্ঠান হিসেবে ¯^ীকৃতি পায় আইবিএ। এই প্রতিষ্ঠানের সুনাম আজও অ¶ুণœ। বাংলাদেশে বেসরকারি পর্যায়ে যে বহু দ¶ প্রশাসনিক কর্মকর্তা তৈরি হয়েছেন গত ৪৫ বছরে, তার কৃতিত্ব আইবিএ’র। সে¶েত্রে মোজাফফর আহমদের অবদান রয়েছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্প-কারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের দ¶ প্রশাসকদের অনেকেই তার প্রত্য¶ ছাত্র।
যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি পিএইচডি করেন ১৯৬৫ সালে। সেখানে তার শি¶কদের কয়েকজন ছিলেন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী। তার সহপাঠী বব লুকাস অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পান। তার প্রাতিষ্ঠানিক শি¶ার মান তার সমসাময়িক অনেকের চেয়ে এবং তার অনেক সহকর্মীর চেয়ে উঁচু ছিল বলে তার ঘনিষ্ঠদের অভিমত।
উচ্চশি¶া প্রতিষ্ঠানে জীবিকার জন্য শি¶কতার চাকরি করা নয়, মোজাফফর আহমদ ছিলেন একজন আদর্শ শি¶াবিদ। ছাত্রদের তিনি উপযুক্ত শি¶া দান করতেন। তার নিজের শি¶ার ভিত্তিও ছিল খুব মজবুত। তার স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠীদের কাছে শুনেছি, সেখানে ৪০-এর শেষ ও ৫০-এর শুর“তে তার সাইকেলের পেছনের ক্যারিয়ারে সব সময় কিছু বই থাকত। শুধু ঘরে নয়, বাইরেও সময় পেলে তিনি পড়তেন। তা নিয়ে তার বন্ধুরা হাসি-ঠাট্টা করতেন। তবে সবাই ¯^ীকার করেন যে তিনি বা¯—বিকই খুব পড়-য়া ছিলেন। দেশে ও দেশের বাইরে তিনি আদর্শ শি¶কদের কাছে পাঠ নিয়েছেন, নিজে হওয়ার চেষ্টা করেছেন আদর্শ শি¶ক।
তার অগণিত অনুরাগীর অনেকেই জানেন না, মোজাফ্ফর আহমদ ছিলেন একটি ঐতিহ্যবাহী শি¶িত মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ। তিনি প্রথম জেনারেশন আধুনিক শি¶িত ছিলেন না। তার গ্রামের বাড়ি আর আমাদের গ্রামের বাড়ির দূরত্ব ছিল মাইল পাঁচেক। আমাদের দুই গ্রামই ছিল পদ্মা নদীর পাড়ে। দুটিই আজ নদীগর্ভে। উনিশ শতক থেকেই আমাদের দুই পরিবারের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। তার বাবা-চাচারা এবং তাদের বাবা-চাচারা ছিলেন উনিশ শতক থেকেই আধুনিক ইংরেজি শি¶ায় শি¶িত। তার দাদার ভাই মবিনউদ্দিন আহমদ গত শতাব্দীর প্রথম দিকে একজন সৎ ও ন্যায়পরায়ণ উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে সারা বাংলায় পরিচিত ছিলেন। তখন বাংলায় উচ্চপদস্থ বাঙালি মুসলিম সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন হাতেগোনা।
কাস্টমস ও আবগারি বিভাগের ক্যাডার সার্ভিসের পদস্থ কর্মকর্তা ছাড়াও, মবিনউদ্দিন আহমদ একজন লেখক হিসেবেও সুপরিচিত ছিলেন। তার লেখনী নাম ছিল মবিনউদ্দিন আহমদ জাহাঙ্গীরনগরী। আগের দিনে ঢাকা জেলার অনেকে তাদের নামের শেষে জাহাঙ্গীরনগরী লিখতেন। তিনি ছিলেন আমার দাদার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মবিনউদ্দিন আহমদের সবচেয়ে বিখ্যাত গ্রন্থটি ছিল ‘কোরআনতত্ত¡’। এই ইসলামী ধর্মতত্তে¡র বইটি ছিল তিন খÊে। সংস্কারমুক্ত মন নিয়ে লেখা। তিনটি খÊই আমার আব্বার সংগ্রহে ছিল। দুটি খÊ তিনি মুহম্মদ মনসুরউদ্দিনের পীড়াপীড়িতে তাকে দেন। আর ফেরত পাওয়া যায়নি। একটি খÊ জীর্ণ হয়ে গেলেও আমার কাছে আছে। এ ধরনের বই পুনর্মুদ্রিত হওয়া দরকার। ইসলামী দর্শনের ওপর তার আরও রচনা রয়েছে।
অধ্যাপক মোজাফফরের অর্থনীতি বিষয়ে মূল্যবান রচনা রয়েছে। শেষ জীবনে তার ইচ্ছা ছিল মহানবী (সা.) ও ইসলামী দর্শন বিষয়ে কিছু লিখবেন। কিন্তু গত ১০ বছর ধরে তার একটি দিনও অবসর ছিল না। আইনের শাসন, গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান, স্থানীয় সরকার শক্তিশালী করা, পরিবেশের বিপর্যয় রোধ প্রভৃতি বিষয়ে আন্দোলন ও অনুষ্ঠানে তাকে প্রতিদিন অংশগ্রহণ করতে হতো। দুর্র্নীতির বির“দ্ধে তার নেতৃত্বাধীন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) যে প্রচারাভিযান চালায় তার তুলনা নেই। তিনি বাংলাদেশে আধুনিক নাগরিক আন্দোলনের জনক।
গত এক দশক ধরে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), টিআইবি এবং সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর সফল নেতৃত্ব দিয়েছেন অধ্যাপক মোজাফফর। তার দেখাদেখি বাংলাদেশে সামাজিক আন্দোলনে আরও অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসেন। কিভাবে আমিও তার সংগঠনগুলোর কর্মকাÊে জড়িয়ে পড়ি, তা আমার মনে নেই। ব্যক্তিগতভাবে আমি কিছু সামাজিক কাজ করি বহুদিন ধরে। কোন সংগঠনের সদস্যপদ বা পদ আমার পছন্দ নয়। তাতে ¯^াধীনভাবে কথা বলা যায় না। আমার নিজের মতো আমি অন্যায়-অবিচারের সাধ্যমতো প্রতিবাদ করাই পছন্দ করি। শ্রদ্ধেয় স্যার ও আমার বন্ধু অত্যš— পরিশ্রমী ও নিবেদিতকর্মী ড. বদিউল আলম মজুমদার তাদের অবাধ-নিরপে¶ নির্বাচনের ল¶্যে গঠিত সংগঠনের সঙ্গে আমাকে সম্পৃক্ত করেন। ১০ বছর ধরে আমি তার একজন অযোগ্য সহকর্মী হিসেবে তাকে খুব কাছে থেকে দেখেছি।
রাজনীতিকে দুর্নীতিমুক্ত করতে এবং গণতন্ত্রকে সুসংহত করতে স্থানীয় সরকার শক্তিশালী করা প্রয়োজন। সুষ্ঠু ও নিরপে¶ নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী ও ¯^াধীন করা দরকার। শুধু রাজনৈতিক দল নয়, নাগরিক সমাজও গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে বড় ভ‚মিকা পালন করে। আমাদের রাজনীতি দুর্বৃত্তায়িত ও কলুষিত। এসব অনাচার থেকে মুক্ত হয়ে একটি সুস্থ গণতান্ত্রিক ধারা প্রবর্তনের ল¶্যে প্রচার চালাতে এবং সৎ, যোগ্য প্রার্থীদের প¶ে জনমত তৈরির ল¶্যে ২০০২ সালে ‘সিটিজেনস ফর ইলেকশন’ নামে নাগরিকদের সংগঠন আÍপ্রকাশ করে মোজাফ্ফর স্যারের নেতৃত্বে। যা পরে নামকরণ হয় সুশাসনের জন্য নাগরিক বা সুজন। জনমত তৈরির জন্য গত ১০ বছরে কত যে সভা-সমাবেশ, গোলটেবিল, মানববন্ধন প্রভৃতি করা হয়েছে সারা দেশেÑ প্রতিটি জেলা উপজেলায়Ñ তার হিসাব বদিউল আলম মজুমদার দিতে পারবেন। কারণ তিনিই সংগঠনের মূল চালিকাশক্তি। তবে স্যার শিখÊীর মতো মাথার উপরে থাকেননি, অকল্পনীয় শারীরিক শ্রমও দিয়েছেন। রোদের ভেতরে সমাবেশ করতে গিয়ে স্যার মাথা ঘুরে পড়ে গেছেন। সোজা তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছি। ভেবেছি, তিনি আর কোন অনুষ্ঠানে যাবেন না। কিন্তু এক সপ্তাহ পরে ঠিকই এসেছেন। এসব কাজে তার বিন্দুমাত্র ব্যক্তিগত ¯^ার্থ ছিল না। এক পয়সা আর্থিক ¯^ার্থের তো প্রশ্নই আসে না।
আমাদের সমাজে বহুকাল থেকেই ¯ে^চ্ছাসমাজসেবক ছিলেন। আশির দশক থেকে বেসরকারি সংস্থা বা এনজিও কার্যক্রম শুর“ হয়। বিদেশ থেকে আসতে থাকে রাশি রাশি টাকা। ভলান্টারি সমাজসেবা বলে আর কিছু থাকল না। যুবসমাজ মজুরি বা আর্থিক সুবিধার বিনিময়ে এনজিওতে কাজ করতে লেগে যায়। শি¶িত বেকারের দেশে সেটা খুবই ¯^াভাবিক। টিআইবি একটি আš—র্জাতিক গবেষণাধর্মী এনজিও, তাছাড়া বাপা বা সুজন নাগরিক সংগঠন, যেখানে প্রয়োজনে সদস্যদের চাঁদা দিয়ে হলেও কাজ করতে হয়। মোজাফফর স্যার সারাদেশে কিছু ¯ে^চ্ছাসেবক পেয়েছিলেন, যারা নিঃ¯^ার্থভাবে তার নেতৃত্বে সামাজিক দায়িত্ব পালন করেছেন।
কোন্ প্রে¶িতে বাংলাদেশে মোজাফফর আহমদের নেতৃত্বে নাগরিক আন্দোলনের সূচনা তা ভেবে দেখতে হবে। গত শতাব্দীর শেষ দশকটি ছিল বাংলাদেশে ছদ্ম গণতন্ত্রের অনাচারের দশক। দুটি বড় দল এবং সেই দুই দলের দুই জনপ্রিয় নেত্রী পাঁচ বছর করে ভাগ করে দেশ শাসন করেন। দুটি সরকারই অধিকাংশ মানুষের সমর্থন নিয়ে ¶মতায় আসে। দীর্ঘ সামরিক শাসনের পরে তাদের কাছে জনগণের প্রত্যাশা ছিল গণতান্ত্রিক সুশাসন। আশির দশকে সামরিক ¯ৈ^রাচারের বির“দ্ধে দুই নেত্রীই বলিষ্ঠ ভ‚মিকা পালন করেন। তারা তখন অব্যাহতভাবে সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্র“তি দিয়েছেন। কিন্তু ¶মতা লাভের পর দুটি সরকারই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে নির্লজ্জ দলতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে। প্রশাসনকে দলীয়করণ করা হয়। রাজনৈতিক নেতা, মন্ত্রী, আমলারা দুর্নীতিতে ডুবে যান। আইনের শাসন, নাগরিক অধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ভ‚লুণ্ঠিত হয়। প্রাধান্য পায় পেশিশক্তি। রাষ্ট্রীয় সম্পদ হতে থাকে অবাধে লুণ্ঠন। সংসদকে করে রাখা হয় অকার্যকর। বিচার বিভাগও হয় দলীয়করণ। সাধারণ মানুষ হয়ে পড়ে অসহায় ও অবর“দ্ধ। প্রতিবাদকারীদের ওপর নেমে আসে নির্যাতন।
শতাব্দীর শেষ সরকারের ক্যাডার বাহিনীর অত্যাচারে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। টিআইবির জরিপে বাংলাদেশ হয় পৃথিবীতে এক নম্বর। দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্র“তি দিয়ে ২০০১-এ চারদলীয় সরকার ¶মতায় যায়। তাদের তখন ছিল বিপুল জনসমর্থন। কিন্তু নির্বাচনী অঙ্গীকার ভুলে গিয়ে তারা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা তো দূরের কথা, বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের ওপর অকারণে নির্যাতন-নিপীড়ন চালায়। ¶মতা গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে সব জর“রি কাজ ফেলে রেখে বিএনপি-জামায়াত ক্যাডার বাহিনী প্রতিহিংসায় উš§ত্ত হয়ে ওঠে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর, যাদের অনেকেই হিন্দু সম্প্রদায়ের, হামলা চালায়। তাদের বাড়িঘর তছনছ করে। তাদের থেকে জোর করে চাঁদা তোলে। মারধর করে। নারীর ওপর পর্যš— চালায় নির্যাতন। আমি তখন এক মাসে ১৪টি জেলায় নিজে ঘুরে দেখেছি কী ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল গ্রামগঞ্জে।
সেই পরিপ্রে¶িতে মোজাফফর স্যারের নেতৃত্বে নির্দলীয় নাগরিক আন্দোলনের সূচনা। স্যার নিজে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে ছিলেন অবিচল। যেসব সংগঠনে অথবা ফোরামে স্যারের সঙ্গে আমি কাজ করেছি, সেখানে তার বা সেই সংগঠনের নীতির সঙ্গে আমি অনেক সময় ভিন্নমত পোষণ করেছি। কখনও তার মতের সম্পূর্ণ বিপরীত কথায় তিনি প্রকাশ্যে বিব্রত হয়েছেন, কিন্তু বিরক্ত বা ¶ুব্ধ হননি। সাম্রাজ্যবাদের প্রশ্নে আমার অবস্থানকে তিনি সহ্য করেছেন। সব মতাদর্শের শাšি—পূর্ণ সহ-অবস্থানকে তিনি মূল্য দিতেন। আমার ভোগবাদবিরোধী দর্শনকে তিনি পছন্দ করতেন, কারণ তিনি নিজে ছিলেন ভোগবাদের ঘোরবিরোধী। যেসব প্রসঙ্গে তিনি কথা বলেছেন, যেমন রাজনীতি, গণতন্ত্র, অর্থনীতি, সমাজ পরিবর্তন, দুর্নীতির কারণ ও তার প্রতিকার প্রভৃতি, সেসব ব্যাপারে তার অত্যš— পরিষ্কার ধারণা ছিল। ভাসাভাসা জেনে তিনি কিছু বলতেন না। যা বলতেন বা করতেন, তা বিশ্বাস ও প্রত্যয় থেকে করতেন।
গত কয়েক বছর আমি তার সফরসঙ্গী হয়ে হাজার হাজার কিলোমিটার ঘুরেছি সারা দেশ। তিনি ছিলেন অত্যš— ধর্মপরায়ণ। ধর্ম ছিল তার ব্যক্তিগত চর্চার বিষয়। কোন রকম গোঁড়ামির লেশমাত্র ছিল না তার মধ্যে। নামাজ আদায় করতেন ও রোজা রাখতেন নিয়মিত। নামাজের সময় হলে গাড়ির মধ্যেই আমাদের পাশে বসে ১০ মিনিটে নামাজ পড়ে নিতেন। অনেকের মতো গাড়ি থামিয়ে মসজিদ খুঁজতে যেতেন না।
যেসব বিষয় আমাদের সমাজকে বিভক্ত করে ফেলেছে, সেসব ব্যাপারে আমি তার মধ্যে একটি যুক্তিবাদী ও সমš^য়ী অবস্থান দেখেছি। জিয়াউর রহমানের সরকারের উপদেষ্টা বা মন্ত্রী ছিলেন কিছুকাল। তাতে খুব ¯^াভাবিকভাবেই কেউ ধারণা করতে পারেন তিনি একজন বিএনপিপন্থী এবং আওয়ামী লীগের ঘোরবিরোধী। দীর্ঘ সময় আমি তার সঙ্গে একাšে— কাটিয়েছি। আমার মনে হয়নি তিনি আওয়ামীবিরোধী বা বিএনপিপন্থী। তিনি অকপটে আওয়ামী লীগের ভুলগুলোর কথা বলতেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতি ছিল তার গভীর শ্রদ্ধা। তবে তার ভুলগুলো গোপন করতেন না। কী কী করলে তিনি আরও ভালো করতেন সে কথাও বলতেন।
অযৌক্তিক ভারতবিরোধিতা ও সাম্প্রদায়িকতা অনেকেই গোপন রাখতে পারেন না। ভারত-বাংলাদেশের পরিবেশ নিয়ে, যৌথ নদী নিয়ে সীমাš— হত্যা নিয়ে, যখন তিনি কথা বলতেন, তখন তিনি ইস্যুটি নিয়ে কথা বলতেন, দেশটি নিয়ে নয়। সেই দেশের রাজনীতি নিয়ে নয়। বাংলাদেশে কারণে-অকারণে ভারতবিরোধী মানুষের সংখ্যা বিখ্যাতদের মধ্যে বহু। মোজাফফর স্যার বিন্দুমাত্র ভারতবিরোধী ছিলেন না। সাম্প্রদায়িকতা তার মধ্যে ছিল না। ভারতবর্ষের মহান সভ্যতা, ভারতের সমৃদ্ধ গণতান্ত্রিক রাজনীতির ঐতিহ্য, ভারতের অনর্ঘ্য সংস্কৃতির তিনি ছিলেন অবিচল অনুরাগী। কিন্তু পানির ন্যায্য হিস্যার প্রশ্নে, সীমাš— হত্যা প্রশ্নে, টিপাইমুখ বাঁধ প্রশ্নে তার অবস্থান ছিল স্পষ্ট ও আপসহীন।
আমাদের সমাজে নাগরিক সমাজের নেতারা বড় বড় দেশের দূতাবাসে ঘুর ঘুর করেন। ক‚টনীতিকদের বাড়িতে দাওয়াত খেয়ে ধন্য হন। বিদেশ সফরে যাওয়ার জন্য এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। কোন দূতাবাস ও ক‚টনীতিকের সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক বা যোগাযোগ ছিল না।
সরল জীবনযাপনের একটি ক্লাসিক উদাহরণ ছিলেন মোজাফফর আহমদ। সমাজে তিন পয়সা দাম নেই, এমন মানুষও আমাদের সমাজে নাক উঁচু করে চলেন। টেলিফোনটা নিজে ধরেন না। স্যার সব ফোন নিজে ধরতেন। যে কেউ অনায়াসে কোন সমস্যা নিয়ে কথা বলতে পারতেন তার সঙ্গে। যে কেউ তার সঙ্গে দেখা করতে পারতেন। কোন অহংকার ছিল না।
কর্ম¶েত্র ও আনুষ্ঠানিক সভা-সমাবেশের বাইরে একজন মানুষের যে দৈনন্দিন জীবনযাপন তাতেই মানুষ হিসেবে তার সত্যিকারের পরিচয় পাওয়া যায়। তার প্রাত্যহিক জীবনযাপনের ধারা এতই সাদাসিধা ছিল যে, তা না দেখলে একালের মধ্যবিত্ত ও উঠতি উচ্চমধ্যবিত্তদের বোঝানো যাবে না। অপচয় ও অপব্যয় অপছন্দ করতেন। নিজে করতেন না, অন্যকেও করতে নির“ৎসাহিত করতেন। তিনি ছিলেন অকপট, সত্যনিষ্ঠ, ন্যায়পরায়ণ ও স্পষ্টভাষী। হঠাৎ তার চলে যাওয়া অপ্রত্যাশিত ছিল না, কিন্তু জাতির ঠিক এই মুহূর্তে তার আর কিছুকাল বেঁচে থাকার প্রয়োজন ছিল।
গণতন্ত্র সংহত করা, নাগরিক অধিকার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে একুশ শতকের প্রথম দশকে বাংলাদেশে যে নাগরিক আন্দোলনের সূচনা মোজাফফর আহমদের নেতৃত্বে, তার ঐতিহাসিক তাৎপর্য ভবিষ্যৎ প্রজšে§র মানুষ মূল্যায়ন করবেন। এবং সেই মূল্যায়নই হবে যথার্থ মূল্যায়ন। আমরা যারা তার সঙ্গে একত্রে কাজ করেছি, তাদের সে সম্পর্কে কিছু না বলাই শোভন।
সৈয়দ আবুল মকসুদ : লেখক ও গবেষক
শিল্প-সাহিত্য ও শি¶া-সংস্কৃতি ¶েত্রে আমাদের কেউ মারা গেলে, তার মৃত্যুতে ‘জাতির অপূরণীয় ¶তি হল’ অথবা তার চলে যাওয়ায় ‘যে শূন্যতার সৃষ্টি হল তা সহজে পূরণ হওয়ার নয়’Ñ বলা যেন আমাদের একটি অর্থহীন অভ্যাস বা প্রথায় পরিণত হয়েছে। শীর্ষ সরকারি নেতারাও এ ভাষাতেই শোকবাণী দেন। অথচ যিনি মারা যান, তার কোন গুর“ত্বপূর্ণ কাজ দেখতে পায়নি দেশের মানুষ ৩০ বছরেও। দেশের মানুষের জন্য তার ত্যাগ নেই এক ছটাক। পুঁজি শুধু কোন এক সময়ে কিছু কাজ করার খ্যাতিটুকু। আমাদের আবেগতাড়িত, যুক্তিবিবর্জিত ও কর্মবিমুখ সমাজে এখনও এমন মানুষ কেউ কেউ আছেন, যাদের মৃত্যুতে আ¶রিক অর্থেই অপূরণীয় শূন্যতার সৃষ্টি হয়। তারা অপ্রতিকল্পনীয়। যাদের পরিবর্তে আর একজন খুঁজে পাওয়া যায় না। তাদেরই একজন ছিলেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ।
কর্মজীবনে অর্থাৎ চাকরি-বাকরিতে মোজাফফর আহমদ কী কী প্রাতিষ্ঠানিক বা প্রশাসনিক পদে দায়িত্ব পালন করেন, তা কোন বিবেচ্য বিষয় নয়। ওসব পদে বহু মানুষই দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স পরী¶া দিয়েই হরগঙ্গা কলেজে শি¶কতা শুর“ করেন। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে যোগ দেন। শি¶কতা ছেড়ে দিয়ে ষাটের দশকে একটি বেসরকারি ব্যাংক এবং পূর্ব পাকি¯—ান শিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশনে কাজ করেন। শি¶ায়তনিক ও তাত্তি¡ক জ্ঞানের সঙ্গে ওই দুই প্রতিষ্ঠানে কাজ করার ফলে তিনি ব্যাংকিং ও শিল্প প্রতিষ্ঠান পরিচালনার অভিজ্ঞতা অর্জন করেন।
¯^াধীনতার পর ১৯৭২ সালে গঠিত বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনে তিনি যোগ দেন। ১৯৭৪ সালে পরিকল্পনা কমিশন থেকে পদত্যাগ করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা প্রশাসন ইন্সটিটিউটে (আইবিএ) অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। তিনি ও তার কয়েকজন সুযোগ্য সহকর্মীর প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের একটি শীর্ষ শি¶া প্রতিষ্ঠান হিসেবে ¯^ীকৃতি পায় আইবিএ। এই প্রতিষ্ঠানের সুনাম আজও অ¶ুণœ। বাংলাদেশে বেসরকারি পর্যায়ে যে বহু দ¶ প্রশাসনিক কর্মকর্তা তৈরি হয়েছেন গত ৪৫ বছরে, তার কৃতিত্ব আইবিএ’র। সে¶েত্রে মোজাফফর আহমদের অবদান রয়েছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্প-কারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের দ¶ প্রশাসকদের অনেকেই তার প্রত্য¶ ছাত্র।
যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি পিএইচডি করেন ১৯৬৫ সালে। সেখানে তার শি¶কদের কয়েকজন ছিলেন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী। তার সহপাঠী বব লুকাস অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পান। তার প্রাতিষ্ঠানিক শি¶ার মান তার সমসাময়িক অনেকের চেয়ে এবং তার অনেক সহকর্মীর চেয়ে উঁচু ছিল বলে তার ঘনিষ্ঠদের অভিমত।
উচ্চশি¶া প্রতিষ্ঠানে জীবিকার জন্য শি¶কতার চাকরি করা নয়, মোজাফফর আহমদ ছিলেন একজন আদর্শ শি¶াবিদ। ছাত্রদের তিনি উপযুক্ত শি¶া দান করতেন। তার নিজের শি¶ার ভিত্তিও ছিল খুব মজবুত। তার স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠীদের কাছে শুনেছি, সেখানে ৪০-এর শেষ ও ৫০-এর শুর“তে তার সাইকেলের পেছনের ক্যারিয়ারে সব সময় কিছু বই থাকত। শুধু ঘরে নয়, বাইরেও সময় পেলে তিনি পড়তেন। তা নিয়ে তার বন্ধুরা হাসি-ঠাট্টা করতেন। তবে সবাই ¯^ীকার করেন যে তিনি বা¯—বিকই খুব পড়-য়া ছিলেন। দেশে ও দেশের বাইরে তিনি আদর্শ শি¶কদের কাছে পাঠ নিয়েছেন, নিজে হওয়ার চেষ্টা করেছেন আদর্শ শি¶ক।
তার অগণিত অনুরাগীর অনেকেই জানেন না, মোজাফ্ফর আহমদ ছিলেন একটি ঐতিহ্যবাহী শি¶িত মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ। তিনি প্রথম জেনারেশন আধুনিক শি¶িত ছিলেন না। তার গ্রামের বাড়ি আর আমাদের গ্রামের বাড়ির দূরত্ব ছিল মাইল পাঁচেক। আমাদের দুই গ্রামই ছিল পদ্মা নদীর পাড়ে। দুটিই আজ নদীগর্ভে। উনিশ শতক থেকেই আমাদের দুই পরিবারের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। তার বাবা-চাচারা এবং তাদের বাবা-চাচারা ছিলেন উনিশ শতক থেকেই আধুনিক ইংরেজি শি¶ায় শি¶িত। তার দাদার ভাই মবিনউদ্দিন আহমদ গত শতাব্দীর প্রথম দিকে একজন সৎ ও ন্যায়পরায়ণ উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে সারা বাংলায় পরিচিত ছিলেন। তখন বাংলায় উচ্চপদস্থ বাঙালি মুসলিম সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন হাতেগোনা।
কাস্টমস ও আবগারি বিভাগের ক্যাডার সার্ভিসের পদস্থ কর্মকর্তা ছাড়াও, মবিনউদ্দিন আহমদ একজন লেখক হিসেবেও সুপরিচিত ছিলেন। তার লেখনী নাম ছিল মবিনউদ্দিন আহমদ জাহাঙ্গীরনগরী। আগের দিনে ঢাকা জেলার অনেকে তাদের নামের শেষে জাহাঙ্গীরনগরী লিখতেন। তিনি ছিলেন আমার দাদার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মবিনউদ্দিন আহমদের সবচেয়ে বিখ্যাত গ্রন্থটি ছিল ‘কোরআনতত্ত¡’। এই ইসলামী ধর্মতত্তে¡র বইটি ছিল তিন খÊে। সংস্কারমুক্ত মন নিয়ে লেখা। তিনটি খÊই আমার আব্বার সংগ্রহে ছিল। দুটি খÊ তিনি মুহম্মদ মনসুরউদ্দিনের পীড়াপীড়িতে তাকে দেন। আর ফেরত পাওয়া যায়নি। একটি খÊ জীর্ণ হয়ে গেলেও আমার কাছে আছে। এ ধরনের বই পুনর্মুদ্রিত হওয়া দরকার। ইসলামী দর্শনের ওপর তার আরও রচনা রয়েছে।
অধ্যাপক মোজাফফরের অর্থনীতি বিষয়ে মূল্যবান রচনা রয়েছে। শেষ জীবনে তার ইচ্ছা ছিল মহানবী (সা.) ও ইসলামী দর্শন বিষয়ে কিছু লিখবেন। কিন্তু গত ১০ বছর ধরে তার একটি দিনও অবসর ছিল না। আইনের শাসন, গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান, স্থানীয় সরকার শক্তিশালী করা, পরিবেশের বিপর্যয় রোধ প্রভৃতি বিষয়ে আন্দোলন ও অনুষ্ঠানে তাকে প্রতিদিন অংশগ্রহণ করতে হতো। দুর্র্নীতির বির“দ্ধে তার নেতৃত্বাধীন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) যে প্রচারাভিযান চালায় তার তুলনা নেই। তিনি বাংলাদেশে আধুনিক নাগরিক আন্দোলনের জনক।
গত এক দশক ধরে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), টিআইবি এবং সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর সফল নেতৃত্ব দিয়েছেন অধ্যাপক মোজাফফর। তার দেখাদেখি বাংলাদেশে সামাজিক আন্দোলনে আরও অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসেন। কিভাবে আমিও তার সংগঠনগুলোর কর্মকাÊে জড়িয়ে পড়ি, তা আমার মনে নেই। ব্যক্তিগতভাবে আমি কিছু সামাজিক কাজ করি বহুদিন ধরে। কোন সংগঠনের সদস্যপদ বা পদ আমার পছন্দ নয়। তাতে ¯^াধীনভাবে কথা বলা যায় না। আমার নিজের মতো আমি অন্যায়-অবিচারের সাধ্যমতো প্রতিবাদ করাই পছন্দ করি। শ্রদ্ধেয় স্যার ও আমার বন্ধু অত্যš— পরিশ্রমী ও নিবেদিতকর্মী ড. বদিউল আলম মজুমদার তাদের অবাধ-নিরপে¶ নির্বাচনের ল¶্যে গঠিত সংগঠনের সঙ্গে আমাকে সম্পৃক্ত করেন। ১০ বছর ধরে আমি তার একজন অযোগ্য সহকর্মী হিসেবে তাকে খুব কাছে থেকে দেখেছি।
রাজনীতিকে দুর্নীতিমুক্ত করতে এবং গণতন্ত্রকে সুসংহত করতে স্থানীয় সরকার শক্তিশালী করা প্রয়োজন। সুষ্ঠু ও নিরপে¶ নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী ও ¯^াধীন করা দরকার। শুধু রাজনৈতিক দল নয়, নাগরিক সমাজও গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে বড় ভ‚মিকা পালন করে। আমাদের রাজনীতি দুর্বৃত্তায়িত ও কলুষিত। এসব অনাচার থেকে মুক্ত হয়ে একটি সুস্থ গণতান্ত্রিক ধারা প্রবর্তনের ল¶্যে প্রচার চালাতে এবং সৎ, যোগ্য প্রার্থীদের প¶ে জনমত তৈরির ল¶্যে ২০০২ সালে ‘সিটিজেনস ফর ইলেকশন’ নামে নাগরিকদের সংগঠন আÍপ্রকাশ করে মোজাফ্ফর স্যারের নেতৃত্বে। যা পরে নামকরণ হয় সুশাসনের জন্য নাগরিক বা সুজন। জনমত তৈরির জন্য গত ১০ বছরে কত যে সভা-সমাবেশ, গোলটেবিল, মানববন্ধন প্রভৃতি করা হয়েছে সারা দেশেÑ প্রতিটি জেলা উপজেলায়Ñ তার হিসাব বদিউল আলম মজুমদার দিতে পারবেন। কারণ তিনিই সংগঠনের মূল চালিকাশক্তি। তবে স্যার শিখÊীর মতো মাথার উপরে থাকেননি, অকল্পনীয় শারীরিক শ্রমও দিয়েছেন। রোদের ভেতরে সমাবেশ করতে গিয়ে স্যার মাথা ঘুরে পড়ে গেছেন। সোজা তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছি। ভেবেছি, তিনি আর কোন অনুষ্ঠানে যাবেন না। কিন্তু এক সপ্তাহ পরে ঠিকই এসেছেন। এসব কাজে তার বিন্দুমাত্র ব্যক্তিগত ¯^ার্থ ছিল না। এক পয়সা আর্থিক ¯^ার্থের তো প্রশ্নই আসে না।
আমাদের সমাজে বহুকাল থেকেই ¯ে^চ্ছাসমাজসেবক ছিলেন। আশির দশক থেকে বেসরকারি সংস্থা বা এনজিও কার্যক্রম শুর“ হয়। বিদেশ থেকে আসতে থাকে রাশি রাশি টাকা। ভলান্টারি সমাজসেবা বলে আর কিছু থাকল না। যুবসমাজ মজুরি বা আর্থিক সুবিধার বিনিময়ে এনজিওতে কাজ করতে লেগে যায়। শি¶িত বেকারের দেশে সেটা খুবই ¯^াভাবিক। টিআইবি একটি আš—র্জাতিক গবেষণাধর্মী এনজিও, তাছাড়া বাপা বা সুজন নাগরিক সংগঠন, যেখানে প্রয়োজনে সদস্যদের চাঁদা দিয়ে হলেও কাজ করতে হয়। মোজাফফর স্যার সারাদেশে কিছু ¯ে^চ্ছাসেবক পেয়েছিলেন, যারা নিঃ¯^ার্থভাবে তার নেতৃত্বে সামাজিক দায়িত্ব পালন করেছেন।
কোন্ প্রে¶িতে বাংলাদেশে মোজাফফর আহমদের নেতৃত্বে নাগরিক আন্দোলনের সূচনা তা ভেবে দেখতে হবে। গত শতাব্দীর শেষ দশকটি ছিল বাংলাদেশে ছদ্ম গণতন্ত্রের অনাচারের দশক। দুটি বড় দল এবং সেই দুই দলের দুই জনপ্রিয় নেত্রী পাঁচ বছর করে ভাগ করে দেশ শাসন করেন। দুটি সরকারই অধিকাংশ মানুষের সমর্থন নিয়ে ¶মতায় আসে। দীর্ঘ সামরিক শাসনের পরে তাদের কাছে জনগণের প্রত্যাশা ছিল গণতান্ত্রিক সুশাসন। আশির দশকে সামরিক ¯ৈ^রাচারের বির“দ্ধে দুই নেত্রীই বলিষ্ঠ ভ‚মিকা পালন করেন। তারা তখন অব্যাহতভাবে সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্র“তি দিয়েছেন। কিন্তু ¶মতা লাভের পর দুটি সরকারই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে নির্লজ্জ দলতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে। প্রশাসনকে দলীয়করণ করা হয়। রাজনৈতিক নেতা, মন্ত্রী, আমলারা দুর্নীতিতে ডুবে যান। আইনের শাসন, নাগরিক অধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ভ‚লুণ্ঠিত হয়। প্রাধান্য পায় পেশিশক্তি। রাষ্ট্রীয় সম্পদ হতে থাকে অবাধে লুণ্ঠন। সংসদকে করে রাখা হয় অকার্যকর। বিচার বিভাগও হয় দলীয়করণ। সাধারণ মানুষ হয়ে পড়ে অসহায় ও অবর“দ্ধ। প্রতিবাদকারীদের ওপর নেমে আসে নির্যাতন।
শতাব্দীর শেষ সরকারের ক্যাডার বাহিনীর অত্যাচারে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। টিআইবির জরিপে বাংলাদেশ হয় পৃথিবীতে এক নম্বর। দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্র“তি দিয়ে ২০০১-এ চারদলীয় সরকার ¶মতায় যায়। তাদের তখন ছিল বিপুল জনসমর্থন। কিন্তু নির্বাচনী অঙ্গীকার ভুলে গিয়ে তারা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা তো দূরের কথা, বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের ওপর অকারণে নির্যাতন-নিপীড়ন চালায়। ¶মতা গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে সব জর“রি কাজ ফেলে রেখে বিএনপি-জামায়াত ক্যাডার বাহিনী প্রতিহিংসায় উš§ত্ত হয়ে ওঠে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর, যাদের অনেকেই হিন্দু সম্প্রদায়ের, হামলা চালায়। তাদের বাড়িঘর তছনছ করে। তাদের থেকে জোর করে চাঁদা তোলে। মারধর করে। নারীর ওপর পর্যš— চালায় নির্যাতন। আমি তখন এক মাসে ১৪টি জেলায় নিজে ঘুরে দেখেছি কী ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল গ্রামগঞ্জে।
সেই পরিপ্রে¶িতে মোজাফফর স্যারের নেতৃত্বে নির্দলীয় নাগরিক আন্দোলনের সূচনা। স্যার নিজে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে ছিলেন অবিচল। যেসব সংগঠনে অথবা ফোরামে স্যারের সঙ্গে আমি কাজ করেছি, সেখানে তার বা সেই সংগঠনের নীতির সঙ্গে আমি অনেক সময় ভিন্নমত পোষণ করেছি। কখনও তার মতের সম্পূর্ণ বিপরীত কথায় তিনি প্রকাশ্যে বিব্রত হয়েছেন, কিন্তু বিরক্ত বা ¶ুব্ধ হননি। সাম্রাজ্যবাদের প্রশ্নে আমার অবস্থানকে তিনি সহ্য করেছেন। সব মতাদর্শের শাšি—পূর্ণ সহ-অবস্থানকে তিনি মূল্য দিতেন। আমার ভোগবাদবিরোধী দর্শনকে তিনি পছন্দ করতেন, কারণ তিনি নিজে ছিলেন ভোগবাদের ঘোরবিরোধী। যেসব প্রসঙ্গে তিনি কথা বলেছেন, যেমন রাজনীতি, গণতন্ত্র, অর্থনীতি, সমাজ পরিবর্তন, দুর্নীতির কারণ ও তার প্রতিকার প্রভৃতি, সেসব ব্যাপারে তার অত্যš— পরিষ্কার ধারণা ছিল। ভাসাভাসা জেনে তিনি কিছু বলতেন না। যা বলতেন বা করতেন, তা বিশ্বাস ও প্রত্যয় থেকে করতেন।
গত কয়েক বছর আমি তার সফরসঙ্গী হয়ে হাজার হাজার কিলোমিটার ঘুরেছি সারা দেশ। তিনি ছিলেন অত্যš— ধর্মপরায়ণ। ধর্ম ছিল তার ব্যক্তিগত চর্চার বিষয়। কোন রকম গোঁড়ামির লেশমাত্র ছিল না তার মধ্যে। নামাজ আদায় করতেন ও রোজা রাখতেন নিয়মিত। নামাজের সময় হলে গাড়ির মধ্যেই আমাদের পাশে বসে ১০ মিনিটে নামাজ পড়ে নিতেন। অনেকের মতো গাড়ি থামিয়ে মসজিদ খুঁজতে যেতেন না।
যেসব বিষয় আমাদের সমাজকে বিভক্ত করে ফেলেছে, সেসব ব্যাপারে আমি তার মধ্যে একটি যুক্তিবাদী ও সমš^য়ী অবস্থান দেখেছি। জিয়াউর রহমানের সরকারের উপদেষ্টা বা মন্ত্রী ছিলেন কিছুকাল। তাতে খুব ¯^াভাবিকভাবেই কেউ ধারণা করতে পারেন তিনি একজন বিএনপিপন্থী এবং আওয়ামী লীগের ঘোরবিরোধী। দীর্ঘ সময় আমি তার সঙ্গে একাšে— কাটিয়েছি। আমার মনে হয়নি তিনি আওয়ামীবিরোধী বা বিএনপিপন্থী। তিনি অকপটে আওয়ামী লীগের ভুলগুলোর কথা বলতেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতি ছিল তার গভীর শ্রদ্ধা। তবে তার ভুলগুলো গোপন করতেন না। কী কী করলে তিনি আরও ভালো করতেন সে কথাও বলতেন।
অযৌক্তিক ভারতবিরোধিতা ও সাম্প্রদায়িকতা অনেকেই গোপন রাখতে পারেন না। ভারত-বাংলাদেশের পরিবেশ নিয়ে, যৌথ নদী নিয়ে সীমাš— হত্যা নিয়ে, যখন তিনি কথা বলতেন, তখন তিনি ইস্যুটি নিয়ে কথা বলতেন, দেশটি নিয়ে নয়। সেই দেশের রাজনীতি নিয়ে নয়। বাংলাদেশে কারণে-অকারণে ভারতবিরোধী মানুষের সংখ্যা বিখ্যাতদের মধ্যে বহু। মোজাফফর স্যার বিন্দুমাত্র ভারতবিরোধী ছিলেন না। সাম্প্রদায়িকতা তার মধ্যে ছিল না। ভারতবর্ষের মহান সভ্যতা, ভারতের সমৃদ্ধ গণতান্ত্রিক রাজনীতির ঐতিহ্য, ভারতের অনর্ঘ্য সংস্কৃতির তিনি ছিলেন অবিচল অনুরাগী। কিন্তু পানির ন্যায্য হিস্যার প্রশ্নে, সীমাš— হত্যা প্রশ্নে, টিপাইমুখ বাঁধ প্রশ্নে তার অবস্থান ছিল স্পষ্ট ও আপসহীন।
আমাদের সমাজে নাগরিক সমাজের নেতারা বড় বড় দেশের দূতাবাসে ঘুর ঘুর করেন। ক‚টনীতিকদের বাড়িতে দাওয়াত খেয়ে ধন্য হন। বিদেশ সফরে যাওয়ার জন্য এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। কোন দূতাবাস ও ক‚টনীতিকের সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক বা যোগাযোগ ছিল না।
সরল জীবনযাপনের একটি ক্লাসিক উদাহরণ ছিলেন মোজাফফর আহমদ। সমাজে তিন পয়সা দাম নেই, এমন মানুষও আমাদের সমাজে নাক উঁচু করে চলেন। টেলিফোনটা নিজে ধরেন না। স্যার সব ফোন নিজে ধরতেন। যে কেউ অনায়াসে কোন সমস্যা নিয়ে কথা বলতে পারতেন তার সঙ্গে। যে কেউ তার সঙ্গে দেখা করতে পারতেন। কোন অহংকার ছিল না।
কর্ম¶েত্র ও আনুষ্ঠানিক সভা-সমাবেশের বাইরে একজন মানুষের যে দৈনন্দিন জীবনযাপন তাতেই মানুষ হিসেবে তার সত্যিকারের পরিচয় পাওয়া যায়। তার প্রাত্যহিক জীবনযাপনের ধারা এতই সাদাসিধা ছিল যে, তা না দেখলে একালের মধ্যবিত্ত ও উঠতি উচ্চমধ্যবিত্তদের বোঝানো যাবে না। অপচয় ও অপব্যয় অপছন্দ করতেন। নিজে করতেন না, অন্যকেও করতে নির“ৎসাহিত করতেন। তিনি ছিলেন অকপট, সত্যনিষ্ঠ, ন্যায়পরায়ণ ও স্পষ্টভাষী। হঠাৎ তার চলে যাওয়া অপ্রত্যাশিত ছিল না, কিন্তু জাতির ঠিক এই মুহূর্তে তার আর কিছুকাল বেঁচে থাকার প্রয়োজন ছিল।
গণতন্ত্র সংহত করা, নাগরিক অধিকার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে একুশ শতকের প্রথম দশকে বাংলাদেশে যে নাগরিক আন্দোলনের সূচনা মোজাফফর আহমদের নেতৃত্বে, তার ঐতিহাসিক তাৎপর্য ভবিষ্যৎ প্রজšে§র মানুষ মূল্যায়ন করবেন। এবং সেই মূল্যায়নই হবে যথার্থ মূল্যায়ন। আমরা যারা তার সঙ্গে একত্রে কাজ করেছি, তাদের সে সম্পর্কে কিছু না বলাই শোভন।
সৈয়দ আবুল মকসুদ : লেখক ও গবেষক
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন