॥ আযম মীর ॥
‘কপালে যা আছে হবে’Ñ এ জাতীয় চিন্তা কোনো সেনানায়ক বা রাষ্ট্রনায়কসুলভ নয়। এমনকি বড়মাপের রাজনৈতিক নেতার জন্যও এমন ভাবনা মানানসই নয়। বলা হয়, রাজনৈতিক নেতারা পরবর্তী নির্বাচনের কথা ভাবেন। আর রাষ্ট্রনায়ক ভাবেন পরবর্তী প্রজন্মের কথা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা দেখছি, ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকেরা স্বল্পদৃষ্টিতে আচ্ছন্ন। যেনতেন প্রকারে ক্ষমতায় থাকা বা যাওয়ার চেষ্টা ছাড়া কোনো দূরদৃষ্টি কিংবা জাতির ভবিষ্যৎ গড়ার আকাক্সার কোনো ছাপ তাদের আচরণে দেখতে পাই না। এটা সবার জানা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও জাতীয় ঐক্য ছাড়া আমাদের মতো বিপুল জনসংখ্যার দেশে উন্নয়ন সম্ভব নয়। আর রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নির্ভরশীল জাতীয় ঐক্যের ওপর। আমাদের সবচেয়ে বড় সম্পদ আমাদের জনসংখ্যা। এই জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে পরিণত করতে পারলে এ জাতিকে বহু দূর এগিয়ে নেয়া সম্ভব। আমরা আমাদের মেধা ও যোগ্যতা বহু ক্ষেত্রেই প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি। আদায় করতে পেরেছি বিশ্ব সম্প্রদায়ের স্বীকৃতি। নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ইউনূস ও স্যার ফজলে হাসান আবেদ আজ বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে রোল মডেল। তাদের মতো বড় মাপের বহু প্রতিভাধর এ দেশে আছেন, যাদের নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি। আমাদের আছে হাজার বছরের সমৃদ্ধ ইতিহাস, আছে গর্ব করার মতো ঐতিহ্য। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সবচেয়ে বড় অহঙ্কার। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নেতৃত্ব দেয়ার মতো যোগ্যতাসম্পন্ন বহু প্রতিভা আছেন এ দেশে। তাদেরই সাফল্যের কারণে মাঝে মধ্যেই বিশ্ববাসী চমকে ওঠে।
নানা কাজে যেসব বিদেশীরা এ দেশে আসেন, তারা কিছুকালের মধ্যেই বুঝতে পারেন, এ দেশের মানুষের মেধা, কর্মক্ষমতা কতটা। কেউ কেউ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান, স্বল্প আয়তনের একটি দেশের এত বিপুল জনসংখ্যার খাদ্য-বস্ত্রের জোগান দেয় এ দেশেরই মানুষ। তারা এটা বিশ্বাস করে, যে সম্পদ এ দেশে আছে, তাকে কাজে লাগাতে পারলে দেশটি স্বল্প সময়ের মধ্যে সম্মান আদায় করার মতো উন্নতি করতে পারে। লাখ লাখ মানুষ কর্মসংস্থানের জন্য বিদেশমুখী হচ্ছে। অথচ আমাদের সম্পদের সদ্ব্যবহার হলে এ দেশেই তাদের কর্মসংস্থান সম্ভব। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি কিনটনও বাংলাদেশ সফরে এসে সে কথাই বলে গেলেন। বললেন, ‘শান্তিপূর্ণ, সমৃদ্ধ ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের পক্ষে আমি বাজি ধরছি। এ দেশ অনেক পথ পাড়ি দেবে। ১৭ বছর আগে মেয়ে চেলসিকে নিয়ে প্রথম এসেছিলেন বাংলাদেশে। তখন তিনি ফার্স্টলেডি। ঢাকা ছাড়াও প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়েছিলেন। মিশেছিলেন গ্রামের মায়েদের সাথে। পরিশ্রমী নারী-পুরুষ-শিশুদের দেখে মুগ্ধ হন। এবারে তার সফর ছিল একেবারেই ঢাকাকেন্দ্রিক। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের প্রধান হওয়ায় বাংলাদেশের হালচাল জানতে তার অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। ঢাকা সফরে আসা ছাড়াও নানা কারণে তিনি বাংলাদেশ সম্পর্কে আগ্রহী। বিশেষ করে পারিবারিক বন্ধু প্রফেসর ইউনূসের মাধ্যমে এ দেশ সম্পর্কে বিশেষভাবে খোঁজখবর রাখেন তিনিÑ এটা গণমাধ্যমে নানাভাবে প্রকাশ পেয়েছে।
বিশ্বরাজনীতিতে হিলারির পরিচিতি শুধু যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নয়Ñ আরো বেশি কিছু। তিনি সাবেক ফার্স্টলেডিই শুধু নন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য ওবামার সাথে মনোনয়নের লড়াইয়ে নেমেছিলেন। ভবিষ্যতেও হয়তো মনোনয়নের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। অনেকেরই মতে, হেনরি কিসিঞ্জারের পর হিলারিই সবচেয়ে বেশি আলোচিত ও ক্ষমতাধর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তার ব্যক্তিত্বও যথেষ্ট আকর্ষণীয়। পাণ্ডিত্যও ঈর্ষণীয়। বাংলাদেশ একটি সম্ভাবনাময় দেশ, এমন কথা হিলারির আগে অনেকেই বলেছেন। বলেছেন, মতপার্থক্য দূর করে লোকজনকে একসাথে কাজ করতে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়াকে একসাথে কাজ করতে বলেছেন। এর ফলে গণতন্ত্র টেকসই হবে এবং দেশের উন্নয়ন অব্যাহত থাকবে। হিলারির এই বক্তব্য যে তার বিশ্বাস ও আচরণের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ, তার জ্বলন্ত সাক্ষী তিনি নিজে।
প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হওয়ার জন্য তিনি ওবামার বিরুদ্ধে লড়েছিলেন। সে লড়াইয়ে যথেষ্ট প্রতিদ্বন্দ্বিতাও হয়েছিল। সে সময় আমরা দু’জনের মধ্যে বাগযুদ্ধ দেখেছি। কিন্তু ওবামার মনোনয়নের পর তার বিজয়ের জন্য এই হিলারিই কোমর বেঁধে কাজ করেছেন। যোগ দিয়েছেন তার স্বামী দুই মেয়াদের প্রেসিডেন্ট কিনটনও। ওবামার বিজয়ের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব সাদরে গ্রহণ করে ওবামাকে করেছেন শক্তিশালী। সেই হিলারি যখন বাংলাদেশের ব্যাপারে আশাবাদের কথা শোনান, ঐক্যের কথা বলেন, তাকে স্রেফ বিদেশীদের জ্ঞান দেয়া বলে ভ্রƒ কুঁচকানো যায় না। তার বাংলাদেশ সফরের আসল উদ্দেশ্য নিয়ে নানামুখী আলোচনা হচ্ছে। ভবিষ্যতে আরো হবে। বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ কী তা নিয়েও পর্যালোচনা হবে। যে কৌশলগত সহযোগিতা চুক্তির কথা বলা হচ্ছেÑ তার মাজেজা কী তা নিয়েও বহু আলোচনা-বিতর্ক হবে। বাংলাদেশের মতো বহু দেশে ক্ষমতার পালাবদলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকার কথাও আমরা জানি। এসব সত্ত্বেও হিলারি বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে তার কূটনৈতিক ভ্যানিটি রক্ষা করেও যে কথাগুলো বলে গেছেন তার যৌক্তিকতা কি আমরা অস্বীকার করতে পারব? সংলাপ ও সমঝোতা ছাড়া কী করে সম্ভব জাতীয় ঐক্য? বিরোধী দলের সহযোগিতা ছাড়া কী করে সম্ভব রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা? আইনের শাসন, সুশাসন ছাড়া সামাজিক উন্নয়ন কি কল্পনা করা যায়, না অর্জন সম্ভব? বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, খুন বন্ধ না করে কি মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব? আর মানবাধিকার উপেক্ষা করে কি গণতান্ত্রিক সমাজের দাবি করা যায়? অনেক ঝড়ঝাপটার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি যখন বাংলাদেশ সফরে, তখন ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জিও বাংলাদেশে আসেন। একই দিনে তারা ঢাকা ত্যাগ করেন। এই দুই অতিথির ঠিক আগে এসেছিলেন জাপানের উপপ্রধানমন্ত্রী। ফলে কূটনৈতিক পর্যায়ে কয়েকটি দিন বাংলাদেশ বেশ আলোচিত ছিল। কিন্তু তাদের এই সফর কি শুধুই কূটনৈতিক সম্পর্কের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, নাকি কোনো বার্তা তারা দিয়ে গেছেনÑ তা নিয়ে চলছে নানা পর্যালোচনা।
হিলারি স্পষ্ট ভাষায় রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানে সংলাপ-সমঝোতার কথা বলে গেছেন। জাপানের উপপ্রধানমন্ত্রী স্থিতিশীলতা ও দুর্নীতিমুক্ত থাকার ওপর জোর দিয়ে গেছেন। আর প্রণব বাবু? তার সুরও কিন্তু এবার অন্য রকম ছিল। বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার সাথে সাক্ষাৎ করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, বিশেষ কোনো দল নয়, বাংলাদেশের সাথে সুসম্পর্ক চায় ভারত। নিরপেক্ষ নির্বাচন প্রশ্নে তার মন্তব্যÑ নির্বাচনপ্রক্রিয়া কেমন হবে তা বাংলাদেশের নিজস্ব ব্যাপার। তবে এ ক্ষেত্রে একতরফা সিদ্ধান্তের বদলে সবার সাথে আলোচনা করে গ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়ার ভিত্তিতেই এগোনো উচিত।
হিলারি ও প্রণব দু’জনই সফরের শেষপর্যায়ে বিরোধীদলীয় নেতার সাথে বৈঠক করেছেন। হিলারির সাথে বৈঠকটি ছিল এক ঘণ্টার এবং প্রণবের সাথে ৪০ মিনিটের। প্রায় একই সময়ে দু’জনের সফর কাকতালীয় কি না জানা যায়নি, তবে তা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করছেন পর্যবেক্ষকেরা। তারা যে বার্তা দিয়ে গেছেন তাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সরকার যদি এ বার্তা অনুধাবন করে থাকে, তবে আর বিলম্ব না করে উচিত হবে কথিত সাঁড়াশি অভিযান কিংবা হামলা-মামলার কৌশল বদলে ফেলা, আলোচনা-সমঝোতার পথে পা বাড়ানো।
দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম করে আমরা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম করেছি। তাকে শুধু টিকিয়ে রাখা নয়, শক্তিশালী করতে হলে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাটি পুনর্বহাল করা জরুরি। এখন এই ইস্যুটিই বিরোধের মূল। আমরা দেখতে চাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই বিষয়ে সব ইগোকে দূরে সরিয়ে দিয়ে আলোচনা-সমঝোতার পথে এগোবেন। সেটাই হবে সঙ্ঘাত এড়ানোর পথ। রাষ্ট্রনায়কোচিত এই পথই ধরতে হবে।
azammir2003@yahoo.com
‘কপালে যা আছে হবে’Ñ এ জাতীয় চিন্তা কোনো সেনানায়ক বা রাষ্ট্রনায়কসুলভ নয়। এমনকি বড়মাপের রাজনৈতিক নেতার জন্যও এমন ভাবনা মানানসই নয়। বলা হয়, রাজনৈতিক নেতারা পরবর্তী নির্বাচনের কথা ভাবেন। আর রাষ্ট্রনায়ক ভাবেন পরবর্তী প্রজন্মের কথা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা দেখছি, ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকেরা স্বল্পদৃষ্টিতে আচ্ছন্ন। যেনতেন প্রকারে ক্ষমতায় থাকা বা যাওয়ার চেষ্টা ছাড়া কোনো দূরদৃষ্টি কিংবা জাতির ভবিষ্যৎ গড়ার আকাক্সার কোনো ছাপ তাদের আচরণে দেখতে পাই না। এটা সবার জানা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও জাতীয় ঐক্য ছাড়া আমাদের মতো বিপুল জনসংখ্যার দেশে উন্নয়ন সম্ভব নয়। আর রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নির্ভরশীল জাতীয় ঐক্যের ওপর। আমাদের সবচেয়ে বড় সম্পদ আমাদের জনসংখ্যা। এই জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে পরিণত করতে পারলে এ জাতিকে বহু দূর এগিয়ে নেয়া সম্ভব। আমরা আমাদের মেধা ও যোগ্যতা বহু ক্ষেত্রেই প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি। আদায় করতে পেরেছি বিশ্ব সম্প্রদায়ের স্বীকৃতি। নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ইউনূস ও স্যার ফজলে হাসান আবেদ আজ বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে রোল মডেল। তাদের মতো বড় মাপের বহু প্রতিভাধর এ দেশে আছেন, যাদের নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি। আমাদের আছে হাজার বছরের সমৃদ্ধ ইতিহাস, আছে গর্ব করার মতো ঐতিহ্য। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সবচেয়ে বড় অহঙ্কার। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নেতৃত্ব দেয়ার মতো যোগ্যতাসম্পন্ন বহু প্রতিভা আছেন এ দেশে। তাদেরই সাফল্যের কারণে মাঝে মধ্যেই বিশ্ববাসী চমকে ওঠে।
নানা কাজে যেসব বিদেশীরা এ দেশে আসেন, তারা কিছুকালের মধ্যেই বুঝতে পারেন, এ দেশের মানুষের মেধা, কর্মক্ষমতা কতটা। কেউ কেউ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান, স্বল্প আয়তনের একটি দেশের এত বিপুল জনসংখ্যার খাদ্য-বস্ত্রের জোগান দেয় এ দেশেরই মানুষ। তারা এটা বিশ্বাস করে, যে সম্পদ এ দেশে আছে, তাকে কাজে লাগাতে পারলে দেশটি স্বল্প সময়ের মধ্যে সম্মান আদায় করার মতো উন্নতি করতে পারে। লাখ লাখ মানুষ কর্মসংস্থানের জন্য বিদেশমুখী হচ্ছে। অথচ আমাদের সম্পদের সদ্ব্যবহার হলে এ দেশেই তাদের কর্মসংস্থান সম্ভব। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি কিনটনও বাংলাদেশ সফরে এসে সে কথাই বলে গেলেন। বললেন, ‘শান্তিপূর্ণ, সমৃদ্ধ ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের পক্ষে আমি বাজি ধরছি। এ দেশ অনেক পথ পাড়ি দেবে। ১৭ বছর আগে মেয়ে চেলসিকে নিয়ে প্রথম এসেছিলেন বাংলাদেশে। তখন তিনি ফার্স্টলেডি। ঢাকা ছাড়াও প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়েছিলেন। মিশেছিলেন গ্রামের মায়েদের সাথে। পরিশ্রমী নারী-পুরুষ-শিশুদের দেখে মুগ্ধ হন। এবারে তার সফর ছিল একেবারেই ঢাকাকেন্দ্রিক। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের প্রধান হওয়ায় বাংলাদেশের হালচাল জানতে তার অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। ঢাকা সফরে আসা ছাড়াও নানা কারণে তিনি বাংলাদেশ সম্পর্কে আগ্রহী। বিশেষ করে পারিবারিক বন্ধু প্রফেসর ইউনূসের মাধ্যমে এ দেশ সম্পর্কে বিশেষভাবে খোঁজখবর রাখেন তিনিÑ এটা গণমাধ্যমে নানাভাবে প্রকাশ পেয়েছে।
বিশ্বরাজনীতিতে হিলারির পরিচিতি শুধু যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নয়Ñ আরো বেশি কিছু। তিনি সাবেক ফার্স্টলেডিই শুধু নন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য ওবামার সাথে মনোনয়নের লড়াইয়ে নেমেছিলেন। ভবিষ্যতেও হয়তো মনোনয়নের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। অনেকেরই মতে, হেনরি কিসিঞ্জারের পর হিলারিই সবচেয়ে বেশি আলোচিত ও ক্ষমতাধর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তার ব্যক্তিত্বও যথেষ্ট আকর্ষণীয়। পাণ্ডিত্যও ঈর্ষণীয়। বাংলাদেশ একটি সম্ভাবনাময় দেশ, এমন কথা হিলারির আগে অনেকেই বলেছেন। বলেছেন, মতপার্থক্য দূর করে লোকজনকে একসাথে কাজ করতে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়াকে একসাথে কাজ করতে বলেছেন। এর ফলে গণতন্ত্র টেকসই হবে এবং দেশের উন্নয়ন অব্যাহত থাকবে। হিলারির এই বক্তব্য যে তার বিশ্বাস ও আচরণের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ, তার জ্বলন্ত সাক্ষী তিনি নিজে।
প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হওয়ার জন্য তিনি ওবামার বিরুদ্ধে লড়েছিলেন। সে লড়াইয়ে যথেষ্ট প্রতিদ্বন্দ্বিতাও হয়েছিল। সে সময় আমরা দু’জনের মধ্যে বাগযুদ্ধ দেখেছি। কিন্তু ওবামার মনোনয়নের পর তার বিজয়ের জন্য এই হিলারিই কোমর বেঁধে কাজ করেছেন। যোগ দিয়েছেন তার স্বামী দুই মেয়াদের প্রেসিডেন্ট কিনটনও। ওবামার বিজয়ের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব সাদরে গ্রহণ করে ওবামাকে করেছেন শক্তিশালী। সেই হিলারি যখন বাংলাদেশের ব্যাপারে আশাবাদের কথা শোনান, ঐক্যের কথা বলেন, তাকে স্রেফ বিদেশীদের জ্ঞান দেয়া বলে ভ্রƒ কুঁচকানো যায় না। তার বাংলাদেশ সফরের আসল উদ্দেশ্য নিয়ে নানামুখী আলোচনা হচ্ছে। ভবিষ্যতে আরো হবে। বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ কী তা নিয়েও পর্যালোচনা হবে। যে কৌশলগত সহযোগিতা চুক্তির কথা বলা হচ্ছেÑ তার মাজেজা কী তা নিয়েও বহু আলোচনা-বিতর্ক হবে। বাংলাদেশের মতো বহু দেশে ক্ষমতার পালাবদলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকার কথাও আমরা জানি। এসব সত্ত্বেও হিলারি বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে তার কূটনৈতিক ভ্যানিটি রক্ষা করেও যে কথাগুলো বলে গেছেন তার যৌক্তিকতা কি আমরা অস্বীকার করতে পারব? সংলাপ ও সমঝোতা ছাড়া কী করে সম্ভব জাতীয় ঐক্য? বিরোধী দলের সহযোগিতা ছাড়া কী করে সম্ভব রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা? আইনের শাসন, সুশাসন ছাড়া সামাজিক উন্নয়ন কি কল্পনা করা যায়, না অর্জন সম্ভব? বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, খুন বন্ধ না করে কি মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব? আর মানবাধিকার উপেক্ষা করে কি গণতান্ত্রিক সমাজের দাবি করা যায়? অনেক ঝড়ঝাপটার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি যখন বাংলাদেশ সফরে, তখন ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জিও বাংলাদেশে আসেন। একই দিনে তারা ঢাকা ত্যাগ করেন। এই দুই অতিথির ঠিক আগে এসেছিলেন জাপানের উপপ্রধানমন্ত্রী। ফলে কূটনৈতিক পর্যায়ে কয়েকটি দিন বাংলাদেশ বেশ আলোচিত ছিল। কিন্তু তাদের এই সফর কি শুধুই কূটনৈতিক সম্পর্কের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, নাকি কোনো বার্তা তারা দিয়ে গেছেনÑ তা নিয়ে চলছে নানা পর্যালোচনা।
হিলারি স্পষ্ট ভাষায় রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানে সংলাপ-সমঝোতার কথা বলে গেছেন। জাপানের উপপ্রধানমন্ত্রী স্থিতিশীলতা ও দুর্নীতিমুক্ত থাকার ওপর জোর দিয়ে গেছেন। আর প্রণব বাবু? তার সুরও কিন্তু এবার অন্য রকম ছিল। বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার সাথে সাক্ষাৎ করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, বিশেষ কোনো দল নয়, বাংলাদেশের সাথে সুসম্পর্ক চায় ভারত। নিরপেক্ষ নির্বাচন প্রশ্নে তার মন্তব্যÑ নির্বাচনপ্রক্রিয়া কেমন হবে তা বাংলাদেশের নিজস্ব ব্যাপার। তবে এ ক্ষেত্রে একতরফা সিদ্ধান্তের বদলে সবার সাথে আলোচনা করে গ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়ার ভিত্তিতেই এগোনো উচিত।
হিলারি ও প্রণব দু’জনই সফরের শেষপর্যায়ে বিরোধীদলীয় নেতার সাথে বৈঠক করেছেন। হিলারির সাথে বৈঠকটি ছিল এক ঘণ্টার এবং প্রণবের সাথে ৪০ মিনিটের। প্রায় একই সময়ে দু’জনের সফর কাকতালীয় কি না জানা যায়নি, তবে তা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করছেন পর্যবেক্ষকেরা। তারা যে বার্তা দিয়ে গেছেন তাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সরকার যদি এ বার্তা অনুধাবন করে থাকে, তবে আর বিলম্ব না করে উচিত হবে কথিত সাঁড়াশি অভিযান কিংবা হামলা-মামলার কৌশল বদলে ফেলা, আলোচনা-সমঝোতার পথে পা বাড়ানো।
দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম করে আমরা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম করেছি। তাকে শুধু টিকিয়ে রাখা নয়, শক্তিশালী করতে হলে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাটি পুনর্বহাল করা জরুরি। এখন এই ইস্যুটিই বিরোধের মূল। আমরা দেখতে চাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই বিষয়ে সব ইগোকে দূরে সরিয়ে দিয়ে আলোচনা-সমঝোতার পথে এগোবেন। সেটাই হবে সঙ্ঘাত এড়ানোর পথ। রাষ্ট্রনায়কোচিত এই পথই ধরতে হবে।
azammir2003@yahoo.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন