শনিবার, ৫ মে, ২০১২

‘...তব বাক্যে ইচ্ছি মরিবারে’




আ ব দু ল হা ই শি ক দা র
আমাদের আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলামের অবিশ্রাম এবং ননস্টপ বাক্যবাণে জাতির কান ও প্রাণ দুটোই ঝালাপালা। ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক ও শিবপ্রসন্ন লাহিড়ী প্রণীত ‘বাংলাদেশের ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে’ বলা হয়েছে, ‘পরস্পর অন্বয়যুক্ত পূর্ণ মনোভাব প্রকাশক পদ সমষ্টিই হলো বাক্য।’ আর বাক্যবাণ সম্পর্কে বলা হয়েছে ‘তীক্ষষ্ট তীরের মতো মর্মভেদী বচন’। এই কর্মে যে আইন প্রতিমন্ত্রী অতিশয় পারঙ্গম তা বলাই বাহুল্য। নিন্দুকেরা বলে তিনি ’৯৪ সালে ঢাকা সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড কমিশনার পদে দাঁড়িয়ে গো-হারা হেরেছিলেন। আবার ডিবির পানির ট্যাঙ্কিতে পাওয়া নিহত ড্রাইভার জালালের সরকারি উকিল হিসেবে তার প্রতি নাকি আদালত বিশ্বাস হারিয়ে সরিয়ে দেন। ১৯৭১ সালে পুরো জাতি যখন মুক্তিযুদ্ধে রত, সেই সময় নাকি তিনি রাজাকারদের সার্টিফিকেট নিয়ে বীরদর্পে ঢাকা শহর দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। তারপর আওয়ামী লীগ করার বদৌলতে এবার জেঁকে বসেছেন মন্ত্রিত্বের আসনে। মোট কথা, যথেষ্ট কীর্তিময় তার জীবন।
ফরিদপুরে আয়োজিত বিএনপির তৃণমূল প্রতিনিধি সম্মেলনে আমি বলেছিলাম, কামরুল সাহেব একেবারে যাচ্ছেতাই। বটতলার উকিল বললেও কম বলা হয়। এই বক্তব্য কক্সবাজার তৃণমূল সম্মেলনে দ্বিতীয়বার উচ্চারণ করে প্রতিমন্ত্রীর রোষানলে পড়েন জাতীয় প্রেস ক্লাবের সেই সময়কার সভাপতি শওকত মাহমুদ। তার বিরুদ্ধে লাগিয়ে দেয়া হয় মামলা।
তো যার সমস্ত কর্মই হলো নিছক বাক্যনির্ভর, তিনি তো বাক্যবাণই ছাড়বেন সব সময়। এবার তিনি হামলে পড়েছেন খ্যাতিমান বর্ষীয়ান আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক উল হকের উপর। ব্যারিস্টার রফিক বলেছিলেন, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের অর্থ কেলেঙ্কারি চাপা দেয়ার জন্যই ইলিয়াস আলীকে গুম করা হয়েছে। আবার ইলিয়াস গুমের প্রতিবাদে ডাকা হরতালে গাড়ি ভাংচুরের নামে ১৮ দলীয় নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে যে মামলা দেয়া হয়েছে তারও উদ্দেশ্য ঘটনাকে ভিন্ন খাতে ঘুরিয়ে দেয়া। ব্যস আর যায় কোথায়। আইন প্রতিমন্ত্রী হা রে রে করে ছুড়লেন তার বাক্যবাণ, ব্যারিস্টার রফিকউল হক মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে বসেছেন। তিনি প্রলাপ বকছেন।
এই কথা যখন আইন প্রতিমন্ত্রী বলেন তখন ব্যারিস্টার রফিক ছিলেন বাইরে। দেশে ফিরে তিনি এর একটা জবাব দিয়েছেন। বলেছেন, এসব পাগল-ছাগল কী বলে না বলে তার কোনো ঠিক নেই। কোথাকার কোন উকিল কী বললো না বললো, সেগুলো পাত্তা দিলে কি চলে?
একথা শোনার পর এ পর্যন্ত আইন প্রতিমন্ত্রীর ভাষ্য আর শোনা যায়নি। আমরা প্রার্থনা করি তিনি যেন দয়া করে চুপ থাকেন।


দুই.
ধারাবাহিক একটা লেখা লিখছিলাম ‘ভারতীয় আগ্রাসনের অন্তরলোক : হারিয়ে যাওয়া হায়দারাবাদ’। আরও কয়েকটি কিস্তি বাকি আছে। কিন্তু সুহৃদরা বললেন, দেশে বর্তমানে যা শুরু হয়েছে, যা সব ভয়াবহ ঘটনা ঘটছে সে সম্পর্কে কথা বলা দরকার। পরে না হয় আবার শুরু করবেন। তথাস্তু বলেই শুরু করেছি এই লেখা। লিখতে গিয়ে বুকটা বেদনায় টনটন করে উঠলো। কষ্ট লাগছে বন্ধু সহযোদ্ধা রাজনীতিবিদ ইলিয়াস আলীর জন্য। সচল-সজীব, প্রাণবন্ত, বন্ধুবত্সল, কর্মপাগল ইলিয়াস আলী এখন কোথায়? তিনি কি বেঁচে আছেন? বেঁচে থাকলে তিনি কী অবস্থায় আছেন? তিনি কি আদৌ ফিরে আসবেন আর তার পরিবারের কাছে, তার রাজনীতির কাছে, বিশ্বনাথ বালাগঞ্জের মানুষের কাছে, সিলেটের কাছে, বাংলাদেশের কাছে? এর উত্তর কার কাছে? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জেনারেল তারেক সিদ্দিকী, র্যাবের মহাপরিচালক, নাকি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে? প্রশ্ন অনেক। উত্তরে সবাই মৌন। তবুও প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, কেউ গুম হলে তাকে খুঁজে বের করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। তিনি বলেছেন, রাজনীতির চাইতে মানবতা বড়।
খুবই ভালো কথা। এর আগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন, আমরা আশা করি ইলিয়াস আলী জীবিতাবস্থায় ফিরে আসবেন।
আমরা এসব কথায় আস্থা স্থাপন করতে চাই। আশায় বুক বাঁধতে চাই। ইলিয়াস আলীর জন্য পথ চেয়ে আছেন তার জননী সূর্যবান বেগম, স্ত্রী লুনা, তার সন্তানরা, তার সহকর্মীরা।
আমি তো সামান্য কবি, তাই বোধ করি ইলিয়াস আলীর স্বজনদের টলমলে অশ্রু আমাকে কাঁদায়। যেমন গুম হওয়া শতাধিক মানুষের বুকফাটা হাহাকার আমাকে অস্থির করে তোলে। বিচারবহির্ভূত প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের জন্য আমার বেদনা আমাকে ঘুমাতে দেয় না রাতে।


তিন.
স্বর্ণ লঙ্কায় নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার চাদরে মোড়া নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে গভীরভাবে প্রার্থনায় রত বারণ পুত্র নিরস্ত্র মেঘনাদ। দেবরাজ ইন্দ্রকে যিনি যুদ্ধে পরাজিত করেছিলেন। সেই নিরাপদতম মন্দিরে দেবতাদের বরে পুষ্ট দশরথপুত্র লক্ষ্মণ রাবণের বিশ্বাসঘাতক ভাই বিভীষণের সাহায্যে প্রবেশ করে আঘাত করলো নিরস্ত্র পূজারি মেঘনাদের ওপর।
রামায়ণের রচয়িতা বাল্মিকীর মনে যাই থাক। ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’র কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত লক্ষ্মণের অনৈতিক অন্যায়ে কঁকিয়ে উঠেছেন। সত্যিকারের বীর ক্ষত্রিয় ধর্মের অবমাননায় রুষে উঠে হাতের কাছে থাকা পূজার কোষা ছুড়ে অজ্ঞান করে ফেললেন লক্ষ্মণকে। তারপর ছুটলেন অস্ত্রাগারের দিকে। কিন্তু মন্দির দুয়ার আগলে দাঁড়িয়ে আছে বিভীষণ। তিনি দরজা খুলে দিতে অস্বীকার করে বললেন, আমি দরজা খুলে দিতে পারবো না। আমি রামের দাস। তার বিপক্ষে কী করে কাজ করি বলো? ক্ষোভে-দুঃখে অসহ্য মনোবেদনায় কাতর মেঘনাদ ধিক্কার দিয়ে বললেন :
‘হে পিতৃব্য, তব বাক্যে ইচ্ছি মরিবারে!
রাঘবের দাস তুমি? কেমনে ও মুখে
আনিলে এ কথা, তাত, কহ তা দাসেরে!
স্থাপিলা বিধুরে বিধি স্থানুর ললাটে;
পড়ি কি ভূতলে শশী যান গড়াগড়ি
ধুলায়? হে রক্ষোরথি, ভুলিনে কেমনে—
কে তুমি? জন্ম তব কোন্ মহাকুলে?
কে বা সে অধম রাম? স্বচ্ছ সরোবরে
করে কেলি রাজহংস পঙ্কজ-কাননে;
যায় কি সে কভু, প্রভু, পঙ্কিল সলিলে,
শৈবাল দলের ধাম? মৃগেন্দ্র-কেশরী,
কবে হে বীর কেশরী, সম্ভোষে শৃগালে
মিত্রভাবে? অজ্ঞদাস, বিজ্ঞতম তুমি,
অবিদিত নহে কিছু তোমার চরণে।
ক্ষুদ্রমতি নর, শূর, লক্ষ্মণ; নহিলে
অস্ত্রহীন যোধে কি সে সম্বোধে সংগ্রামে?
কহ, মহারথী, এ কি মহারথী প্রথা?
নাহি শিশু লঙ্কাপুরে, শুনি না হাসিবে
একথা!


মোট কথা, ক্ষোভে ক্রোধে দুঃখে ফেটে পড়েছিলেন বীর মেঘনাদ। কিন্তু বিশ্বাসঘাতক বিভীষণের মন টলেনি তাতে। তিনি তার অপকর্ম জারি রেখেছিলেন। ফলে প্রাণ গেল মেঘনাদের। পতন হলো স্বর্ণ লঙ্কার। চলে গেল স্বাধীনতা।
আমাদের ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন স্তরের কর্তাদের কথাবার্তা শুনে বহুদিন পর মেঘনাদ বধ কাব্যের এই চরণগুলো মনে এলো।


চার.
রাজনীতিবিদ ইলিয়াস আলী অপহৃত হয়েছেন। তাকে গুম করা হয়েছে। অপহরণের ১৮ দিন পেরিয়ে গেলেও কোনো কূলকিনারা পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি জীবিত না মৃত, তাও অজানা। উদ্বেগ, উত্কণ্ঠা, ভীতি ও আতঙ্কে অস্থির তার পরিবার। টালমাটাল করে উঠেছে দেশের রাজনীতি। সেই সময় দায়িত্ব যাদের তাদের কাছ থেকে দেশবাসী যখন আশা করছে সাহায্য, সহনাভূতি, সমবেদনা—তখন আমাদের কর্তারা হরদম কাণ্ডজ্ঞানহীন-দায়িত্বজ্ঞানহীন বাণী বর্ষণ করে চলেছেন।
আওয়ামী লীগের চাঁদপুর, কচুয়া রণাঙ্গনের কমান্ডার ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীর বলেছেন, ইলিয়াস আলী সন্ত্রাসীদের লালন-পালন করতো। তার লালিত-পালিত সন্ত্রাসীরাই তাকে খুন করেছে। মাহবুবউল হক হানিফ এখন আওয়ামী লীগের মুখপাত্র। তিনি বলছেন, ইলিয়াস আলী একজন সন্ত্রাসী ছিল। কে তাকে গুম করেছে সেটা বিএনপিই ভালো জানে। এটা একটা সাজানো নাটক।
মন্নুজান সুফিয়ান শ্রমিক নেত্রী। তিনি আবার শ্রম প্রতিমন্ত্রীও। তিনি তো সবজান্তা শমসের। মাথা নেড়ে নেড়ে বক্তৃতায় বললেন, ইলিয়াস আলীর স্ত্রী ‘বিধবা’। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার সময় তিনি যেন বলে দেন হত্যাকারীদের নাম।
আরও অনেক মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, নেতা-কর্মী অনেক আজেবাজে কথা বলেছেন। সব কথা এখন মনেও পড়ছে না। তাছাড়া ওসব রুচি ও শিষ্টাচারহীন।
তবে একথা ঠিক, সবাইকে টেক্কা দিয়েছেন আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। তিনি প্রথমে বললেন, ইলিয়াস আলীকে বেগম খালেদা জিয়াই লুকিয়ে রেখেছেন। তার নির্দেশেই ইলিয়াস আলী লুকিয়ে আছে। দ্বিতীয়বার বলেছেন, ইলিয়াস আলীর গুম হয়ে যাওয়া এবারই প্রথম নয়। এর আগেও সে গুম হয়েছিলে। পরে একা একাই ফিরে এসেছে।
মন্নুজান সুফিয়ানের পক্ষ নিয়ে গতকাল দেখলাম সরকারের এক অনুগত চ্যানেলের কদমবুচি উপস্থাপক বললেন, ‘বিধবা’ শব্দটি ছিল তার স্লিপ অব টাং। প্রশ্ন করা হলো, যার কথা এটি, সেই মন্নুজান সুফিয়ান কিন্তু একবারের জন্যও এখনও বলেননি ওটি ছিল তার স্লিপ অব টাং, সেক্ষেত্রে আপনি কীভাবে জানলেন ওটি স্লিপ অব টাং। প্রশ্নের সামনে লেজ গুটিয়ে দ্রুত প্রসঙ্গান্তরে চলে গেলেন বিচক্ষণ উপস্থাপক।
আরেকটি ঘটনার কথা উল্লেখ করতে হচ্ছে। আমাদের একশ্রেণীর গণমাধ্যমের অধঃপতনের গতি এতই তীব্র যে গোটা সাংবাদিক সমাজ লজ্জায় পড়ে যান।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে ইলিয়াস আলীর সহধর্মিণী গেছেন গুলশানে বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে। এই সংবাদ ওই মূর্খ চ্যানেলের সংবাদ পাঠিকা বললেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার পর ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর লুনা দ্রুততার সঙ্গে সরাসরি চলে যান গুলশানে বেগম খালেদা জিয়ার কার্যালয়। সেখানে তিনি দীর্ঘ ৫০ মিনিট ধরে বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। এই রুদ্ধদ্বার বৈঠকে কী কী আলোচনা হয় সে সম্পর্কে বেগম জিয়ার প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান সোহেল কিংবা তাহসিনা রুশদীর লুনা কেউ সাংবাদিকদের কিছু বলতে রাজি হননি।’
এই মানবতাবোধবর্জিত দাসানুদাস ষড়যন্ত্র সন্ধানী চ্যানেল সম্পর্কে কী মন্তব্য করা যায়?


পাঁচ.
আওয়ামী কর্তাদের কথাবার্তা শুনে আমারও মেঘনাদের মতো বলতে ইচ্ছে করে—‘তব বাক্যে ইচ্ছি মরিবারে।’ কিন্তু কথা হলো, ব্যক্তিগতভাবে আমার মধ্যে যে বোধই কাজ করুক, দেশের মানুষ তো একযোগে মরতে পারে না। তারা কেন মরবে? দেশটা তো তাদের। তারা বরং আপদ বিদায়ের জন্য উদ্যোগ নেবে। সেটাই তো সবার প্রত্যাশা। তাহলে দেশও বাঁচবে, জনগণও হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে।
আরও একটা বিষয় ভাববার। আমাদের কর্তাদের জিহ্বার অসংযত ব্যবহার বন্ধে এখন দেখি আইন প্রণয়ন অথবা আন্দোলন জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ এই জিহ্বা দিয়েই তাদের ভিতরকার অন্ধকার ও দুর্গন্ধ বাইরে বেরিয়ে এসে নষ্ট করে পরিবেশ। অতিষ্ঠ করে তোলে জনজীবন। এজন্যই পিথাগোরাস খ্রিস্টের জন্মেরও বহু আগে বলে গেছেন, জিহ্বা দ্বারা কৃত আঘাত তরবারি দ্বারা কৃত আঘাতের চাইতেও বিষময়। আর জাপানি প্রবাদে আছে, জিহ্বা যদিও আকারে মাত্র তিন ইঞ্চি লম্বা, তবু এটা ছয় ফুট লম্বা লোককে হত্যা করতে পারে।
কাজেই এই বস্তুটিকে নিয়ন্ত্রণে আনাটাও কিন্তু খুবই জরুরি একটি বিষয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন