শুক্রবার, ৪ মে, ২০১২

র‌্যাব কি এখন রাজনীতির হাতিয়ার?

মশিউল আলম | তারিখ: ০৫-০৫-২০১২


‘পরবর্তী নির্বাচনে যদি আওয়ামী লীগ জয়ী হতে পারে, তাহলে র‌্যাবকে সহজেই ভেঙে দেওয়া যাবে...।’ ২০০৫ সালের ২১ ডিসেম্বর এই কথাগুলো লিখেছিলেন ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের সে সময়ের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স জুডিথ শামাস। তখন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের চতুর্থ বছর শেষ হয়েছে, পরের ১২ মাসের মধ্যে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিক ঢাকা থেকে ওয়াশিংটনকে আশ্বস্ত করতে চাইছেন, একের পর এক বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে এক বছরের মধ্যেই ‘নটোরিয়াস’ হয়ে ওঠা বাহিনী র‌্যাব আর বেশি দিন থাকবে না, যদি আওয়ামী লীগ পরবর্তী সরকার গঠন করতে পারে।
আওয়ামী লীগের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের অমন ভরসার কী কারণ ছিল? তারা কেন আশা করেছিল যে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে র‌্যাবকে বিলুপ্ত করবে? এটা বোঝার চেষ্টা করতে গিয়ে দেখলাম, ঢাকার মার্কিন দূতাবাস থেকে ওয়াশিংটনে পাঠানো একাধিক গোপন তারবার্তায় বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগের নেতারা তাঁদের কাছে নালিশ করেছেন, বিএনপি সরকারের গঠন করা এই বাহিনীটি আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের পিছু লেগেছে, তারা তাদের ‘ক্রসফায়ার’-এ মারছে। ২০০৫ সালের ১ জুন পাঠানো এক গোপন তারবার্তায় ঢাকার মার্কিন দূতাবাস ওয়াশিংটনকে জানিয়েছিল, র‌্যাবের সদস্যরা ঢাকার রামপুরা এলাকায় আবুল কালাম আজাদ সুমন নামে যুবলীগের এক কর্মীকে ‘ক্রসফায়ার’-এ হত্যা করেছে।
‘ক্রসফায়ার’-এর প্রায় প্রত্যেকটি ঘটনাই ঢাকার মার্কিন দূতাবাস গোপনে অনুসরণ করার চেষ্টা করত। যারা ক্রসফায়ারে মারা পড়ছে, তাদের মধ্যে কে সত্যিকারের ক্রিমিনাল, কে রাজনৈতিক কর্মী, কে সাধারণ নিরীহ মানুষ, কিন্তু র‌্যাবের ভুলের শিকার—ঢাকার মার্কিন কূটনীতিকেরা এসব জানার চেষ্টা করতেন তাঁদের নিজস্ব উপায়ে। কারণ, সরকারের কাছে জানতে চাইলে তাঁদের একই রকমের কাহিনি শোনানো হতো; র‌্যাবের সদস্যরা আত্মরক্ষার্থে গুলি করেছেন—এ রকম ছকবাঁধা ব্যাখ্যা (টেম্পলেট এক্সপ্লেনেশান) দেওয়া হতো।
র‌্যাবের সদস্যদের হাতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র সরকার এতটাই বিরক্ত হয়ে উঠেছিল যে জুডিথ শামাস সে সময়ের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের সঙ্গে এক বৈঠকে তাঁকে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছিলেন, র‌্যাবের যে প্রতিনিধিদল ওয়াশিংটন সফরে যেতে চায় তাদের সঙ্গে মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগ কোনো বৈঠকে বসবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ২০০৪ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত, র‌্যাবের প্রথম তিন বছর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডগুলোর কারণে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের চক্ষুশূল ছিল র‌্যাব। ২০০৫ সাল থেকে র‌্যাব ও বাংলাদেশ সরকার যুক্তরাষ্ট্রকে অনুরোধ করা শুরু করে র‌্যাবের সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে তাতে কোনো সাড়াই দেয়নি; বরং মুখের ওপরেই বলে দিয়েছে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনমূলক কর্মকাণ্ড বন্ধ না করলে যুক্তরাষ্ট্র র‌্যাবের কোনো সদস্যের জন্য একটি পয়সাও খরচ করতে পারবে না। এমনকি, বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে যাঁরা র‌্যাবে দায়িত্ব পালন করবেন, তাঁরাও যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অর্থায়নে পরিচালিত প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণের সুযোগ হারাবেন।
সেই র‌্যাবের সদস্যদের এখন প্রশিক্ষণ দেয় যুক্তরাষ্ট্র। আজ থেকে বছর চারেক আগেই তারা এটা শুরু করেছে। কিন্তু র‌্যাবের বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ এখনো অব্যাহত। বরং ‘ক্রসফায়ার’-এর চেয়েও ভয়াবহ, বলা চলে, এক অভিনব পন্থা আবিষ্কার করেছে র‌্যাব, যদি তাদের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ সত্য হয়ে থাকে যে তারা লোকজনকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে, তারপর ‘গুম’ করে দিচ্ছে। ‘ক্রসফায়ার’-এর একটা ছকবাঁধা গল্প ছিল। ‘গুম’-এর কোনো গল্প নেই। যাদের বিরুদ্ধে ‘গুম’ করার অভিযোগ তোলা হচ্ছে, তাদের কোনো গল্প সাজাতে হচ্ছে না, যেমনটি করতে হতো ‘ক্রসফায়ার’, ‘এনকাউন্টার’ ও ‘বন্দুকযুদ্ধ’-এর ক্ষেত্রে। 
তো, যে র‌্যাব সেই র‌্যাবই যখন আছে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটানোর অভিযোগ যার পিঠে স্থায়ী ছাপ্পড় হয়ে উঠেছে, সেই র‌্যাব বিলুপ্ত করতে বাংলাদেশের সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করার ভাবনা থেকে ক্রমশ সরে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার কী করে র‌্যাবের সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে, সেসব ব্যাখ্যা-বিবরণ দিতে হলে পৃথক একটি নিবন্ধ লেখার প্রয়োজন হবে। এখন আপাতত এ কথা বলা যায়, র‌্যাবের রাজনীতিকরণ ঘটতে পারে, এই বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের হাতিয়ারে পরিণত করা হতে পারে—যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এমন আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল র‌্যাব গঠনের ছয় মাসের মধ্যেই। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সেই আদি আশঙ্কা এখন এক বাস্তব সংকট সৃষ্টি করেছে।
২০০৪ সালে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া র‌্যাব গঠন করেছিলেন দুর্দমনীয় সন্ত্রাসী-অপরাধীদের দমন করার ঘোষিত উদ্দেশ্য নিয়ে। সে সময় তাঁর সরকার বলেছিল, র‌্যাবকে কখনোই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের হাতিয়ার করা হবে না। আজ ২০১২ সালে এসে প্রধান বিরোধী দলের নেতা হিসেবে বেগম খালেদা জিয়া অভিযোগ করছেন, তাঁর দলের সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলীকে র‌্যাবের লোকেরা তুলে নিয়ে গেছেন। ইলিয়াস আলীর ‘নিখোঁজ’ হওয়াকে কেন্দ্র করেই বাংলাদেশের রাজনীতি দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে ঘুরপাক খাচ্ছে কানাওলায় পাওয়া দিশাহারা মানুষের মতো। তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতে বিএনপি ইতিমধ্যে দুই দফায় পাঁচ দিন হরতাল পালন করেছে। তাতে প্রাণ হারিয়েছেন পাঁচজন মানুষ। এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষাগুলোয় অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের ক্ষতি-হতাশা, অর্থনীতির ক্ষয়ক্ষতি আর জনভোগান্তির কথা বলাই বাহুল্য।
হরতালকে কেন্দ্র করে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা, গ্রেপ্তার-অভিযান, নেতারা আগাম জামিন চাইতে আদালতে যাবেন বলে আদালত এলাকাকে ‘পুলিশি রাজ্যে’ পরিণত করা, আর এসবের বিপরীতে বিএনপির আরও কঠোর কঠোর হুমকি উচ্চারণ—এসবের সূচনাবিন্দু হিসেবে ইলিয়াস আলীর ‘নিখোঁজ’ হয়ে যাওয়ার মুহূর্তটিতে ফিরে যাই। খালেদা জিয়া বললেন, ইলিয়াসকে র‌্যাবের লোকেরা তুলে নিয়ে গেছেন। কিন্তু তাঁর এই অভিযোগের ভিত্তি কী? প্রমাণ কোথায় যে সত্যিই র‌্যাবের সদস্যরা ওই কাজ করেছেন? র‌্যাব তো তাৎক্ষণিকভাবে বলে দিয়েছে, তারা এটা করেনি, তারা ইলিয়াস আলীর অবস্থান ও অবস্থা সম্পর্কে কিছুই জানে না। না, খালেদা জিয়া বা বিএনপির পক্ষ থেকে প্রমাণ হাজির করার প্রয়োজন নেই, হয়তো সেই সামর্থ্যও তাদের নেই। তারা ফরিয়াদি, অপরাধের শিকার পক্ষ, ভিকটিম। ভিকটিম অভিযোগ করে, অভিযোগের সত্যতার প্রমাণ তার হাতে থাকতেও পারে, না-ও থাকতে পারে। বিএনপি বা খালেদা জিয়ার হাতে প্রমাণ নেই যে ইলিয়াসকে র‌্যাবের লোকেরাই তুলে নিয়ে গেছেন। কিন্তু এই অভিযোগ মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিতে হলে র‌্যাব বা সরকারকে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে হবে যে ‘র‌্যাবের লোকেরা’ এই কাজ করেননি। 
খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হিসেবে র‌্যাবকে দেখেছেন, এ কথা বললে কম বলা হবে। তিনিই র‌্যাব সৃষ্টি করেছেন; আড়াই বছরের বেশি সময় ধরে র‌্যাব কাজ করেছে তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বে পরিচালিত সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে। সুতরাং র‌্যাব কী করতে পারে, বা সরকারের পক্ষে র‌্যাবের সদস্যদের দিয়ে কী করানো সম্ভব, তা তিনি বিলক্ষণ জানেন। তিনি যখন অভিযোগ করছেন, তাঁর দলের একজন বড় নেতাকে র‌্যাবের সদস্যরা তুলে নিয়ে গেছেন, তখন এই প্রশ্ন গুরুতরভাবে উঠে আসে: র‌্যাব কি ইতিমধ্যে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে?
২০০৫ সালে র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক চৌধুরী ফজলুল বারীকে ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তারা জিজ্ঞেস করেছিলেন, র‌্যাবকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের আশঙ্কা আছে কি না। বারী তখন জোর দিয়ে বলেছিলেন, র‌্যাবের কোনো সদস্য রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কোনো নির্দেশ পালন করবেন না; পলিটিক্যাল কিলিং বা রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড তাঁরা ঘটাবেন না। অর্থাৎ সরকারের নীতিনির্ধারকেরা যদি তাঁদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করার উদ্দেশ্যে র‌্যাবের সদস্যদের প্রতি কোনো নির্দেশ দেন, তাহলে র‌্যাবের সদস্যরা সেই নির্দেশ অমান্য করবেন—চৌধুরী ফজলুল বারী এমন কথাই বোঝাতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত সংস্থা র‌্যাব, যতই এলিট হোক না কেন, সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছার বাইরে থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কি কাজ করতে পারে? যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিকদের অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ উল্লেখ করা যাক: ‘সরকার নিজের মর্জিমাফিক ক্রসফায়ার চালাতে ও বন্ধ করতে পারে। ক্রসফায়ারে হত্যাকাণ্ডের ইস্যুতে বাংলাদেশ সরকারের ওপর আমাদের কঠোর চাপ এবং এ বিষয়ে লেহি আইনের বিরূপ ফলাফলের ব্যাপারে সতর্ক করে দেওয়া হলে গত মার্চ ও এপ্রিল মাসে ক্রসফায়ারে মৃত্যুর সংখ্যা নাটকীয়ভাবে হ্রাস পায়। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বাবরের সাম্প্রতিক যুক্তরাষ্ট্র সফরের কিছু আগে এবং সফর চলাকালীন সময়ও ক্রসফায়ার হত্যাকাণ্ডে স্পষ্টতই ভাটা লক্ষ করা গেছে।’
অর্থাৎ সরকারই সর্বেসর্বা; র‌্যাব সরকারের হাতে এক ক্ষিপ্র ও ক্ষুরধার হাতিয়ার। এই হাতিয়ারের রাজনীতিকরণ ঘটেছে কি না, এ জিজ্ঞাসার জবাব কোনো সরকারই এ দেশের জনগণকে দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করে না। আমেরিকা, ইউরোপসহ বিদেশি ‘দাতা’দের দিক থেকে যখন চাপ বেড়েছে, তখন র‌্যাবের ক্রসফায়ার কমেছে, আর যখন তাদের চাপ কমেছে, তখন র‌্যাবের ক্রসফায়ার বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন সরকারি সফরে আজ বিকেলে ঢাকা আসছেন। সরকারের বাইরে তিনি বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার সঙ্গেও বৈঠকে বসবেন। সেখানে ইলিয়াস আলীর ‘নিখোঁজ’ হওয়ার সূত্র ধরে র‌্যাবের বিরুদ্ধে ‘গুম’ করার অভিযোগও নিশ্চয়ই উঠবে।
তারপর কিছুদিন কি ‘গুম’ হওয়ায় বিরতি চলবে? অন্তত রাজনৈতিক ‘গুম’?
 মশিউল আলম: সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন