মঙ্গলবার, ৮ মে, ২০১২

শীর্ষেন্দুর সংলাপ ও ইতিহাস নিয়ে লুকোচুরি




॥ মীযানুল করীম ॥

যারা ট্রেনে যাতায়াত করেন, বড় বড় স্টেশনে বইয়ের হকারের দেখা পান প্রায় সময়। নির্দিষ্ট কয়েকজন লেখকের গল্প-উপন্যাস নিয়ে তাদের ছোটাছুটি ও হাঁকডাকের অভিজ্ঞতা আছে অনেকেরই। এই লেখকদের মধ্যে কলাকাতারও আছেন, যাদের বইয়ের পাইরেটেড এডিশনই পথেঘাটে মেলে। এসব জনপ্রিয় লেখকের মধ্যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব গুহ, সৈয়দ মুস্তফা সিরাজ, মহাশ্বেতা দেবী প্রমুখের নাম প্রথমেই উল্লেখ করতে হয়।
সেই শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের একজন শীর্ষস্থানীয় কথাসাহিত্যিক। জন্মভূমি এ দেশে হলেও ঢাকায় এসেছেন খুব কমই। তিনি এত পাঠকপ্রিয়; তার লেখা বই কেনা ও পড়ার জন্য এ দেশের অনেকে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। অথচ তিনিই বাংলাদেশের একটি পত্রিকায় বলেছেন, ‘পাঠকের জন্য লিখিনি কখনো। পাঠককে খুশি করার জন্য লিখিনিÑ পাঠক আমার লেখা নিলে নিলো, না নিলে ফেলে দিলো; কিন্তু পাঠককে খুশি করার এমন অ্যাটিচিউড আমার কখনো ছিল না।’ তা না থাকলে কী হবে, পাঠক তো তার লেখা পড়ে মহা খুশি! ঠিক যেমন ভারতের সাহিত্য-সংস্কৃতিসেবীদের বেশির ভাগই বাংলাদেশের সাহিত্যকর্ম, সঙ্গীত বা চলচ্চিত্রের হদিস না রাখলেও আমাদের দেশে তাদের কদরের শেষ নেই।
শীর্ষেন্দু মুখুজ্জের জন্ম ১৯৩৫ সালে আমাদের ময়মনসিংহে। সে দিক দিয়ে তিনি কলকাতার চোখে ‘বাঙাল’। তবে তার চিন্তাভাবনায় তার জন্মস্থান অর্থাৎ সাবেক পূর্ব বাংলা ও বর্তমান বাংলাদেশ যে খুব একটা নমস্য নয়, তা জানিয়ে দিতে দ্বিধা করেননি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী সরকারের এই আমলে ওপার থেকে অবিরাম আসছেন লেখক, শিল্পী, সাহিত্যিক, সংস্কৃতিসেবী। তাদের একটা বড় অংশের পৈতৃক ভূমি, জন্মস্থান, এমনকি শৈশব ও বাল্যের পাদপীঠ হলো বাংলাদেশ। তারা যে সেই শিকড়ের টানে এখানে আসছেন তা নয়, যদিও আমাদের অনেকে গদগদ কণ্ঠে এমনটাই বলে থাকেন। তারা আসেন গরজে। জীবিকার পেশা কিংবা চর্চার নেশায়। এ ক্ষেত্রে তাদের আগমনের সাথে ‘আত্মিক’ বিষয়ের চেয়ে ‘আর্থিক’ যোগসূত্রই বেশি।
শীর্ষেন্দুর সাথে অনেক ব্যাপারেই হয়তো আমরা একমত হবো না। তবে প্রশংসনীয় হলো তার খোলামেলা কথা। তিনি যে ‘পপুলার’ হওয়ার তোয়াক্কা করেন না, প্রেমপীরিতি না করা ‘সেকেলে’ মানুষ, ভূতে বিশ্বাস করেন, শুধু স্রষ্টায় বিশ্বাসীই নন, ঠাকুরের প্রতি অচলাভক্তি, বাংলাদেশকে যে তেমন আপন মনে হয় নাÑ এসব বলেছেন অকপটে। মুশকিল হয়েছে আমাদের দেশের একশ্রেণীর মানুষ নিয়ে। তারা শীর্ষেন্দুর মতো ব্যক্তিদের সম্পর্কে তিক্ত সত্য জেনেও একটা ঘোরের মধ্যে থাকেন। সম্মোহিতের মতো তাদের অতি উঁচু আসনে বসিয়ে ভাবেন, এমন মানুষেরা নিখুঁত পূজনীয়। কিংবা তাদের বক্তব্য বা বিশ্বাস থেকে শিক্ষা নেন না; বরং হীনম্মন্যতায় ভোগেন। শীর্ষেন্দুর ধর্মবোধ আমাদেরকে নিজ নিজ ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করবে, এটাই যুক্তিযুক্ত। সেখানে হীনমনারা মুসলিম লেখক-শিল্পীকে সাম্প্রদায়িক বা প্রতিক্রিয়াশীল মনে করছেন, যদিও তারা স্বধর্মে অনুরাগের কথা প্রকাশ করেন। শীর্ষেন্দু এ দেশের কে কী ভাববে, তার ধার না ধেরে নিজের আসল পরিচয় তুলে ধরেছেন। আমাদের শিল্পী-সাহিত্যিকেরাও যেন ভণিতা না করে নিজেদের পরিচয় দেন এবং নিজের ধর্ম ও ধর্মীয় ঐতিহ্য নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই গর্ববোধ করেন। 
আমাদের দেশের প্রগতিবাদী ও সেকুলার মহলের কাছে ধর্ম নিছক গৌণ ব্যাপার। অনেকের কাছে ধর্ম অবশ্যই পরিত্যাজ্য। কারণ স্রষ্টায় বিশ্বাস এবং ধর্মপালন স্রেফ গোঁড়ামি, প্রতিক্রিয়াশীলতা। এসব ‘মধ্যযুগীয়’ কর্মকাণ্ড ডিজিটাল যুগে অচল বলে মনে করেন আধুনিককালের এই মতান্ধরা।
শীর্ষেন্দুর ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ পাঠক ও ভক্তদের জানা দরকার, তিনি ধর্মের প্রশ্নে মোটেও নিরপেক্ষ নন। এটাই বাস্তব প্রেক্ষাপটে অতি স্বাভাবিক। নাস্তিক প্রগতিশীলেরা কুঁচকিয়ে বাঁকা চোখে তাকাবে কি না, সে তোয়াক্কা না করে শীর্ষেন্দু গর্বের সাথেই বলে থাকেন, তিনি ঠাকুর অনুকূল চন্দ্রের শত ভাগ ভক্ত এবং সবই তার আশীর্বাদের ফল।
এমনকি মানবজমিন পত্রিকাকে তিনি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন ঢাকার হিন্দু অধ্যুষিত শাঁখারীবাজারে এই ঠাকুরের সৎসঙ্গ আশ্রমে বসে। এতে তাকে হীনম্মন্যতায় ভুগতে হয়নি।
ভারতীয় উপমহাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের পিতৃতুল্য ব্যক্তিত্ব, কমরেড মুজফফর আহমদ জীবনসায়াহ্নে দুঃখের সাথে বলে গেছেন, মুসলমানেরা কমিউনিস্ট হলে নিজ ধর্ম ছুড়ে ফেলে আসে। আর হিন্দুরা কমিউনিস্ট হলেও নিজের ধর্মীয় পরিচয় বিসর্জন দেয় না। মুজফফর নিজে শেষ জীবনে নামাজ-রোজা ধরেছিলেন। ১৯৭৩ সালে তার মৃত্যুর পর কলকাতার পত্রিকাই এ খবর দিয়েছিল।
শীর্ষেন্দুর লেখায় শুধু নয়, তার লেখা বিভিন্ন বই উৎসর্গ করেছেন পাবনার ঠাকুর অনুকূল চন্দ্রের উদ্দেশে। তিনি বলেছেন, ‘ঠাকুর তো আমার গুরু, কাজেই ঠাকুরের কথা থাকবেই। তার স্মারক বা চিহ্ন আমার সব বই-ই বহন করে। আমার জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ঠাকুরের।... তিনি আমাকে সঙ্কট থেকে রক্ষা করেন। তার জীবনদর্শন বা অনুশাসনবাদ আমাকে প্রভাবিত করে রেখেছে এবং হানড্রেড পারসেন্ট তাকে অবলম্বন করে জীবনের পথে চলি। আমার যা কিছু, সব ঠাকুরের।’ এ কথাগুলো বললেন প্রথম আলোকে।
এরপর মানবজমিনকে বলেছেন, ‘ঠাকুর আমার মাথার ওপর।... জীবনে তাকেই সবচেয়ে বড় প্রেরণা বলে মনে করি। আমার জীবনের নিয়ন্ত্রক, গতি-প্রকৃতি সবই তিনি। সুতরাং তার জীবন দর্শন, আদর্শ আমার লেখার মধ্যেও ফুটে ওঠে।... আজ আমি যা, সব কিছু ঠাকুরের অবদান। বলা যায়, আমাকে নিয়ে চলেছেন ঠাকুর।’ উল্লেখ্য, নিষ্ঠাবান ধর্মাচারী হিসেবে তিনি নিজে রান্না করে খান।
শীর্ষেন্দুর এই বিশ্বাস ও বক্তব্য থেকে এ দেশের শীর্ষেন্দুভক্ত ও পাঠকদের শিক্ষা নেয়া উচিত। কারণ আমরা নিজ ধর্ম সম্পর্কে না জেনেই তাকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিচ্ছি। দেখা যায়, বাংলাদেশের সেকুলাররা মুসলমানদের ধর্মকর্মকে সাম্প্রদায়িকতা এবং অন্যদের ধর্মাচারকে বাঙালিয়ানা কিংবা একধরনের জাতীয়তাবাদ মনে করার বিভ্রান্তিতে নিমজ্জিত।
এবার ১৩ এপ্রিল প্রথম আলোয় প্রথম সাক্ষাৎকার ছাপা হওয়ার পর ২৫ এপ্রিল আরেকটি দৈনিক পত্রিকায় বর্ষপূর্তি সংখ্যায়ও শীর্ষেন্দুর আলাপচারিতার বয়ান উঠেছে। এতে বাংলাদেশের সাথে জন্মসূত্রে সম্পর্ক প্রসঙ্গে জানানো হয়েছে। তার দাদু বাড়ি করেছিলেন ময়মনসিংহ শহরের দুর্গাবাড়ি সড়কে। বিরাট বাড়ি। বলেছেন, ‘এগুলো আমার খুব মধুর স্মৃতি, প্রিয় স্মৃতি।’ তবুও বাবু শীর্ষেন্দু রাখঢাক না রেখে বলে দিয়েছেন, ‘মাটির টানে এ বাংলায় ফিরে আসিÑ এমনটা মনে হয় না।’ তদুপরি তিনি এক, দুই, তিন বাংলায় বিশ্বাসী, যেমন বিশ্বাস করেন ভূতপেতনীতে। ‘পূর্ব বঙ্গে জন্মেছি। উত্তরবঙ্গে বাবা বাড়ি করেছেন। দক্ষিণবঙ্গে (কলকাতায়) আমার বাস’Ñ এই সোজা হিসাব দিয়ে দাদা শীর্ষেন্দু বলেছেন, ‘তিন বাংলার কোনোটাই আমার কাছে ফেলনা মনে হয় না।’ তিনি বলেছেন, দেশ ভাগ না হলে হয়তো ঢাকাতেই সেটেল হতাম।’ কিন্তু ’৪৭-এর সেই দেশ ভাগের পর কি অনেক হিন্দু কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, সংস্কৃতিসেবী এখানেই থেকে যাননি? তাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ তো পুরো পাকিস্তান আমলেই এখানে ছিলেন। এ দেশেই কাটিয়েছেন শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত। জন্মভূমি, তথা নিজের শিকড়ের জন্য বিশেষ টান থাকলে শীর্ষেন্দুদের ঢাকায় থেকে যাওয়া অসম্ভব হতো না। শীর্ষেন্দু অন্তরে সে টান বোধ করেন না বলে নির্দ্বিধায় জানিয়েছেন, ‘এখন এটা বলা মুশকিল যে, এই বাংলায় ফিরে আসতে চাই।’
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে শীর্ষেন্দুর পর্যবেক্ষণে বাস্তববোধ যেমন আছে, তেমনি কিছু কথা শুধু বিভ্রান্তিকর নয়, আপত্তিকরও। তিনি বলেছেন, ‘সীমান্তে কখনো বিএসএফ গুলি চালায়, কখনো বিজিবি।’ হতবাক হতে হয় এটা পড়ে। শীর্ষেন্দু প্রমাণ দিলেন, তার কাছে ‘বাঙালি’র চেয়ে ‘ভারতীয়’ পরিচয় অনেক বড়। আমাদের উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা কিন্তু ‘বাংলাদেশী’ পরিচয় দিতে লজ্জা পান; ুব্ধ হন।
ফালানীর মর্মান্তিক হত্যাযজ্ঞ, বাংলাদেশের পাদুয়া দখল, আর বড়াইবাড়ীতে অনুপ্রবেশ ও অনাচার, নিত্যনিয়ত অকারণে বাংলাদেশী নাগরিকদের হত্যা, নির্যাতন, নগ্ন করে অত্যাচার, পিটিয়ে খুন, লাশটাও অপহরণ এবং সেই সাথে মাঝে মাঝে ধর্ষণ, লুণ্ঠন-বিএসএফের এসব জঘন্য অপরাধ এবং নারকীয় দুষ্কৃতি শীর্ষেন্দুর ভাবনার তালিকায় শীর্ষে তো নয়ই, নিচের দিকেও ঠাঁই পাওয়ার প্রমাণ মেলে না। তিনি আগ্রাসী বিএসএফ আর আক্রান্ত বিজিবি, অর্থাৎ সাবেক বিডিআরকে, সমান করে দেখলেন। এটা শুধু তেল ও ঘি একদরে বেচা নয়, আন্তর্জাতিকভাবে ‘খুনি বাহিনী’র খেতাবধারী বিএসএফের পৈশাচিক বর্বরতা লুকানোর ব্যর্থ প্রয়াস মাত্র।
শীর্ষেন্দু মুখার্জি আরজি পেশ করেছেন, ‘গণতন্ত্রের রানী’ মমতা ব্যানার্জির উকিল হিসেবে। মহাশ্বেতা দেবীর মতো সাহিত্যি করা পশ্চিমবঙ্গের গত নির্বাচনে মমতার সপক্ষে ছিলেন সোচ্চার। নতুন দিনের রঙিন স্বপ্নে লেখক-শিল্পী-সাহিত্যি করা মমতার জন্য অপার মমতায় রাজনৈতিক কর্মীর মতো রাজপথে-ময়দানে কাজ করেছেন। বছর না ঘুরতেই দিদির দাবড়ানো আর দুর্বৃত্তপনায় আতঙ্কিত মহাশ্বেতা তাকে বলেছেন, ‘ফ্যাসিস্ট’। অথচ শীর্ষেন্দু বাংলাদেশী পত্রিকাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে অমৃতবচন শোনালেন, ‘মমতাকে আরো সময় দিতে হবে। দীর্ঘ বাম শাসনের অবসানে অল্প দিনেই সব কিছু বদলে যাবেÑ এমনটা বলা যায় না। এটা বলা যায়, মমতা বাংলাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে।’ জেনে রাখা ভালো, এই ‘বাংলা’ কিন্তু বাংলাদেশ নয়, পশ্চিমবঙ্গ। এ দিকে মমতা তিস্তার পানি না দিয়ে আমাদের শুকিয়ে মারতে চেয়েছেন (ইন্দিরা যেমন চেয়েছিলেন গঙ্গার পানি থেকে বাংলাদেশকে বঞ্চিত রেখে)। ভারতের খোদ প্রধানমন্ত্রী মনমোহনের মনে পর্যন্ত আঘাত লাগে তিস্তা নিয়ে মমতার আচরণে। কিন্তু বাঙালি শীর্ষেন্দু মনে করেন, তার জন্মভূমি বাংলাদেশকে ‘তিস্তার জল ইচ্ছে করলেই তো ভারত দিতে পারে না।’
শীর্ষেন্দু যাই বলুন, সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ে তিনি কিন্তু ‘এপার বাংলা-ওপার বাংলা’র ঐকতানে মোহিত নন। ভারত আর বাংলাদেশ যেন হরিহর আত্মা, এমন অবাস্তব একাত্মবাদীদের চোখও কিছুটা খুলে দিতে পারে শীর্ষেন্দুর সংলাপ। তার মতে, এই দুই দেশের জীবনযাপন ‘খানিকটা’ একই রকম। আর মিল থাকলেও ‘সেই মিল তো রাজনৈতিক বিভাজন মেটাতে পারবে না।’
বুঝহ সুজন যে জানহ সন্ধান।

অর্ধসত্য মিথ্যার চেয়েও ভয়ঙ্কর
সম্প্রতি একটি দৈনিক পত্রিকার উদ্যোগে ধারাবাহিক প্রতিযোগিতার অংশ হিসেবে দেশের একটি শহরে বিরাট আয়োজন ছিল। প্রচারণাসমৃদ্ধ জাঁকালো সে অনুষ্ঠানে স্কুলপর্যায়ের ছাত্রছাত্রীরা অংশ নেয়। বিষয় যদিও ছিল ভাষা, তবুও শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ তাদের কৌতূহল থেকে অন্য প্রসঙ্গেও প্রশ্ন করে।
এমনই একটি প্রশ্ন ছিল, ভারত আমাদের বাংলাদেশ তিন দিক ঘিরে রেখেছে, তবুও আমরা ’৪৭ সালে ভারতের অংশ না হয়ে সাবেক পাকিস্তানের অংশ হয়েছিলাম কেন?’ আলোচ্য পত্রিকায় এই প্রশ্নের সাথে উত্তরটাও দেয়া হয়েছে। ওই প্রতিযোগিতার সাথে সংশ্লিষ্ট একজন শিক্ষাবিদ ওই শিক্ষার্থীর প্রশ্নটির জবাব দিয়েছিলেন, ‘ঔপনিবেশিক শক্তির শাসনের কুফল এটা।’ এর থেকে প্রতীয়মান হয়, ১৯৪৭ সালে বর্তমান বাংলাদেশ যে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, তা একটা বিরাট ভুল এবং এ জন্য ব্রিটিশ সামাজ্যবাদী শাসকরাই দায়ী। অথচ এই জবাবদাতা বুদ্ধিজীবী শ্রেণীভুক্ত এবং তিনি জবাবটা দিতে চেয়েছেন বুদ্ধি করে। বাস্তবে তিনি প্রশ্নকারী স্কুলশিক্ষার্থীর মনে আরো বড় প্রশ্ন জাগিয়ে নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিয়েছেন। কারণ তার কথিত জবাবে কোনো স্পষ্ট ধারণা তো মেলেইনি, বরং বিভ্রান্তি জন্ম নেবে।
এই শিক্ষক যে ইতিহাসের বাস্তবতা থেকে নজর সরিয়ে তার রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ ও বদ্ধমূল ভ্রান্ত বিশ্বাস থেকে উত্তর দিয়েছেন, তা তথ্যাভিজ্ঞ যে কারো কাছে স্পষ্ট। নতুবা বলতে হয়, তিনি ব্রিটিশ শাসনের অবসান এবং এই উপমহাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞ। আর নিজের অজ্ঞতা পুষে রেখে কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের ইতিহাস জ্ঞানদানের নামে বিভ্রান্ত করা বিরাট অন্যায়। উপরিউক্ত জবাবটি পড়ে এটাও মনে হতে পারে, উত্তরদাতা জেনেশুনে সত্যকে গোপন করছেন এবং নিদেনপক্ষে অর্ধসত্য বলছেন, বাকি অর্ধেক লুকিয়ে রেখে। একজন সুশিক্ষিত ব্যক্তি হিসেবে তার জানা থাকার কথা, Half truth is more dangerous than lie (অর্ধসত্য মিথ্যার চেয়ে ভয়ঙ্কর)।
১৯০ বছরের ঔপনিবেশিক অপশাসন ও শোষণের রাজত্বের অবসান ঘটেছিল ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে। এর অব্যবহিত আগে আজকের বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঐতিহাসিক রায়ে জানিয়ে দিয়েছিল, তারা অখণ্ড ভারত নয়, পৃথক নতুন রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হতে চায়। সে রাষ্ট্রটিই ’৪৭-এর ১৪ আগস্ট ‘পাকিস্তান’ নামে আত্মপ্রকাশ করে। কেন বাংলাদেশের মানুষ নয়াদিল্লিকেন্দ্রিক বিশাল ভারতের মধ্যে বিলীন হতে চাননি এবং কেনই বা ‘ওপার বাংলা’র বাঙালিরা আমাদের সাথে না এসে দিল্লির অধীনতা সাগ্রহে মেনে নিলেন, সে তিক্ত ইতিহাস আজ মিষ্টি কথামালায় ভুলিয়ে দেয়ার অদ্ভুত প্রয়াস চলছে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের আগে শত শত বছরের ইতিহাসে উপমহাদেশের হিন্দু-মুসলমান শান্তি ও সম্প্রীতির মধ্যে সহাবস্থান করে এসেছেন। এর কারণ, তখনকার মুসলিম শাসকেরা তেমন ধর্মভীরু না হলেও ইসলামের প্রভাবে তারা ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। কুচক্রী ব্রিটিশ বেনিয়ারা তাদের শাসন বজায় রাখতে ভারতীয় জনগণের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিভাজন সৃষ্টি করেছিল এবং উসকে দিয়েছিল। এই বিভেদ বারবার ভয়াবহ দাঙ্গাহাঙ্গামার জন্মও দিয়েছে। এ সব কিছু অনস্বীকার্য সত্য। এর পাশাপাশি, ইতিহাস পুরো তুলে ধরাই সততা ও ন্যায়নীতির দাবি।
ব্রিটিশ শাসনের সূচনা থেকেই তাদের ঘনিষ্ঠ হয়ে সাম্রাজ্যবাদী শোষণ ও কর্তৃত্ব কায়েমে বিশ্বস্ত তাঁবেদার রূপে দেখা গেছে বর্ণহিন্দুদের একটা বড় অংশকে। এই স্বদেশী সুযোগসন্ধানীরা বিদেশীদের লুণ্ঠন-নির্যাতনের দোসর হয়ে নিজেরাও বিত্তবেসাতে ফুলেফেঁপে উঠেছিল। অন্য দিকে মুসলমানদের অবস্থান ছিল অচ্ছুৎ ও দলিত সম্প্রদায়ের চেয়েও অনেক দিক দিয়ে খারাপ। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, শিক্ষাÑ সব ক্ষেত্রেই মুসলিম জনগোষ্ঠী পুরো ব্রিটিশ আমলে ছিল শোষিত, বঞ্চিত, পশ্চাৎপদ ও উপেক্ষিত। তাদের আরো ট্র্যাজেডি ছিল, প্রতিবেশী সম্প্রদায় বরাবর মুসলমানদের ন্যায্য স্বার্থ ও সামষ্টিক উন্নতির বিরোধিতা করেছে যথাসাধ্য। এই দীর্ঘ পটভূমিতে মুসলমানেরা ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহোর প্রস্তাবের মাধ্যমে নিজেদের ভিন্ন স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রত্যয় ঘোষণা করেছিল। শতবর্ষের নিষ্করুণ অভিজ্ঞতা তাদের শিখিয়েছে, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও আত্মবিকাশের জন্য পৃথক রাষ্ট্রসত্তার বিকল্প নেই। বাঙালি জননেতা ‘শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন করে স্মরণীয় হয়ে আছেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সে প্রস্তাব বিরাট প্রেরণা জুগিয়েছিল। ২৫ মার্চের কালরাতে শহীদ লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন স্বাধীনতার লক্ষ্যে ’৭০-৭১ সালে যে সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তার নাম ‘লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়ন কমিটি’। যা হোক, বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যে সম্প্রদায়ভুক্ত, তারা তো উপমহাদেশ ভাগ করতে চায়নি। ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজা ধরে গান্ধী, নেহরু, প্যাটেলের কংগ্রেস যে সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তির পরিচয় দিয়েছিল, মূলত সেটাই ভারত বিভক্তির কারণ। ’৪৭ সালে মুসলিম লীগ নেতা সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিম সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। মুসলিম লীগের শীর্ষ নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এতে গ্রিন সিগন্যাল দিলেও কংগ্রেসের অত্যন্ত শক্তিশালী নেহরু-প্যাটেল জুটি রেড সিগন্যাল দিয়েছিলেন। আর গান্ধীও একপর্যায়ে এই দুই নেতার সাথে একমত হন। ফলে বাঙালিদের কলকাতাকেন্দ্রিক রাষ্ট্র কায়েমের সে প্রচেষ্টা বানচাল হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তার এক লেখায় ঠিক এ কথাই তুলে ধরেছেন। গান্ধী-নেহরু-প্যাটেল বৈরিতা না করলে হয়তো ’৪৭ সালেই বৃহত্তর বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা পেত এবং ’৭১ সালে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের প্রয়োজন হতো না। অন্য দিকে এটাও উপলব্ধি করতে হয় দেশপ্রেমিকদেরÑ ’৪৭ সালে ভারতভুক্তির পরিণামে আজ আর আমরা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কল্পনাও করতে পারতাম না। বাংলা রাষ্ট্রভাষা হওয়া দূরের কথা, বাঙালিত্ব বিলীন হওয়ার উপক্রম হতো হিন্দির হামলায়। আজকের কলকাতাসহ পশ্চিমবঙ্গের করুণ অবস্থার দিকে তাকালেই বোঝা যায়, ৬৫ বছর আগে ভারতে যোগ না দিয়ে এ দেশের জনগণ মোটেও ভুল করেনি। সেই মহা ভুল করা হলে বাংলাদেশ হতো ‘দেশ’ নয়; ‘প্রদেশ’; আমরা ‘প্রধান’ নয়, ‘মুখ্য মন্ত্রী’ পেতাম। আমাদের আলাদা পতাকা উড়ত না পত পত করে। বহির্বিশ্বে বাঙালি কিংবা বাংলাদেশী জাতীয়তা বা ন্যাশনালিটির পরিচয় দেয়ার অধিকার তখন আর পেতাম না আমরা। 
তিন দিক ঘেরা ভারতের বদলে হাজার মাইল দূরের পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত আমরা কেন হয়েছিলামÑ এমন একটি অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন মাথায় এসেছে খুব অল্প বয়সী একজন স্কুলশিক্ষার্থীর। অথচ প্রাপ্তবয়স্ক, ডিগ্রিধারী এবং সমাজের কোনো না কোনো ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল, এমন ব্যক্তিদের ক’জন আজ ইতিহাসের সে ক্রান্তিকাল নিয়ে ভাবছেন? তাদের মনে প্রশ্নটি জাগলে আজকের বাংলাদেশের রাজনীতি, প্রশাসন, অর্থনীতি, সমাজ, সংস্কৃতির নতুন নতুন ও বর্ধমান সঙ্কটের কারণ ও চরিত্র অনেকটা উপলব্ধি করা যেত। তবে যারা এমন একটি প্রশ্নের জবাব দেন পূর্বোক্ত অনুষ্ঠানের বক্তার মতো অতি ‘সরলীকরণ’ করে, তাদের এই হেঁয়ালির জটিল কোনো লক্ষ্য আছে ধরে নিতে হয়। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন