শনিবার, ৫ মে, ২০১২

বাংলাদেশে স্বাধীন হয়েছে কারা?




ব দ র“ দ্দী ন উ ম র


১৯৭১ সালে একটা যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করে আমরা কী পেলাম? এটা বেশ কিছুদিন থেকেই এ দেশের জনগণের এক হƒদয় মোচড়ানো জিজ্ঞাসা। জনগণের নিজের কাছে এ প্রশ্ন স্বপ্নে পাওয়া অথবা আকাশ থেকে পড়া নয়। স্বাধীনতা-উত্তরকালে এদেশে যা ঘটে চলেছে এবং এই ঘটনাপ্রবাহে সাধারণ মানুষের ভাগ্যে কী এসেছে, তার দিকে তাকালেই জনগণের এই জিজ্ঞাসার বাস্তব ভিত্তির দেখা পাওয়া যাবে।
এসব নিয়ে কথাবার্তা নতুন নয়। কিš‘ এমন কিছু কথা বা বিষয় আছে যা পুরান হয় না। বাংলাদেশে জনগণের দুরব¯’ার কথা তেমনই একটি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের আসল ইতিহাসের সঙ্গে যারা পরিচিত তারা জানেন যে, স্বাধীনতা-উত্তরকালে যারা এদেশে রাজা-উজির হিসেবে গদিতে বসেছিলেন তারা কোন যুদ্ধ ১৯৭১ সালে করেননি। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পর যারা বিপ্লবী স্বাধীনতাযোদ্ধা হিসেবে অনেক লম্ফঝম্প করে লুটপাটে অংশগ্রহণ করেছিলেন, ক্ষমতার তলোয়ার ঘুরিয়েছিলেন, তারা ১৯৭১ সালের যুদ্ধকালীন প্রায় পুরো সময়টা ভারতীয় জেনারেল ওবানের অধীনে দেরাদুনে কমিউনিস্ট ও বামপš’ী নিধনের ট্রেনিং নিয়েছিলেন। পাকিস্তান জাতীয় ও প্রাদেশিক আইনসভার সদস্যরা যুদ্ধ করার পরিবর্তে কলকাতায় বসে বা শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শন করে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত ছিলেন। এদিক দিয়ে তাজউদ্দীন আহমদের মতো সামান্য কিছু ব্যতিক্রম উল্লেখযোগ্য। সেক্টর কমান্ডাররা সাধ্যমতো চেষ্টা করেছিলেন কিš‘ ভারত সরকার যেভাবে নানা ধরনের নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তাদের হাত-পা বেঁধে রেখেছিল (সেক্টর কমান্ডার কাজী নূর“জ্জামানের ‘যুদ্ধস্মৃতি’ দ্রষ্টব্য) তাতে তাদের করার বিশেষ কিছু ছিল না। মোট কথা, ভারত ও পাকিস্তানে যেসব আওয়ামী লীগ নেতা ১৯৭১ সালে পলাতক ছিলেন, যারা কোন যুদ্ধ করেননি, যুদ্ধের ধারেকাছেও যারা ছিলেন না, তারাই ১৯৭১ সালের পর স্বাধীন বাংলাদেশে গদিনশিন হয়েছিলেন। এভাবে গদিনশিন হতে গিয়ে তারা ১৯৭১ সালের যুদ্ধের ইতিহাসকে কুৎসিতভাবে বিকৃত করে, মিথ্যার পাহাড় বানিয়ে এক কলঙ্কজনক কাজ করেছিলেন। যে কথা চিন্তা করলে মনে হয়, সারা বাংলাদেশই যেন মিথ্যার ওপর ভাসছে।
১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় এদেশের শ্রমিক-কৃষক মধ্যবিত্ত জনগণ চরম আÍত্যাগ করেছিলেন। তাদের পরিবারের অসংখ্য ছেলেমেয়ে শুধু সম্মুখযুদ্ধে বা গেরিলা যুদ্ধেই নয়, অন্য নানাভাবে যুদ্ধের প্রক্রিয়ায় শামিল হয়েছিলেন। জীবন দিয়েছিলেন, অঙ্গহানির কারণে পঙ্গু হয়েছিলেন। অসংখ্য নিরীহ মানুষকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী হত্যা করেছিল, অগণিত নারী তাদের দ্বারা ধর্ষিত হয়েছিল। লাখ লাখ মানুষ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণ ও নির্যাতন থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য নিজ দেশে পরবাসী হয়েছিলেন। তারা পরিণত হয়েছিলেন অভ্যন্তরীণ শরণার্থীতে। এদিক থেকে বিচার করলে পলাতক আওয়ামী লীগ নেতারা ১৯৭১ সালের যুদ্ধের কোন ধরনের নায়ক ছিলেন না। সে যুদ্ধের প্রকৃত নায়ক ছিলেন এদেশের জনগণ। আজকাল অসংখ্য লোকের নামের আগে লেখা হয় ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’। কিš‘ জনগণের বীরত্বের কথা কেউ সেভাবে বলেন না। এসব থেকে মনে হয়, এদেশে স্বাধীনতা আন্দোলন জনগণ করেননি, করেছিলেন পলাতক আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ এবং তাদের সাঙ্গপাঙ্গরা। যারা দেশের জনগণকে অসহায় অব¯’ায় ফেলে ভারতে গিয়ে নিজেদের জীবন রক্ষা করেছিলেন এবং ভারতের হাতে দেশ স্বাধীন করার দায়িত্ব অর্পণ করে নিরাপদ জীবনযাপন করেছিলেন, তারাই বাংলাদেশের কথিত প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধা! তারাই বাংলাদেশের পরিত্রাতা!!
ভারতীয় সরকার ও সেনাবাহিনীর সহায়তায় ও কল্যাণে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা ও পরিত্রাতারা ১৯৭১ সালে ক্ষমতাসীন হয়েছিলেন। ক্ষমতাসীন হওয়ার পরমুহূর্ত থেকেই তারা যেভাবে লুটপাট শুর“ করেছিলেন এবং জনগণের ওপর নির্যাতন চালিয়েছিলেন, সেটা ইতিহাসের পাতায় লেখা হয়েছে। সে ইতিহাসকে চাপা দিয়ে, বিকৃত করে এখন যে মিথ্যা ইতিহাস স্কুল পাঠ্যপুস্তকে পর্যন্ত ঘুণ ধরিয়েছে, সে ইতিহাস গ্রাহ্য নয়। সে ইতিহাস ঐতিহাসিকভাবেই বর্জিত হবে।
যারা এই মিথ্যা ইতিহাস নিজ নিজ দলীয়, পারিবারিক ও ব্যক্তিস্বার্থে রচনা করেছেন, তারাই প্রথম থেকে বাংলাদেশের জনগণের শোষক-নির্যাতক। তাদের উৎপীড়নে বাংলাদেশের জনগণ আজ পর্যন্ত স্বাধীনতার কোন স্বাদ পাননি। এ পরি¯ি’তিতে স্বাধীনতা থেকে নিজেদের প্রাপ্তির হিসাব নেয়ার চিন্তা জনগণের পক্ষে স্বাভাবিক। দেখা যাবে যে, ১৯৭১ সালের পর থেকে বাংলাদেশে উৎপাদন বেড়েছে, দেশে ধনসম্পদ অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে, দেশের কিছু লোক অচিন্তনীয় ধনসম্পদের অধিকারী হয়ে বিলাসিতায় ভাসছে।
কিš‘ যারা বিপুল অধিকাংশ, যারা দেশের ৯০ শতাংশ, তাদের জীবন আজ দুর্বিষহ। শুধু যে খাদ্য, বাস¯’ান, চিকিৎসা, শিক্ষা ইত্যাদির অভাবই তাদের জীবনকে ঘিরে আছে তা-ই নয়; তাদের ওপর রাজনৈতিক নির্যাতন আজ এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যা ১৯৭২-৭৫ সময়ের পর আর দেখা যায়নি।
জনগণের জীবনে আজ কোন নিরাপত্তা নেই। ক্রসফায়ারে হত্যা, অপহরণ, গুম-খুন, ধর্ষণ, ঘরবাড়ি, জমিজমা থেকে উ”েছদ, কাজের অভাব, ছাঁটাই, মূল্যবৃদ্ধি, ফসলের উপযুক্ত দাম না পাওয়া ইত্যাদি জনগণের জীবনে আজ চরম দুর্দশা ডেকে এনেছে। এ পরি¯ি’তিতে এসবের বির“দ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন স্বাভাবিক। এ স্বাভাবিক ব্যাপার যাতে ঘটতে না পারে তার জন্য সরকার এখন জনগণের কণ্ঠ রোধে তাদের রাজনৈতিক তৎপরতার বির“দ্ধে সব রকম সম্ভাব্য পদক্ষেপই গ্রহণ করছে।
পরাধীন ব্রিটিশ আমলে এবং পরে পাকিস্তানেও জনগণের যে রাজনৈতিক স্বাধীনতা ছিল, বাংলাদেশে এখন আর তা নেই। সবই সরকার কেড়ে নিয়েছে। এখন মিটিং-সমাবেশ, মিছিলের জন্য এমনভাবে পুলিশের অনুমতির ব্যব¯’া হয়েছে যাতে স্বাধীনভাবে কোন রাজনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ প্রায় অসম্ভব হয়েছে। ঢাকায় এখন প্রেস ক্লাব ও জাদুঘরের সামনে ছাড়া অন্য কোন জায়গাতেই সভা-সমাবেশ করতে দেয়া হ”েছ না এবং এভাবে সভা করতে হলেও সেটা রাস্তার ওপর দাঁড়িয়েই করতে হ”েছ। পল্টন ময়দান, মুক্তাঙ্গন ইত্যাদির মতো জায়গায় যেখানে আগে সব সময়ই সভা-সমাবেশ হতো, সেখানে আজ নিষেধাজ্ঞা জারি আছে। অথচ মুক্তাঙ্গন তৈরি করার সময় বলা হয়েছিল, সেখানে কোন সভা-সমাবেশের জন্য কোন সময়ই কারও অনুমতির প্রয়োজন হবে না। এখন অনুমতি নিয়ে সভা করা তো দূরের কথা, মুক্তাঙ্গন সভা-সমাবেশের জন্য নিষিদ্ধ এলাকা হিসেবে সরকার ঘোষণা করেছে!
অনুমতিসাপেক্ষে যেসব সভা হয় সেখানে সভার অনুমতি ছাড়াও পৃথকভাবে মাইক ব্যবহারের অনুমতি নিতে হয়! অনেক সময় সভার সময় পর্যন্ত বেঁধে দেয়া হয়, এবং অতিরিক্ত সময় সভা চললে পুলিশ হামলা করে!! দেয়াল লিখন সরকার আগেই নিষিদ্ধ করেছে। এখন তারা পোস্টার ও লিফলেট পর্যন্ত নিষিদ্ধ করার পাঁয়তারা চালা”েছ। শিগগিরই এ নিষেধাজ্ঞা তারা জারি করবে!!! এ ব্যাপারে তারা আদালতের ওপরও প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালায়!!! কাজেই কোথায় আছি আমরা? কোথায় যা”িছ আমরা? এ প্রশ্ন আজ স্বাভাবিক। যে দেশে জনগণের স্বাধীনতায় এ ধরনের ফ্যাসিস্ট হস্তক্ষেপ করা হয়, সে দেশের জনগণকে স্বাধীন বলার কোন সুযোগ নেই। কাজেই স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষ যে আজ পরাধীন এতে আর সন্দেহ কী?
এ পরি¯ি’তিতে বাংলাদেশে স্বাধীন কারা, এ প্রশ্ন স্বাভাবিক। আগেই বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালে যারা পলাতক ছিলেন এবং যুদ্ধে যাদের সাক্ষাৎ ভূমিকা নগণ্য ছিল বা ছিলই না, তারাই ভারতীয় সরকার ও সেনাবাহিনীর সহায়তায় বাংলাদেশের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। তারাই আজ ফুলে-ফেঁপে এ দেশে শোষণ-নির্যাতনের জাল বিস্তার করে আছেন। সাম্রাজ্যবাদের কাছে দেশের স্বাধীনতা বিক্রি করতেও তাদের অসুবিধা হ”েছ না। না হওয়ারই কথা, কারণ এই স্বাধীনতা অর্জনে যাদের কোন প্রকৃত ভূমিকা ছিল না তাদের ও তাদের বংশধরদের বাংলাদেশের প্রতি কোন প্রেম, ভালোবাসা এবং জনগণের জন্য দরদ ও কর্তব্যবোধ থাকার কথা নয়। সেটা নেইও।
আসলে সাম্রাজ্যবাদীরাই শুধু নয়, এদেশীয় শোষক-শাসকরাও বাংলাদেশের জনগণের জীবনে এক ধরনের বহিরাগত। এরা জনগণের কেউ নয়। এ কারণেই জনগণের জন্য এদের করণীয় কিছু নেই। কিš‘ এরাই শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। এদের শাসন যতদিন পর্যন্ত উ”েছদ না হ”েছ ততদিন পর্যন্ত জনগণের উপরোক্ত জিজ্ঞাসা থেকেই যাবে। বিদ্যমান শোষক-শাসকদের ক্ষমতার অবসান ছাড়া এই জিজ্ঞাসার অবসান সম্ভব নয়।
৫.৫.২০১২







কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন