শুক্রবার, ৪ মে, ২০১২

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরে বাংলাদেশের সম্ভাবনা



আহমদ আশিকুল হামিদ : আজ ৫ মে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন বাংলাদেশ সফরে আসবেন। সফর মাত্র ২৫ ঘণ্টার হলেও হিলারি ক্লিনটনের এই সফরকে ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক জল্পনা-কল্পনা চলছে। এর কারণ শুধু ঢাকা-ওয়াশিংটনের নয়, হিলারি-হাসিনার সম্পর্কও। এ ব্যাপারে নিশ্চয়ই বিস্তারিত জানাতে হবে না। গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে কেন্দ্র  করে ঢাকা ও ওয়াশিংটনের সম্পর্কে যে তিক্ততার সৃষ্টি হয়েছিল হিলারি ক্লিনটন ছিলেন তার কেন্দ্রবিন্দুতে। ড. ইউনূসের বিষয়টিকে তিনি ব্যক্তিগতভাবে নিয়েছিলেন, এর সঙ্গে তার মানসম্মানও জড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘বাগে' আনতে এবং ড. ইউনূসকে তার পদে পুনর্বহাল করতে পারেননি হিলারি। সে সময় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে হিলারির একটি টেলিফোন সংলাপের কথা ফাঁস হয়ে গিয়েছিল। এটা ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসের ঘটনা। টেলিফোনের এই কথোপকথনে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সরকারের অভিযান সম্পর্কে হিলারি ক্লিনটন শেখ হাসিনাকে কঠোর কিছু কথা শুনিয়েছিলেন। জবাবে ড. ইউনূসের প্রসঙ্গকে প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়' হিসেবে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন। ঠিক তখনই হিলারি একে একে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, কিভাবে ভারতের উদ্যোগে পূর্ব-নির্ধারিত একটি নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় আনা হয়েছে এবং ভারতের অনুরোধে যুক্তরাষ্ট্র কিভাবে ওই নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বলে সমর্থন জানিয়েছে। নির্বাচনমুখী ঘটনাপ্রবাহের প্রধান নায়ক জেনারেল মইন উ আহমদ যে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন এবং তিনি (হিলারি) যে মইন ও তার কর্মকান্ড সম্পর্কে শেখ হাসিনার চাইতে অনেক বেশি জানেন সে কথাও যথেষ্ট কঠোরতার সঙ্গেই বলেছিলেন হিলারি ক্লিনটন। তার কথার মধ্যে শেখ হাসিনাকে ধমক দেয়ার এবং সতর্ক করার উদ্দেশ গোপন থাকেনি।
শেখ হাসিনার সঙ্গে হিলারি ক্লিনটনের সে কথোপকথনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রসঙ্গও এসেছিল। প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ দূত হিসেবে বাংলাদেশ সফর শেষে স্টিফেন জে র‌্যাপ পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের কাছে যে রিপোর্ট পেশ করেছিলেন সে রিপোর্ট মার্কিন সরকারের জন্য মোটেও সস্তোষজনক হয়নি। এজন্যই রিপোর্ট পাওয়ার পর পর হিলারি ক্লিনটন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে টেলিফোন করেছিলেন। টেলিফোনে হিলারি ও শেখ হাসিনার কথোপকথনে মার্কিন মনোভাবের পাশাপাশি চমকে দেয়ার মতো কিছু কথাও জানা গিয়েছিল। যেমন হিলারি ক্লিনটন বলেছিলেন, তারা স্টিফেন জে র‌্যাপকে ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন ‘ভারতের অনুরোধে'। দ্বিতীয় তথ্যটি ছিল অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ এবং গুরুতর। হিলারি ক্লিনটন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে উপর্যুপরি সংশয় প্রকাশ করায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে বলেছিলেন, তিনি নিশ্চিত, এ ব্যাপারে ওয়াশিংটনে নিযুক্ত ‘ভারতের রাষ্ট্রদূত' আপনাকে বিস্তারিত অবহিত করবেন এবং বুঝিয়ে বলবেন। এখানে বিশেষভাবে লক্ষণীয় হলো, বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে বাংলাদেশের হলেও একদিকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, তারা ‘ভারতের অনুরোধে' স্টিফেন জে র‌্যাপকে ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন, অন্যদিকে শেখ হাসিনা বলেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া সম্পর্কে ওয়াশিংটনে নিযুক্ত ‘ভারতের রাষ্ট্রদূত' মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে অবহিত করবেন। দু'টি কথার মধ্যদিয়েই পরিষ্কার হয়েছিল, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পেছনে সকল কলকাঠি নাড়ছে আসলে ভারত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেমন ভারতের অনুরোধে তৎপর হয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারও তেমনি ভারতের নির্দেশই বাস্তবায়ন করছে মাত্র। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অন্য একটি কথায় আরো স্পষ্ট হয়েছিল। হিলারি ক্লিনটনকে তিনি বলেছিলেন, তার সরকার ‘ভারতের সক্রিয় সমর্থন ও সহযোগিতা নিয়েই' বিচারের কাজ হাতে নিয়েছে!
এ ধরনের বিভিন্ন কারণে- বিশেষ করে ড. ইউনূসকেন্দ্রিক তিক্ততা থাকার পরও হিলারি ক্লিনটন বাংলাদেশে আসছেন বলেই রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মধ্যে ব্যাপক কৌতূহলের সৃষ্টি হয়েছে। এখানে অন্য একটি তথ্যও উল্লেখ করা দরকার। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা সফরে এসে দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট ব্লেক জানিয়ে গিয়েছিলেন, ড. ইউনূসের সমস্যা না মেটা পর্যন্ত হিলারি ক্লিনটন বাংলাদেশে আসবেন না। দৃশ্যত সে সমস্যা এখনো মেটেনি, কিন্তু হিলারি ক্লিনটন আসছেন। পর্যবেক্ষকদের কৌতূহল ও আগ্রহের দ্বিতীয় কারণ হলো, এমন এক সময়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকায় আসছেন যখন বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীকে গুম করার প্রতিবাদে সারাদেশে তুমুল আন্দোলন চলছে। তার সফরের কারণে আন্দোলন কিছুটা স্তিমিত করলেও বিরোধী দল কঠোর অবস্থানেই রয়েছে। হিলারি ক্লিনটনের এ সফরকে সঙ্গত কারণেই আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি সমর্থন ও পাশে দাঁড়ানো হিসেবে চিহ্নিত করা হতে পারে। কিন্তু সে আশঙ্কা সত্ত্বেও হিলারি ক্লিনটন বাংলাদেশ সফরে আসছেন। তাকে সঙ্গ দেয়ার জন্য আসছেন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট ব্লেকও। হিলারি ক্লিনটনের এই সফরের প্রকৃত উদ্দেশ নিয়ে কথা উঠেছে এ দুটি প্রধান কারণেই।
কিছু বিশেষ তথ্য স্মরণ করা হলে অবশ্য বোঝা যাবে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তিক্ততার অবসান না ঘটা সত্ত্বেও হিলারি ক্লিনটন কেন বাংলাদেশ সফরে আসছেন। পাঠকদের মনে পড়তে পারে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার এক মাসের মধ্যে ঢাকায় এসেছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রিচার্ড বাউচার। রিচার্ড বাউচারকে সেবার বেশি আগ্রহী দেখা গিয়েছিল বাংলাদেশের সমুদ্রের ব্যাপারে। তিনি সুনির্দিষ্টভাবেই বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র সমুদ্র সীমা রক্ষায় বাংলাদেশকে ‘সহায়তা' দেবে। আসলে এখানেই ওয়াশিংটনের প্রকৃত উদ্দেশ্যের প্রকাশ ঘটেছিল। সমুদ্র সীমা নিয়ে রিচার্ড বাউচারদের মাথাব্যথার কারণ সম্পর্কে নতুন করে বলার প্রয়োজন পড়ে না। বাংলাদেশের সমুদ্রের তলদেশে রয়েছে তেল-গ্যাসসহ বিপুল সম্পদ। এই সম্পদের দিকে ভারতের মতো যুক্তরাষ্ট্রেরও লোলুপ দৃষ্টি পড়েছে। সমুদ্র সীমা রক্ষার নামে যুক্তরাষ্ট্র আসলে সমুদ্র তলদেশের সম্পদের ওপর নিজের দখল নিশ্চিত করতে চেয়েছে। একই সঙ্গে অন্য একটি বিশেষ উদ্দেশ্যও রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। সমুদ্র সীমায় পাহারা দেয়ার নাম করে যুক্তরাষ্ট্র তার নৌবাহিনীকে বঙ্গোপসাগরে নিয়ে আসতে ও মোতায়েন করতে চায়। এটা করা গেলে বাংলাদেশ মার্কিন সেনাবাহিনীর একেবারে হাতের নাগালের মধ্যে এসে পড়বে। বাংলাদেশে যখন-তখন ঢুকে পড়তে পারবে মার্কিন বাহিনী। ঢুকে পড়ার অজুহাতও তারাই তৈরি করবে, যেমনটি করে চলেছে পাকিস্তানে। সেখানে তালেবান ও আল-কায়েদা দমনের নামে মার্কিন বাহিনী পাকিস্তানের অনেক ভেতরেও বোমা বর্ষণ করে চলেছে। মার্কিন সেনারাও ঢুকে পড়ছে কথায় কথায়। ফলে বিপন্ন হচ্ছে পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব। মুসলিম প্রধান রাষ্ট্র হওয়ায় বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্রের নীতি একই রকম। এ লক্ষ্য নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতা শুরু হয়েছিল চারদলীয় জোট সরকারের শেষ দিকে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কন্ডোলিজা রাইস ২০০৫ সালের মার্চেই ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘অত্যন্ত সমস্যাপূর্ণ রাষ্ট্র' বাংলাদেশের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র ‘পদক্ষেপ' নেবে এবং এই ‘পদক্ষেপ' নেয়ার সময় ভারতকে ‘সঙ্গে' রাখবে। ‘উদ্দিন সাহেবদের' দিয়ে ক্ষমতা দখল করানোর এবং দেশপ্রেমিক ও ইসলামী দলগুলোকে নির্বাচনে হারিয়ে দেয়ার মাধ্যমে ‘পদক্ষেপ' নেয়ার প্রাথমিক পর্যায় সম্পন্ন হয়েছে। এর পর এসেছে পরবর্তী পর্যায়ের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া। এজন্যই যুক্তরাষ্ট্রের দরকার বাংলাদেশের কাছাকাছি অবস্থান নেয়া। সেটা সম্ভব হতে পারে যদি ‘পাহারাদার' সাজিয়ে হলেও মার্কিন বাহিনীকে বঙ্গোপসাগরে মোতায়েন করা যায়। রিচার্ড বাউচার সে আয়োজনই সেরে গিয়েছিলেন।
কথাটা বলার কারণ, রিচার্ড বাউচার সফরে আসার আগে থেকে ‘টিফা' নামের চুক্তি নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠেছিল। প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিলেন দেশপ্রেমিক সকল মহল। এর পেছনে যুক্তিসঙ্গত কারণও ছিল। কারণটি হলো, নামে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ চুক্তি হলেও টিফা স্বাক্ষর করলে ব্যবসা-বাণিজ্য ও রফতানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছাধীন হয়ে পড়তে হবে। শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের মতো স্বল্পোন্নত দেশের অনেক বাণিজ্য সুবিধা হারাতে হবে বাংলাদেশকে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার দেয়া কোনো সুযোগ-সুবিধাও আর পাবে না বাংলাদেশ। তাছাড়া টিফা স্বাক্ষরকারী শ্রীলংকা ও পাকিস্তানের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, চুক্তিটির মাধ্যমে কোনো দেশই লাভবান হতে পারেনি। এজন্যই রিচার্ড বাউচারের সফরের প্রাক্কালে টিফার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ উঠেছিল। বাউচারও বিচক্ষণতার প্রমাণ দিয়ে গেছেন। তিনি জানিয়েছিলেন, টিফা নিয়ে সরকারের সঙ্গে কোনো আলোচনা হয়নি এবং যুক্তরাষ্ট্র এই মুহূর্তে টিফা স্বাক্ষর করার ব্যাপারে আগ্রহী নয়। প্রশ্ন উঠেছিল, যে চুক্তিতে বাংলাদেশকে দিয়ে স্বাক্ষর করানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র ২০০২ সাল থেকে চেষ্টা চালিয়ে আসছে এবং যে চুক্তিকে প্রত্যাখ্যান করেছিল বলে চারদলীয় জোটের বিরুদ্ধে রীতিমতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল যুক্তরাষ্ট্র, সে চুক্তির ব্যাপারেই হঠাৎ আগ্রহ হারিয়ে ফেলার রহস্যটা কি? কিছুটা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে প্রশ্নের উত্তরও রিচার্ড বাউচারই জানিয়ে গিয়েছিলেন। সে উত্তর হলো, সমুদ্র সীমা পাহারা দেয়ার সুযোগ পাওয়া গেলে টিফার কোনো প্রয়োজনই থাকবে না। যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন বাংলাদেশকে হাতের মুঠোয় রাখা। এজন্য টিফার মতো জটিল প্রক্রিয়ার চাইতে ‘পাহারাদার' হওয়ার সুযোগ পাওয়া হাজার গুণে ভালো। রিচার্ড বাউচারকে সম্ভবত সে নিশ্চয়তাই দিয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার।
বলা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থ উদ্ধারের জন্য তাগিদ দেয়া হয়েছে বলেই ব্যক্তিগত রাগ-অভিমান ভুলে হিলারি ক্লিনটনকে বাংলাদেশ সফরে আসতে হচ্ছে। গণতন্ত্র ও মানবাধিকারসহ বাংলাদেশের স্বার্থোদ্ধার করে দেয়ার জন্য নয়, তিনি আসছেন সর্বতোভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব এজেন্ডা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এই মুহূর্তের প্রধান এজেন্ডা হলো গণচীনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রাচীর গড়ে তোলা। এ উদ্দেশ্যে ভারতকে সঙ্গে নিয়ে বহুদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্র কাজ করে চলেছে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের দরকার কৌশলগত পার্টনার হিসেবে পাওয়া। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর ধারাবাহিকভাবেই যুক্তরাষ্ট্র তার সে প্রচেষ্টাকে এগিয়ে নিয়েছে। সন্ত্রাস দমনসহ নানা চুক্তির প্রস্তাবও বাংলাদেশকে দিয়েছে। সরকারের মেয়াদ শেষদিকে চলে আসায় যুক্তরাষ্ট্র এখন আর অপেক্ষা করতে চাচ্ছে না। দেশে চলমান আন্দোলনকেও যুক্তরাষ্ট্র উল্টো সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির উপলক্ষ হিসেবেই ব্যবহার করতে চাচ্ছে। দুর্বল হয়ে পড়া সরকারও যুক্তরাষ্ট্রকে ত্রাণকর্তা মনে করছে। ফলে হিলারি ক্লিনটনের এ সফরের সময় কৌশলগত সহযোগিতার চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হতে পারে। চুক্তি স্বাক্ষর করাতে না পারলেও বিষয়টি পাকাপাকি না করে যাবেন না হিলারি। যারা মনে করেন, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘পুরোধা পুজারীর' ভূমিকা নেবে এবং গুম-খুন, গ্রেফতার ও মিথ্যা মামলাসহ দমন-নির্যাতন বন্ধ করার জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে, হিলারি ক্লিনটন নিশ্চিতভাবেই তাদের হতাশ করবেন। কারণ, প্রমাণিত সত্য হলো, অন্য দেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ব্যাপারে সামান্যও মাথাব্যথা নেই দেশটির। যুক্তরাষ্ট্র শুধু নিজেরটুকুই বোঝে, নিজের জন্য যা কিছু প্রয়োজন সেটুকুই আদায় করে। বর্তমান পর্যায়ে বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এর অন্যথা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। হিলারি ক্লিনটন এমনকি ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে তাকে অসম্মানিত করার কর্মকান্ডকেও দিব্যি পাশ কাটিয়ে যাবেন। কারণ, চীনের বিরুদ্ধে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি এবং সমুদ্রে দখল পাওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের দরকার ভারতের পাশাপাশি বাংলাদেশকেও কৌশলগত পার্টনার হিসেবে পাশে পাওয়া। এই সম্মতি জনগণের ভোটে নির্বাচিত কোনো দেশপ্রেমিক সরকারের কাছ থেকে আদায় করা সম্ভব নয়। সেদিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বর্তমান সরকার একটি ‘আদর্শ' সরকার। কারণ, লগি-বৈঠার তান্ডব থেকে ‘ডিজিটাল' নির্বাচন ও দলটির ক্ষমতায় আসা পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহে পরিষ্কারভাবে প্রমাণিত হয়েছে, বাংলাদেশে ‘পদক্ষেপ' নেয়ার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র যেমন ভারতকে ‘সঙ্গে' রেখেছে, আওয়ামী লীগও তেমনি দেশ দুটির ‘সঙ্গেই' থেকেছে। দেশ ও জাতি বিরোধী সমগ্র এই কর্মকান্ডে বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী এবং ইসলামী দলগুলো ছিল তাদের সকলের ‘কমন টার্গেট'। কথাটার প্রমাণ দেয়ার জন্য নিশ্চয়ই কথা বাড়ানোর প্রয়োজন পড়ে না।
এ ধরনের বাস্তব বিভিন্ন কারণেই ধরে নেয়া যায়, হিলারি ক্লিনটন আদায় করে নেবেন একেবারে কড়ায়-গন্ডায়। কিন্তু আপত্তির কারণ হলো, ভারতের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রকে খুশি করার মাধ্যমে সরকার কোনোভাবে টিকে যেতে পারলেও ক্ষতি যা হওয়ার সবই হবে বাংলাদেশের। কেননা, যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুত্বের মূল্য গুণতে গিয়ে বিশ্বের বহু দেশেরই সর্বনাশ হয়েছে। এখানে পাকিস্তানের অভিজ্ঞতা উল্লেখ করা দরকার। জেনারেল আইয়ুব খানের উদ্যোগে ১৯৫০-এর দশকেই পাকিস্তান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। ‘সিয়্যাটো' ও ‘সেন্টো' ধরনের সামরিক জোট এবং ‘পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি'র মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে ইচ্ছাধীন করে ফেলেছিল। সে সময় পাকিস্তানকে একটি ‘মহাশক্তিশালী রাষ্ট্র' হিসেবে প্রচারণা চালানো হতো। অন্যদিকে ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে সে পাকিস্তানই বিপন্ন হয়ে পড়েছিল। কারণ সামরিক জোটের সঙ্গী ব্রিটেন ও ফ্রান্সকে সঙ্গে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র হঠাৎ ঘোষণা করেছিল, এই যুদ্ধে তারা ‘নিরপেক্ষ' থাকবে। ‘নিরপেক্ষতার' নামে যুক্তরাষ্ট্র প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানকে চরম বিপদের মুখেই ঠেলে দিয়েছিল। কারণ, সমরাস্ত্রের সবকিছুর জন্য পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের ওপর নির্ভরশীল ছিল। অন্যদিকে ভারতের প্রধান সরবরাহকারী ছিল সোভিয়েট ইউনিয়ন (বর্তমান রাশিয়া)। ফলে ভারতের কোনো অসুবিধা হয়নি। উল্লে­খ্য, বিপন্ন অবস্থায় পাকিস্তান সেবার রাশিয়ার কাছে হাত বাড়াতে বাধ্য হয়েছিল। রাশিয়াই মধ্যস্থতা করে যুদ্ধের অবসান ঘটিয়েছিল।
আপত্তি ও প্রতিবাদের অন্য এক প্রধান কারণ বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা। বাংলাদেশ পাকিস্তানের কোনো সমরাস্ত্র পেতে পারেনি। স্বাধীনতাযুদ্ধে সমর্থন দেয়ার সুযোগ নিয়ে যুদ্ধের পরপর ভারতের সেনারা পাকিস্তানীদের সমুদয় সমরাস্ত্র লুণ্ঠন করে নিয়ে গিয়েছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামী জাতীয় নেতা মওলানা ভাসানীর হিসাবে এসব সমরাস্ত্রের দাম ছিল প্রায় ৯৩ হাজার কোটি টাকা। এর ফলে সামরিক শক্তির দিক থেকে বাংলাদেশ শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছিল। সশস্ত্র বাহিনীর হাতে কোনো অস্ত্রই ছিল না। অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছিল ১৯৭৫-এর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর। বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছিল গণচীন। বস্তুত গণচীনের আন্তরিক সমর্থন ও সহযোগিতা নিয়েই গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী। গাজীপুরস্থ সমরাস্ত্র কারখানায় অস্ত্র তৈরির মাধ্যমে তো বটেই, রফতানির পথেও গণচীনই বাংলাদেশকে অস্ত্রশস্ত্রের যোগান দিয়ে চলেছে। ট্যাংক থেকে যুদ্ধ বিমান পর্যন্ত বাংলাদেশের ৯০ শতাংশেরও বেশি সমরাস্ত্র এসেছে গণচীন থেকে। অর্থাৎ গণচীনের সহযোগিতা ছাড়া বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর পক্ষে যুদ্ধ করার কথা কল্পনা করাও সম্ভব নয়। এমন অবস্থায় ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধার মাধ্যমে চীনের বিরুদ্ধে পা বাড়াতে গেলে বিষয়টিকে চীন সহজভাবে নাও নিতে পারে। ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বনদ্বমূলক সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে তো বটেই, নিজের সমরাস্ত্রের গোপনীয়তা রক্ষার ব্যাপারে চীনের সতর্কতাও একটি বড় কারণ হয়ে উঠবে। চীন ভাববে, আওয়ামী লীগ সরকারের মাধ্যমে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র চীনের সামরিক প্রযুক্তি চালান করে নিয়ে যাবে- যা চীনের মতো পারমাণবিক শক্তিধর একটি রাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এর ফলে বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্কে অবনতি ঘটতে পারে, চীন এমনকি সামরিক সহযোগিতা বন্ধও করতে পারে। তেমন অবস্থায় বাংলাদেশকে সম্পূর্ণরূপেই ভারতের ওপর নির্ভরশীল হতে হবে- যার অর্থ, বাংলাদেশ আসলে ভারতের ইচ্ছাধীন হয়ে পড়বে। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন জড়িত রয়েছে বলেই বিষয়টিকে হাল্কাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই।
এভাবে পর্যালোচনায় দেখা যাবে, হিলারি ক্লিনটনের সফরে বাংলাদেশ কোনো দিক থেকেই লাভবান হতে পারবে না বরং ক্ষতিগ্রস্ত হবে সর্বতোভাবে। আর সবকিছুর জন্য দায়ী থাকবে আওয়ামী লীগ সরকার।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন