আবুল মোমেন | তারিখ: ০৪-০৫-২০১২
আমাদের আরও একটি গণতান্ত্রিক সরকার তিন বছরের মাথায় বিতর্কিত হয়ে উঠছে। যাঁরা সরকারের সাফল্য চেয়েছেন, তাঁরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছেন, দিনে দিনে সমস্যার আবর্তে সরকারের তলিয়ে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে।
মানতেই হবে, বাংলাদেশের যে বাস্তবতা, তাতে সরকার পরিচালনা সহজ কাজ নয়, পথ দুস্তর এবং অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। যেকোনো কাজের জন্য কিছুটা হলেও অনুকূল পরিবেশ প্রয়োজন। সেটা অবশ্য কেউ হাতে ধরে দেবে না, নিজেদেরই তৈরি করতে হবে।
দুঃখ এই খানে যে এই সরকারকে জনগণ বিপুল ভোটে বিজয়ী করেছিল অনেক প্রত্যাশা নিয়ে। গণতান্ত্রিক আমলে যে ব্যর্থতার বৃত্ত তৈরি হয়েছিল, তা থেকে বেরিয়ে আসার তাগিদ ছিল মানুষের দিক থেকে। মানুষ নানাভাবে ইতিবাচক পরিবর্তনের পক্ষে তাদের সদিচ্ছার প্রকাশ ঘটাচ্ছিল। আর সে কারণেই নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের প্রতি নমনীয়তা দেখা যাচ্ছিল সমাজের এমন কিছু অংশের, যারা ঐতিহ্যগতভাবে আওয়ামী লীগের প্রতি বিরূপ বলেই জানা ছিল। শহুরে তরুণ, মুসলিম বয়স্ক নারীর সমর্থন এবারই আওয়ামী লীগ, ঢালাওভাবে না পেলেও, অনেকাংশে পেয়েছে। তা ছাড়া ভারতপন্থী এবং ইসলামবিরোধী রাজনৈতিক পরিচয়ের অপবাদও অনেকটা কেটেছিল এ সময়ে। শেষের বিষয়টিতে, অর্থাৎ এ অপবাদ ঘুচানোর জন্য আওয়ামী লীগের সযত্ন প্রয়াস লক্ষণীয়, হয়তো এসব প্রয়াসের জন্য অনেক ক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাজনীতির জায়গা থেকে কিছুটা উদ্বেগ সৃষ্টিরই কারণ ঘটেছে। তবে এসব পরিবর্তনের পেছনে জনগণের মধ্যে রাজনীতির ক্ষুদ্র ঘূর্ণাবর্ত থেকে বেরিয়ে আসার আকাঙ্ক্ষার প্রভাবও কাজ করেছে। ক্ষমতায় যাওয়াও যে প্রধান একটি কারণ ছিল, তা-ও বলতে হবে।
ক্ষমতায় আসার পর সরকারের দিক থেকেও খুব ভালো সাড়া মিলেছে কয়েকটি ক্ষেত্রে। তার মধ্যে প্রথমেই বলতে হবে সর্বসাধারণের জন্য শিক্ষার দ্বার সুগম করে দেওয়া। সমাজ পরিবর্তন, উন্নত সমাজ তৈরি, যুগোপযোগী উন্নয়ন ইত্যাদির বিকল্পহীন প্রধান হাতিয়ার শিক্ষা। না, এখনো অভীষ্ট মানের শিক্ষা সবার জন্য সুলভ নয়, কিন্তু আশার কথা, একটি যুগোপযোগী শিক্ষানীতি প্রবর্তনসহ তার কাঠামো ও একটা কার্যকর পদ্ধতির রূপরেখা তৈরি হয়েছে। এখন উপযুক্ত মানসম্পন্ন ও প্রয়োজনীয় শিক্ষক নিয়োগ, স্কুলের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, পাঠাগার-গবেষণাগার-খেলার মাঠসহ সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি, পাঠ্যবইয়ের টেক্সট ও প্রকাশনার মানোন্নয়নের কাজ ধাপে ধাপে করা সম্ভব। কিন্তু সাড়ে তিন কোটি শিশু-কিশোর-কিশোরীকে স্কুলে আনা, বছরের নির্দিষ্ট দিনে বই দেওয়া, ছাত্রীদের পোশাক ও উপবৃত্তি দেওয়া, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া ইত্যাদি নিঃসন্দেহে বড় কাজ। তবে অভীষ্ট সুফল পেতে এ খাতে বাজেট বরাদ্দ আরও বাড়াতে হবে।
এরপর বলতে হবে, এ সরকার কৃষির উৎপাদন ও কৃষকের কল্যাণে সঠিকভাবেই মনোযোগ দিয়েছে। এখানে কৃষিমন্ত্রীর পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভিন্ন স্তরের কর্মীদের ভূমিকা এবং দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের উদ্যোগের কথাও বলতে হবে। বীজ, সার, বিদ্যুৎ সরবরাহ ও কৃষিবিদদের যথাযথ তদারকি এবং সেই সঙ্গে কৃষিবান্ধব ব্যাংকিংয়ের সুবাদে কৃষি উৎপাদন বেড়েছে, কৃষির বৈচিত্র্যময় সম্প্রসারণ ঘটেছে, নতুন প্রযুক্তির ব্যবহারে দক্ষতাও বেড়েছে। এখন কৃষি-বাণিজ্যে মধ্যস্বত্বভোগীদের একচ্ছত্র আধিপত্য ও মুনাফাবাজি কমিয়ে এনে তার সুবিধা উৎপাদক ও ভোক্তার কাছে পৌঁছাতে পারলে কৃষির যে সাফল্য তার সুফল ফড়িয়ার পরিবর্তে কৃষক ও ভোক্তার কাছে পৌঁছাবে।
বর্তমানে আমাদের অর্থনীতির মূল তিনটি বাহু—কৃষি, তৈরি পোশাক ও প্রবাসী শ্রমিকের উপার্জন। সরকার প্রবাসী উপার্জনকারীদের কল্যাণে যে ব্যাংক গঠনে হাত দিয়েছে, তার ফায়দা সাধারণ শ্রমিকেরা কীভাবে কতটা পাবে, তা এখনো পরিষ্কার নয়। কিন্তু তাদের কল্যাণ যে সরকারের এজেন্ডায় আছে, সেটা বোঝা যাচ্ছে। এই ব্যাংক যাতে শুধু বিত্তবান প্রবাসীদের বিনিয়োগ ও মুনাফার ক্ষেত্র হয়ে না পড়ে, সাধারণ অল্প আয়ের শ্রমিকদেরও কল্যাণে আসে, তার ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ছাড়া বিদেশে মানবশক্তি প্রেরণের যে ব্যবসা তাকে মুনাফাবাজি, শোষণ-বঞ্চনা-প্রতারণার ফাঁদ থেকে মুক্ত করে শ্রমজীবী-বান্ধব দক্ষ ব্যবস্থায় পরিচালনা করতে হবে। তাতে কার্যকর কিছু পদক্ষেপ এখনই প্রয়োজন। কারণ, এ খাত ভবিষ্যতে আরও বড় হবে।
পোশাকশ্রমিকদের বেতন বাড়ানোর কাজে সরকার প্রথমেই হাত দিয়েছিল। এ ক্ষেত্রে কাজের পরিবেশ, কর্মঘণ্টা, ওভারটাইম এবং বস্ত্রবালিকাদের নিরাপদ, স্বাস্থ্যসম্মত সামাজিক পরিবেশের জন্য কাজ করা জরুরি। কারণ, আরও কিছুকাল নির্বিঘ্নে এ খাতেরও সম্প্রসারণ ঘটানো ও তা থেকে বৈদেশিক মুদ্রার আয় বাড়ানো সম্ভব।
দেশের আর্থসামাজিক অগ্রগতির জন্য আরও তিনটি ক্ষেত্রে উন্নয়ন যে জরুরি, তা সরকার উপলব্ধি করে, তা বোঝা যায়। খাত তিনটি হলো—বিদ্যুৎ-জ্বালানি, রেল ও যোগাযোগ এবং ডিজিটাল প্রযুক্তির সম্প্রসারণ। এ সরকার তো ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্লোগান দিয়েই ক্ষমতায় এসেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকেও মনোযোগী হয়েছিল, চটজলদি অনেক প্রকল্পও হাতে নিয়েছিল, একেবারে ফল পায়নি তা-ও নয়, তবে চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দেওয়া যায়নি। রেল, নৌপথ ও সড়ক যোগাযোগের উন্নতির জন্য নানা প্রকল্প তৈরি করলেও বড় বড় প্রকল্প নিয়ে হোঁচট খেয়েছে সরকার। দুই প্রতিবেশী মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে দীর্ঘদিনের টানাপোড়েন থাকলেও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে ইতিবাচকতা তৈরি হয়েছে, এটা নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি।
কৃষি, পোশাকশিল্প ও প্রবাসী শ্রমজীবীর আয় ঠিকঠাক চললে বাংলাদেশের অর্থনীতির অগ্রগতি অব্যাহত থাকবে। কিন্তু গণতন্ত্রে একটি সরকারের মূল্যায়নের জন্য এই সব ভালো কাজই যথেষ্ট নয়। এমনকি নানা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমীক্ষায় অর্থনীতি ও অন্যান্য সামাজিক সূচকে অগ্রগতিই লক্ষগোচর হলেও গণতন্ত্রে নির্বাচনের সময় তা ঢাকা পড়ে গিয়ে চাঞ্চল্যকর অন্য কোনো বিষয় ভোটারের বিবেচনায় অগ্রাধিকার পেয়ে যেতে পারে। গণতন্ত্রে গণমাধ্যম ও সংবাদপত্রেরও বড় ভূমিকা থাকে। প্রতিদিনের ঘটনার ভিত্তিতেই সেজে ওঠে সংবাদপত্র, অন্যান্য গণমাধ্যম। তাতে ভিন্ন ইস্যু চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে ও উত্তেজনার খোরাক জোগায় এবং প্রতিটি ঘটনাকে ঘিরে কুশীলব থাকলেও তার মাত্রা যখন বড় হয়, তখন এর দায় এসে পড়ে সরকারের ওপর। এতে জাতীয়ভাবে গুরুত্বের দিক থেকে ইস্যুগুলোর সুবিচার সব সময় হয় না।
সরকার প্রতিনিয়ত এভাবে দায়ী হতে থাকে মানুষের বিচারে, গণমাধ্যমের বিচারেও। অন্য অভিযুক্ত ব্যক্তিরা ঘটনা ভেদে পাল্টায়, কিন্তু ধ্রুব অভিযুক্ত হচ্ছে সরকার। ফলে সংবাদপত্রের কাঁধে ভর দিয়ে অনেক সময় নিত্য কৌশলী প্রচারণার মাধ্যমে সব ঘটনার সবটা দায় সরকারের ওপর চাপানো যায় এবং দায় নিয়ে একসময় সবার চোখে ও বিচারে সরকার অপরাধী হয়ে পড়ে।
এটাই হচ্ছে এখানকার বিরোধী দলের রাজনীতি। কিন্তু গণমাধ্যমের তো নিরপেক্ষ থাকার কথা। সব ঘটনাই তুলে ধরতে হবে, সব অন্যায়ের প্রতিকার চাইতে হবে, সব অপরাধের বিচার চাইতে হবে। কিন্তু ঘুরেফিরে সব দায় সরকারের ঘাড়ে চাপিয়ে দিলে অপরাধীরা সে সুযোগ নেবেই—সরকারের ভেতরে থেকে যেমন, বাইরে থেকেও তেমনি নেবে।
দুর্নীতি, অপরাধ, মুনাফাবাজি ও দ্রব্যমূল্য, রাজনৈতিক ক্ষমতা-কোন্দল ও হরতাল প্রভৃতি অস্থিরতা, অদক্ষতা ইত্যাদি এ সমাজের যেসব রোগ প্রকটভাবে চোখে পড়ে এবং জনসাধারণের চরম ভোগান্তির কারণ হয়, সেগুলোও রোগ বটে, কিন্তু মূল রোগের বহিঃপ্রকাশ ঘটানো উপজাত রোগ। এ খানিকটা ঘায়ের মতো, চিকিৎসার অভাবে ঘা সর্বাঙ্গে ছড়িয়েও পড়েছে। তবে সঠিক ওষুধ পড়লে ঘা যেমন ভেতর থেকে শুকিয়ে আসে এবং একসময় ওপরের রুগ্ণ মরা চামড়া আপনিই খসে পড়ে, সমাজের ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটার কথা। ঠিক রোগের মতোই ওপরের ঘায়ে মলম লাগাতে হবে, কিন্তু সেই সঙ্গে ঠিক ওষুধই খেতে হবে, তবেই রোগ নির্মূল হবে। নয়তো সাময়িকভাবে চাপা থাকতে পারে মাত্র।
আমরা যেন চিকিৎসার এই নিয়ম মানতে চাইছি না। ওপরের রোগের (যা মূল রোগের উপজাত) দিকেই সব মনোযোগ ঢেলে দিচ্ছি, হইচই করছি। তাতে সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা প্রশমনের চেয়ে উসকে ওঠে, জিইয়ে থাকে। কিন্তু শিক্ষা, কৃষি, শিল্পের বিস্তার এবং জ্বালানি, যোগাযোগ, প্রযুক্তির মতো অবকাঠামোর উন্নয়ন ঘটতে থাকলে অশিক্ষা, বেকারত্ব ও দারিদ্র্য কমে এলে যেগুলোকে এখন মূল সমস্যা ভাবছি, তা আপনিই হ্রাস পাবে। পত্রিকার কলাম, টিভির টক-শো, এনজিওর গোলটেবিলে এ নিয়ে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ হতে পারে, কিন্তু সেই কচকচি দিয়ে রোগ সারবে না।
না, সরকার সাগর-রুনির হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন না করার দায় এড়াতে পারে না। আর বিএনপির নেতা ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়ার দায় একটু বেশিই পড়বে ঘাড়ে। কারণ, তিনি প্রধান বিরোধী দলের—বিতর্কিত হলেও—আওয়ামী-বিরোধিতার রাজনীতিতে কার্যকর ব্যক্তি ছিলেন। এ সরকারও তার পূর্ববর্তী সব সরকারের মতোই দুর্নীতি, স্বজনতোষণ, প্রশাসনে অযাচিত হস্তক্ষেপ, দলীয়করণ, টেন্ডারবাজি, ছাত্র-যুব সংগঠনের অন্তর্দলীয় হানাহানি, ক্যাম্পাস দখল—এসব অপরাধে সমানভাবেই শামিল। সংবাদপত্রে প্রতিদিন ঝাঁক বেঁধে এসব খবরই প্রকাশিত হবে। আর তার পুঞ্জীভূত দায়ভার তথা অভিযোগের ভার বহন করতে হবে সরকারকে।
নিবন্ধের শুরুতে বর্ণিত ভালো কাজগুলো এই প্রথমবারের মতো আমাদের কোনো সরকার যুগপৎ সফলভাবে করতে পেরেছে। এর তাৎক্ষণিক সুফল মিলেছে, সুদূরপ্রসারী সুফলও মিলবে। কিন্তু দুঃখের সঙ্গেই বলতে হবে, এ সরকারও যদি আমাদের সরকারগুলোর ট্র্যাডিশনাল ভুল ও অপরাধগুলো বন্ধে, অন্তত কার্যকরভাবে হ্রাস করার জন্য যত্নশীল না হয়, তবে গণমাধ্যমই বা কী করবে।
দুর্ভাগ্য হলো, জনতার স্মৃতি থেকেও সব বেমালুম মুছে যায়। ভোটের সময় কাছে এলে চাঞ্চল্যকর ঘটনার কাভারেজ বাড়ে আর সেই প্রচারণা ও স্মৃতিই ভোটারকে পথ দেখায়। এভাবে রাজা যায় রাজা আসে—কবির এই উক্তির সত্যতাই আমরা প্রমাণ করে চলেছি।
এটি আমার বিচারে আমাদের রাজনীতি ও সাম্প্রতিক ইতিহাসের জন্য একেবারে গ্রিক ট্র্যাজেডির মতো ঘটনা। ক্ষুব্ধ, হতাশ ভোটার যেন ময়লা পানির সঙ্গে স্নানরত শিশুটিকেই ছুড়ে ফেলতে কুণ্ঠিত হয় না। সরকার, সংবাদপত্র এবং আমরা সবাই মিলেই যেন নিজেদের ব্যর্থতার বৃত্তটিকে ভবিতব্য হিসেবে চিরস্থায়ী করে রাখছি।
সমকালীন ইতিহাসের অন্তত মূল দুই কুশীলব—সরকার ও গণমাধ্যম—আরও একটু সংযত ও সুদূরপ্রসারী পরিণতি ভেবে কি চলতে পারে না?
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
মানতেই হবে, বাংলাদেশের যে বাস্তবতা, তাতে সরকার পরিচালনা সহজ কাজ নয়, পথ দুস্তর এবং অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। যেকোনো কাজের জন্য কিছুটা হলেও অনুকূল পরিবেশ প্রয়োজন। সেটা অবশ্য কেউ হাতে ধরে দেবে না, নিজেদেরই তৈরি করতে হবে।
দুঃখ এই খানে যে এই সরকারকে জনগণ বিপুল ভোটে বিজয়ী করেছিল অনেক প্রত্যাশা নিয়ে। গণতান্ত্রিক আমলে যে ব্যর্থতার বৃত্ত তৈরি হয়েছিল, তা থেকে বেরিয়ে আসার তাগিদ ছিল মানুষের দিক থেকে। মানুষ নানাভাবে ইতিবাচক পরিবর্তনের পক্ষে তাদের সদিচ্ছার প্রকাশ ঘটাচ্ছিল। আর সে কারণেই নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের প্রতি নমনীয়তা দেখা যাচ্ছিল সমাজের এমন কিছু অংশের, যারা ঐতিহ্যগতভাবে আওয়ামী লীগের প্রতি বিরূপ বলেই জানা ছিল। শহুরে তরুণ, মুসলিম বয়স্ক নারীর সমর্থন এবারই আওয়ামী লীগ, ঢালাওভাবে না পেলেও, অনেকাংশে পেয়েছে। তা ছাড়া ভারতপন্থী এবং ইসলামবিরোধী রাজনৈতিক পরিচয়ের অপবাদও অনেকটা কেটেছিল এ সময়ে। শেষের বিষয়টিতে, অর্থাৎ এ অপবাদ ঘুচানোর জন্য আওয়ামী লীগের সযত্ন প্রয়াস লক্ষণীয়, হয়তো এসব প্রয়াসের জন্য অনেক ক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাজনীতির জায়গা থেকে কিছুটা উদ্বেগ সৃষ্টিরই কারণ ঘটেছে। তবে এসব পরিবর্তনের পেছনে জনগণের মধ্যে রাজনীতির ক্ষুদ্র ঘূর্ণাবর্ত থেকে বেরিয়ে আসার আকাঙ্ক্ষার প্রভাবও কাজ করেছে। ক্ষমতায় যাওয়াও যে প্রধান একটি কারণ ছিল, তা-ও বলতে হবে।
ক্ষমতায় আসার পর সরকারের দিক থেকেও খুব ভালো সাড়া মিলেছে কয়েকটি ক্ষেত্রে। তার মধ্যে প্রথমেই বলতে হবে সর্বসাধারণের জন্য শিক্ষার দ্বার সুগম করে দেওয়া। সমাজ পরিবর্তন, উন্নত সমাজ তৈরি, যুগোপযোগী উন্নয়ন ইত্যাদির বিকল্পহীন প্রধান হাতিয়ার শিক্ষা। না, এখনো অভীষ্ট মানের শিক্ষা সবার জন্য সুলভ নয়, কিন্তু আশার কথা, একটি যুগোপযোগী শিক্ষানীতি প্রবর্তনসহ তার কাঠামো ও একটা কার্যকর পদ্ধতির রূপরেখা তৈরি হয়েছে। এখন উপযুক্ত মানসম্পন্ন ও প্রয়োজনীয় শিক্ষক নিয়োগ, স্কুলের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, পাঠাগার-গবেষণাগার-খেলার মাঠসহ সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি, পাঠ্যবইয়ের টেক্সট ও প্রকাশনার মানোন্নয়নের কাজ ধাপে ধাপে করা সম্ভব। কিন্তু সাড়ে তিন কোটি শিশু-কিশোর-কিশোরীকে স্কুলে আনা, বছরের নির্দিষ্ট দিনে বই দেওয়া, ছাত্রীদের পোশাক ও উপবৃত্তি দেওয়া, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া ইত্যাদি নিঃসন্দেহে বড় কাজ। তবে অভীষ্ট সুফল পেতে এ খাতে বাজেট বরাদ্দ আরও বাড়াতে হবে।
এরপর বলতে হবে, এ সরকার কৃষির উৎপাদন ও কৃষকের কল্যাণে সঠিকভাবেই মনোযোগ দিয়েছে। এখানে কৃষিমন্ত্রীর পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভিন্ন স্তরের কর্মীদের ভূমিকা এবং দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের উদ্যোগের কথাও বলতে হবে। বীজ, সার, বিদ্যুৎ সরবরাহ ও কৃষিবিদদের যথাযথ তদারকি এবং সেই সঙ্গে কৃষিবান্ধব ব্যাংকিংয়ের সুবাদে কৃষি উৎপাদন বেড়েছে, কৃষির বৈচিত্র্যময় সম্প্রসারণ ঘটেছে, নতুন প্রযুক্তির ব্যবহারে দক্ষতাও বেড়েছে। এখন কৃষি-বাণিজ্যে মধ্যস্বত্বভোগীদের একচ্ছত্র আধিপত্য ও মুনাফাবাজি কমিয়ে এনে তার সুবিধা উৎপাদক ও ভোক্তার কাছে পৌঁছাতে পারলে কৃষির যে সাফল্য তার সুফল ফড়িয়ার পরিবর্তে কৃষক ও ভোক্তার কাছে পৌঁছাবে।
বর্তমানে আমাদের অর্থনীতির মূল তিনটি বাহু—কৃষি, তৈরি পোশাক ও প্রবাসী শ্রমিকের উপার্জন। সরকার প্রবাসী উপার্জনকারীদের কল্যাণে যে ব্যাংক গঠনে হাত দিয়েছে, তার ফায়দা সাধারণ শ্রমিকেরা কীভাবে কতটা পাবে, তা এখনো পরিষ্কার নয়। কিন্তু তাদের কল্যাণ যে সরকারের এজেন্ডায় আছে, সেটা বোঝা যাচ্ছে। এই ব্যাংক যাতে শুধু বিত্তবান প্রবাসীদের বিনিয়োগ ও মুনাফার ক্ষেত্র হয়ে না পড়ে, সাধারণ অল্প আয়ের শ্রমিকদেরও কল্যাণে আসে, তার ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ছাড়া বিদেশে মানবশক্তি প্রেরণের যে ব্যবসা তাকে মুনাফাবাজি, শোষণ-বঞ্চনা-প্রতারণার ফাঁদ থেকে মুক্ত করে শ্রমজীবী-বান্ধব দক্ষ ব্যবস্থায় পরিচালনা করতে হবে। তাতে কার্যকর কিছু পদক্ষেপ এখনই প্রয়োজন। কারণ, এ খাত ভবিষ্যতে আরও বড় হবে।
পোশাকশ্রমিকদের বেতন বাড়ানোর কাজে সরকার প্রথমেই হাত দিয়েছিল। এ ক্ষেত্রে কাজের পরিবেশ, কর্মঘণ্টা, ওভারটাইম এবং বস্ত্রবালিকাদের নিরাপদ, স্বাস্থ্যসম্মত সামাজিক পরিবেশের জন্য কাজ করা জরুরি। কারণ, আরও কিছুকাল নির্বিঘ্নে এ খাতেরও সম্প্রসারণ ঘটানো ও তা থেকে বৈদেশিক মুদ্রার আয় বাড়ানো সম্ভব।
দেশের আর্থসামাজিক অগ্রগতির জন্য আরও তিনটি ক্ষেত্রে উন্নয়ন যে জরুরি, তা সরকার উপলব্ধি করে, তা বোঝা যায়। খাত তিনটি হলো—বিদ্যুৎ-জ্বালানি, রেল ও যোগাযোগ এবং ডিজিটাল প্রযুক্তির সম্প্রসারণ। এ সরকার তো ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্লোগান দিয়েই ক্ষমতায় এসেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকেও মনোযোগী হয়েছিল, চটজলদি অনেক প্রকল্পও হাতে নিয়েছিল, একেবারে ফল পায়নি তা-ও নয়, তবে চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দেওয়া যায়নি। রেল, নৌপথ ও সড়ক যোগাযোগের উন্নতির জন্য নানা প্রকল্প তৈরি করলেও বড় বড় প্রকল্প নিয়ে হোঁচট খেয়েছে সরকার। দুই প্রতিবেশী মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে দীর্ঘদিনের টানাপোড়েন থাকলেও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে ইতিবাচকতা তৈরি হয়েছে, এটা নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি।
কৃষি, পোশাকশিল্প ও প্রবাসী শ্রমজীবীর আয় ঠিকঠাক চললে বাংলাদেশের অর্থনীতির অগ্রগতি অব্যাহত থাকবে। কিন্তু গণতন্ত্রে একটি সরকারের মূল্যায়নের জন্য এই সব ভালো কাজই যথেষ্ট নয়। এমনকি নানা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমীক্ষায় অর্থনীতি ও অন্যান্য সামাজিক সূচকে অগ্রগতিই লক্ষগোচর হলেও গণতন্ত্রে নির্বাচনের সময় তা ঢাকা পড়ে গিয়ে চাঞ্চল্যকর অন্য কোনো বিষয় ভোটারের বিবেচনায় অগ্রাধিকার পেয়ে যেতে পারে। গণতন্ত্রে গণমাধ্যম ও সংবাদপত্রেরও বড় ভূমিকা থাকে। প্রতিদিনের ঘটনার ভিত্তিতেই সেজে ওঠে সংবাদপত্র, অন্যান্য গণমাধ্যম। তাতে ভিন্ন ইস্যু চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে ও উত্তেজনার খোরাক জোগায় এবং প্রতিটি ঘটনাকে ঘিরে কুশীলব থাকলেও তার মাত্রা যখন বড় হয়, তখন এর দায় এসে পড়ে সরকারের ওপর। এতে জাতীয়ভাবে গুরুত্বের দিক থেকে ইস্যুগুলোর সুবিচার সব সময় হয় না।
সরকার প্রতিনিয়ত এভাবে দায়ী হতে থাকে মানুষের বিচারে, গণমাধ্যমের বিচারেও। অন্য অভিযুক্ত ব্যক্তিরা ঘটনা ভেদে পাল্টায়, কিন্তু ধ্রুব অভিযুক্ত হচ্ছে সরকার। ফলে সংবাদপত্রের কাঁধে ভর দিয়ে অনেক সময় নিত্য কৌশলী প্রচারণার মাধ্যমে সব ঘটনার সবটা দায় সরকারের ওপর চাপানো যায় এবং দায় নিয়ে একসময় সবার চোখে ও বিচারে সরকার অপরাধী হয়ে পড়ে।
এটাই হচ্ছে এখানকার বিরোধী দলের রাজনীতি। কিন্তু গণমাধ্যমের তো নিরপেক্ষ থাকার কথা। সব ঘটনাই তুলে ধরতে হবে, সব অন্যায়ের প্রতিকার চাইতে হবে, সব অপরাধের বিচার চাইতে হবে। কিন্তু ঘুরেফিরে সব দায় সরকারের ঘাড়ে চাপিয়ে দিলে অপরাধীরা সে সুযোগ নেবেই—সরকারের ভেতরে থেকে যেমন, বাইরে থেকেও তেমনি নেবে।
দুর্নীতি, অপরাধ, মুনাফাবাজি ও দ্রব্যমূল্য, রাজনৈতিক ক্ষমতা-কোন্দল ও হরতাল প্রভৃতি অস্থিরতা, অদক্ষতা ইত্যাদি এ সমাজের যেসব রোগ প্রকটভাবে চোখে পড়ে এবং জনসাধারণের চরম ভোগান্তির কারণ হয়, সেগুলোও রোগ বটে, কিন্তু মূল রোগের বহিঃপ্রকাশ ঘটানো উপজাত রোগ। এ খানিকটা ঘায়ের মতো, চিকিৎসার অভাবে ঘা সর্বাঙ্গে ছড়িয়েও পড়েছে। তবে সঠিক ওষুধ পড়লে ঘা যেমন ভেতর থেকে শুকিয়ে আসে এবং একসময় ওপরের রুগ্ণ মরা চামড়া আপনিই খসে পড়ে, সমাজের ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটার কথা। ঠিক রোগের মতোই ওপরের ঘায়ে মলম লাগাতে হবে, কিন্তু সেই সঙ্গে ঠিক ওষুধই খেতে হবে, তবেই রোগ নির্মূল হবে। নয়তো সাময়িকভাবে চাপা থাকতে পারে মাত্র।
আমরা যেন চিকিৎসার এই নিয়ম মানতে চাইছি না। ওপরের রোগের (যা মূল রোগের উপজাত) দিকেই সব মনোযোগ ঢেলে দিচ্ছি, হইচই করছি। তাতে সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা প্রশমনের চেয়ে উসকে ওঠে, জিইয়ে থাকে। কিন্তু শিক্ষা, কৃষি, শিল্পের বিস্তার এবং জ্বালানি, যোগাযোগ, প্রযুক্তির মতো অবকাঠামোর উন্নয়ন ঘটতে থাকলে অশিক্ষা, বেকারত্ব ও দারিদ্র্য কমে এলে যেগুলোকে এখন মূল সমস্যা ভাবছি, তা আপনিই হ্রাস পাবে। পত্রিকার কলাম, টিভির টক-শো, এনজিওর গোলটেবিলে এ নিয়ে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ হতে পারে, কিন্তু সেই কচকচি দিয়ে রোগ সারবে না।
না, সরকার সাগর-রুনির হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন না করার দায় এড়াতে পারে না। আর বিএনপির নেতা ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়ার দায় একটু বেশিই পড়বে ঘাড়ে। কারণ, তিনি প্রধান বিরোধী দলের—বিতর্কিত হলেও—আওয়ামী-বিরোধিতার রাজনীতিতে কার্যকর ব্যক্তি ছিলেন। এ সরকারও তার পূর্ববর্তী সব সরকারের মতোই দুর্নীতি, স্বজনতোষণ, প্রশাসনে অযাচিত হস্তক্ষেপ, দলীয়করণ, টেন্ডারবাজি, ছাত্র-যুব সংগঠনের অন্তর্দলীয় হানাহানি, ক্যাম্পাস দখল—এসব অপরাধে সমানভাবেই শামিল। সংবাদপত্রে প্রতিদিন ঝাঁক বেঁধে এসব খবরই প্রকাশিত হবে। আর তার পুঞ্জীভূত দায়ভার তথা অভিযোগের ভার বহন করতে হবে সরকারকে।
নিবন্ধের শুরুতে বর্ণিত ভালো কাজগুলো এই প্রথমবারের মতো আমাদের কোনো সরকার যুগপৎ সফলভাবে করতে পেরেছে। এর তাৎক্ষণিক সুফল মিলেছে, সুদূরপ্রসারী সুফলও মিলবে। কিন্তু দুঃখের সঙ্গেই বলতে হবে, এ সরকারও যদি আমাদের সরকারগুলোর ট্র্যাডিশনাল ভুল ও অপরাধগুলো বন্ধে, অন্তত কার্যকরভাবে হ্রাস করার জন্য যত্নশীল না হয়, তবে গণমাধ্যমই বা কী করবে।
দুর্ভাগ্য হলো, জনতার স্মৃতি থেকেও সব বেমালুম মুছে যায়। ভোটের সময় কাছে এলে চাঞ্চল্যকর ঘটনার কাভারেজ বাড়ে আর সেই প্রচারণা ও স্মৃতিই ভোটারকে পথ দেখায়। এভাবে রাজা যায় রাজা আসে—কবির এই উক্তির সত্যতাই আমরা প্রমাণ করে চলেছি।
এটি আমার বিচারে আমাদের রাজনীতি ও সাম্প্রতিক ইতিহাসের জন্য একেবারে গ্রিক ট্র্যাজেডির মতো ঘটনা। ক্ষুব্ধ, হতাশ ভোটার যেন ময়লা পানির সঙ্গে স্নানরত শিশুটিকেই ছুড়ে ফেলতে কুণ্ঠিত হয় না। সরকার, সংবাদপত্র এবং আমরা সবাই মিলেই যেন নিজেদের ব্যর্থতার বৃত্তটিকে ভবিতব্য হিসেবে চিরস্থায়ী করে রাখছি।
সমকালীন ইতিহাসের অন্তত মূল দুই কুশীলব—সরকার ও গণমাধ্যম—আরও একটু সংযত ও সুদূরপ্রসারী পরিণতি ভেবে কি চলতে পারে না?
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন