আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
আটাশ দিন পর লন্ডনে ফিরে এসে ডাক্তারের কাছে গিয়েছি। আমরা তাদের বলি জিপি বা জেনারেল প্র্যাকটিসনার। তিনি মধ্যবয়সী সুশ্রী মহিলা বেশ মিস্টি হেসে কথা বলেন। আমাকে দেখেই হেসে বললেন, এবার বাংলাদেশ থেকে কি কি রোগ নিয়ে এসেছ? বললাম, ডায়েরিয়া এবং জ্বর। তিনি বললেন, প্রতিবারই তো এই রোগ নিয়ে বাংলাদেশ থেকে ফের। এবার ক’দিন ছিলে ঢাকায়? মাত্র আট দিন। তাকে জানালাম। দু’সপ্তাহ ছিলাম সিঙ্গাপুরে। তখন কিছু হয়নি। ২৭ এপ্রিল লন্ডনে ফেরার পথে আটদিনের জন্য ঢাকায় থেমেছি। দু’দিন না যেতেই এই অসুখ।
জিপি বললেন, বাংলাদেশে গেলেই দেখছি আমার সকল পেসেন্টই নানা রোগের ভাইরাস বহন করে ফিরে আসে। দীর্ঘদিন ভোগে। তোমরা এই দেশটাতে যাও কেন? বললাম, কি করব? এটা আমার স্বদেশ। এই দেশে জন্মেছি। তার অন্নে মানুষ হয়েছি। তা কি করে ভুলব?
জিপি আমার ওষুধের প্রেসক্রিপসন লিখতে লিখতে গুণগুন করে গানের একটি চয়ন গাইলেনÑ ‘ঐড়সবষধহফ সু যড়সবষধহফ, ড়য, রঃ রং হড় সড়ৎব সু ড়হি যড়সব’ একটি ইংরেজী গানের চরণ। শুনে আমার দেশে ব্রিটিশ আমলের এক কবির কবিতার পঙ্ক্তি মনে পড়লÑ ‘স্বদেশ স্বদেশ করিস তোরা, এ দেশ তো তোদের নয়।’ কথাটা মনে হলো, বড় নির্মম সত্য। অন্তত এবার আটদিন ঢাকায় অবস্থানের সময় এ কথাটাই মনে হয়েছে।
সেই সবুজ ঢাকা শহর নেই। নেই সেই সহজ সরল মানুষগুলোও। এখন এক কংক্রিটের দানব রোজই উর্ধ আকাশে মাথা তুলছে। মানুষগুলো যেন রোবট। অন্তত আমার তাই মনে হয়েছে। সিঙ্গাপুরে দেখেছি ঐশ্বর্যের সঙ্গে সৌন্দর্যের মিলন ঢাকায় দেখেছি ঐশ্বর্যের সঙ্গে কুৎসিত দরিদ্র ও বুভুক্ষার মিলন। শহরের অভিজাত ওয়েস্টিন হোটেলের বহুতল কোন ভোজন কক্ষে বসলে আপনার মনে হবে, নিউইয়র্কের ম্যানহাটনে বসে আছেন। হোটেল থেকে বেরিয়ে আসুন, মনে হবে আফ্রিকার কোন দরিদ্র দেশের গ্রাম এরিয়ায় নেমে এসেছেন।
রাস্তায় যানজট। এক মাইল যেতে তিন ঘণ্টা লাগে। খাদ্যে ভেজাল। পানি গ্যাস বিদ্যুত সঙ্কট। মে মাসের তাল পাকানো গরমে ঘন ঘন লোডশেডিং। আমি আটদিনেই অস্থির হয়ে গিয়েছিলাম। দিন গুনেছি, কখন লন্ডনে ফিরে আসব। নিজেকে ধিক্কার দিয়েছি, যে শহরে দুই কি তিন কোটি লোক বাস করে আমি সেখানে বাস করতে পারছি না কেন? মন বলেছে, তুমি বিশ্বাসে সমাজতন্ত্রী, কিন্তু শরীরে ও স্বভাবে পাঁতি-বুর্জোয়ারও অধম হয়ে গেছ। আমার ধারণা, তাই হয়েছি।
এক কুৎসিত দানবের পাশে এক সুন্দরী রমণীকে দাঁড় করালে মনে যে অনুভূতি জাগে এবার ঢাকা শহরকে দেখে আমার মনে সেই অনুভূতি জেগেছে। ঐশ্বর্য যে এত ভালগার হতে পারে এবং তার পাশে দরিদ্র যে এত নগ্ন ও বিকট চেহারা ধারণ করতে পারে, তা বাংলাদেশ ছাড়া আর কোন দেশে দেখতে পাইনি। এর বলি হয়েছে মানবতা, মানব মনের সকল সুকুমার প্রবৃত্তি। আমাকে ঢাকার এক প্রবীণ রিটায়ার্ড অফিসার বলেছেন, আগে বাংলাদেশের মানুষের মনে ছিল মহব্বত ও ইনসানিয়াত অর্থাৎ ভালবাসা ও মনুষ্যত্ববোধ। এখন তা নেই। এখন অন্ধ লোভ, হিংসা, সন্ত্রাস, কপটতা, নির্মম হৃদয়হীনতা সে স্থান দখল করেছে। গড়হবু রং হড়ি মড়ফ। এবং এই গডের পূজায় সারাদেশ উন্মাদ।
কথাগুলো চিরাচরিত আপ্তবাক্য মনে হতে পারে। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে নির্মম সত্য। ২৭ এপ্রিল ঢাকা শহরে পা দিয়েই শুনেছি, ২৯ ও ৩০ তারিখে পর পর দু’দিন হরতাল হবে। বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ায় বিএনপি এই হরতাল ডেকেছে। বিএনপির হাতে কোন প্রমাণপত্র নেই। তারা ঘোষণা দিয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারই এই গুম-হত্যা করেছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। তাদের দায়িত্ব ইলিয়াস আলীকে খুঁজে বের করার। সেই দায়িত্ব পালনের আগেই তাঁরা ঘোষণা দিলেন, ইলিয়াস আলীকে বিএনপি লুকিয়ে রেখেছে। উদ্দেশ্য, রাজনৈতিক আন্দোলন করার ইস্যু তৈরি করা।
এ যেন হীরক রাজার দেশ। ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হতেই বিএনপির উচিত ছিল, আগে তাকে জীবিত ও সুস্থ অবস্থায় উদ্ধার করার জন্য এ সরকারের কাছে জোর দাবি জাননো, বরং তার উদ্ধার প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা করা। মানুষটিকে তো আগে জীবিত অবস্থায় চাই। তার প্রাণ বাঁচানো দরকার। বিএনপির কার্যক্রম দেখে মনে হলো, ইলিয়াস আলীকে তাদের দরকার নেই। তাদের দরকার একটি ইস্যু। নিখোঁজ নেতার প্রতি দরদ থাকলে কোন দল রাতারাতি তাকে ইস্যু বানাতে পারত না। আগে তার জীবন রক্ষা, তাকে উদ্ধারের চেষ্টা চালাত। বাংলাদেশের রাজনীতি কতটা হৃদয়হীনতায় গিয়ে পৌঁছেছে, ইলিয়াস আলী সংক্রান্ত ঘটনায় বিএনপির কার্যক্রম তার প্রমাণ। আগে তো অপহৃত মানুষটিকে উদ্ধার কর। তারপর আন্দোলন। যদি তদন্ত ও উদ্ধার প্রচেষ্টা শেষে প্রমাণিত হয়, আওয়ামী লীগ সরকারই এ কাজটি করেছে, তাহলে সারাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে গর্জে উঠত। হরতাল ডাকা দরকার হতো না।
দু’দিনের হরতাল তাই সফল হয়নি। তা ভয়তালে পরিণত হয়েছে। নিরীহ পাঁচটি মানুষকে অপহরণে প্রাণ বলি দিতে হয়েছে। ঢাকায় এখন যে কেউ হরতাল ডাকলেই যে ভয়তাল হয়, হরতাল হয় না, তা আমি এবার নিজ চোখে দেখেছি। অর্থাৎ মানুষ হরতালের ডাকে সাড়া দেয় না, কিন্তু ভয়ে গাড়িঘোড়া বের করতে চায় না। দোকানপাট খুলতে চায় না। যে দল হরতাল ডাকে, তারা সদম্ভে দাবি করে, হরতাল সফল হয়েছে। হরতালের প্রথম দিন আমি ছিলাম ঢাকার মিরপুরে। দেখি এক তরুণী, সেজেগুজে কর্মস্থলে যাচ্ছেন। বললাম, আজ হরতাল। কাজে যাবেন কি করে? তরুণী বললেন, কিছুটা বাসে, কিছুটা রিক্সায় তারপর হেঁটে। যেসব রাস্তায় বিএনপির গু-ারা আক্রমণ চালাচ্ছে, সেসব রাস্তায় প্রাইভেটকার, বাস চলছে না। কিন্তু সবস্থানে রিক্সা চলছে। সবাই অফিস করছে।
এই হরতালের চেহারাটাও নিজের চোখে দেখলাম, অবশ্য টেলিভিশনের পর্দায়। যাত্রীবাহী বাস চলছে। তাতে সমানে ঢিল, পাথর ছুড়ছে বিএনপির সমর্থকেরা । বাসের জানালার কাঁচ ভেঙ্গে শিশুকোলে মা আহত হচ্ছে। কিন্তু নির্দয় পাথর বর্ষণের ক্ষান্ত নেই। টেলিভিশনে এই দৃশ্য যখন দেখানো হচ্ছে, তার পাশাপাশি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মীর্জা ফখরুল ইসলামেরও বক্তব্য প্রচারিত হচ্ছিল। তিনি বলছেন, সরকার শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের চেহারাটা কি, টেলিভিশনে একই সঙ্গে সেই দৃশ্য দেখছিলেন দর্শকরা। ইট-পাটকেল হাতে নিরীহ বাসযাত্রীদের ওপর নির্মম গু-ামি হচ্ছে শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক বিরোধিতা। এটা গেল ইলিয়াস আলীকে নিয়ে বিএনপির রাজনৈতিক ইস্যু সৃষ্টি করার খেলা। অন্যদিকে এই ব্যাপারে সরকারী দলের ভূমিকাটা কি? সাগর-রুনীর হত্যাকা-ের কিনারা তারা এখন পর্যন্ত করতে পারেননি। ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারেও সরকারের প্রাথমিক ও প্রধান দায়িত্ব তাকে খুঁজে বের করা। অপরাধীদের শনাক্ত করা। সে কাজটি না করে সরকার প্রথমেই বিএনপির পাতা ফাঁদে পা দিল। অর্থাৎ তদন্ত শুরু করার আগেই বলে দিল, ইলিয়াস আলীকে তার নিজের দলই গুম করে ফেলেছে। ব্যস, যে রাজনৈতিক ইস্যুটি বিএনপি তৈরি করতে চেয়েছিল, তা তৈরি হয়ে গেল। ইলিয়াস আলী চুলোয় যাক। তাকে উদ্ধারের নামে আরও পাঁচটি প্রাণ হরণ করা হলো। আর এই তথাকথিত হরতালে জনজীবনে দুর্ভোগের অন্ত ছিল না। এটা স্কুলের পরীক্ষার মৌসুম। হরতালের জন্য বহু পরীক্ষা হতে পারেনি। শিক্ষার্থীদের এই ক্ষতি ও দুর্ভোগের দিকটিও কেউ আমলে নেয়নি।
দেশে হত্যা, সন্ত্রাস ক্রমাগত বাড়ছে। সরকার তা সামাল না দিয়ে যদি বিরোধী দলের ওপর সব দায়দায়িত্ব চাপায়, তাহলে জনজীবনকে আশ্বস্ত করতে পারবেন না। প্রধানমন্ত্রীর সমুদ্র বিজয়ের নাগরিক সংবর্ধনার দিন আমি ঢাকা শহরেই ছিলাম। এই ব্যাপারে নাগরিক জীবনে কোন সাড়া, উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখিনি। আমার কাছে গোটা ব্যাপারটা মনে হয়েছে, স্তাবকদের নান্দীপাঠ। সমুদ্র বিজয় একটা উপলক্ষ মাত্র। এই বিজয়ের ঐতিহাসিকতা ও তাৎপর্য কিছুই জনজীবনে পৌঁছিয়ে দেয়া সম্ভব হয়নি। বিদ্যুত, পানি, গ্যাস সঙ্কটে জর্জরিত মানুষ এই সরকারের বড় সাফল্যগুলো দেখতে চায় না। আগে ছোট সাফল্যগুলো দেখতে চায়। যে ছোট সাফল্য তাদের দৈনন্দিন জীবনের দুর্ভোগ দূর করবে।
আমি হরতালের দিনগুলো ছাড়া যেদিনই এবার ঢাকার রাস্তায় বেরিয়েছি, সেদিনই ভয়াবহ যানজটে পড়েছি। আমার চাচা বাহাউদ্দীন চৌধুরী কিডনির গুরুতর রোগে আক্রান্ত হয়ে ঢাকার কম্যুনিটি হসপিটালে চিকিৎসাধীন আছেন। তাঁকে গাড়িতে চেপে মিরপুর থেকে দেখতে যেতে দু’দফায় আড়াই ঘণ্টা করে যানজটে আটকে ছিলাম। প্রচ- গরমে গাড়িতে বসে সিদ্ধ হয়েছি, আর ভেবেছি, মানুষ কেন এই অসহ্য অবস্থার বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়ায় না? বাঙালীর সেই ক্রোধ ও সাহস কোথায় গেল?
আমার অচল গাড়ির পাশ দিয়েই সেদিন এক মন্ত্রীর পতাকাশোভিত সচল গাড়ি দ্রুত ছুটে গেছে। যানজট তাকে আটকায়নি। ওয়াকিটকির সাহায্যে ট্রাফিক পুলিশকে আগেভাগে সিগন্যাল দিয়ে রাস্তা পরিষ্কার করে এয়ারকন্ডিশন্ড গাড়িতে মন্ত্রী পরম সুখে চলে যাচ্ছেন। অন্য কোন দেশ হলে এই মন্ত্রী এত সহজে রাস্তা অতিক্রম করতে পারতেন না। যানজটে ক্ষুব্ধ, ত্যক্ত মানুষ তার পথরোধ করত। তাকে গাড়ি থেকে টেনে নামাত। যেমন একবার টেনে নামিয়েছিল ফ্রান্সের এক মন্ত্রীকে।
এই মন্ত্রীকে চিনতে আমার দেরি হয়নি। ময়মনসিং-নন্দন। পাকিস্তান আমলে আরেক ময়মনসিং-নন্দন এভাবে বাঁশি ফুঁকিয়ে, গাড়ির আগে পিছে পাহারা নিয়ে ঢাকার রাস্তায় চলতেন। তিনি তখন ছিলেন গবর্নর। পরে ঢাকার সদরঘাটে জনতার হাতে তাকে নির্দয়ভাবে নাকাল হতে হয়েছিল। ক্ষমতায় থাকলে এসব ইতিহাস কেউ মনে রাখে না। তখন ইতিহাসের আবার পুনরাবৃত্তি ঘটে। প্রথমে ঘটে ট্র্যাজেডি, তারপর তা তামাশায় রূপান্তরিত হয়।
দুঃখ হয় বাংলাদেশের কথা ভেবে, ঢাকা শহরের অবস্থা দেখে। অবশ্য বাংলাদেশের সব শহরেরই আজ চেহারা একই ধরনের। এই চেহারা কি কোনদিন আবার পাল্টাবে, আবার সবুজ ও সতেজ হবে? মানুষ আবার তার হারানো মানবতাবোধ ফিরে পাবে? অবশ্যই একদিন ইতিহাসের চাকা ঘুরবে। ঘুরতে বাধ্য। কংক্রিটের দানবের এই কঠিন ভুজবন্ধন থেকে অবশ্যই মুক্ত হবে ঢাকা শহর। শয়তানের কাছে জিন্মি রাখা আত্মা ফাউসট আবার ফিরে পাবে। তবে তা দেখার জন্য অবশ্যই আমি সেদিন বেঁচে থাকব না। তাই গত শনিবার (৫ মে) যখন ঢাকা বিমানবন্দর থেকে লন্ডনের উদ্দেশ পাড়ি জমিয়েছি, সেদিন অপসৃয়মাণ ঢাকা শহরের দিকে তাকিয়ে বলেছি, ‘স্বদেশ, স্বদেশ করিস তোরা, স্বদেশ তো আর তোদের নয়।’
লন্ডন, ৮ মে, মঙ্গলবার ॥ ২০১২
জিপি বললেন, বাংলাদেশে গেলেই দেখছি আমার সকল পেসেন্টই নানা রোগের ভাইরাস বহন করে ফিরে আসে। দীর্ঘদিন ভোগে। তোমরা এই দেশটাতে যাও কেন? বললাম, কি করব? এটা আমার স্বদেশ। এই দেশে জন্মেছি। তার অন্নে মানুষ হয়েছি। তা কি করে ভুলব?
জিপি আমার ওষুধের প্রেসক্রিপসন লিখতে লিখতে গুণগুন করে গানের একটি চয়ন গাইলেনÑ ‘ঐড়সবষধহফ সু যড়সবষধহফ, ড়য, রঃ রং হড় সড়ৎব সু ড়হি যড়সব’ একটি ইংরেজী গানের চরণ। শুনে আমার দেশে ব্রিটিশ আমলের এক কবির কবিতার পঙ্ক্তি মনে পড়লÑ ‘স্বদেশ স্বদেশ করিস তোরা, এ দেশ তো তোদের নয়।’ কথাটা মনে হলো, বড় নির্মম সত্য। অন্তত এবার আটদিন ঢাকায় অবস্থানের সময় এ কথাটাই মনে হয়েছে।
সেই সবুজ ঢাকা শহর নেই। নেই সেই সহজ সরল মানুষগুলোও। এখন এক কংক্রিটের দানব রোজই উর্ধ আকাশে মাথা তুলছে। মানুষগুলো যেন রোবট। অন্তত আমার তাই মনে হয়েছে। সিঙ্গাপুরে দেখেছি ঐশ্বর্যের সঙ্গে সৌন্দর্যের মিলন ঢাকায় দেখেছি ঐশ্বর্যের সঙ্গে কুৎসিত দরিদ্র ও বুভুক্ষার মিলন। শহরের অভিজাত ওয়েস্টিন হোটেলের বহুতল কোন ভোজন কক্ষে বসলে আপনার মনে হবে, নিউইয়র্কের ম্যানহাটনে বসে আছেন। হোটেল থেকে বেরিয়ে আসুন, মনে হবে আফ্রিকার কোন দরিদ্র দেশের গ্রাম এরিয়ায় নেমে এসেছেন।
রাস্তায় যানজট। এক মাইল যেতে তিন ঘণ্টা লাগে। খাদ্যে ভেজাল। পানি গ্যাস বিদ্যুত সঙ্কট। মে মাসের তাল পাকানো গরমে ঘন ঘন লোডশেডিং। আমি আটদিনেই অস্থির হয়ে গিয়েছিলাম। দিন গুনেছি, কখন লন্ডনে ফিরে আসব। নিজেকে ধিক্কার দিয়েছি, যে শহরে দুই কি তিন কোটি লোক বাস করে আমি সেখানে বাস করতে পারছি না কেন? মন বলেছে, তুমি বিশ্বাসে সমাজতন্ত্রী, কিন্তু শরীরে ও স্বভাবে পাঁতি-বুর্জোয়ারও অধম হয়ে গেছ। আমার ধারণা, তাই হয়েছি।
এক কুৎসিত দানবের পাশে এক সুন্দরী রমণীকে দাঁড় করালে মনে যে অনুভূতি জাগে এবার ঢাকা শহরকে দেখে আমার মনে সেই অনুভূতি জেগেছে। ঐশ্বর্য যে এত ভালগার হতে পারে এবং তার পাশে দরিদ্র যে এত নগ্ন ও বিকট চেহারা ধারণ করতে পারে, তা বাংলাদেশ ছাড়া আর কোন দেশে দেখতে পাইনি। এর বলি হয়েছে মানবতা, মানব মনের সকল সুকুমার প্রবৃত্তি। আমাকে ঢাকার এক প্রবীণ রিটায়ার্ড অফিসার বলেছেন, আগে বাংলাদেশের মানুষের মনে ছিল মহব্বত ও ইনসানিয়াত অর্থাৎ ভালবাসা ও মনুষ্যত্ববোধ। এখন তা নেই। এখন অন্ধ লোভ, হিংসা, সন্ত্রাস, কপটতা, নির্মম হৃদয়হীনতা সে স্থান দখল করেছে। গড়হবু রং হড়ি মড়ফ। এবং এই গডের পূজায় সারাদেশ উন্মাদ।
কথাগুলো চিরাচরিত আপ্তবাক্য মনে হতে পারে। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে নির্মম সত্য। ২৭ এপ্রিল ঢাকা শহরে পা দিয়েই শুনেছি, ২৯ ও ৩০ তারিখে পর পর দু’দিন হরতাল হবে। বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ায় বিএনপি এই হরতাল ডেকেছে। বিএনপির হাতে কোন প্রমাণপত্র নেই। তারা ঘোষণা দিয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারই এই গুম-হত্যা করেছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। তাদের দায়িত্ব ইলিয়াস আলীকে খুঁজে বের করার। সেই দায়িত্ব পালনের আগেই তাঁরা ঘোষণা দিলেন, ইলিয়াস আলীকে বিএনপি লুকিয়ে রেখেছে। উদ্দেশ্য, রাজনৈতিক আন্দোলন করার ইস্যু তৈরি করা।
এ যেন হীরক রাজার দেশ। ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হতেই বিএনপির উচিত ছিল, আগে তাকে জীবিত ও সুস্থ অবস্থায় উদ্ধার করার জন্য এ সরকারের কাছে জোর দাবি জাননো, বরং তার উদ্ধার প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা করা। মানুষটিকে তো আগে জীবিত অবস্থায় চাই। তার প্রাণ বাঁচানো দরকার। বিএনপির কার্যক্রম দেখে মনে হলো, ইলিয়াস আলীকে তাদের দরকার নেই। তাদের দরকার একটি ইস্যু। নিখোঁজ নেতার প্রতি দরদ থাকলে কোন দল রাতারাতি তাকে ইস্যু বানাতে পারত না। আগে তার জীবন রক্ষা, তাকে উদ্ধারের চেষ্টা চালাত। বাংলাদেশের রাজনীতি কতটা হৃদয়হীনতায় গিয়ে পৌঁছেছে, ইলিয়াস আলী সংক্রান্ত ঘটনায় বিএনপির কার্যক্রম তার প্রমাণ। আগে তো অপহৃত মানুষটিকে উদ্ধার কর। তারপর আন্দোলন। যদি তদন্ত ও উদ্ধার প্রচেষ্টা শেষে প্রমাণিত হয়, আওয়ামী লীগ সরকারই এ কাজটি করেছে, তাহলে সারাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে গর্জে উঠত। হরতাল ডাকা দরকার হতো না।
দু’দিনের হরতাল তাই সফল হয়নি। তা ভয়তালে পরিণত হয়েছে। নিরীহ পাঁচটি মানুষকে অপহরণে প্রাণ বলি দিতে হয়েছে। ঢাকায় এখন যে কেউ হরতাল ডাকলেই যে ভয়তাল হয়, হরতাল হয় না, তা আমি এবার নিজ চোখে দেখেছি। অর্থাৎ মানুষ হরতালের ডাকে সাড়া দেয় না, কিন্তু ভয়ে গাড়িঘোড়া বের করতে চায় না। দোকানপাট খুলতে চায় না। যে দল হরতাল ডাকে, তারা সদম্ভে দাবি করে, হরতাল সফল হয়েছে। হরতালের প্রথম দিন আমি ছিলাম ঢাকার মিরপুরে। দেখি এক তরুণী, সেজেগুজে কর্মস্থলে যাচ্ছেন। বললাম, আজ হরতাল। কাজে যাবেন কি করে? তরুণী বললেন, কিছুটা বাসে, কিছুটা রিক্সায় তারপর হেঁটে। যেসব রাস্তায় বিএনপির গু-ারা আক্রমণ চালাচ্ছে, সেসব রাস্তায় প্রাইভেটকার, বাস চলছে না। কিন্তু সবস্থানে রিক্সা চলছে। সবাই অফিস করছে।
এই হরতালের চেহারাটাও নিজের চোখে দেখলাম, অবশ্য টেলিভিশনের পর্দায়। যাত্রীবাহী বাস চলছে। তাতে সমানে ঢিল, পাথর ছুড়ছে বিএনপির সমর্থকেরা । বাসের জানালার কাঁচ ভেঙ্গে শিশুকোলে মা আহত হচ্ছে। কিন্তু নির্দয় পাথর বর্ষণের ক্ষান্ত নেই। টেলিভিশনে এই দৃশ্য যখন দেখানো হচ্ছে, তার পাশাপাশি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মীর্জা ফখরুল ইসলামেরও বক্তব্য প্রচারিত হচ্ছিল। তিনি বলছেন, সরকার শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের চেহারাটা কি, টেলিভিশনে একই সঙ্গে সেই দৃশ্য দেখছিলেন দর্শকরা। ইট-পাটকেল হাতে নিরীহ বাসযাত্রীদের ওপর নির্মম গু-ামি হচ্ছে শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক বিরোধিতা। এটা গেল ইলিয়াস আলীকে নিয়ে বিএনপির রাজনৈতিক ইস্যু সৃষ্টি করার খেলা। অন্যদিকে এই ব্যাপারে সরকারী দলের ভূমিকাটা কি? সাগর-রুনীর হত্যাকা-ের কিনারা তারা এখন পর্যন্ত করতে পারেননি। ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারেও সরকারের প্রাথমিক ও প্রধান দায়িত্ব তাকে খুঁজে বের করা। অপরাধীদের শনাক্ত করা। সে কাজটি না করে সরকার প্রথমেই বিএনপির পাতা ফাঁদে পা দিল। অর্থাৎ তদন্ত শুরু করার আগেই বলে দিল, ইলিয়াস আলীকে তার নিজের দলই গুম করে ফেলেছে। ব্যস, যে রাজনৈতিক ইস্যুটি বিএনপি তৈরি করতে চেয়েছিল, তা তৈরি হয়ে গেল। ইলিয়াস আলী চুলোয় যাক। তাকে উদ্ধারের নামে আরও পাঁচটি প্রাণ হরণ করা হলো। আর এই তথাকথিত হরতালে জনজীবনে দুর্ভোগের অন্ত ছিল না। এটা স্কুলের পরীক্ষার মৌসুম। হরতালের জন্য বহু পরীক্ষা হতে পারেনি। শিক্ষার্থীদের এই ক্ষতি ও দুর্ভোগের দিকটিও কেউ আমলে নেয়নি।
দেশে হত্যা, সন্ত্রাস ক্রমাগত বাড়ছে। সরকার তা সামাল না দিয়ে যদি বিরোধী দলের ওপর সব দায়দায়িত্ব চাপায়, তাহলে জনজীবনকে আশ্বস্ত করতে পারবেন না। প্রধানমন্ত্রীর সমুদ্র বিজয়ের নাগরিক সংবর্ধনার দিন আমি ঢাকা শহরেই ছিলাম। এই ব্যাপারে নাগরিক জীবনে কোন সাড়া, উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখিনি। আমার কাছে গোটা ব্যাপারটা মনে হয়েছে, স্তাবকদের নান্দীপাঠ। সমুদ্র বিজয় একটা উপলক্ষ মাত্র। এই বিজয়ের ঐতিহাসিকতা ও তাৎপর্য কিছুই জনজীবনে পৌঁছিয়ে দেয়া সম্ভব হয়নি। বিদ্যুত, পানি, গ্যাস সঙ্কটে জর্জরিত মানুষ এই সরকারের বড় সাফল্যগুলো দেখতে চায় না। আগে ছোট সাফল্যগুলো দেখতে চায়। যে ছোট সাফল্য তাদের দৈনন্দিন জীবনের দুর্ভোগ দূর করবে।
আমি হরতালের দিনগুলো ছাড়া যেদিনই এবার ঢাকার রাস্তায় বেরিয়েছি, সেদিনই ভয়াবহ যানজটে পড়েছি। আমার চাচা বাহাউদ্দীন চৌধুরী কিডনির গুরুতর রোগে আক্রান্ত হয়ে ঢাকার কম্যুনিটি হসপিটালে চিকিৎসাধীন আছেন। তাঁকে গাড়িতে চেপে মিরপুর থেকে দেখতে যেতে দু’দফায় আড়াই ঘণ্টা করে যানজটে আটকে ছিলাম। প্রচ- গরমে গাড়িতে বসে সিদ্ধ হয়েছি, আর ভেবেছি, মানুষ কেন এই অসহ্য অবস্থার বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়ায় না? বাঙালীর সেই ক্রোধ ও সাহস কোথায় গেল?
আমার অচল গাড়ির পাশ দিয়েই সেদিন এক মন্ত্রীর পতাকাশোভিত সচল গাড়ি দ্রুত ছুটে গেছে। যানজট তাকে আটকায়নি। ওয়াকিটকির সাহায্যে ট্রাফিক পুলিশকে আগেভাগে সিগন্যাল দিয়ে রাস্তা পরিষ্কার করে এয়ারকন্ডিশন্ড গাড়িতে মন্ত্রী পরম সুখে চলে যাচ্ছেন। অন্য কোন দেশ হলে এই মন্ত্রী এত সহজে রাস্তা অতিক্রম করতে পারতেন না। যানজটে ক্ষুব্ধ, ত্যক্ত মানুষ তার পথরোধ করত। তাকে গাড়ি থেকে টেনে নামাত। যেমন একবার টেনে নামিয়েছিল ফ্রান্সের এক মন্ত্রীকে।
এই মন্ত্রীকে চিনতে আমার দেরি হয়নি। ময়মনসিং-নন্দন। পাকিস্তান আমলে আরেক ময়মনসিং-নন্দন এভাবে বাঁশি ফুঁকিয়ে, গাড়ির আগে পিছে পাহারা নিয়ে ঢাকার রাস্তায় চলতেন। তিনি তখন ছিলেন গবর্নর। পরে ঢাকার সদরঘাটে জনতার হাতে তাকে নির্দয়ভাবে নাকাল হতে হয়েছিল। ক্ষমতায় থাকলে এসব ইতিহাস কেউ মনে রাখে না। তখন ইতিহাসের আবার পুনরাবৃত্তি ঘটে। প্রথমে ঘটে ট্র্যাজেডি, তারপর তা তামাশায় রূপান্তরিত হয়।
দুঃখ হয় বাংলাদেশের কথা ভেবে, ঢাকা শহরের অবস্থা দেখে। অবশ্য বাংলাদেশের সব শহরেরই আজ চেহারা একই ধরনের। এই চেহারা কি কোনদিন আবার পাল্টাবে, আবার সবুজ ও সতেজ হবে? মানুষ আবার তার হারানো মানবতাবোধ ফিরে পাবে? অবশ্যই একদিন ইতিহাসের চাকা ঘুরবে। ঘুরতে বাধ্য। কংক্রিটের দানবের এই কঠিন ভুজবন্ধন থেকে অবশ্যই মুক্ত হবে ঢাকা শহর। শয়তানের কাছে জিন্মি রাখা আত্মা ফাউসট আবার ফিরে পাবে। তবে তা দেখার জন্য অবশ্যই আমি সেদিন বেঁচে থাকব না। তাই গত শনিবার (৫ মে) যখন ঢাকা বিমানবন্দর থেকে লন্ডনের উদ্দেশ পাড়ি জমিয়েছি, সেদিন অপসৃয়মাণ ঢাকা শহরের দিকে তাকিয়ে বলেছি, ‘স্বদেশ, স্বদেশ করিস তোরা, স্বদেশ তো আর তোদের নয়।’
লন্ডন, ৮ মে, মঙ্গলবার ॥ ২০১২
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন