মঙ্গলবার, ৮ মে, ২০১২

আওয়ামী লীগের লাভ, না বিএনপির?


আব্দুল কাইয়ুম | তারিখ: ০৯-০৫-২০১২


আওয়ামী লীগেরও না, বিএনপিরও না। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের সফরে বোধহয় সবচেয়ে বেশি লাভ হলো বাংলাদেশের। কারণ, হরতাল অন্তত কয়েক দিনের জন্য হলেও থামল। এক দিন হরতালে কত ক্ষতি তার হিসাব করতে শুরু করেছেন ব্যবসায়ীরা। বিএনপি নয় দিনের মধ্যে পাঁচ দিন হরতাল করে, মাঝখানে সাপ্তাহিক ছুটি মিলিয়ে বলতে গেলে সাত দিনই কর্মবিহীন দিনের মুশকিলে ফেলেছিল দেশকে। সেখানেই শেষ নয়। তাদের অন্তর্হিত নেতা ইলিয়াস আলীর খোঁজ দিতে সরকার ব্যর্থ হলে আরও কঠোর কর্মসূচি দেওয়ার কথা বলছিল। এখনো কথাটা চলছে।
দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল-এর ৭ মের অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত নিবন্ধে আগামী ৩০ জুনের মধ্যে দুই হাজার ৪০ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, এ জন্য হরতাল কিছুটা দায়ী। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারকেরা এ রকম আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন। এই সময় হঠাৎ হিলারির সফর হরতালের আগুনে কিছু পানি ঢেলে দিল। 
এর আগে ২০০৩ সালে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কলিন পাওয়েল ঢাকা সফরে এলে বিরোধী দল আওয়ামী লীগ হরতাল ডেকেছিল। তার আগে বিভিন্ন সময় বিরোধী দল বিএনপিও হরতাল ডেকেছে। অর্থাৎ, বিরোধী রাজনীতির মূল দর্শন হলো, যুক্তরাষ্ট্র বা বিশ্বব্যাংকের কাছে দেখাতে হবে যে সরকার দেশ ভালোভাবে চালাতে পারছে না। রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে। ওরা যেন হতাশ হয়ে ক্ষমতাসীনদের ওপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। তাই বেছে বেছে সফরের দিনগুলোতে হরতাল ডাকার রেওয়াজ ছিল। কিন্তু এবার ব্যতিক্রম দেখা গেল। বিএনপি হরতাল ফিরিয়ে নিল।
অবশ্য এর পেছনে মানুষের হরতালবিরোধী মনোভাবও কাজ করেছে। বিশেষ করে, এইচএসসি পরীক্ষার সময় হরতাল দেওয়ায় মানুষ একটু ক্ষুব্ধই ছিল। বিএনপিও জানত মানুষের মনোভাব। তারা তো এমনও বলেছে, বড় কিছু পেতে হলে হরতালের জ্বালা সহ্য করতে হবে। এ অবস্থায় এবার হরতালে বিরতির জন্য বিএনপির কিছু সুবিবেচনাকেই ধন্যবাদ দিতে হয়।
এখন দেশের এই লাভের ভাগ কার ঘরে বেশি যাবে—বিএনপির ঘরে, না আওয়ামী লীগের? ঢোল পেটাতে সবাই ওস্তাদ। আওয়ামী লীগ বলবে, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী তো আগে দুবার আসবেন বলেও আসেননি। দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, মানবাধিকার পরিস্থিতি, গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলেছিলেন। বর্তমানে এর একটারও উন্নতি হয়েছে বলে দাবি করার কোনো কারণ নেই। তার পরও তিনি এলেন এবং ভালোভাবেই আলাপ-আলোচনা করলেন। টিকফা চুক্তিও স্বাক্ষর হলো না। তো, লাভ তো সরকারি দল আওয়ামী লীগেরই বেশি হলো। বোঝা গেল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খাতায় তাদের নাম কাটা যায়নি, যেটা বেশ কিছুদিন থেকে রাজনৈতিক মহলে আলোচিত হচ্ছিল।
কিন্তু এখানে আওয়ামী লীগের বোঝা দরকার, হিলারি ঢাকা সফরে এসেছেন কি আওয়ামী লীগকে খুশি রাখতে, না নিজেদের ভূ-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করতে? যুক্তরাষ্ট্র তো কাঁচা কাজ করে না। তাদের অত্যন্ত সংবেদনশীল অ্যান্টেনায় কিছু সংকেত না গেলে সাধারণত তাদের কথার নড়চড় হয় না। তাহলে কী এমন ঘটল, যা হিলারিকে ঢাকায় টেনে আনল?
হিলারির সফরের আগে মার্কিন কর্মকর্তারা আশা প্রকাশ করেছিলেন, সফরের সময়, দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার অংশীদারি সংলাপ সম্পর্কিত চুক্তি, সন্ত্রাসবাদ দমন প্রভৃতির পাশাপাশি বাংলাদেশে শেভরন ও কনোকোফিলিপসের মতো মার্কিন জ্বালানি সম্রাটদের বিপুল বিনিয়োগের স্বার্থ রক্ষার বিষয়টিও আলোচনায় আসবে। নিউইয়র্ক টাইমস ডটকম ৫ মে সংখ্যায় এ কথা লিখেছে। জ্বালানির বিষয়টি আলোচনায় কতটা এসেছে, বা আদৌ এসেছে কি না, আমরা জানি না। পত্রপত্রিকায় বিষয়টি আলোচিত হয়নি। কিন্তু, এটা তো ঠিক যে বাংলাদেশ খনিজ সম্পদে অত্যন্ত সম্ভাবনাময় একটি দেশ। কয়েক দিন আগে রাশিয়ার গ্যাস কোম্পানি আমাদের গ্যাসক্ষেত্রগুলোতে ১০টি কূপ খনন করে দেওয়ার চুক্তি করেছে। ওরা শুধু কূপ খনন করে দিয়ে চলে যাবে। গ্যাসসম্পদের নিয়ন্ত্রণ থাকবে আমাদের পেট্রোবাংলার হাতে। আমরা তো এটাই চাইছিলাম, আমাদের গ্যাসের ওপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ থাকুক। কিন্তু বড় বড় বিদেশি তেল কোম্পানিগুলো নানা শর্তের বেড়াজালে আমাদের বাঁধতে চায়। আমাদের প্রযুক্তি নেই বলে উপায়ও থাকে না। ওদের হাতে ধরা দিতে হয়। সেখানে রাশিয়ার গ্যাস কোম্পানি ঢুকতে শুরু করেছে। এটা যদি যুক্তরাষ্ট্রের অ্যান্টেনায় ধরা না পড়ে, তাহলে চলবে কী করে?
সে জন্যই বোধহয় মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নিষ্পত্তি এবং ভারতের সঙ্গে এ প্রক্রিয়ায় অগ্রসর হওয়ার বিষয়টিতে হিলারি ক্লিনটন গুরুত্ব দিয়ে বলেছেন, এর ফলে বাংলাদেশ সম্পদ আহরণের সুযোগ পাবে। ওদিকে চীন, এদিকে ভারত। মাঝখানে বাংলাদেশ। এই ত্রিভুজের ভূ-রাজনৈতিক তাৎপর্য তো আছেই। এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে প্রাকৃতিক সম্পদ গ্যাসের বিপুল মজুদ। সুতরাং, বাংলাদেশের গুরুত্ব বাড়ছে। আগে বলা হতো, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব তেমন নেই, যেন সিন্ধুতে বিন্দু। কে খবর রাখে! কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, বিন্দুতে সিন্ধু প্রতিভাত হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র বা উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও সংস্থাগুলোর মূল স্বার্থ হলো, তাদের বিনিয়োগ যেন নিরাপদ থাকে, ফলপ্রসূ হয়। এ জন্য দরকার অবারিত গণতন্ত্র। সুষ্ঠু নির্বাচন। এমন নির্বাচন, যেন সব দল অংশ নেয়। যেন নির্বাচন সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়। হিলারি ক্লিনটন এসব বিষয়ের ওপর জোর দিয়ে যে বলেছেন দুই নেত্রী বা দলের মধ্যে সংলাপের কথা, তার তাৎপর্য এখানেই। সেই নির্বাচন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হবে, নাকি দলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে হবে, সে বিতর্কে না গিয়ে হিলারি বলেছেন সংলাপের কথা।
সরকার যদি গাড়ি পোড়ানো ও ককটেল মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব, দপ্তর সম্পাদকসহ মূল কেন্দ্রীয় নেতাদের পেঁচায়, তাঁদের জামিন নেওয়ার জন্য আদালতে যাওয়ার পথে পুলিশি প্রহরা বসায়, তাহলে সংলাপ কীভাবে হবে? হরতালে কে আগুন দিল, মামলা তো তার বিরুদ্ধে হতে হবে। হরেদরে সবাইকে মামলায় জড়ানোর পদ্ধতিটি ঠিক গণতন্ত্রে চলে না। এটা আসলে একধরনের সামরিক স্বৈরাচারী পদ্ধতি।
মনে পড়ে, ১৯৮০ সালে একবার সচিবালয়ে কর্মচারীদের ধর্মঘটকে কেন্দ্র করে জেনারেল জিয়াউর রহমানের বিএনপি সরকারের নির্দেশে পুলিশ এক রাতে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) কেন্দ্রীয় ও মহানগর নেতাদের মধ্যে মঞ্জুরুল আহসান খান, প্রয়াত ওসমান গণিসহ প্রায় সবাইকে গ্রেপ্তার করে, অনেকের বাড়ি বাড়ি হানা দেয়। এর কিছুদিন আগে এক সমাবেশে বক্তৃতার সূত্র ধরে সিপিবির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত মণি সিংহ ও মোহাম্মদ ফরহাদ, কেন্দ্রীয় নেতা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমসহ অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। সবচেয়ে অবাক ব্যাপার, সবার বিরুদ্ধে পাইকারি হারে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দায়ের করা হয়। সচিবালয়ে কর্মচারীদের সামান্য ধর্মঘটের উদ্যোগ কীভাবে রাষ্ট্রদ্রোহের পর্যায়ে পড়ে, তা বড় বড় আইনজীবীরও মাথায় ঢোকেনি। শেষ পর্যন্ত কিছুদিন জেল খাটিয়ে নেতাদের বেকসুর খালাস দেওয়া হয়।
আশির দশকের বিএনপির সেই বস্তাপচা পদ্ধতিটি এখন আওয়ামী লীগ সরকার অনুসরণ করছে। তারা সচিবালয়ে ককটেল ছুড়ে মারার মামলায় বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের হেনস্তা করছে। এই সব মামলা দিয়ে বিএনপির ক্ষোভ আরও উসকে দেওয়া ছাড়া বিশেষ কোনো লাভ হবে না।
বরং সোমবার টাঙ্গাইল-৫ আসনে ১৪ দলীয় জোটের (জাতীয় পার্টি) সাংসদের সদস্যপদ বাতিল করে নির্বাচন কমিশন যে বিএনপির প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণা করেছে, সেটাই এই সময়ে একটি বিরাট সুসংবাদ। আদালতের রায়ের আলোকে নির্বাচন কমিশন এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই প্রথম এ রকম সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। এর আগে ২০০৯ সালে ভোলা-৩ আসনের নির্বাচন বাতিল করে সরকারদলীয় সাংসদের আসন শূন্য করা হয়েছিল, সেখানে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোটলাভকারী বিএনপিদলীয় প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়নি। পরে ওই আসনের নির্বাচনে সরকারদলীয় প্রার্থী বিজয়ী হন। কিন্তু এবার ব্যতিক্রম দেখা গেল। আসন শূন্য না করে সেখানে বিএনপির প্রার্থীকে বিজয়ী করা হলো।
এটা যদি হিলারির সফরের একটা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়, তাহলে হয়তো ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কিছুটা আশাবাদী হওয়া যায়। একদিকে লাভ হলো বিএনপির। তাদের একজন সাংসদ বাড়ল। অন্যদিকে আওয়ামী লীগেরও হরতালের চাপ কমার একটা সম্ভাবনা হয়তো দেখা দিল।
সবকিছু ঠিকভাবে চললে হয়তো দেশ আগামী কিছুদিন আর হরতালের পাল্লায় পড়বে না।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন