প্রফেসর ড. মো. হারুনর রশীদ খান
গেল কয়েক মাসে দেশে যে আশঙ্কাজনকভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে তাতে দেশের সব শ্রেণী-পেশার মানুষ আতঙ্কিত এবং সামগ্রিকভাবে অসহায় বোধ করছে। দার্শনিকরা বলেন, ‘Living means die,’—এক দিন বাঁচা মানে মৃত্যুর দিকে এক দিন এগিয়ে যাওয়া। আর আমরা এদেশে প্রতি মুহূর্তে যেভাবে সম্ভাব্য মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে চলছি তাতে কোনোভাবে এক দিন বেঁচে থাকলে মনে হয় মৃত্যু এক দিন পিছিয়ে গেল। ওই দার্শনিক হয়তো বাংলাদেশের এই প্রেক্ষাপট আগে ভাবলে কথাটি অন্যভাবে বলতেন! প্রায় প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও কেউ গুম হচ্ছেন কিংবা কেউ না কেউ নির্বিচারে খুন হচ্ছেন। স্বাধীন-সার্বভৌম পুরো এ দেশ এখন যেন এক মৃত্যুপুরী। পথে, ঘাটে, রাস্তায় কিংবা বাসায় কোথাও যেন কারও জীবনের বিন্দুমাত্র নিরাপত্তা নেই।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে নিজ বাসায় মর্মান্তিকভাবে খুন হন তরুণ সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তখন বলেছিলেন, ‘৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনের রহস্য উদঘাটন করা হবে।’ বস্তুত ৮০ দিন পেরিয়ে গেলেও অদ্যাবধি কোনো রহস্যই উদঘাটিত হয়নি। পুলিশ আদালতে তাদের ব্যর্থতার কথা অকপটে স্বীকার করার পরেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তার স্বভাবসুলভ বক্তব্যে বলেছেন, ‘তদন্তে অগ্রগতি হয়েছে।’ আদালত পুলিশকে অব্যাহতি দিয়ে র্যাবকে তদন্তের দায়িত্ব প্রদানের প্রেক্ষিতে র্যাব মৃত্যুর ৭৫ দিন পর কবর থেকে তাদের লাশ তুলে ভিসেরা করার জন্য। যেহেতু আদালত লাশ তোলার এই নির্দেশ প্রদান করেছেন, সেহেতু এ নিয়ে খুব বেশি কিছু বলা সমীচীন নয়। এরকম চাঞ্চল্যকর একটি হত্যাকাণ্ডে কেন ভিসেরা না করে লাশ দাফন করা হয়েছিল, এ নিয়ে পুলিশ আর ডাক্তার এখন পরস্পর নিজের দায়িত্ব অন্যের ঘাড়ে তুলে বক্তব্য দিচ্ছে।
আমাদের দেশে কতজন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ আছেন আর তাদের অভিজ্ঞতাইবা কতটুকু তা আমার জানা নেই। ১২ কোটি লোকের বসবাসের দেশ জাপানে মাত্র ২০০ ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ আছেন যারা পুলিশের পক্ষে কাজ করেন। যাই হোক আমাদের ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা মৃত্যুর ৭৫ দিন পরে ফরেনসিক পরীক্ষায় কতটুকু সাফল্য পাবেন, তা সময়ই বলে দেবে। তবে এই মৃত্যুরহস্য নিয়ে যত দিন যাচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তথা সরকারের ভূমিকা নিয়ে জনমনে তত ব্যাপক সংশয় দেখা দিচ্ছে। হিন্দি সিরিয়ালে পর্ব বাড়ানোর জন্য পরিচালক যেমন নিত্য-নতুন মসলাদার চমক আনেন, জোড়া খুনের এ ঘটনা নিয়েও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নানা সুতোয় একের পর এক প্রয়োজনীয় কিংবা অপ্রয়োজনীয় পর্ব যোগ করছে। ঘটনার পরপরই সরকারের দায়িত্বশীল মহল থেকে যেসব বক্তব্য দেয়া হয়েছিল তখনই অনেকের বুঝতে বাকি ছিল না সরকারের উদ্দেশ্য কী। আমরা জানি না এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে এখন থেকে আবার আমরা কোন নতুন উপন্যাস পড়ব। নতুন ভিসেরা রিপোর্ট দিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কী প্রমাণ করতে চায়, তা তারাই ভালো জানে। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, মানুষ মরেও যেন শান্তিতে থাকতে পারছে না। মৃত্যুর ৭৫ দিন পর কবর থেকে গলিত লাশ তোলা তাদের পরিবার-পরিজনের কাছে যে কত কষ্টের, কত দুঃসহের তা বোধকরি এ মুহূর্তে তাদের পরিবার ছাড়া কেউ উপলব্ধি করতে পারবে না। পুলিশ বাহিনীর এই ব্যর্থতার দায় কে নেবে—সরকার, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, নাকি পুলিশপ্রধান? উন্নত দেশ হলে নাগরিক জীবনে নিরাপত্তা প্রদানের এই ব্যর্থতায় অনেক আগেই তারা পদত্যাগ করতেন। সাগর-রুনির এই গলিত লাশ এখন যেন আমাদের দুর্গন্ধ-ছোটা গণতন্ত্র, ক্ষমতা ও আইনের শাসনের প্রতীক হয়ে আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, আমাদের গন্তব্য এক অজানা অন্ধকার পথে।
মাস দেড়েক আগে খুন হন একজন সৌদি কূটনীতিক। যথা নিয়মেই অদ্যাবধি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কোনো কূল-কিনারা করতে পারেনি এ হত্যাকাণ্ডেরও। সর্বশেষ চাঞ্চল্যকর ঘটনাটি ঘটল গত ১৭ এপ্রিল বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী নিখোঁজের মাধ্যমে। এ নিখোঁজের মধ্য দিয়ে দেশের জনগণের নিরাপত্তার বিষয়টি সামনে চলে আসে। দুই সপ্তাহের বেশি সময় পার হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত ইলিয়াস আলীর খোঁজ মেলেনি। গত ২৬ এপ্রিল ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ও এলজিআরডিমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ইলিয়াস আলীকে জীবিত খুঁজে বের করার আশাবাদ ব্যক্ত করেন। মন্ত্রী মহোদয়ের বক্তব্যে আমাদের মাঝে স্বস্তি ফিরে এসেছিল। আমরা ভাবছিলাম, ইলিয়াস আলীকে খুব শিগগিরই জীবিত ফেরত পাবে তার পরিবার। তার কথা শুনে মনে হয়েছিল সরকার সংঘাতের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করবে। হারিয়ে যাওয়া ব্যক্তিকে খুঁজে বের করায় সরকারের যে দায়িত্ব তা তারা পালন করবে। মন্ত্রী মহোদয়ের বক্তব্যের আগে সরকারের শীর্ষমহল বারবার যে দায়িত্বহীন বক্তব্য প্রদান করছে, তা জাতির জন্য হতাশাজনক। সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তদন্তের আগে যখন দেখে, সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে পক্ষপাতমূলক কোনো বক্তব্য আসছে, তখন তদন্ত সংস্থা চায় না—সঠিক তদন্তে সরকার নারাজ হোক। সাগর-রুনির ব্যাপারে সরকারের সর্বোচ্চ মহল যখন বলে ‘বেডরুম পাহারা দেয়া সরকারের দায়িত্ব নয়’ তখনই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যা ভাবার ভেবে নিয়েছে। ইলিয়াস আলীর ব্যাপারেও সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে যেসব বক্তব্য দেয়া হয়েছিল বা এখনও হচ্ছে, তাতে জনগণ কখনোই আশা করে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্তের কোনো ফলাফল এসব বক্তব্যের বাইরে যাবে। এর আগে এলজিআরডিমন্ত্রীর মতো সরকারের উচ্চমহল এরকম অনেক আশার কথা বলেও সাগর-রুনিসহ কোনো গুম বা গুপ্তহত্যার রহস্যই উদঘাটন করেনি বা করতে পারেনি। তাই মন্ত্রী বা সরকারের এ জাতীয় কথায় জনগণের তেমন কোনো আস্থা নেই। অন্যদিকে মাননীয় এলজিআরডিমন্ত্রীর এরকম বক্তব্যের অনেক ভয়ঙ্কর দিকও আছে। ওনার কথায় মনে হয়, সরকার জানে ইলিয়াস আলী কোথায় আছেন। আর সেটা যদি সত্যি হয়, তাহলে নিশ্চয়ই ইলিয়াস আলীকে সরকার বা সরকারের মদতপুষ্ট কোনো বাহিনী, ব্যক্তি বা গোষ্ঠী আটকে রেখেছে। তার অর্থ হলো পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র এই গুমের ঘটনায় জড়িত। দেশ, জাতি তথা গণতন্ত্রের জন্য এ এক ভয়াবহ অশনি সঙ্কেত। আর তা যদি সত্যি নাও হয় তবুও ইলিয়াস আলীকে খুঁজে বের করার দায়িত্ব কিন্তু রাষ্ট্রেরই। বিএনপি তাকে লুকিয়ে রেখেছে—এই বলে সরকারের পার পাওয়ার কোনো অবকাশ নেই। গুম, হত্যা, সন্ত্রাস বন্ধে বর্তমান সরকারের সাফল্য প্রমাণের দায়িত্ব সরকারেরই। ইলিয়াস আলীর স্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত্ করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাত্ প্রদান আমাদের মনে ব্যাপক আশার সঞ্চার করেছে। সরকার যদি এ কাজে আন্তরিকতার অভাব দেখায়, তাহলে সচেতন মহল এরই মধ্যে ‘সাবেক রেলমন্ত্রীর অর্থ কেলেঙ্কারি ঢাকতেই ইলিয়াস আলীকে গুম করা হয়েছে’ বলে যে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তার সত্যতার ইঙ্গিত মিলতে পারে। সুতরাং সব দিক বিবেচনা করে সরকারের নৈতিক দায়িত্ব ইলিয়াস আলীকে খুঁজে বের করা।
নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশে গুমের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করে নিরপেক্ষ তদন্ত চেয়েছে। কিন্তু সরকার বিগত দিনে রাজনৈতিক নেতাসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের যে ১০০ জনের ওপরে গুম হয়েছে, তার একটিরও কোনো কূলকিনারা করতে পারেনি, যা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তথা সরকারের চরম ব্যর্থতারই চিত্র। সাম্প্রতিককালে মীরপুর, আশুলিয়া ও বিরুলিয়া বেড়িবাঁধের পাশাপাশি দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে প্রায়ই মানুষের লাশ, হাড়গোড়, ছেঁড়া প্যান্ট, গেঞ্জিসহ অসংখ্য আলামত পাওয়া যায়। কেরানীগঞ্জে পাওয়া এসব লাশ, কঙ্কাল, হাড়গোড় সাধারণত মিটফোর্ড মর্গে পাঠানো হয়। মিডিয়ার তথ্যে জানা যায়, শুধু জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্তই ২৬ জনের লাশ বা কঙ্কাল দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে পাওয়া গেছে। হতভাগ্য এসব মানুষ স্বাধীন সার্বভৌম আমাদের এ বাংলাদেশেরই নাগরিক এবং হয়তো তারা দেশের কোনো না কোনো স্থান থেকে গুম হয়েছিল, যাদের কোনোদিন আর সন্ধান মিলবে না, কোনোদিন তাদের পরিবার লাশটিও ফেরত পাবে না। অজানা এসব মানুষের লাশের শেষ গন্তব্য হয় আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের বেওয়ারিশ লাশ দাফনে। লাশের এ চিত্র আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সারাদেশে অগণিত বেওয়ারিশ লাশের কথাই মনে করিয়ে দেয়। পাকিস্তান আমলে সামরিক শাসকেরা কাউকে ধরে নিয়ে গেলে চেষ্টা-তদবির করলে হয়তোবা তার অবস্থান জানা যেত। এখন অবস্থা যেন তার চেয়েও বেগতিক। আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে, তাহলে এ দেশের মানুষের স্বাধীনতা কোথায়? একটি সভ্য সমাজে, স্বাধীন দেশে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় এভাবে নির্বিচারে মানুষ মরতে পারে না। এটা নিশ্চয়ই রাষ্ট্রযন্ত্রের চরম ব্যর্থতা। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের গন্তব্য কোথায়?
ইলিয়াস আলী প্রশ্নে সারাদেশ যখন উত্তাল, দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষাসহ জনজীবন যখন হুমকির মুখে, তখনও সরকারের দায়িত্বশীল মহল যথা নিয়মেই একের পর এক লাগামহীনভাবে উদ্ভট বক্তব্য প্রদান করে যাচ্ছেন। তার মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টিকারী বক্তব্যটি দিয়েছেন গত ২৭ এপ্রিল আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম। তিনি ব্যারিস্টার রফিক-উল-হককে ‘ভারসাম্যহীন’ বলে মন্তব্য করেন। আমি প্রথম আলো অনলাইনে প্রতিমন্ত্রীর এই বক্তব্যের ওপর পাবলিক কমেন্ট পড়েছি। সবাই প্রতিমন্ত্রীর এই বক্তব্যের নিন্দা জানিয়েছেন এবং তাকে নানা রকম কটূক্তি করেছেন। ব্যারিস্টার রফিক একজন সর্বজনস্বীকৃত জ্ঞানী মানুষ। ব্যারিস্টার রফিক-উল-হকের মতো লোককে ভারসাম্যহীন বলাতে আইন প্রতিমন্ত্রীর ভাবমূর্তি কতটুকু উজ্জ্বল হয়েছে আমি জানি না। তবে আমার মনে হয়, আমাদের মন্ত্রী মহোদয়সহ যারা অহরহ বড় বড় বুলি আওড়ান, তাদের এইসব অনলাইন কমেন্টসহ প্রচুর লেখাপড়া করে বক্তব্য প্রদান করা উচিত। ক্ষমতাসীন দলের চারপাশে সব সময় কিছু চাটুকার থাকে। তারা সব সময়ই কাজে-অকাজে সরকারকে তোষামোদ করতে চায়। ২৮ এপ্রিল বিকালে একই সময় ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রচারিত হচ্ছিল নাগরিক কমিটি আয়োজিত ‘সমুদ্র জয়ের’ সংবর্ধনা আর বিরোধী দলের হরতাল কর্মসূচি ঘোষণা। কী বিচিত্র আমাদের এই দেশ! ‘সমুদ্র জয়’ বিষয়টা আসলে কী? পর্তুগিজ জলদস্যুরা যে সমুদ্র জয় করত, কিংবা আমরা লঙ্কা বিজয়ের যে কাহিনী শুনেছি, বাংলাদেশের সমুদ্র জয় বিষয়টা আসলে মোটেও সেরকম কিছু নয়। বাংলাদেশ সরকার সমুদ্র আইনসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনালের দ্বারস্থ হয়েছিল, যাতে ২০০ ন্যাটিক্যাল মাইল পর্যন্ত আমরা আমাদের সমুদ্রসীমার মালিকানা বুঝে পাই। বিরোধটা ছিল মিয়ানমারের সঙ্গে। সবচেয়ে আশ্চর্য বিষয় হলো মিয়ানমারও বলছে, তারা আদালতের এই রায়ে জিতেছে, তবে সে দেশে সমুদ্র জয়ের এরকম অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। সেখানে স্বয়ং রাষ্ট্রপ্রধানকেও বিজয়ের মালা দেয়া হচ্ছে না। কোনো একটি মামলায় ‘দুটি পক্ষই জিতে গেছে’ এটা বোধকরি এর আগে কেউ কখনও শোনেনি। সুতরাং বাংলাদেশের ‘সমুদ্র জয়’ বিষয়টা আসলে একটা গোলমেলে ব্যাপার। আমরা ড. ইউনূসকে সংবর্ধনা দিয়েছিলাম, কারণ তিনি নোবেলবিজয়ী হয়েছিলেন। কোনো ব্যক্তিকে যখন সংবর্ধনা দেয়া হয়, তখন অর্জনটিও তার ব্যক্তিগত হতে হয় বা তার জন্য তার ব্যাপক অবদান দরকার পড়ে, অন্যথায় বিষয়টি হাস্যকর হয়ে যায়। আমরা চাই না আমাদের প্রধানমন্ত্রী এসব চাটুকারের কবলে পড়ে দেশের আইনশৃঙ্খলার অবনতিসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মনোযোগ না দিয়ে একটার পর একটা সংবর্ধনা নামে এরকম হাস্যকর বিষয় নিয়ে ব্যস্ত থাকুন।
স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হরতালে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের ধরতে সাঁড়াশি অভিযান চালানোর কথা বলেছেন। আমরা আশা করি তিনি গুম, গুপ্তহত্যার রহস্য উদঘাটনেও সাঁড়াশি অভিযান চালাবেন। সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, রিজভী আহমেদসহ বিরোধী দলের অনেক জ্যেষ্ঠ নেতার বিরুদ্ধে ‘হুকুমের আসামি’ করে মামলা দিয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে পুরোদস্তুর গণতন্ত্রমনা, সর্বজনশ্রদ্ধেয় এবং অতি সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত যে ক’জন রাজনীতিবিদ আছেন মির্জা ফখরুল এবং রিজভী আহমেদ তাদের অন্যতম। তাদের বিরুদ্ধে হাস্যকর এ মামলায় সরকারের ভাবমূর্তি কোন দিকে যাচ্ছে তা বিচারের ভার জনগণের ওপর ছেড়ে দেয়াই ভালো। প্রতিটি ক্ষেত্রে উঠতে-বসতে বিরোধী দলের প্রতি বিষোদ্গার না করে রক্ষক যাতে ভক্ষকের ভূমিকায় না নামে সেদিকে সরকারকে দৃষ্টি দিতে হবে। গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় বিরোধী দল সরকারেরই অংশ। অন্যদিকে বিরোধী দলবিহীন গণতন্ত্র শোষণের হাতিয়ার ছাড়া আর কিছু নয়। সুতরাং গণতন্ত্রের লেবাসে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করা জাতির জন্য কখনও কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু হলো জনগণ। সেই জনগণের নিরাপত্তা হুমকির মুখে রেখে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কখনও প্রতিষ্ঠিত হয় না। মন্ত্রীদের দুর্নীতি, বিদ্যুত্ সমস্যা, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের চরম ঊর্ধ্বগতি, আইনশৃঙ্খলার অবনতি—এগুলোর সঠিক ব্যবস্থা নেয়া সরকারেরই দায়িত্ব। সরকারের প্রতি আমাদের অকুণ্ঠ আবেদন—দেশকে অরাজকতার হাত থেকে রক্ষা করুন। আমরা সাধারণ জনগণ দম আটকানো এই সময়ের অবসান চাই।
লেখক : ডিন, বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও প্রযুক্তিবিদ্যা স্কুল, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়
গত ফেব্রুয়ারি মাসে নিজ বাসায় মর্মান্তিকভাবে খুন হন তরুণ সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তখন বলেছিলেন, ‘৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনের রহস্য উদঘাটন করা হবে।’ বস্তুত ৮০ দিন পেরিয়ে গেলেও অদ্যাবধি কোনো রহস্যই উদঘাটিত হয়নি। পুলিশ আদালতে তাদের ব্যর্থতার কথা অকপটে স্বীকার করার পরেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তার স্বভাবসুলভ বক্তব্যে বলেছেন, ‘তদন্তে অগ্রগতি হয়েছে।’ আদালত পুলিশকে অব্যাহতি দিয়ে র্যাবকে তদন্তের দায়িত্ব প্রদানের প্রেক্ষিতে র্যাব মৃত্যুর ৭৫ দিন পর কবর থেকে তাদের লাশ তুলে ভিসেরা করার জন্য। যেহেতু আদালত লাশ তোলার এই নির্দেশ প্রদান করেছেন, সেহেতু এ নিয়ে খুব বেশি কিছু বলা সমীচীন নয়। এরকম চাঞ্চল্যকর একটি হত্যাকাণ্ডে কেন ভিসেরা না করে লাশ দাফন করা হয়েছিল, এ নিয়ে পুলিশ আর ডাক্তার এখন পরস্পর নিজের দায়িত্ব অন্যের ঘাড়ে তুলে বক্তব্য দিচ্ছে।
আমাদের দেশে কতজন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ আছেন আর তাদের অভিজ্ঞতাইবা কতটুকু তা আমার জানা নেই। ১২ কোটি লোকের বসবাসের দেশ জাপানে মাত্র ২০০ ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ আছেন যারা পুলিশের পক্ষে কাজ করেন। যাই হোক আমাদের ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা মৃত্যুর ৭৫ দিন পরে ফরেনসিক পরীক্ষায় কতটুকু সাফল্য পাবেন, তা সময়ই বলে দেবে। তবে এই মৃত্যুরহস্য নিয়ে যত দিন যাচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তথা সরকারের ভূমিকা নিয়ে জনমনে তত ব্যাপক সংশয় দেখা দিচ্ছে। হিন্দি সিরিয়ালে পর্ব বাড়ানোর জন্য পরিচালক যেমন নিত্য-নতুন মসলাদার চমক আনেন, জোড়া খুনের এ ঘটনা নিয়েও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নানা সুতোয় একের পর এক প্রয়োজনীয় কিংবা অপ্রয়োজনীয় পর্ব যোগ করছে। ঘটনার পরপরই সরকারের দায়িত্বশীল মহল থেকে যেসব বক্তব্য দেয়া হয়েছিল তখনই অনেকের বুঝতে বাকি ছিল না সরকারের উদ্দেশ্য কী। আমরা জানি না এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে এখন থেকে আবার আমরা কোন নতুন উপন্যাস পড়ব। নতুন ভিসেরা রিপোর্ট দিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কী প্রমাণ করতে চায়, তা তারাই ভালো জানে। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, মানুষ মরেও যেন শান্তিতে থাকতে পারছে না। মৃত্যুর ৭৫ দিন পর কবর থেকে গলিত লাশ তোলা তাদের পরিবার-পরিজনের কাছে যে কত কষ্টের, কত দুঃসহের তা বোধকরি এ মুহূর্তে তাদের পরিবার ছাড়া কেউ উপলব্ধি করতে পারবে না। পুলিশ বাহিনীর এই ব্যর্থতার দায় কে নেবে—সরকার, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, নাকি পুলিশপ্রধান? উন্নত দেশ হলে নাগরিক জীবনে নিরাপত্তা প্রদানের এই ব্যর্থতায় অনেক আগেই তারা পদত্যাগ করতেন। সাগর-রুনির এই গলিত লাশ এখন যেন আমাদের দুর্গন্ধ-ছোটা গণতন্ত্র, ক্ষমতা ও আইনের শাসনের প্রতীক হয়ে আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, আমাদের গন্তব্য এক অজানা অন্ধকার পথে।
মাস দেড়েক আগে খুন হন একজন সৌদি কূটনীতিক। যথা নিয়মেই অদ্যাবধি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কোনো কূল-কিনারা করতে পারেনি এ হত্যাকাণ্ডেরও। সর্বশেষ চাঞ্চল্যকর ঘটনাটি ঘটল গত ১৭ এপ্রিল বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী নিখোঁজের মাধ্যমে। এ নিখোঁজের মধ্য দিয়ে দেশের জনগণের নিরাপত্তার বিষয়টি সামনে চলে আসে। দুই সপ্তাহের বেশি সময় পার হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত ইলিয়াস আলীর খোঁজ মেলেনি। গত ২৬ এপ্রিল ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ও এলজিআরডিমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ইলিয়াস আলীকে জীবিত খুঁজে বের করার আশাবাদ ব্যক্ত করেন। মন্ত্রী মহোদয়ের বক্তব্যে আমাদের মাঝে স্বস্তি ফিরে এসেছিল। আমরা ভাবছিলাম, ইলিয়াস আলীকে খুব শিগগিরই জীবিত ফেরত পাবে তার পরিবার। তার কথা শুনে মনে হয়েছিল সরকার সংঘাতের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করবে। হারিয়ে যাওয়া ব্যক্তিকে খুঁজে বের করায় সরকারের যে দায়িত্ব তা তারা পালন করবে। মন্ত্রী মহোদয়ের বক্তব্যের আগে সরকারের শীর্ষমহল বারবার যে দায়িত্বহীন বক্তব্য প্রদান করছে, তা জাতির জন্য হতাশাজনক। সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তদন্তের আগে যখন দেখে, সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে পক্ষপাতমূলক কোনো বক্তব্য আসছে, তখন তদন্ত সংস্থা চায় না—সঠিক তদন্তে সরকার নারাজ হোক। সাগর-রুনির ব্যাপারে সরকারের সর্বোচ্চ মহল যখন বলে ‘বেডরুম পাহারা দেয়া সরকারের দায়িত্ব নয়’ তখনই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যা ভাবার ভেবে নিয়েছে। ইলিয়াস আলীর ব্যাপারেও সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে যেসব বক্তব্য দেয়া হয়েছিল বা এখনও হচ্ছে, তাতে জনগণ কখনোই আশা করে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্তের কোনো ফলাফল এসব বক্তব্যের বাইরে যাবে। এর আগে এলজিআরডিমন্ত্রীর মতো সরকারের উচ্চমহল এরকম অনেক আশার কথা বলেও সাগর-রুনিসহ কোনো গুম বা গুপ্তহত্যার রহস্যই উদঘাটন করেনি বা করতে পারেনি। তাই মন্ত্রী বা সরকারের এ জাতীয় কথায় জনগণের তেমন কোনো আস্থা নেই। অন্যদিকে মাননীয় এলজিআরডিমন্ত্রীর এরকম বক্তব্যের অনেক ভয়ঙ্কর দিকও আছে। ওনার কথায় মনে হয়, সরকার জানে ইলিয়াস আলী কোথায় আছেন। আর সেটা যদি সত্যি হয়, তাহলে নিশ্চয়ই ইলিয়াস আলীকে সরকার বা সরকারের মদতপুষ্ট কোনো বাহিনী, ব্যক্তি বা গোষ্ঠী আটকে রেখেছে। তার অর্থ হলো পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র এই গুমের ঘটনায় জড়িত। দেশ, জাতি তথা গণতন্ত্রের জন্য এ এক ভয়াবহ অশনি সঙ্কেত। আর তা যদি সত্যি নাও হয় তবুও ইলিয়াস আলীকে খুঁজে বের করার দায়িত্ব কিন্তু রাষ্ট্রেরই। বিএনপি তাকে লুকিয়ে রেখেছে—এই বলে সরকারের পার পাওয়ার কোনো অবকাশ নেই। গুম, হত্যা, সন্ত্রাস বন্ধে বর্তমান সরকারের সাফল্য প্রমাণের দায়িত্ব সরকারেরই। ইলিয়াস আলীর স্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত্ করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাত্ প্রদান আমাদের মনে ব্যাপক আশার সঞ্চার করেছে। সরকার যদি এ কাজে আন্তরিকতার অভাব দেখায়, তাহলে সচেতন মহল এরই মধ্যে ‘সাবেক রেলমন্ত্রীর অর্থ কেলেঙ্কারি ঢাকতেই ইলিয়াস আলীকে গুম করা হয়েছে’ বলে যে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তার সত্যতার ইঙ্গিত মিলতে পারে। সুতরাং সব দিক বিবেচনা করে সরকারের নৈতিক দায়িত্ব ইলিয়াস আলীকে খুঁজে বের করা।
নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশে গুমের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করে নিরপেক্ষ তদন্ত চেয়েছে। কিন্তু সরকার বিগত দিনে রাজনৈতিক নেতাসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের যে ১০০ জনের ওপরে গুম হয়েছে, তার একটিরও কোনো কূলকিনারা করতে পারেনি, যা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তথা সরকারের চরম ব্যর্থতারই চিত্র। সাম্প্রতিককালে মীরপুর, আশুলিয়া ও বিরুলিয়া বেড়িবাঁধের পাশাপাশি দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে প্রায়ই মানুষের লাশ, হাড়গোড়, ছেঁড়া প্যান্ট, গেঞ্জিসহ অসংখ্য আলামত পাওয়া যায়। কেরানীগঞ্জে পাওয়া এসব লাশ, কঙ্কাল, হাড়গোড় সাধারণত মিটফোর্ড মর্গে পাঠানো হয়। মিডিয়ার তথ্যে জানা যায়, শুধু জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্তই ২৬ জনের লাশ বা কঙ্কাল দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে পাওয়া গেছে। হতভাগ্য এসব মানুষ স্বাধীন সার্বভৌম আমাদের এ বাংলাদেশেরই নাগরিক এবং হয়তো তারা দেশের কোনো না কোনো স্থান থেকে গুম হয়েছিল, যাদের কোনোদিন আর সন্ধান মিলবে না, কোনোদিন তাদের পরিবার লাশটিও ফেরত পাবে না। অজানা এসব মানুষের লাশের শেষ গন্তব্য হয় আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের বেওয়ারিশ লাশ দাফনে। লাশের এ চিত্র আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সারাদেশে অগণিত বেওয়ারিশ লাশের কথাই মনে করিয়ে দেয়। পাকিস্তান আমলে সামরিক শাসকেরা কাউকে ধরে নিয়ে গেলে চেষ্টা-তদবির করলে হয়তোবা তার অবস্থান জানা যেত। এখন অবস্থা যেন তার চেয়েও বেগতিক। আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে, তাহলে এ দেশের মানুষের স্বাধীনতা কোথায়? একটি সভ্য সমাজে, স্বাধীন দেশে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় এভাবে নির্বিচারে মানুষ মরতে পারে না। এটা নিশ্চয়ই রাষ্ট্রযন্ত্রের চরম ব্যর্থতা। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের গন্তব্য কোথায়?
ইলিয়াস আলী প্রশ্নে সারাদেশ যখন উত্তাল, দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষাসহ জনজীবন যখন হুমকির মুখে, তখনও সরকারের দায়িত্বশীল মহল যথা নিয়মেই একের পর এক লাগামহীনভাবে উদ্ভট বক্তব্য প্রদান করে যাচ্ছেন। তার মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টিকারী বক্তব্যটি দিয়েছেন গত ২৭ এপ্রিল আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম। তিনি ব্যারিস্টার রফিক-উল-হককে ‘ভারসাম্যহীন’ বলে মন্তব্য করেন। আমি প্রথম আলো অনলাইনে প্রতিমন্ত্রীর এই বক্তব্যের ওপর পাবলিক কমেন্ট পড়েছি। সবাই প্রতিমন্ত্রীর এই বক্তব্যের নিন্দা জানিয়েছেন এবং তাকে নানা রকম কটূক্তি করেছেন। ব্যারিস্টার রফিক একজন সর্বজনস্বীকৃত জ্ঞানী মানুষ। ব্যারিস্টার রফিক-উল-হকের মতো লোককে ভারসাম্যহীন বলাতে আইন প্রতিমন্ত্রীর ভাবমূর্তি কতটুকু উজ্জ্বল হয়েছে আমি জানি না। তবে আমার মনে হয়, আমাদের মন্ত্রী মহোদয়সহ যারা অহরহ বড় বড় বুলি আওড়ান, তাদের এইসব অনলাইন কমেন্টসহ প্রচুর লেখাপড়া করে বক্তব্য প্রদান করা উচিত। ক্ষমতাসীন দলের চারপাশে সব সময় কিছু চাটুকার থাকে। তারা সব সময়ই কাজে-অকাজে সরকারকে তোষামোদ করতে চায়। ২৮ এপ্রিল বিকালে একই সময় ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রচারিত হচ্ছিল নাগরিক কমিটি আয়োজিত ‘সমুদ্র জয়ের’ সংবর্ধনা আর বিরোধী দলের হরতাল কর্মসূচি ঘোষণা। কী বিচিত্র আমাদের এই দেশ! ‘সমুদ্র জয়’ বিষয়টা আসলে কী? পর্তুগিজ জলদস্যুরা যে সমুদ্র জয় করত, কিংবা আমরা লঙ্কা বিজয়ের যে কাহিনী শুনেছি, বাংলাদেশের সমুদ্র জয় বিষয়টা আসলে মোটেও সেরকম কিছু নয়। বাংলাদেশ সরকার সমুদ্র আইনসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনালের দ্বারস্থ হয়েছিল, যাতে ২০০ ন্যাটিক্যাল মাইল পর্যন্ত আমরা আমাদের সমুদ্রসীমার মালিকানা বুঝে পাই। বিরোধটা ছিল মিয়ানমারের সঙ্গে। সবচেয়ে আশ্চর্য বিষয় হলো মিয়ানমারও বলছে, তারা আদালতের এই রায়ে জিতেছে, তবে সে দেশে সমুদ্র জয়ের এরকম অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। সেখানে স্বয়ং রাষ্ট্রপ্রধানকেও বিজয়ের মালা দেয়া হচ্ছে না। কোনো একটি মামলায় ‘দুটি পক্ষই জিতে গেছে’ এটা বোধকরি এর আগে কেউ কখনও শোনেনি। সুতরাং বাংলাদেশের ‘সমুদ্র জয়’ বিষয়টা আসলে একটা গোলমেলে ব্যাপার। আমরা ড. ইউনূসকে সংবর্ধনা দিয়েছিলাম, কারণ তিনি নোবেলবিজয়ী হয়েছিলেন। কোনো ব্যক্তিকে যখন সংবর্ধনা দেয়া হয়, তখন অর্জনটিও তার ব্যক্তিগত হতে হয় বা তার জন্য তার ব্যাপক অবদান দরকার পড়ে, অন্যথায় বিষয়টি হাস্যকর হয়ে যায়। আমরা চাই না আমাদের প্রধানমন্ত্রী এসব চাটুকারের কবলে পড়ে দেশের আইনশৃঙ্খলার অবনতিসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মনোযোগ না দিয়ে একটার পর একটা সংবর্ধনা নামে এরকম হাস্যকর বিষয় নিয়ে ব্যস্ত থাকুন।
স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হরতালে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের ধরতে সাঁড়াশি অভিযান চালানোর কথা বলেছেন। আমরা আশা করি তিনি গুম, গুপ্তহত্যার রহস্য উদঘাটনেও সাঁড়াশি অভিযান চালাবেন। সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, রিজভী আহমেদসহ বিরোধী দলের অনেক জ্যেষ্ঠ নেতার বিরুদ্ধে ‘হুকুমের আসামি’ করে মামলা দিয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে পুরোদস্তুর গণতন্ত্রমনা, সর্বজনশ্রদ্ধেয় এবং অতি সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত যে ক’জন রাজনীতিবিদ আছেন মির্জা ফখরুল এবং রিজভী আহমেদ তাদের অন্যতম। তাদের বিরুদ্ধে হাস্যকর এ মামলায় সরকারের ভাবমূর্তি কোন দিকে যাচ্ছে তা বিচারের ভার জনগণের ওপর ছেড়ে দেয়াই ভালো। প্রতিটি ক্ষেত্রে উঠতে-বসতে বিরোধী দলের প্রতি বিষোদ্গার না করে রক্ষক যাতে ভক্ষকের ভূমিকায় না নামে সেদিকে সরকারকে দৃষ্টি দিতে হবে। গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় বিরোধী দল সরকারেরই অংশ। অন্যদিকে বিরোধী দলবিহীন গণতন্ত্র শোষণের হাতিয়ার ছাড়া আর কিছু নয়। সুতরাং গণতন্ত্রের লেবাসে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করা জাতির জন্য কখনও কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু হলো জনগণ। সেই জনগণের নিরাপত্তা হুমকির মুখে রেখে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কখনও প্রতিষ্ঠিত হয় না। মন্ত্রীদের দুর্নীতি, বিদ্যুত্ সমস্যা, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের চরম ঊর্ধ্বগতি, আইনশৃঙ্খলার অবনতি—এগুলোর সঠিক ব্যবস্থা নেয়া সরকারেরই দায়িত্ব। সরকারের প্রতি আমাদের অকুণ্ঠ আবেদন—দেশকে অরাজকতার হাত থেকে রক্ষা করুন। আমরা সাধারণ জনগণ দম আটকানো এই সময়ের অবসান চাই।
লেখক : ডিন, বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও প্রযুক্তিবিদ্যা স্কুল, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন