মো: নুরুল আবেদীন | সোমবার, ৭ মে ২০১২,
যে কোন জাতির অগ্রগতির কতকগুলো পূর্বশর্ত থাকে। অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি, কৃষি, শিক্ষা, শিল্প, স্বাস্থ্য, বিদ্যুত্, জ্বালানি, দারিদ্র্য বিমোচন, যোগাযোগ, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, ক্রীড়া ও সংস্কৃতি ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রেই অগ্রগতির জন্য প্রয়োজন যোগ্য নেতৃত্ব। যে কোন জাতির অগ্রগতি যে সমস্ত পূর্বশর্ত রয়েছে তার মধ্যে যোগ্য নেতৃত্ব অন্যতম। যোগ্য, সত্ ও নিঃস্বার্থ নেতৃত্বের অভাবে জাতীয় উন্নয়নের এ সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলো দিক নির্দেশনা হারিয়ে ফেলে এবং ফলশ্রুতিতে জাতীয় উন্নয়ন হয় ব্যাহত। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন অনেক ব্যক্তিত্ব আছে যারা তাদের নেতৃত্বের গুণে জাতিকে উন্নতির শিখরে নিয়ে গেছেন। তাদের সবার অবদান উল্লেখ করতে গেলে এ লেখার কলেবর বৃদ্ধি পাবে।
বস্তুত: প্রত্যেক জাতির জীবনে একটা ‘‘Great Moment’’ থাকে সেই Great Moment কে মূলধন করে দেশপ্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে একটি জাতিকে গড়ে তোলা যায়। আমাদেরও একটা Great Moment ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমরা সেই Great Moment- কে মূলধন করে তা দেশগড়ার কাজে বিনিয়োগ করতে পারিনি। এ প্রসংগে প্রখ্যাত আইরিশ কবি W.B.Y eats-এর একটি উক্তি আমাদের ক্ষেত্রেও খুবই প্রাসংগিক। আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতার পরবর্তী বছরগুলোর দুঃশাসনে বিক্ষুব্ধ হয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘’Irelands great moments have passed away and she had filled no roomy vessels with strong sweet wine whereas we have filled our porcelain jars against the comming winter’’ ১৯৭৫ সনের ১৫ই আগস্টের পট-পরিবর্তনের পর পদ্মা, যমুনায় অনেক পানি প্রবাহিত হয়েছে। সময়ের বিবর্তনে বাংলাদেশও অনেক চড়াই উত্রাই অতিক্রম করে ৩৭টি বত্সর (১৯৭৫ থেকে গণনা করে) অতিবাহিত করে এসেছে।
মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়েছে। এতটা বছর পেরিয়ে এসেও আমরা একটি দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসী, ন্যায়নীতি বিবর্জিত ও মানবাধিকার বিরোধী একটি দরিদ্র দেশ। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় কি? আমার মতে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ বর্তমান এবং ভবিষ্যত্ নেতৃত্বই দেশকে এ অবস্থা থেকে উদ্ধার করতে পারে। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিল্প বাণিজ্য, ব্যবসা, জননিরাপত্তা, ডিজিটাল প্রযুক্তির বিকাশ, নারী উন্নয়ন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রভৃতি ক্ষেত্রের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন যোগ্য, দক্ষ, নিঃস্বার্থ ও আন্তরিক নেতৃত্বের। এ সবের পিছনে চালিকা শক্তি দেশপ্রেম। “ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়”— একটি চমত্কার রাজনৈতিক শ্লোগান। এখানে দেশপ্রেমকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে আমরা কি দেখছি? “দেশের চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে ব্যক্তি বড়”। ১৯৭৫-এর পর থেকে জাতিকে কতকগুলো দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। মহাত্মা করমচাঁদ মোহনদাস গান্ধী এই দুর্ভোগের কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছেন। যথাঃ—
- Politics without principle
- Pleasure without conscience
- Wealth without work
- Knowledge without character
- Business without humanity
- Worship without sacrifice
কথাগুলো সর্বজনীন সত্য। সব দেশের জন্য প্রযোজ্য। আমাদের দেশের জন্য তো বটেই। আমাদের দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট ভালভাবেই বুঝিয়ে দিয়েছে যে কথাগুলো আমাদের দেশের জন্য কতটা গভীরভাবে প্রযোজ্য। আমাদের দেশেও আমরা প্রত্যক্ষ করি নীতিবিহীন রাজনীতি, কাজবিহীন সম্পদ গড়ে তোলার মানসিকতা, বিবেকবিহীন ভোগসুখ, চরিত্রবিহীন জ্ঞান, মানবতা বিরোধী ব্যবসা এবং ত্যাগবিহীন বন্দনা।
কিন্তু এমনটি হওয়ার তো কথা ছিল না। হয়েছে সঠিক নেতৃত্বের অভাবে। বাংলাদেশের দুর্নীতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা, হত্যা, অপহরণ, নারী নির্যাতন, শেয়ার বাজারের ধস, বিনিয়োগে মন্দা (দেশি ও বিদেশি), ব্যাংকে তারল্য সংকট, শিক্ষা অঙ্গন ও অন্যত্র সন্ত্রাস, পরিবেশ দূষণ, নদী দখল ইত্যাদি এখন দেশে/ বিদেশে কারও অজানা নয়। সঠিক পদক্ষেপ নিলে পদ্মা সেতুর কাজ অনেকটা এগিয়ে যেত। দুর্নীতির কারণে বিশ্বব্যাংক, এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক ও জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা অর্থায়ন স্থগিত রেখেছে। আমাদের দুর্নীতির তদন্ত হয় কানাডায় (পদ্মা সেতু) এবং সিঙ্গাপুরে (অর্থ পাচার)। বিদেশি কর্মকর্তা এসে আমাদের আদালতে দুর্নীতির সাক্ষ্য দিয়ে যান। জাতি হিসাবে এ সমস্ত ঘটনা আমাদের জন্য খুবই লজ্জাকর বিষয়। নেতৃত্বের অভাবে এক “অদ্ভুত আঁধার’’ চারপাশ থেকে আমাদের গ্রাস করে নিতে চলেছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আমাদের সরকার দলীয় ও বিরোধী দলীয় নেতৃত্বের ধ্যান ধারণা একই দিকে ধাবিত- ‘‘তোরা যে যা বলিস ভাই, আমার সোনার হরিণ (এ ক্ষেত্রে ক্ষমতা) চাই। ‘‘অথচ আমাদের নেতৃবৃন্দের উপলব্ধি করা উচিত ক্ষমতা কোন চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত (Permanent Settlement) নয়। নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে অথবা পরপারের ডাক এলে ক্ষমতা ছেড়ে চলে যেতে হবে। নেতৃত্বের ক্ষমতা আঁকড়ে ধরার এ প্রবণতায় চীনা দার্শনিক লাওেসর (খৃস্টপূর্ব ৫৭০ বত্সর আগে যার জন্ম) একটি উক্তি আমার মনের জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে যায় :
‘‘বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে চুল পাকে, দাঁত নড়ে, চোখ ও কান দুর্বল হয়। কিন্তু বার্ধক্যের গতি যত দ্রুত হোক যা চির নবীন থাকে তার নাম ক্ষমতার লোভ’’।
আমাদের নেতৃত্বকে ক্ষমতার লোভ পরিহার করে তার মেয়াদে যতদূর সম্ভব দেশ সেবা করে যেতে হবে। সঠিক নেতৃত্ব যে একটি দেশকে উন্নতির কোন পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ আমাদের বাড়ির কাছের ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর। এদের উন্নতি যে পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে তাতে প্রয়াত জ্যোতি বসু, ড. মহাথির মোহাম্মদ ও লি কুয্ান, ইউ-এর অবদান অতুলনীয়; অনন্য; অসামান্য এবং অসাধারণ। দেশপ্রেমই ছিল তাদের মূল চালিকা শক্তি।
আমাদের প্রবীণ নেতৃত্ববৃন্দ কোন নবীন নেতৃত্ব গড়ে তোলেননি? দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্বের একটি Line of Succession গড়ে তোলা উচিত। এ বিষয়ে দূরবর্তী কোন দেশের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করব না। করব প্রতিবেশী ভারতের দিকে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহর লাল নেহেরুর মৃত্যুর পর দেশ/ বিদেশের পত্র পত্রিকায় একটি খবর প্রকাশিত হয়েছিল, who after Nehru?’ নেহেরু ছিলেন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন একজন নেতা। তিনি দেওয়ালের বাহিরেও দৃকপাত করতে সমর্থ হয়েছিলেন। তিনি প্রথমে প্রয়াত লালবাহাদুর শাস্ত্রীকে দফতরবিহীন মন্ত্রী হিসাবে নিয়োগ দেন। এ অবস্থানে থেকে শাস্ত্রী সরকার পরিচালনার দীক্ষা গ্রহণ করেন। কন্যা ইন্দিরাকে সঙ্গে নিয়ে বিদেশ ভ্রমণে গিয়ে আন্তর্জাতিক বিষয়াদি এবং Art Of negotiation সম্পর্কে প্রশিক্ষিত করে তোলেন। এতদসত্ত্বেও তাকে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। প্রথমে প্রয়াত শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। পরে লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যুর পর প্রধানমন্ত্রীর আসনে আসীন হন। বাংলাদেশে সরকার পরিচালনায় নেতাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার কোন ব্যবস্থা নেই। প্রয়াত BNP নেতা ফিরোজ খান নূন এ বিষয়ে একটি পরিকল্পনা নিয়েছিলেন বটে কিন্তু তার মৃত্যুর সংগে সংগে তার পরিকল্পনারও মৃত্যু হয়।
বাংলাদেশে নবীন নেতৃত্ব গড়ে তুলতে হলে তৃণমূল পর্যায় থেকে তা গড়ে তুলতে হবে; কিন্তু দু:খের বিষয়, এ ব্যাপারে প্রবীণ নেতৃবৃন্দের কোনো চিন্তা-ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। উপজেলা, জেলা এবং জাতীয় পর্যায়েও এ লক্ষ্যে কোনো Council সভা হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও নবীন নেতৃত্ব গড়ে তোলার একটা গুরুত্বপূর্ণ উত্স হতে পারত। বিগত কয়েক বছর যাবত্ সেখানেও কেন্দ্রীয়ভাবে এবং হল ভিত্তিক ছাত্র সংসদ প্রতিষ্ঠাকল্পে কোনো নির্বাচন হয় না। ঐতিহ্যগত DUCSU নির্বাচনের জন্য কোনো মহলেরই কোনো উদ্যোগ নেই। নবীন নেতৃত্ব গড়ার আর একটি ক্ষেত্র হতে পারত স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা। সেখানেও নির্বাচিত চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানদের নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছে। পার্লামেন্টেও বয়কটের ধারা অব্যাহত। এ অবস্থায় নবীন নেতৃত্ব গড়ে উঠবে কিভাবে? আমাদের ছাত্র রাজনীতির একটা ঐতিহ্য ছিল যা আমরা ১৯৫২, ১৯৬৯ এবং ১৯৭১-এ প্রত্যক্ষ করেছি। জাতীয় ইস্যুতে অবশ্যই তারা অবদান রাখবে।
যখন এরূপ ইস্যু থাকে না এবং বিশ্ববিদ্যালয়ও বন্ধ থাকে তখন আমাদের ছাত্র সমাজ একটা Development Brigade হিসাবে কাজ করতে পারে; কিন্তু নিজ এলাকায় গিয়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ, জনসংখ্যা ও দারিদ্র্য বিমোচন ইত্যাদি বিষয়ে অভিযান পরিচালনা করতে পারে। সিডর, আইলার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে দুস্থ মানবতার পাশে এসে দাঁড়াতে পারে। পুনর্বাসনের কাজেও সহায়তা দিতে পারে। আমাদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা কি এ বিষয়ে ছাত্রদের যথাযথ পরামর্শ দেবেন? তারা কি পরামর্শ, কারিগরি এবং আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে গ্রামে গ্রামে একটি করে পলান সরকার (যিনি রাজশাহীর বাঘা উপজেলার বাউশা গ্রামে বিনা পয়সায় বই বিতরণ করে শিক্ষার আলো জ্বেলে দেন), একটি করে প্রবীর দেবদাস (সিলেটের খাদিম নগরের এই দোকানী নিজ খরচে প্রচারপত্র বিতরণ করে অচেতন মানুষকে সচেতন করে তোলেন), একটি করে হরেন্দ্রনাথ গাইন (ডাক পিওন এ লোকটি কৃষিকাজে আলো ছড়িয়ে দেন খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার দাউনিয়াফাঁদ গ্রামে), একটি করে শাকিলা আক্তার তিথি (যিনি হস্তশিল্পের সাহায্যে নীলফামারীর সৈয়দপুর জেলার নলছাগাড়া গ্রামে ৫০০ নারীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেন), জয়পুরহাট জেলার পাঁচবিবি উপজেলার আটপুর ইউনিয়নের জামপাড়া গ্রামের ২৫ নারীকে (যারা নিজস্ব প্রচেষ্টায় দুই কিলোমিটার সংযোগ রাস্তা তৈরী করেন) এবং সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার সে সমস্ত মানুষকে (যারা উপজেলার প্রত্যন্ত জনপদে সমন্বিত প্রচেষ্টায় কলেজ স্থাপন করেন) গড়ে তুলতে পারেন না?
এ সবই সম্ভব দেশে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারলে। গণতন্ত্রই যে কোনো দেশের উন্নয়নের পূর্ব শর্ত। আর এই গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায় নিরপেক্ষ নির্বাচনে, কার্যকর সংসদে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায়, আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির উন্নয়নে, রাজনৈতিক পরমতসহিষ্ণুতায় ও বলিষ্ঠ প্রশাসনে, এক কথায় কাজ করার উপযোগী শান্তিপূর্ণ অবস্থা বিরাজ করলে দেশের উন্নয়ন হবেই। সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব, যে কোনো নাগরিকের জীবনের নিরাপত্তা বিধান করা। দেশে নিরাপত্তা থাকলে জনমনে স্বস্তি আসবে, তারা কাজে উত্সাহিত হবে এবং ফলশ্রুতিতে দেশ হবে উন্নত।
লেখক : বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সচিব
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন