সোমবার, ৭ মে, ২০১২

হিলারি-পরামর্শ এবং আমাদের দেশপ্রেম



 ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ  |  মঙ্গলবার, ৮ মে ২০১২, 
সৈ য়দ মুজতবা আলীর ‘দেশে বিদেশে’ অনেকেরই পড়া আছে। সেই আবদুর রহমানের কথা। আফগান পরিচারক আবদুর রহমান গর্বের সাথে তার দেশের প্রকৃতি আর আবহাওয়ার বর্ণনা দিচ্ছিলেন লেখকের কাছে। লেখক বরফাচ্ছাদিত পর্বত সঙ্কুল দেশের প্রকৃতিতে গর্ব করে উপস্থাপন করার কিছু দেখতে পেলেন না। সে কথা আবদুর রহমানকে বলায় তার বিশাল দেহ গহ্বর থেকে বেরিয়ে এলো শব্দ ‘ইনহাস্ত ওয়াতনম’ অর্থাত্ তবুতো আমার জন্মভূমি। একজন দেশপ্রেমিক আবদুর রহমান এভাবেই দেশের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করেছিলেন। আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় প্রকৃত অর্থে গণতন্ত্র চর্চা থাকলে সে সমাজের মানুষের দেশের প্রতি মমত্ববোধ অনেক বেশি সক্রিয় থাকে বলে সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন। ১৯৯১ সালের একটি খণ্ডচিত্র মনে করতে পারছি। তখন আমি গবেষণার কাজে কিছুকাল কলকাতায় কাটিয়েছিলাম। আমি থাকতাম উত্তর কলকাতায় শ্যামবাজারের কাছে। এক পড়ন্ত বিকেলে ট্যাক্সি করে ধর্মতলা থেকে বাসায় ফিরছি। আমার পরিচিত রাস্তা। রাজাবাজার পার হতেই ট্যাক্সি চালক হঠাত্ কিছু না বলে প্রধান সড়ক থেকে একটি গলি পথের দিকে মাথা ঘোরালেন। আমি খানিকটা ভয় পেলাম। কোনো অসত্ উদ্দেশ্য নয়তো! একটু এগিয়ে একপাশে গাড়ি থামিয়ে দরজা খুলে হনহন করে এগিয়ে গেলেন চালক। আমার চোখ অনুসরণ করলো তাকে। লক্ষ্য করলাম রাস্তার পাশে সরকারি কলের পাইপ থেকে পানি পড়ছে। ড্রাইভার কাছে গিয়ে চাবি ঘুরিয়ে কল বন্ধ করে ফিরে এলেন। নিঃশব্দে স্ট্রার্ট দিলেন ট্যাক্সি।
আমি চালকের এই নাগরিক বোধ দেখে আপ­ুত হলাম। দেশাত্ববোধ থেকে এমন সচেতনতার জন্ম হয়। তাই আজো আমার স্মৃতিতে এই ছবিটি স্পষ্ট। বুঝলাম যে ভারতে দীর্ঘদিন থেকে গণতন্ত্র চর্চা হচ্ছে সেখানে মানুষের মধ্যে দেশাত্মবোধ জাগরুক থাকবেই। বাংলাদেশের মানুষের দেশাত্ববোধ আরো তীব্র হওয়ার কথা। অন্তত ইতিহাস সে কথা বলে। দেড় থেকে দুই হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দে বহিরাগত আর্য আগমন ঠেকিয়ে দিয়েছিল এ দেশের আদিবাসী কোল, ভিল, সাঁওতালরা। এরপর হাজার বছরের ইতিহাস একই রকম উজ্জ্বল। বার বার এ  দেশের মানুষ বিদেশি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। আর এর ধারাবাহিকতায় আমরা মুক্তিযুদ্ধের মহাকাব্য রচনা করতে পেরেছিলাম। ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার এমন প্রণোদনা আমাদের দেশপ্রেমের জায়গাটিকে শক্ত ভিত্তি দেয়ার কথা। সাধারণ মানুষ নিশ্চয়ই কমবেশি তা ধারণ করে। কিন্তু এদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের ব্যর্থতা ক্রমে দুর্বল করে ফেলতে থাকে দেশপ্রেমের জায়গাটিকে। প্রকৃত অর্থে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো এখনো তৈরি করতে পারেনি। দলতন্ত্র, গোষ্ঠীতন্ত্র আধিপত্য লাভ করায় দাপুটে রাজনীতিকদের চেতনায় ও আচরণে নীতিহীনতা জায়গা করে নিয়েছে। তাই তাদের মধ্য থেকে যেন অপসৃত হচ্ছে দেশপ্রেম ও স্বাজাত্যবোধ। বড় দলগুলোর নেতৃত্বের মধ্যে রাষ্ট্রক্ষমতা প্রাপ্তি একমাত্র আরাধ্য হওয়ায় তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন যেন। তাই এসব দলের নেতানেত্রীরা যেন ভুলতে বসেছেন বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। এ কারণে নিজ নিজ রাজনৈতিক সুবিধা লাভের জন্য মোড়ল দেশগুলোর কাছে নতজানু হতে কিছুমাত্র দ্বিধাগ্রস্ত হন না। অবলীলায় দেশকে অসম্মানিত করেন।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। তিনি এমন এক সময়ে ঘুরে গেলেন যখন সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশে এক ধরনের অস্থিরতা চলছে। এদেশে নির্বাচন ঘনিয়ে এলে ক্ষমতাপ্রিয় বিরোধী দল আত্মবিশ্বাসের অভাবে নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক পথে না হেঁটে ক্রমে খ্যাপাটে হয়ে যেতে থাকে। নিয়মতান্ত্রিক পথে হাঁটার চেষ্টা সরকারি দলের অভ্যাসেও নেই। তাই দলীয় নীতি নির্ধারকরা নানা রকমের দলন পীড়নের নীতিকেই আরাধ্য জ্ঞান করে তা প্রয়োগের মাধ্যমে নিজেদের অস্তিত্ব ধরে রাখতে চান। ফলে নির্বাচনের সময় যত ঘনিয়ে আসতে থাকে ততই অস্থিরতা বাড়তে থাকে দেশে।
এই ফর্মূলাতেই প্রধান বিরোধী দল বিএনপির মধ্যে চঞ্চলতা দেখা দিয়েছে প্রায় এক বছর আগে থেকেই। এই দলের প্রধান বন্ধু জামায়াতে ইসলামী মানবতা বিরোধী অপরাধীদের বিচার কার্যক্রম শুরু হওয়ায় অনেকটা কোনঠাসা। বিএনপির পক্ষপুটে এক ধরনের আশ্রয়ে আছে তারা। তাই বিএনপিকেই রাজনীতির ময়দানে সরব থাকতে হচ্ছে। ছোটখাটো হরতাল কর্মসূচি দিয়ে ওয়ার্মআপ সেশন চলেছিল। জনস্বার্থ কেন্দ্রিক ইস্যুর চেয়ে সংকীর্ণ দলীয় ইস্যু নিয়ে আন্দোলনের এহেন মহড়ার গা গরম সেশন তেমন সাড়া তুলতে পারেনি। রোডমার্চ কর্মসূচি এরচেয়ে বেশি সফল ছিল। কর্মী- সমর্থকদের সংগঠিত করতে রোডমার্চের সাফল্য প্রসংশিত হয়েছে। কিন্তু নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি করার অভ্যাস না থাকায় সরকার পতনের আন্দোলনের জন্য মরিয়া বিএনপি। তাই বড় কোনো ইস্যু খোঁজায় ছটফট করছিলেন দলের নেতা-নেত্রীরা। যেভাবেই হোক শেষ পর্যন্ত একটু ইস্যু হাতে এলো দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার মধ্যদিয়ে। বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলী ড্রাইভারসহ নিখোঁজ হলেন। দেখা গেল ইলিয়াস আলীকে খোঁজার চেয়ে বিএনপি এই ঘটনাকে অনেক বেশি মোক্ষম ইস্যু ভাবতেই পছন্দ করছে। ইলিয়াস আলী নিখোঁজের সাথে দেশের অবনতিশীল আইন- শৃঙ্খলা পরিস্থিতির বাস্তবতাটি অনেক বেশি স্পষ্ট। সরকারের উপর অর্পিত দায়িত্ব হচ্ছে ইলিয়াস আলীকে খুঁজে বের করা। কিন্তু আমাদের হতাশ করে দিয়ে সরকার এবং বিরোধী দলের প্রধান ও অপেক্ষাকৃত কম প্রধানরা নিষ্ঠুর রাজনৈতিক ভাষণে বে­ম গেমের প্রতিযোগিতাতেই ব্যস্ত রইলেন। ইলিয়াস আলী নিখোঁজ এই সত্যের চেয়ে এই মুহূর্তে আর কোনো কিছুই সত্য নয়। ইলিয়াস আলী অন্তর্ধানের আগেও অনেক ‘অপ্রধান’ মানুষ গুম-খুন হয়েছেন। তারা তেমন মূল্যবান ছিলেন না রাজনীতিকদের কাছে। তাই তেমন সরব প্রতিবাদ হয়নি। ইলিয়াস আলী উদ্ধারে সরকারের ওপর রাজনৈতিক চাপ অবশ্যই রাখতে পারে বিএনপি। যদি বিএনপি তথ্য প্রমাণে নিশ্চিত হতে পারতো সরকারের হাতেই বন্দি আছেন তাঁদের নেতা। এতে সর্বশ্রেণীর মানুষের মানবিক সমর্থনও পেতো দলটি। কিন্তু বিএনপি সরকারকে শাস্তি দিতে গিয়ে একজন ইলিয়াস আলী ও তাঁর ড্রাইভার নিখোঁজ হওয়ায় সমগ্র জাতিকে শাস্তি দিতে মাঠে নামলো কেন বোঝা গেল না। প্রায় ব্যক্তিক এমন ইস্যুতে দেশ জুড়ে পাঁচটি পূর্ণ দিবস হরতাল চাপিয়ে দিল জনগণের ঘাড়ে। অমানবিকভাবে দেশ ও জাতির অপূরণীয় ক্ষতিসাধন করলো। দেশ ও জাতির জন্য আরো শাস্তি অপেক্ষা করছে বলে এখন শাসাচ্ছেন বিএনপি নেতারা।  যেহেতু ইলিয়াস আলী অন্তর্ধান বিষয়টি ফয়সালার জন্য বিএনপি আন্তর্জাতিক আদালতের দ্বারস্থ হয়নি তাই মানতেই হবে এটি এখনো আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। কিন্তু খটকা লেগেছিল তখন যখন হিলারি বাংলাদেশে আসবেন শুনেই বিএনপি নেতারা এ কথা হিলারির কানে তুলবেন বলে আওয়াজ দিচ্ছিলেন। সচেতন দেশপ্রেমিক মানুষের স্বাজাত্যবোধে এমন ধারা আচরণ আঘাত করবে সন্দেহ নেই। একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের মানুষ নিজের অভ্যন্তরীণ সমস্যা সংকট যৌক্তিকভাবে নিজেরা মেটানোর চেষ্টা করার বদলে একজন বিদেশি মেহমানের কাছে বিচার দেয়া কতটা সম্মানের তা আমাদের রাজনীতিকরা ভাবেন কিনা আমরা জানি না। হিলারি ক্লিনটন বেগম জিয়ার সাথে সাক্ষাত্ করতে গেলে বিএনপি নেতারা এই বিদেশিনীর কাছে দেশের অবনতিশীল আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির কথা তুলে ধরেন। আবেগঘন পরিবেশ সৃষ্টির জন্য ইলিয়াস আলীর শিশুকন্যাকে আগেই সভাকক্ষে এনে রাখা হয়। ওর হাতে আবেদনপত্র দিয়ে হিলারিকে বানিয়ে দেয়া হয় ইলিয়াস নিখোঁজের বিচারক। আমারতো মনে হয় আফগানিস্তানের আবদুর রহমান বা কোলকাতার সেই ট্যাক্সি ড্রাইভার হলে নিজ দেশের সম্মান এইভাবে বিকিয়ে দিতেন না।
অন্যদিকে ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জীর কাছে বিরোধী দলীয় নেত্রী যথাযোগ্য ভূমিকাই রাখলেন। সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশী হত্যা বন্ধের দাবি জানালেন। টিপাইমুখ প্রসঙ্গ তুললেন। তাঁর এই দায়িত্বশীল আচরণকে আমরা সাধুবাদ জানাই। তবে মানতে হবে স্বাধীন দেশের বিরোধী দলীয় নেতাদের মোড়ল দেশের নেত্রীর কাছে এভাবে সব বিকিয়ে দিতে চাওয়া সচেতন দেশবাসী ভালো নজরে দেখবে না। কিন্তু বেগম জিয়া ও তাঁর সতীর্থরা দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এবং নিখোঁজ ইলিয়াস আলীকে উদ্ধারে সরকারি ব্যর্থতা তুলে ধরলেন মার্কিন নেত্রীর কাছে। অথচ এ মার্কিন প্রশাসন ইরাক, আফগানিস্তানসহ বিশ্বজুড়ে মানবতা বিরোধী অপরাধের সাথে যুক্ত। আমার মনে হয়, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে এদেশের প্রধান বিরোধী দলের আচরণ সাংঘর্ষিক।
অবশ্য বাংলাদেশের ক্ষমতার রাজনীতিতে এটি এখন অবধারিত সত্য যে দুর্বল গণতন্ত্রের এই দেশে মসনদে পৌঁছানোর জন্য মার্কিনী সুদৃষ্টি সকল পক্ষেরই কাম্য। বড় দুই দলের মধ্যকার দূরত্ব কমিয়ে আলোচনার টেবিলে বসে ঐকমত্য গড়ে তোলার জন্য দেশের সুস্থধারার রাজনীতিক ও সুশীল সমাজের মানুষরা অনেক দিন থেকে বলে আসছেন। কিন্তু বিএনপি-আওয়ামী লীগ কোনো পক্ষের পরিচালকরাই সেদিকে কর্ণপাত না করে সংঘাতের পথ বেছে নিচ্ছেন। আমরা বৈরি রাজনীতিকে এই পর্যায়ে নিয়ে গেছি যে রাজনৈতিক সহবত শেখার প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষক মানছি শক্তিমান বিদেশিদের। তাই হিলারি এসে পরামর্শ দেন রাজনীতিকদের কি আচরণ করা উচিত। প্রণব মুখার্জীও সহবত শেখাতে ভুল করেন না। এটি আমাদের রাজনীতিকদের সৃষ্ট বাস্তবতা বলে মনকষ্ট নিয়েই আমরা আশা করবো দেশবাসীর আকুতি পায়ে মাড়ালেও মোড়ল দেশের অনুরোধ ফেলতে পারবেন না তারা। এ কারণেই হিলারি ক্লিনটনের আহবান আমাদের আশাবাদী করে তুলেছে। তিনি সকল পক্ষকে ভেদাভেদ ভুলে আলোচনার টেবিলে আসার আহবান জানিয়েছেন। আমাদের রাজনীতিতে যেহেতু আত্মসম্মানবোধ টনটনে নয় তাই আমরা আশা করতেই পারি হিলারির আহবানে এবার বরফ গলবে। সম্মান বর্গা দিয়ে হলেও রাজনীতিতে যদি সুবাতাস প্রবাহিত হয় তবে মন্দ কী! দেশবাসী এখন সংঘাতের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। হিলারির মধ্যস্ততায় যদি কঠিন অসম্ভব সম্ভব হয় তবে অবশ্যই হিলারি ক্লিনটনকে ধন্যবাদ।
n লেখক:অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
shahnawazju@yahoo.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন