দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

এটাও মনে রাখতে হবে যে, আমাদের প্রতি যারা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে চায়, তাদের নিজস্ব কিছু লক্ষ্য থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু এ বাড়িয়ে দেওয়া হাত আমাদের সমৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রেও অপরিহার্য
ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে বাংলাদেশের জন্য নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে_ এমন আলোচনা এখন আর কেবল বিশেষজ্ঞ মহলে সীমাবদ্ধ নেই। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে জাপানি উপ-প্রধানমন্ত্রী কাতসুয়া ওকাদা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন এবং ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও বর্তমান অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জির ঢাকা সফরের পর বিষয়টি নিয়ে সাধারণ পর্যায়েও আলোচনা হচ্ছে। অনেকেই প্রশ্ন করছেন, হঠাৎ বাংলাদেশ কেন এত গুরুত্ব পেতে শুরু করেছে? তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা এবং আরও কিছু ইস্যুতে সরকার ও বিরোধীপক্ষ মুখোমুখি_ এ রকম এক প্রেক্ষাপটে সংঘটিত সফরকালে তিন নেতাই সংবাদ সম্মেলনে এসব বিষয়ে খোলামেলাভাবে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তারা আলোচনার মাধ্যমে মতপার্থক্য কমিয়ে আনার কথা বলেছেন। তাগিদ দিয়েছেন সংলাপের। কিন্তু বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতির বিষয়ে অভিজ্ঞ মহল এসব উচ্চ পর্যায়ের সফরকে কেবল অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে 'মধ্যস্থতার চেষ্টা' হিসেবে সীমিত করে দেখতে রাজি হবেন না।
বিশ্ব অর্থনীতিতে বিশেষ করে ধনবান দেশগুলোতে বিরাজমান মন্দা যথেষ্ট প্রলম্বিত হয়ে চলেছে। এ থেকে উত্তরণের প্রক্রিয়ায় এশিয়ার জন্য এখন নতুন ভূমিকা নির্ধারিত হয়েছে। অর্থাৎ তাদের গুরুত্ব বেড়েছে। বিশেষ করে চীন ও ভারতের উত্থানকে তারা বিবেচনায় নিচ্ছে। একই সঙ্গে এ দুই বড় অর্থনৈতিক শক্তির বাইরেও নতুন প্রবৃদ্ধি কেন্দ্রের অনুসন্ধান চলছে। পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো তো আছেই, পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়াও বিবেচনায় আসছে। বাংলাদেশ তার ভৌগোলিক অবস্থান, বিদ্যমান প্রাকৃতিক সম্পদ এবং ব্যবহারযোগ্য শ্রমশক্তির লভ্যতা বিবেচনায় তাদের কাছে বিশেষ আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে বাংলাদেশে বিনিয়োগের বিষয়টি যে বিবেচনা পাচ্ছে_ তার কারণ সহজেই বোধগম্য।
আমাদের নিকট প্রতিবেশী মিয়ানমারের সাম্প্র্রতিক পরিবর্তনও তারা যথেষ্ট আমলে নিচ্ছে। পূর্ব এশিয়া-দক্ষিণ এশিয়া, ভারত-চীন_ এসব দেশের মধ্যে ভৌগোলিক যোগসূত্রের জন্য এখন নতুন 'উন্নয়ন' করিডোর প্রয়োজন। মিয়ানমার-বাংলাদেশ যুক্ত না হলে তা পূর্ণাঙ্গ রূপ পাবে না। মিয়ানমারের গণতন্ত্রের পথে চলা এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় রাষ্ট্রগুলোর সংস্থা আসিয়ানে তার আসন্ন নেতৃত্ব লাভের প্রেক্ষাপটে যে নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে, তাতে বাংলাদেশের গুরুত্ব বেড়েছে।
প্রভাবশালী বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে এখন স্বীকৃত যে, আমাদের এ অঞ্চলে ভারত হচ্ছে 'নায়ক', পাকিস্তান ও আফগানিস্তান 'খলনায়ক', শ্রীলংকা-নেপাল-ভুটান নাটকের 'পার্শ্বচরিত্র'। বাংলাদেশকে এ প্রেক্ষাপটে এখন বিকল্প নেতা হিসেবে ভাবা হচ্ছে। কৌশলগত দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের গুরুত্ব নতুনভাবে উপলব্ধি করায় তাই সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
গ্যাস এবং কয়লা সম্পদের বাইরে বাংলাদেশের নতুন জ্বালানি সম্ভাবনাও আন্তর্জাতিক বিনিয়োগের নতুন ক্ষেত্র হিসেবে দেশটিকে চিহ্নিত করছে। মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে বাংলাদেশ ভূখণ্ডের প্রায় সমপরিমাণ সমুদ্র এলাকা প্রাপ্তিকে তারা বিবেচনায় নিচ্ছে। এ রায় ভারতের সঙ্গে আন্তর্জাতিক মামলায় বাংলাদেশের জন্য আরও সমুদ্র এলাকা এনে দেওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে।
এর বাইরেও আমাদের প্রতি আকর্ষণের কারণ রয়েছে। বাংলাদেশে দুই যুগ ধরে গণতান্ত্রিক শাসন চলছে। এ সময়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটেছে ধারাবাহিকভাবে। জঙ্গিবাদের মোকাবেলাতে রয়েছে সাফল্য; বাংলাদেশের ভূখণ্ড এখন অন্য কোনো দেশের চরমপন্থিদের জন্যও নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে বিবেচিত হয় না। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে সফল অংশগ্রহণ বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক মর্যাদা ও গুরুত্ব বাড়িয়ে দিচ্ছে। এই অঞ্চল ও বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় বাংলাদেশ ভারতের পর 'দ্বিতীয় প্রতিরক্ষা বূ্যহ' হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
এসব কারণে দ্বিতীয় না হলেও অন্তত তৃতীয় প্রজন্মের প্রবৃদ্ধির বাহক হিসেবে বাংলাদেশকে বিশ্ব সম্প্রদায় গণ্য করতে শুরু করেছে। জনসংখ্যার বিচারে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে সপ্তম। এখানে মাথাপিছু আয় অল্প বাড়লেই জিডিপির আয়তনে তার উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়ে। বাংলাদেশ বিশ্বের তৃতীয় মুসলিমপ্রধান দেশ, যেখানে গণতন্ত্র কার্যকর রয়েছে। সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্য বা শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা খাতে উল্লেখযোগ্য অর্জনও তাদের নজর এড়ায় না। বাংলাদেশ তাদের কাছে সামাজিক উদ্ভাবনেরও দেশ। গ্রামীণ ব্যাংক ও ব্র্যাকের কর্মকাণ্ডকে তারা ইতিবাচকভাবে মূল্যায়ন করছে এবং স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল অনেক দেশের জন্য তা মডেল হিসেবে বিবেচিত হয়।
সব মিলিয়ে আমরা বলতে পারি, আর্থ-সামাজিক এবং কৌশলগত কারণে বাংলাদেশের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আমরা একে অর্থনৈতিক উন্নয়নে কীভাবে কাজে লাগাব_ সেটাই হচ্ছে চ্যালেঞ্জ। এ জন্য প্রধান করণীয় হচ্ছে, গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করা। শুধু নিয়মিত নির্বাচন অনুষ্ঠান নয়, সমাজের সর্বস্তরে গণতান্ত্রিক চর্চা থাকা চাই। প্রতিবাদের অধিকার ও বিচার পাওয়ার অধিকারসহ সাধারণ মানবাধিকার রক্ষায় সচেতন থাকতে হবে। যেহেতু আলোচনার কেন্দ্রে অর্থনীতি, তাই শ্রম অধিকার শীর্ষ এজেন্ডায় থাকতে হবে। অবকাঠামোগত উন্নয়নও মনোযোগ দাবি করে। দুর্নীতি দমনকেও রাখতে হবে মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে।
বাংলাদেশের সঙ্গে যারা দীর্ঘমেয়াদে নতুন সম্পর্ক গড়ে তুলতে চায়, তারা নিশ্চয়তা খুঁজবে_ এটাই স্বাভাবিক। সরকার বদল হতে পারে, কিন্তু দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় সম্পর্কে তারা ধারাবাহিকতা প্রত্যাশা করবে। এমন ব্যবস্থা চাইবে, যা হবে প্রাতিষ্ঠানিক এবং অবশ্যই টেকসই।
বাংলাদেশের নেতৃত্বকে এটাও মনে রাখতে হবে যে, এমন সুযোগ সর্বদা সব দেশের জন্য আসে না। আন্তর্জাতিক ও জাতীয় ঘটনাপরম্পরায় অনেকটা আকস্মিকভাবেই সুযোগ তৈরি হয়। কিন্তু সৃষ্ট সুযোগ কাজে লাগানো না গেলে সেটা অন্যত্র চলে যেতেও সময় লাগে না। আমাদের এ সুযোগ অবশ্যই দক্ষতার সঙ্গে কাজে লাগাতে হবে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশ শ্রীলংকা এমন সুযোগ একবার হারিয়েছে। সেখানে গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটেছে, কিন্তু তামিল জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার দারুণভাবে লঙ্ঘিত হওয়ার বিষয়টি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মেনে নিতে পারেনি।
জাতীয় নেতৃত্বকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, রাজনৈতিক সংকট এবং বিবিধ আশু সমস্যাদিতেই যেন সব মনোযোগ নিঃশেষ হয়ে না যায়। তাদের অবশ্যই মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদের সম্ভাবনাকে বিবেচনায় রেখে কাজ করতে হবে। এ জন্য তাদের সামনে চ্যালেঞ্জ হচ্ছে রাজনৈতিক অস্থিরতার অবসান ঘটানো, অবকাঠামোগত উন্নতি সাধনে পদক্ষেপ গ্রহণ, মানবাধিকার সংরক্ষণ এবং দুর্নীতি মোকাবেলায় আরও পদক্ষেপ গ্রহণ। নতুন সম্ভাবনার প্রেক্ষাপটে এসব বিষয় আর দলীয় ইস্যু হিসেবে সীমাবদ্ধ নেই। বরং এগুলো হচ্ছে জাতীয় ঐক্যের নূ্যনতম ইস্যু। বিশ্ব সম্প্রদায় বাংলাদেশকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব প্রদান করতে চায় এবং এ জন্য তারা আগ্রহভরে এগিয়ে এসেছে। আমরা কি এ সুযোগ হেলায় হারিয়ে ফেলব, নাকি তাকে কাজে লাগিয়ে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক পরিমণ্ডলে দেশের অবস্থান সুদৃঢ় করায় যত্নবান হবো? জাতীয় নেতৃত্বকে এসব বিষয়ে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে।
এটাও মনে রাখতে হবে যে, আমাদের প্রতি যারা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে চায়, তাদের নিজস্ব কিছু লক্ষ্য থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু এ বাড়িয়ে দেওয়া হাত আমাদের সমৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রেও অপরিহার্য। বিশ্বায়নের যুগে বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে জাতীয় অর্থনীতির ভবিষ্যৎ সমকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে। তাকে কাজে লাগাতে সম্ভাব্য সবকিছু করা হবে_ নেতারা নিশ্চয়ই জনগণকে এ বার্তা দেবেন। অভ্যন্তরীণ ইস্যুগুলোতে যতই মতপার্থক্য থাকুক, দেশের সার্বিক অগ্রগতির চ্যালেঞ্জগুলো অবশ্যই তার আওতামুক্ত থাকা চাই। আমাদের বিশ্বায়নের সঙ্গে থাকতে হবে। আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক সম্ভানাকেও উপেক্ষা করা চলবে না।
কেউ প্রশ্ন করতেই পারেন যে, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সম্ভাবনার মুলা ঝুলিয়ে বাংলাদেশকে কি বিশ্ব সম্প্রদায়ের ক্রীড়নকে পরিণত করার চেষ্টা চলছে? এ প্রশ্নের উত্তরে বলব, বিশ্ব রাজনীতি বা অর্থনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান এর আগে কখনও এত গুরুত্ববহ হয়নি। এখন ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক এবং অভ্যন্তরীণ কিছু ইতিবাচক কর্মকাণ্ডের সুবাদে নতুন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এটা অবশ্যই সবাই স্বীকার করবেন যে, নজরে না পড়ার চেয়ে নজরে পড়া অনেক ভালো। এর সর্বোত্তম ব্যবহারের দায়ভার একান্তই আমাদের। এ থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখার অর্থ নিজেদের সর্বোচ্চ স্বার্থকেই গৌণ করে দেখা। অপরের এজেন্ডার চেয়ে আমাদের উন্নয়নের দাবিও এ ক্ষেত্রে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন